‘ভ্যাকসিন ছাড়াই কোভিড দুর্যোগ মোকাবিলায় বাধ্য হবে অধিকাংশ দেশ’
চোর পালালে যেমন তাকে ধরার বুদ্ধি বাড়ে, ঠিক তেমনি সময় থাকতে উদ্যমী হয় না অনেকেই। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন এবং সুরক্ষা নিয়েও অধিকাংশ রাষ্ট্রনেতাদের উদাসীনতা যার সঙ্গে তুলনীয়।
বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে যে মহামারির তাণ্ডব চলছে, তার সম্ভাবনা নিয়ে ইতোপূর্বেই সতর্ক করেছিলেন ক্লাউস স্টোহর নামের এক শীর্ষ সুইস জীবাণু বিজ্ঞানী ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ। ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে কাজ করার সময়েই তিনি এ সতর্কবার্তা দেন। এসময় ক্লাউসের নেতৃত্বে এক অনুসন্ধানেই করোনাভাইরাস গোত্রের আরেকটি জীবাণু সার্স ভাইরাস- অতিদ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
পরিযায়ী পাখিদের থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ফ্লু' গোত্রের ভাইরাস থেকে আগামীদিনে পৃথিবীতে বিশ্বমারি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, বলে জানিয়েছিলেন তিনি। আসন্ন সঙ্কট মোকাবেলায় সকল দেশ ও চিকিৎসা খাতের কোম্পানিকে প্রতিষেধক উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বানও জানান। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতি দৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেসময় কেউ তার কথায় তেমন গুরুত্ব দেয়নি।
বসুন্ধরার বুক থেকে ৬ লাখ জীবনপ্রদীপ এপর্যন্ত নিভিয়েছে কোভিড-১৯। জীবাণু বিশেষজ্ঞ ক্লাউস স্টোহর যে আশঙ্কা করেছিলেন, বিশ্ব এখন সেই সঙ্কটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে।
২০০৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছেড়ে সুইস ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি নোভারটিস এজি'র ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন গবেষণার প্রধান পরিচালকের চাকরি করেন তিনি। কয়েক বছর আগে সেখান থেকেও অবসরগ্রহণ করেছেন। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে ক্লাউস সম্প্রতি মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গকে টেলিফোন সাক্ষাৎকার দেন। তারই সংশোধিত ও সংক্ষেপিত অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: সম্ভাব্য ভ্যাকসিন সহজলভ্য হওয়ার পূর্বে মহামারি পরিস্থিতি কীভাবে বিস্তার লাভ করবে বলে আপনি মনে করেন?
ক্লাউস স্টোহর: ফুসফুস আক্রান্ত করে এমন সকল ভাইরাস যেভাবে সংক্রমণ ছড়ায়, তার সঙ্গে নতুন করোনাভাইরাস বিস্তার লাভের প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণত, প্রতিবছর শীতকালে এসব ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ে।
তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সংক্রমণের আরেকটি মারাত্মক জোয়ার আসতে চলেছে। বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন। আমরা যদি আবারও জোরদার লকডাউন চালু না করি বা সংক্রমণ প্রতিরোধে কড়া সুরক্ষা ব্যবস্থা না নেই; তাহলে এবার মহামারি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। বলতে পারেন ভ্যাকসিনের আগেই শীত আসছে (শীতকে মহাবিপদের রূপক হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি)। সংক্রমণের সংখ্যা এবার যেমন দ্রুত বাড়বে, ঠিক তেমনি ভাইরাসের বিস্তার রোধের প্রচেষ্টা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, ইতোমধ্যেই জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ায় তাদের মধ্যে লকডাউন কার্যক্রমের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। নতুন করে চলাচলের স্বাধীনতা বন্ধ হোক, এটা অধিকাংশই চাইবেন না।
প্রশ্ন: ভ্যাকসিন কবে নাগাদ আসতে পারে বলে অনুমান করছেন?
ক্লাউস: আগামী বছরের শুরুর দিকেই যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করতে পারে জার্মানির মতো কিছু দেশ । তবে বয়স্ক নাগরিকদের এ ভ্যাকসিন পেতে চার, পাঁচ বা ছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা চিলির মতো দক্ষিণ আমেরিকার মতো কিছু দেশের জন্য এক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল লক্ষ্য করা যেতে পারে। এসব দেশে ভ্যাকসিনের একটি ডোজও না আসার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে ভ্যাকসিন ছাড়াই তাদের করোনা প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে।
আসলে; পুরো পৃথিবীকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। একদলের কাছে ভ্যাকসিন থাকবে, আরেকদল থাকবে ভ্যাকসিন ছাড়াই।
প্রশ্ন: ব্যাধি বিস্তারের প্রবণতা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি, ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন?
ক্লাউস: আগামী বছরের মাঝমাঝি নাগাদ পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষের দেহে প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (অ্যান্টিবডি) থাকবে বলে আমি অনুমান করছি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। এরপর আঘাত হানবে ভাইরাস সংক্রমণের তৃতীয় জোয়ার। তৃতীয় পর্যায়ের শেষে যারা বেঁচে থাকবেন তাদের ৮০ শতাংশের দেহে অ্যান্টিবডি গড়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস। এসময় সঠিকভাবে লকডাউন কার্যকর করা না গেলেই কেবল এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য দীর্ঘসময় জুড়ে লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে আমার দৃঢ় সন্দেহের কথা আগেই জানিয়েছি।
প্রশ্ন: এসব ঘটনার সম্ভাবনায় চলমান ভ্যাকসিনের গবেষণাগুলো কিভাবে প্রভাবিত হবে?
ক্লাউস: আমরা এখন অনেক অনেক বড় এবং জটিল এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। ভ্যাকসিন তৈরিতে সমস্ত সম্পদ আর মেধা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তারপরও, আমার সাধারণ জ্ঞান বলছে, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ভ্যাকসিনের সুবিধা বঞ্চিত হতে চলেছেন।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের শুরুর দিকে পুরো বিশ্বের জন্য মাত্র ৫০ কোটি ডোজ পাওয়া যাবে। অথচ পৃথিবীর জনসংখ্যা হচ্ছে; সাড়ে ৭শ কোটি। বিশেষ করে, যেসব দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা, নেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো অথচ আছে বিপুল জনগোষ্ঠী- তাদের ভাগ্যে কি ভ্যাকসিনের ছিটেফোঁটাও জুটবে বলে আপনি আশা করেন!
প্রশ্ন: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো বেশ কিছু গ্রুপ সকলে যেন ভ্যাকসিনের সুবিধা পায়, তা নিশ্চিতের চেষ্টা চালাচ্ছে। এর ফলেও কি পরিস্থিতির উন্নতি হবে না?
ক্লাউস: কিছু না করে বসে থাকা হচ্ছে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। এজন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। অবশ্য তাদের শত চেষ্টা স্বত্বেও, বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ ভ্যাকসিন পাবেন না। ভাইরাস বিস্তার লাভ করতেই থাকবে। এভাবে দুই-তিন বছরের মধ্যেই বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করবে নভেল করোনাভাইরাস।
কোনো ভ্যাকসিনের সাহায্যে বিশ্ব থেকে এ মহামারি দূর হবে না। প্রথমে সংক্রমণের আগুন দাবানলে রূপ নেবে। সামনে পাওয়া সব শুকনো কাঠ পুড়িয়ে ফেলবে সে। অর্থাৎ, আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন এমন একজন ব্যক্তি অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত, ভাইরাসের তাণ্ডব থামবে না।
এরপর ভ্যাকসিন কী ভূমিকা রাখতে পারে; সেটা সেটা আরেক প্রশ্ন।