সন্তানের উচ্চতা বাড়াতে গ্রোথ হরমোনের দ্বারস্থ হচ্ছেন চীনের অভিভাবকরা
সন্তানের 'ভবিষ্যতের কথা ভেবে' অনেক উদ্বিগ্ন চীনা অভিভাবক তাদেরকে লম্বা করার জন্য গ্রোথ হরমোনের ইনজেকশন দিচ্ছেন। শিশুদের উচ্চ-প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বেড়ে ওঠাসহ একাধিক কারণে এই পথে হাঁটছেন চীনা বাবা-মায়েরা।
মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ২০০৩ সালে শিশুদের জন্য সিন্থেটিক গ্রোথ হরমোন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল, এবং পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি সাড়ে পাঁচ বছর ধরে নিতে থাকলে বাচ্চাদের উচ্চতা ২ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অর্থনৈতিকভাবে সিংহভাগ চীনা পরিবারই সচ্ছল হওয়ায় এই পণ্য নেওয়ার সামর্থ্য গড়ে উঠেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
পূর্ব চীনের জিয়াংজি প্রদেশের ১১ বছর বয়সী মেয়ে ইয়ান ইপিং নিজেকে শক্তিশালী এবং সুস্থ বলেই ভেবে থাকে। গড়ের চেয়ে উচ্চতায় একটু ছোট হলেও নিজের শারীরিক গড়ন নিয়ে বেশ সন্তুষ্টই ছিল ইয়ান। কিন্তু তার বাবা-মা সন্তুষ্ট না। তাদের ধারণা ইয়ান উচ্চতায় এতোটাই ছোট যে সমবয়সীদের সাথে মানিয়ে নিতে তার চিকিৎসা প্রয়োজন।
"আমার বাবা-মা মনে করে আমি ছোট। আমি মনে করি না। আমাদের ক্লাসে আমার চেয়েও খাটো শিক্ষার্থী আছে," ইয়ান বলে।
গ্রোথ হরমোন নেওয়া শুরু করার সময় ইয়ানের উচ্চতা ছিল ১২০ সে.মি (৩ ফুট ১১ ইঞ্চি)-র কম। পরের এক বছর, সে তার বাবা-মায়ের অনুরোধে প্রতি রাতে একটি করে ইনজেকশনের শট নিয়েছে।
এখন তার উচ্চতা ১৩১ সে.মি (৪ ফুট ৩.৫ ইঞ্চি)। তবে এই বৃদ্ধি গ্রোথ হরমোনের জন্য কতটুকু হয়েছে, আর স্বাভাবিকভাবেই কতটুকু হয়েছে, সেটা এখন নির্ণয় করা সম্ভব না।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইয়ানের বয়সী চীনা মেয়েদের গড় উচ্চতা প্রায় ১৪৭ সে.মি (৪ ফুট ১০ ইঞ্চি)।
শুধু ইয়ানকেই এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। সাংহাই চিলড্রেনস মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক ডা. ওয়াং জিউমিন বলেন, "সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা অনেক বাবা-মা পাচ্ছি যারা তাদের বাচ্চাদের জন্য গ্রোথ হরমোন ইনজেকশনের আবেদন করছে। তারা হয়তো নিজেরা লম্বা না, এজন্য উদ্বিগ্ন; অথবা তারা ভয় পায় বাচ্চারা খাটো থেকে গেলে তাদের জন্য ভবিষ্যতে চাকরি পাওয়া কঠিন হবে।"
ডা. ওয়াং জিউমিন জানান তিনি যেসব বাচ্চাদের দেখেছেন তাদের অধিকাংশেরই আসলে গ্রোথ হরমোনের প্রয়োজন ছিল না।
"যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন নেই তাদের জন্য সিন্থেটিক গ্রোথ হরমোনের সহযোজন শরীরে হরমোনের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়। এর ফলে শরীরে অন্যান্য হরমোনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়," ওয়াং যোগ করেন।
কিন্তু এরপরও জেনেশুনেই এই ঝুঁকি নেয় অনেক পরিবার। তাদের মতে, খাটো হয়ে বেড়ে উঠলে ভবিষ্যতে যেসব সমস্যায় পড়তে হবে তাদের সন্তানদের, সেই তুলনায় এই ঝুঁকি তেমন কিছু না।
সাংহাইয়ের আরেক মা ন্যান্সি লিন তার ৫ বছর বয়সী ছেলেকে গ্রোথ হরমোন চিকিৎসা দেয়ার কথা ভাবছেন। তিনি চিন্তিত এটা ভেবে যে তার ছেলে সমবয়সী অন্য শিশুদের দ্বারা হেনস্তার শিকার হবে, কেননা সে ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।
"এবং বয়স হলে হয়তো তাকে লম্বা মানুষদের মতো ভালো নাও দেখাতে পারে। এটা তার আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে পারে। সবশেষে, উচ্চতার জন্য সে কিছু ভালো ভালো চাকরি থেকেও বঞ্চিত হতে পারে," লিন বলেন।
গত ৩৫ বছরে চীনা শিশুদের গড় উচ্চতা এমনিতেও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা এসময়ে জীবনযাত্রার মানে উন্নতির ফলে চীনা পরিবারগুলো শিশুদের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৮৫ সালে থেকে ২০১৯ সালের মাঝে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের গড় উচ্চতা ৫ সে.মি (প্রায় ২ ইঞ্চি) বেড়েছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ৭.৬ সে.মি (প্রায় ৩ ইঞ্চি)।
এই সময়ে বিশ্বের আর কোনো দেশে ছেলেদের উচ্চতা এই পরিমাণ বাড়েনি। আর এই সময়কালের মধ্যে মেয়েদের উচ্চতা বৃদ্ধিতে চীন বিশ্বে তৃতীয়।
গ্রোথ হরমোনের উৎপাদন ও বিক্রিও একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আর্থিক পরিসেবা সংস্থা সাউথওয়েস্ট সিকিউরিটিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চীনে এই শিল্পের আকার গত বছর ৭৭০ কোটি ইউয়ানে (বাংলাদেশী মুদ্রায় ১০১২৬ কোটি টাকায়) পৌঁছেছে।
উত্তর-পশ্চিম চীনের গানসু প্রদেশের কিংইয়াং পিপলস হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট সং টাও জানান, গ্রোথ হরমোনের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসাটি তরল ওষুধ আকারেই আসে। সেই তরল ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রতিদিন গ্রহণ করতে হয়। আর এর পেছনে প্রতি মাসে তিন থেকে চার হাজার ইউয়ান (বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩৯ থেকে ৫২ হাজার টাকা) খরচ হয়ে থাকে।
সং বলেন, ২০১৯ সালের এপ্রিলে হাসপাতালটি চালু হওয়ার পর হাসপাতালের শিশু বৃদ্ধি ক্লিনিকে অভিভাবকদের আগমন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
সং আরও বলেন, "সাধারণত যদি কোনো শিশু তার সমবয়সীদের তুলনায় কয়েক সেন্টিমিটারের চেয়ে কম উচ্চতার হয়, এবং ডায়াবেটিসের মতো কোন রোগবালাই না থাকে' সেক্ষেত্রেই আমরা এই ওষুধ (গ্রোথ হরমোন) লিখে দেই।"
ইয়ান জানায়, তাকে প্রতি তিন মাসে একবার নতুন প্রেসক্রিপশন এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং প্রতি ভিজিটের জন্য তার বাবা-মাকে ১০ হাজার ইউয়ান (১ লাখ ৩০ হাজার টাকা) গুণতে হয়।
এতো টাকা খরচ করা ঠিক হচ্ছে কি না জানতে চাইলে মেয়েটি বলে, "আমার খুবই খারাপ লাগে এতো টাকা খরচ করতে দেখে। এই টাকা দিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে পারতাম আমি।"
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট