দুর্ভিক্ষ: বাস্তুচ্যুত আফগানদের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/6720_4.jpg)
৭০ বছর বয়সী সাঈদ মুহাম্মাদ বললেন, "গত ছয় বছরে এই প্রথম আমি বাড়িতে এসেছি।"
কিন্তু পরিবারসহ বাড়িতে ফিরে তিনি যে দৃশ্য দেখতে পেলেন, তা ছিল সত্যিই ধ্বংসাত্মক। বর্তমানে পরিত্যক্ত একটি সামরিক ঘাঁটির কাছে অবস্থিত তার বাড়ির পিছনের পুরো অংশটিই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের মারজা শহরের বেশিরভাগ মানুষই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গত এক দশকে। কারণ এই শহরটিতে তালেবান বাহিনীর সঙ্গে সাবেক সরকার ও জোট বাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। শহরে এমন একটি দালান পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, যেখানে ধ্বংসের চিহ্ন নেই।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/6720.jpg)
হেলমান্দসহ আফগানিস্তানের অন্যান্য প্রদেশগুলোতে এখন হাজার হাজার অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। তবে, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া তাদের ভিটেমাটি পুনর্গঠনের চেয়েও বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তারা হয়েছেন তা হল, পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা।
সাঈদ বলেন, "মাঝেমাঝে আমরা সবজি পাই; কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই আমরা রুটি আর চা খেয়ে থাকি। আমার সব সন্তানেরা ক্ষুধার্ত।"
ছিন্নভিন্ন এই শহরের অন্যান্য লোকদেরও একই অভিযোগ। পরিবারগুলোর কাছে পর্যাপ্ত খাবার কেনার টাকা নেই। সম্প্রতি সাঈদের মতো যারা ফিরে এসেছেন, তাদের কৃষিকাজ শুরু করার জন্য সামনের বসন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; কারণ এই খরায় চাষাবাদ সম্ভব নয়।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/6720_1.jpg)
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানজুড়ে জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ মানুষ পর্যন্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম, বাকি ৯৮ শতাংশই ভুগছেন খাদ্য সংকটে। এছাড়া, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি এই বছর তীব্র অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে।
ডাঃ মোহাম্মদ আনোয়ার নিজেও সম্প্রতি ফিরে আসা একজন অভ্যন্তরীন বাস্তুচ্যুত। মারজায় তিনি ছোট একটি প্রাইভেট ক্লিনিক চালান। সেখানে প্রতি সপ্তাহেই অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, "শিশুদের যা ওজন হওয়া উচিত, তার চেয়ে অর্ধেক ওজনের শিশুরা ক্লিনিকে আসছে।" ডাঃ আনোয়ারের অনুমান, এলাকায় কমপক্ষে ২ হাজার শিশু এখন মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে এবং মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/6720_2.jpg)
আফগানিস্তানের দরিদ্র গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য সংকটের সমস্যাটি নতুন নয়। তবে এটি এখন প্রকট আকার ধারন করার পিছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটিতে তালেবান সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে বাইরের দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও বন্ধ; পাশাপাশি আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে গেছে এবং দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে ফসল ও চারণভূমিও শুকিয়ে গেছে। ফলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখন অনেকটাই খারাপ।
মারজায় ফিরে আসা অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতরা খাবার কেনা বা বাড়ি মেরামতের জন্য টাকা ধার করে এখন চরমভাবে ঋণগ্রস্ত। সাঈদ জানিয়েছেন, তিনি দোকানদার এবং অন্যান্য পাওনাদারদের কাছে কমপক্ষে ৫০ হাজার আফগানী (৩৫০ পাউন্ড) ঋণ রয়েছেন।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/6720_3.jpg)
"আমাদের খাবার দরকার। নগদ টাকা দরকার, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ আমাদের কোনো সাহায্য দেয়নি", বললেন সাঈদ।
হেলমান্দে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদিকিও শহরে চরম খাদ্য সংকট, অপুষ্টি আর অভাবের কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন শহরের এই অনটন যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে।
তিনি বলেন, "যদি শীতকালে পরিস্থিতি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে হেলমান্দের বেশিরভাগ পরিবার আগের চেয়েও দরিদ্র হয়ে যাবে এবং অনেকের মৃত্যু হবে।"
স্থানীয় সংস্থাগুলোর সহায়তায় ইউএনএইচসিআর হেলমান্দে ফিরে আসা প্রায় ২২ হাজার বাস্তুচ্যুত পরিবারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। তাদেরকে শীতবস্ত্র দেওয়ার পাশাপাশি বাড়িঘর মেরামত করতেও সাহায্য করছে।
ডাঃ আনোয়ারের মতে, শিশুদের অপুষ্টি বৃদ্ধির মূল কারণ হল মায়েরা পর্যাপ্ত খাবার খেতে পারছেন না। তিনি বলেন, "তাদের খাবার তালিকায় পর্যাপ্ত আমিষ নেই, তাই তারা সন্তানদেরকেও ঠিকভাবে খাওয়াতে পারছেন না।"
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/6720_8_0.jpg)
এছাড়া, খরার কারণে বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। সেইসঙ্গে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া জীবনযাপনকে আরও কঠিন করে তুলেছে বলে জানান ডাঃ আনোয়ার। এসব কারণে দ্রুতই শিশুদের ওজন কমে যাচ্ছে।
শারীরিকভাবে দুর্বল ও অপুষ্টির শিকার শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে, পর্যন্ত খাবার ও চিকিৎসা না পেলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়তে পারে। আনোয়ার বলেন, "কিছু অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু আবার নিউমোনিয়ায়ও আক্রান্ত হচ্ছে।"
এসব কিছুই তাদের জীবনের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/6720_6.jpg)
দেশের প্রায় অব প্রদেশেই খরার প্রভাব দেখা দিয়েছে। সেচের খাল শুকিয়ে গেছে এবং লবণের স্তর চাষের জমিকে নষ্ট করে ফেলেছে। ফলে চাষাবাদ হয়ে উঠেছে কঠিন।
বছরের শুরুতে যদিও বৃষ্টি দেখেছে আফগানবাসী, তবে বৃষ্টির পরিমাণ এতই বেশি ছিল যে হেলমান্দ এবং পার্শ্ববর্তী কান্দাহার উভয় প্রদেশেই আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে বাড়িঘর, ক্ষেত খামারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সেচের জন্য পানি সঞ্চিত হওয়ার পরিবর্তে, তার বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। আর এ কারণেই খরা পরিস্থিতি সামলাতে যেকোনো পদক্ষেপ খুব বেশি সময় স্থায়ী হবে না বলেই মনে করছেন এলাকার বাসিন্দারা।
ইউএনএইচসিআর-এর মোহাম্মদ সাদিকি বলেছেন, "এলাকার সব যুবকেরা চলে যাচ্ছে। এখানে থেকে তারা আর কি বা করতে পারবে?"
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/6720_5.jpg)
নভেম্বরে মারজায় ফিরে আসা ফজল মোহাম্মদ বলেন, "যদি পানি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়, সেচের ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে আমাদের ইরান বা পাকিস্তানে চলে যেতে হবে।"
"অথবা আমরা নিজেদের জন্য নিজেরাই হয়তো কবর খুঁড়বো", আক্ষেপের সুরে বললেন ফজল।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান