আফগানিস্তানে গাঁজা উৎপাদনে মিলিয়ন ডলার খরচে আগ্রহী যে জার্মান ব্যক্তি
২০২১-এর আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর থেকেই দেশটিতে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের খবর পাওয়া গেছে। এমন অবস্থায় সেখানে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগে আগ্রহী নয় কোনো দেশই। কিন্তু গত বছর নভেম্বরের শেষে আফগানিস্তানে গাঁজা প্রক্রিয়াকরণের জন্য একটি জার্মান কোম্পানির ৪৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের খবর ছড়িয়ে পড়ে। তালেবান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি টুইট থেকে জানা যায় এ তথ্য।
সিফার্ম ইন্টারন্যাশনাল (ইসিআই) নামক জার্মান গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থাটি গত ২০ বছর ধরে দ্রুত বর্ধনশীল গাঁজা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।
তবে, কোম্পানির মালিক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ৫৬ বছর বয়সী ওয়ার্নার জিমারম্যান এই চুক্তিটি জনসমক্ষে আসা নিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নয়। "আমি ঠিকমতো ঘুমাতেও পারি না," বলেন তিনি।
জিমারম্যান জানান, তার কোম্পানি ইতোমধ্যে লেসোথো, মরক্কো, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উত্তর মেসিডোনিয়া এবং সাইপ্রাসসহ বিশ্বের একাধিক দেশে কাজ করেছে। কোম্পানিটি মূলত গাঁজা প্রক্রিয়াকরণের জন্য সুযোগ-সুবিধা তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে কীভাবে বৈধভাবে গাঁজা রপ্তানি করা যায় সেই আইনি বিষয়েও পরামর্শ দেয়। কোম্পানির আসন্ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি হলো কাজাখস্তানের একটি প্ল্যান্ট। এরপরেই রয়েছে আফগানিস্তান।
বর্তমানে তিনি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য আফগানিস্তানে মেডিকেল গাঁজা উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন। পরবর্তীতে জার্মানির মতো দেশে গাঁজার সর্বাত্মক ব্যবহার বৈধ করা হলে আফগানিস্তানে চিকিৎসামূলক কাজের বাইরেও এটি উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে তার।
আফগানিস্তানের স্থানীয় এবং হিমালয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে জন্মায় গাঁজা। যদিও ৭০ এর দশকে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি নিষিদ্ধ করা হয়, তবুও দেশের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে তালেবান দখলের আগ পর্যন্ত ঐতিহ্যগতভাবে গাঁজা সেবন করা হতো।
কিন্তু একটি বাইরের দেশের নাগরিক কেনই বা আফগানিস্তানে ব্যবসার সিদ্ধান্ত নিলেন? জিমারম্যান জানান, তিনি নব্বইয়ের দশকে আফগানিস্তান ভ্রমণ করেন। সেসময় আহমেদ শাহ মাসুদ নামক একজন আফগান বিরোধী গেরিলা নেতার সাথে বন্ধুত্বও হয় তার। ২০০১-এ হত্যা করা হয় তাকে। তিনি আফগানিস্তানকে বেশ ভালো করেই চেনেন বলে জানান জিমারম্যান।
"বিগত ২০ বছরে যে কয়জন জার্মান সৈন্য নিহত হয়েছে তার চেয়েও বেশি আফগান মারা গেছে আমার শেষ ২ কর্মদিবসে," বলেন তিনি।
জিমারম্যান আরও জানান, তিনি বর্তমানে আফগানিস্তানে তার কার্যক্রম থেকে কোনো প্রকারের পরামর্শ ফি পাচ্ছেন না। গাঁজা বৈধভাবে রপ্তানি করা গেলেই কেবল তার কোম্পানি অর্থ উপার্জন শুরু করবে। কিন্তু, তার এই চিন্তা বেশ সময়সাপেক্ষ। বিশেষ করে, জাতিসংঘ এখনও তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দেওয়ায় তা আরও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু, কীভাবে একটি জার্মান কোম্পানি এমন একটি সরকারের সাথে ব্যবসা করতে পারে যা জার্মানি নিজেই স্বীকৃতি দেয়নি? জিমারম্যান বলেন, জার্মান সরকারের প্রথম দিন থেকেই তালেবানদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ছিল। "অতি পরাক্রমশালী একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফগান জনগনের জন্য সবচেয়ে খারাপ," বলেন তিনি।
ফলে, আফগানিস্তানে তার ভূমিকার মধ্যে রয়েছে তালেবান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পৃথক দেশের সাথে চুক্তির আলোচনায় সহায়তা করা যাতে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশী ব্যবসায়িক বিনিময় সহজতর করা যায়। "আমরা অপরাধী নই," জিমারম্যান প্রতিবাদ করেন।
তবে তিনি সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করেন না বলে উল্লেখ করেন জিমারম্যান। এমনকি নিজের পরবর্তী ব্যবসায়িক ভ্রমণের সময় গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ও রয়েছে তার। জিমারম্যান বলেন, "আফগানিস্তানের প্রচলিত নৈতিক কোডের সাথে আমার মানবতার দৃষ্টিভঙ্গির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি তা পরিবর্তনও করতে পারবো না। আমার জীবদ্দশায় আফগানিস্তানে প্রকৃত সমতা আসবে না।"
তবে, এটি সত্য যে আফগানিস্তানের সাথে জড়িত যে কোনো ব্যবসায়িক লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা দিলেই তালেবান মোকাবেলা করা সহজ হবে না। এছাড়া, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে একাধিক দেশ ইতোমধ্যেই এক্ষেত্রে দেশটিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এতে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আফগানিস্তানের নিরপরাধ সাধারণ মানুষ।
আপাতত, সিফার্ম ও তালেবানের মধ্যকার চুক্তি আটকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি আফগানিস্তানে ব্যবসার উদ্যোগ নেওয়ায় ইউরোপের কিছু ড্রাগ কার্টেল থেকে মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছেন বলে জানান জিমারম্যান।
জিমারম্যান স্বীকার করেন যে, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে বিকশিত হবে তা অনুমান করা কঠিন। তবে, নিজেকে একজন 'প্রত্যয়শীল ব্যক্তি' হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি।
- সূত্র: ভাইস