‘আমার মতো মেয়েরাই এখন তালেবানের লক্ষ্যবস্তু,’ কাবুলের মেকআপ আর্টিস্ট
গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের মাধ্যমে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয় তালেবানরা। বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটের অংশ হিসেবে সেদিনের পর থেকে কাবুলজুড়ে বিভিন্ন দেওয়ালে আঁকা নারীদের ছবি মুছে ফেলা হয়।
বিউটি পার্লারগুলোর বাইরে বধূবেশে বিভিন্ন নারীর পোস্টার টাঙানো ছিল; কালি লেপে ঢেকে দেওয়া হয় সেসব। তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেয়া হয় সকল সৌন্দর্যচর্চা কেন্দ্র। এখন আস্তে আস্তে অনেকেই তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে শুরু করলেও বেশিরভাগই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছেন।
ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এসব পার্লারের কর্মীরা। এমনই একজন আফগানি মেকআপ আর্টিস্ট আফসুন (ছদ্মনাম) বিবিসির কাছে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন; আত্মগোপনে থাকা এ নারী জানান সৌন্দর্য শিল্প আফগান নারীদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ!
১৫ আগস্টের দিন আফসুন জীবনে প্রথমবার 'তাকান' অনুভব করেন।
ভিন্ন ভাষায় 'তাকান খোরদুম' শব্দটিকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা হয়তো সম্ভব নয়। একদিন হঠাৎ আপনার প্রিয় কারো মৃত্যু হলো অথবা এমন কিছু ঘটল যা আপনার হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল, যার জন্য আপনি চিরতরে বদলে গেলেন- তখন যেমন অনুভব করবেন, আফসুনের অনুভূত 'তাকান খোরদুম' তেমনই কিছু একটার ভাব বোঝায়।
সেদিনও আফসুনের সকাল শুরু হয় সাধারণভাবেই। ১০টার দিকে পার্লারেরই এক সহকর্মীর ফোনে ঘুম ভাঙে তার। তাজা শ্যাম্পু আর নেইল পলিশের ঘ্রাণ, হেয়ার ড্রায়ারের ঘড়ঘড়ে আওয়াজ, নিত্য ছুটোছুটি- আফসুনের কাছে সবটাই ছিল আনন্দের।
কিন্তু ফোন ধরার পরে তার সে সহকর্মী বলে ওঠেন, " আজ আর কাজে এসো না। আমরা এক্ষুণি পার্লার বন্ধ করছি। সব শেষ হয়ে গেছে"।
বিছানায় বসা অবস্থায়ই আফসুন তার মোবাইল ফোন খুলে চেক করতে শুরু করেন। আঙুলের ডগায় ফোন স্ক্রিনের ওপর-নিচে যতই যেতে থাকেন, বন্ধু এবং পরিবারের কাছ থেকে আসা ডজনখানেক মেসেজ এবং শত শত সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে তার চোখ আটকে যেতে থাকে। আফসুনের মেরুদণ্ড বেয়ে যেন ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়; রীতিমত অসুস্থ বোধ করতে থাকেন তিনি।
সবখানে একটা কথারই প্রতিধ্বনি- তালেবানেরা কাবুলে প্রবেশ করে ফেলেছে।
"সব শেষ", এবার নিজের মনেই বলে ওঠেন আফসুন। এরপর থেকে পালিয়ে রয়েছেন তিনি।
বয়স ২০ পেরোনো আফসুন নিজেকে একজন আধুনিক আফগান নারী হিসেবে মনে করেন।
আফসুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটাতে পছন্দ করেন, সিনেমা দেখতে ভালবাসেন, গাড়ি চালাতে জানেন এবং তার ক্যারিয়ার নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষাও রয়েছে।
৯০'র দশকে তালেবানরা যখন প্রথমবার তার দেশে বিউটি পার্লারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, সে সময়ের কথা মনে পড়ে না আফসুনের।
তিনি যে আফগানিস্তানে বড় হয়েছেন, সেখানে বিউটি পার্লার তার জীবনের একটি নিয়মিত অংশ হয়ে ছিল।
কিশোর বয়স থেকেই গ্ল্যামারের জগত তাকে আকর্ষণ করতো; গ্ল্যামারাস লুকের জন্য বিনোদন ম্যাগাজিনের পাতার পর পাতা উল্টাতেন আফসুন, পরিবারের অন্যান্যদের সাথে পার্লারে যেতেন নিয়মিত।
অবশেষে একদিন আফসুন নিজেকে একজন সফল মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে মেলে ধরলেন। এই স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবার পর তার যেন আর কিছুই চাইবার ছিল না জীবনে!
কাবুলের সমস্ত বিউটি পার্লারের মতো, আফসুনের পার্লারেও জানালাগুলো ঢাকা ছিল গ্ল্যামারাস এবং অভিজাত নারীদের ছবিসম্বলিত পোস্টারে।
নানা বয়সী আফগান নারীদের উপস্থিতিতে দিনের সব বেলাতেই এসব পার্লার মুখরিত থাকত। ডাক্তার, গণমাধ্যমকর্মী, শিল্পী, টেলিভিশন তারকা, কনে সাজতে আসা তরুণী কিংবা মায়ের সাথে প্রথমবার আসা কিশোরী-আফগানিস্তানের পার্লারগুলোতে গ্রাহকের অভাব কখনো হয় নি।
আফসুন বলেন, "আমি মেয়েদের ভালবাসি। আমি আমার কাজের মাধ্যমে নারীদের জন্য এমন একটি পরিসর তৈরী করতে চেয়েছি যেখানে তারা মুক্ত এবং আনন্দিত হয়ে সময় কাটাবে"।
কিন্তু ১৫ আগস্ট যখন তালেবান ক্ষমতায় এলো, তার এত বছরের পরিশ্রম আর স্বপ্ন যেন এক নিমিষে মিইয়ে গেল।
বিবিসির সাথে যখন আফসুনের ফোনালাপ হয়, কাবুলে তখন মধ্যরাত। গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে, ভয়ার্ত কন্ঠে আফসুন কথা বলছিলেন। সেই রোববারেই (১৫ আগস্ট) আফসুন তার বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন এবং একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পান।
"যারা বিউটি ইন্ড্রাস্ট্রির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, বিশেষত আমার মতো মেয়েরা যারা জনসম্মুখে এসেছেন, তারাই এখন মূল লক্ষ্যবস্তু"।
আফসুন জানতে পারেন, কাবুলের রাস্তায় নারী সৌন্দর্যের প্রতিনিধিত্বকারী যত পোস্টার রয়েছে তার সবই ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। খোদ আফসুনের এক বন্ধুই তালেবানদের সুনজরে থাকতে এবং সৌন্দর্যচর্চা ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট তার নারী বন্ধুদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে এসব পোস্টার ঢাকার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন।
আফসুন বলেন, "তারা নারীদের উন্মোচিত মুখমন্ডল কিংবা উন্মুক্ত ঘাড়ের ছবি প্রদর্শন করতে দেবে? প্রশ্নই ওঠে না"!
"এটাই আফগানিস্তানের বিউটি ইন্ডাস্ট্রির সমাপ্তি"।
আফসুনের জন্য কোন আমন্ত্রণপত্র আসে নি এবং তার কাছে এমন কোন ডকুমেন্ট নেই যার জেরে সে কাবুল ত্যাগ করা বিমানগুলোতে একটি আসন নিশ্চিত করতে পারত।
এককথায় তার আসলে আফগানিস্তান ছেড়ে বেরোনোর কোন পথ নেই।
বর্তমানে সহকর্মীদের সাথে আফসুনের যোগাযোগ হচ্ছে গ্রুপ চ্যাটে। সর্বশেষ ২৪ আগস্ট তারা বেতন পেয়েছিল। সেটাই শেষ পারিশ্রমিক ছিল; পার্লার বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মীরা সবাই মেনেই নিয়েছে যে, আর কখনো তারা কেউ কাজে ফিরবে না।
সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করে আছে তা জানে না আফসুন। কেমন পোশাক পরবেন কিংবা আর কখনও বাড়ির বাইরে যাবেন কিনা সেটিও এখন ভাবতে পারছেন না।
তার সমস্ত আশা-ভরসার উপর কেউ যেন হতাশার কালো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে।
আফসুন বলেন, "এখন একমাত্র বেঁচে থাকার কথাই ভাবতে পারছি। মৃত্যুকে ভয় নেই আমার- তাই বলে এভাবে নিশ্চয়ই নয়- আতঙ্কিত এবং হতাশাকে সঙ্গী করে"।
"প্রতি মুহূর্তে আমার মনে হয়, এই বুঝি আমার খোঁজে তালেবান চলে এলো এখানে"।
- সূত্র- বিবিসি