অস্ট্রেলিয়ার ভাসমান পাঁচতারকা হোটেল: ঘাটে ঘাটে বিক্রি হয়ে শেষে যার ঠাঁই উত্তর কোরিয়ায়
আশির দশকের শেষে সাততলা একটি পাঁচতারকা হোটেল গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে ভাসানোর চিন্তা করলেন ড্রগ তর্কা। অস্ট্রেলিয়ার টাউন্সভিলের ল্যান্ড ডেভেলপার তর্কা। তিনি জায়গা পেলেন জন ব্রুয়ার রিফে। টাউনসভিল উপকূল থেকে এটি ৭০ কিলোমিটার দূরে। হোটেলের আশপাশে তিনটি প্রমোদতরি রাখারও বুদ্ধি করেছিলেন তিনি। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের অনুমতি পাননি। কারণ রিফের কোরাল রক্ষার কথা সবসময়ই মাথায় রাখতে হচ্ছিল। পরিবেশ সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখেই ড্রগ একটি সিঙ্গাপু্রী প্রতিষ্ঠানকে হোটেল নির্মাণের দায়িত্ব দিলেন। শর্ত ছিল নির্মাণকাজে এমন কোনো কিছুই ব্যবহার করা যাবে না যেটি দূষণ ছড়ায় । আর কোনো বর্জ্যই পানিতে ফেলা যাবে না। এমনকি তরল বর্জ্যও রিফ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নিয়ে ফেলতে বলা হয়েছিল।
নির্মাণ শেষ হলো ১৯৮৭ সালে। খরচ হলো ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু চুক্তির গোলমালের কারণে আরো প্রায় এক বছর বসে থাকতে হলো। তারপর সাইক্লোনের কবলে পড়ল হোটেলটি যাতে পিছিয়ে যেতে হলো আরো দুই মাস। যখন ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে এর দরজা খুলল ততদিনে ওই মৌসুমের পর্যটকরা বাড়ি ফিরে গেছে। হিসাব করে দেখা গেল, লোকসান কম হয়নি।
আসল সমস্যা ছিল ওই ৭০ কিলোমিটার সমুদ্র পথ। ওয়াটার ট্যাক্সিতে এতো পথ পেরুতে অনেকেই ভয় পেত আর খারাপ আবহাওয়াও ভোগাতো ভালো। অনেক সময় দেখা যেত পর্যটকরা এসে পৌঁছানোর পর তারা সি সিকনেসে ভুগছে। একবার হোটেলের জন্য মাল পরিবহনকারী নৌযানে আগুন ধরে গেলে লোকে হোটেলটাকে 'অপয়া' ভাবল। আর হোটেল পরিচালনাও ভীষণই ব্যয়বহুল হয়ে উঠল।
হোটেলটায় দুইশ ঘর, ডিস্কো, বার, ব্যায়ামাগার, সওনাবাথ, দুটি রেস্তরাঁ আছে। একটি ভাসমান টেনিস কোর্টও আছে হোটেলটায়। টাউনসভিলের পুরনো অনেক বাসিন্দার কাছে হোটেলটি আজো দারুণ স্মৃতি হয়ে রয়েছে।
গন্তব্য সায়গন
কিন্তু কতদিন আর পাগলা হাতি পোষা যায়? পরের বছরই মানে ১৯৮৯ সালে ড্রুগ হোটেলটি ভিয়েতনামের এক কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দিতে হলো। সায়গনে চলে গেল হোটেলটি, ৫০০০ কিলোমিটার দূরে। নোঙর ফেলল সায়গন নদীতে। নাম পেল সায়গনের ভাসমান হোটেল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ায় ভিয়েতনামে পর্যটকের ঢল নেমেছিল আর অনেক বিলাসবহুল হোটেলেরও প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। তাই ভাসমান হোটেলটি একটি রাতারাতি সমাধান ছিল আর তা ফলও ভালো বয়ে এনেছিল।
কিন্তু একসময়ে মালিকরা আবার বিপদে পড়লেন। এ তো রাহা খরচ! হাতি পোষাও এর চেয়ে সহজ। তারা হোটেলটি বিক্রি করে দিলেন উত্তর কোরিয়ার কাছে। পরে ভাসতে ভাসতে হোটেলটি চলল কুমগ্যাং টুরিস্ট অঞ্চলে যা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে। ১৯৯৮ সালে এর দরজা খুলল আবার কোরিয়ায়। এর নতুন নাম হলো সি কুমগ্যাং হোটেল। দশ বছর পরে যখন একজন উত্তর কোরীয় সৈনিক ভুল করে একজন দক্ষিণ কোরীয় নারীকে হত্যা করে তখন হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ওই জায়গাতেই হোটেলটি দশ বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। একবার উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন হোটেলটি পরিদর্শন করেছেন। তিনি সেটি দেখে খুশি হননি। তিনি বরং এটিকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী, চান একে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করতে।
টাউনসভিলের মানুষ মনে রেখেছে
পেরিয়ে গেছে দুই যুগেরও বেশি সময়। তবু হোটেলটিকে ভোলেনি টাউনসভিলের মানুষ। বেলিন্ডা ও'কনর তাদের একজন যিনি একটি ওয়াটার ট্যাক্সিতে কাজ করতেন। বলছিলেন, "যখনই হোটেলটি নজরে আসত তখনই ভালো লাগত। অনেক ভালো দিন কেটেছে আমার হোটেলটায়। কোনোদিন ফিশিং ট্রিপে গিয়েছি, কোনোদিন বা ছিল ক্রু পার্টি। কোনোদিন আবার কেটেছে হোটেলের নীচে ডাইভ দিয়ে। ভেসে ভেসে পিৎজা খাওয়ার কথাও ভুলব না।"
হোটেলের সাবেক কর্মী লুক স্টেইন স্মৃতিতাড়িত হয়ে বলছিলেন, "এটা ছিল আমার জীবনের সেরা চাকরি। যা করতাম মানে হাঁটা, সাঁতার কাটা, রোদ পোহানো-সবকিছুর জন্য বেতন পেতাম। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়- ওটা কি সত্যি ছিল না স্বপ্ন? টাউনসভিলের নৌ জাদুঘরে হোটেলটির মডেল সংরক্ষিত আছে, অনেক তথ্য আছে আর আছে স্মৃতি।"