হিমালয়ে চীন ও ভারতের সেনারা কেন সংঘর্ষে জড়ায়
এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দুই দেশ চীন ও ভারতের মোট জনসংখ্যা ২৭০ কোটির বেশি। গেল বছর তারা হিমালয় পর্বতমালার বিতর্কিত সীমান্ত রেখা বরাবর লাখো সেনা মোতায়েন করে। কিন্তু, ওই অঞ্চলের অধিকার নিয়ে দেশ দুটির বিরোধের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৯৬২ সালে প্রথম এনিয়ে দুই দেশের মধ্যে এক যুদ্ধ হয়। তারপর, ২০১৭ সালে ভুটান সীমান্তের কাছে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সেসময় কোনো প্রাণহানি না হলেও মহামারির প্রথম বছরেই ঘটে যায় ব্যতিক্রম।
২০২০ সালের মধ্য জুনের ওই সময়ে দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষে নিহত হয় ২০ জন ভারতীয় সেনা সদস্য। চার দশকের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনা। এরপর, কিছু সেনা উভয়পক্ষ থেকে প্রত্যাহার করার কথা জানানো হয়েছে চলতি মাসেই। তারপরও, উল্লেখযোগ্য সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখবে দুই দেশ। তাছাড়া, বিশাল সীমানার অন্যান্য অঞ্চলের মালিকানা নিয়েও বিরোধ রয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে তা প্রাণঘাতি সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। চীনের সম্প্রসারণমুখী মনোভাব এবং ভারতের উগ্র-জাতীয়তাবাদ দুইয়ে মিলে; ভারত এরফলে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক সহযোগীতে পরিণত হচ্ছে।
বিরোধের উৎস কী?
২০২০ সালের ৫ মে, সীমান্ত রেখার তিনটি অংশে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে ভারতকে চমকে দেয় চীন। এরমধ্যে, লাদাখেরই ছিল দুটি অংশে চীনা সেনাদের বড় উপস্থিতি। ওই অঞ্চল থেকে চীন নিয়ন্ত্রিত তিব্বত এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর খুব কাছেই। দুই দেশের ৩,৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা সুনির্ধারিত নয়, এবং মালিকানা নিয়ে পূর্ব-বিরোধ আছে। তাই চীনের আকস্মিক সেনা সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্য বুঝতে পারেনি ভারত। তাছাড়া, এর আগে সীমান্ত এলাকায় ভারতের পক্ষে থেকেও যেভাবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছে, সেটাও চীনকে আগ্রাসী অবস্থানে আসতে বাধ্য করে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
লাদাখের জনগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক দিক থেকে তিব্বতের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই চীন এই এলাকাটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ভারতের আগের একটি সিদ্ধান্ত নিয়েও ক্ষুদ্ধ ছিল। দেশটি একে তাদের ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের চেষ্টা বলে সেসময় নিন্দা জানায়।
উত্তেজনা যেভাবে মারাত্মক আকার ধারণ করে?
গালোয়ান নদী এবং তিব্বতীয় মালভূমির ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হিমবাহ গলে সৃষ্টি হওয়া হ্রদ পংগং-সো'কে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থান চলতে থাকে। টানা কয়েক সপ্তাহ জুড়ে বিচ্ছিন্ন কিছু হাতাহাতির ঘটনার পর মধ্য জুনের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মারা যায় ২০ ভারতীয় সেনা। চীনা এক মুখপাত্র তাদের পক্ষেও হতাহতের কথা স্বীকার করলেও, তার আনুষ্ঠানিক সংখ্যা প্রকাশ করেননি।
তারপর, গত ৩১ আগস্ট আবারও উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়, ভারত পংগং-সো' হ্রদের তীরবর্তী পাহাড়ের চূড়ায় সেনা মোতায়েন করলে। দেশটির দাবি, চীনা সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধেই তারা এ পদক্ষেপ নেয়।
এরপর, গত সেপ্টেম্বরে উভয়দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনায় উত্তেজনা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরপর, চলতি ফেব্রুয়ারিতে উভয় সরকার সীমান্তে নতুন করে সেনা না পাঠানোর এক চুক্তি করে। বিরোধপূর্ণ, পংগং-সো হ্রদ অঞ্চল থেকেও সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয় এসময়।
ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, সেনা কমান্ডারদের মধ্যে আরেকদফা আলোচনার ভিত্তিতে বিতর্কিত অঞ্চল থেকে বাড়তি সেনা প্রত্যাহার করা হবে।
চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ কত পুরোনো?
সত্যিকার অর্থে বিরোধের সূত্রপাত সেই ১৯৫০ এর দশকে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামাকে ভারত আশ্রয় দেওয়ার পর থেকেই সীমান্তে ছোটোখাটো সংঘর্ষের কথা জানা যায়। এর তিন বছর পরেই সংগঠিত হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণ ছিল, কার্যকর সীমান্ত রেখা চিহ্নিত করতে ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি মানচিত্র অনুসারে চৌকি স্থাপন করার উদ্যোগ নেয় ভারত। চীন তাতে শুরু থেকেই তীব্র আপত্তি জানায়। তিব্বত ও উত্তর ভারতের সীমান্ত নির্দেশক ব্রিটিশদের নির্ধারিত ওই মানচিত্র কখনোই মেনে নেয়নি চীন।
বর্তমানে 'প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা' বলে পরিচিত ওই সীমানা আসলে ব্রিটিশদের আদলেই তৈরি। তাই উত্তেজনার ধারাবাহিকতা চলে ১৯৬৭ এবং তারপর ১৯৮৭ সালেও। এটা অবশ্য উভয় দেশে 'লাউডস্পিকার ওয়ার' নামেই পরিচিত। কারণ, গোলাগুলি না ছুড়ে উভয়পক্ষের সেনারা এসময় লাউডস্পিকারের মাধ্যমে একে-অপরকে হুমকি-ধামকি দেয়।
এরপর, ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে স্বাক্ষরিত পাঁচটি চুক্তির মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। চীন পরিণত হয় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারে। তারপর ২০১৭ সালের আগপর্যন্ত সীমান্ত শান্তই ছিল। ২০১৭ সালে ভূটানের দোকলাম মালভূমিতে আবারও সীমান্ত নিয়ে বিবাদের সূত্রপাত।
তবে শীতকালের প্রতিকূল আবহাওয়াজনিত কারণে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভারত ও চীনের মধ্যেকার সংঘর্ষগুলো গ্রীষ্মকালে হয়ে থাকে।
উত্তেজনা নিরসনের উদ্যোগ কেন?
করোনাভাইরাস মহামারিতে ভারতে ১ কোটি ৮ লাখের বেশি সংক্রমিত হয়েছেন। অর্থনীতিও হয়েছে ব্যাপক ক্ষতির শিকার। আবার চীনের সঙ্গে উত্তেজনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই উদ্যোগ চীনের উপর স্নায়বিক চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় বেইজিংকে উদ্বিগ্ন করেছে। এছাড়া, বাণিজ্যিক দিক তো আছেই।
ইতোমধ্যেই, চীনের কয়েক ডজন অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, স্থানীয় ব্যবসা অধিগ্রহণেও চীনা কোম্পানিগুলোকে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
উত্তেজনা কি আবারও বাড়তে পারে?
বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকের মতে, উভয়পক্ষই পরিস্থিতি আরও নাজুক করতে অনিচ্ছুক হওয়ায় যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে ভারত নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ঘনিষ্ঠ হলো। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও চীন বিরোধী জোট কোয়াড শক্তিশালী মাত্রা পাবে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের এই জোট আরও ঘনিষ্ঠভাবে ভারত মহাসাগরে নৌ-মহড়া চালাবে। তারপরও অবশ্য এতো বড় সীমান্তের যে কোনো জায়গায় নতুন করে সংঘর্ষের ঝুঁকি থেকেই যায়।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ