জনগণের আস্থায় স্বৈরতন্ত্রের কাছে হেরে যাচ্ছে গণতন্ত্র: জরিপ
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/18/tiananmen_square.jpg)
বিশ্বব্যাপী যেভাবে করোনা মহামারি পরিস্থিতি সামলানো হয়েছে, এবং অর্থনৈতিক মন্দার মাত্রা যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারগুলোর উপর জনগণের আস্থা তলানিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছে। এমন তথ্যই উঠে এসেছে এক সাম্প্রতিক বৈশ্বিক জরিপে।
দ্য এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার নামের একটি সংস্থা এই জরিপটি চালিয়েছে। তারা গত দুই দশকে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে জরিপ করে দেখেছে সরকার, গণমাধ্যম, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর উপর তাদের আস্থার মাত্রা কেমন। সেখানে দেখা গেছে, চীনের মতো বেশ কিছু স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সরকারের উপর জনগণের আস্থার মাত্রা ক্রমবর্ধমান।
এছাড়া আরো দেখা গেছে যে টিকা উৎপাদন থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রের নতুন ব্যবস্থা ও পণ্য বিক্রির নতুন ধরন উদ্ভাবনের কারণে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারেও জনগণের আস্থার মাত্রা বেশ শক্তিশালী। অবশ্য সামাজিক স্বচ্ছতার ব্যাপারে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা দায়বদ্ধ, তা নিয়ে এখনো অনেকেই সন্দিহান।
"আসলেই গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের বিশ্বাসে ধস নেমেছে," জানান রিচার্ড এডেলম্যান। তার নেতৃত্বাধীন এডেলম্যান কমিউনিকেশন্স গ্রুপই গত বছরের ১ থেকে ২৪ নভেম্বর ২৮টি দেশের ৩৬,০০০ অংশগ্রহণকারীর সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে জরিপের ফলাফলটি প্রকাশ করেছে।
"এক্ষেত্রে সকলে যে প্রশ্নটিতে ফিরে যাচ্ছে তা হলো: 'আপনাদের কি অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস রয়েছে?'" এডেলম্যান যোগ করেন। তিনি জানান, মহামারি অথবা অটোমেশনের কারণে অনেক মানুষই চাকরি হারাচ্ছে, যা নিয়ে গণমানুষের চিন্তা বেড়েই চলেছে।
গত বছর মহামারি চলাকালীন জনগণের আস্থা সবচেয়ে বেশি হারিয়েছে জার্মানির প্রতিষ্ঠানগুলো। ৭ পয়েন্ট হারানোর ফলে তাদের স্কোর বর্তমানে ৪৬। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ৬ পয়েন্ট হারিয়ে ৫৩, নেদারল্যান্ড ৬ পয়েন্ট হারিয়ে ৫৭, দক্ষিণ কোরিয়া ৫ পয়েন্ট হারিয়ে ৪২, এবং যুক্তরাষ্ট্র ৫ পয়েন্ট হারিয়ে ৪৩।
অন্যদিকে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে জনগণের আস্থা বেড়েছে ৮৩ শতাংশ বা ১১ পয়েন্ট। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৭৬ শতাংশ বা ৯ পয়েন্ট, এবং থাইল্যান্ডের ৬৬ শতাংশ বা ৫ পয়েন্ট।
বিশ্বের ধনীতম রাষ্ট্রগুলো মহামারি চলাকালে তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখতে ট্রিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু জরিপের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, এরপরও তারা জনমনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাপানে মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেছেন যে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তারা ও তাঁদের পরিবার ভালো অবস্থায় থাকতে পারবেন। অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের মধ্যেও এক্ষেত্রে ইতিবাচক উত্তর প্রদানের হার ২০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে।
অথচ চীনে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ছিল। এদিকে ৮০ শতাংশ ভারতীয়ও বিশ্বাস করেছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের অবস্থা ভালো হবে।
এডেলম্যানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, চীনে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বেশি হওয়ার নেপথ্যে কারণ কেবল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণই নয়। পাশাপাশি মহামারি সত্ত্বেও চীনা নীতিমালার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের নিশ্চয়তার মনোভাবও এক্ষেত্রে একটা বড় প্রভাব ফেলেছে।
"আমার মনে হয় যা করা হয়েছে আর যা বলা হয়েছে তার মধ্যে একটা পারস্পরিক যোগসূত্র রয়েছে। তারা (চীনা জনগণ) বিশ্বাস করে যে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তারা অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে কোভিড পরিস্থিতি সামলাতে পেরেছে।"
রয়টার্সের প্যান্ডেমিক ট্র্যাকার বলছে, প্রতিদিন গড়ে নতুন মৃত্যুর সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র এখন সবার উপরে রয়েছে। অথচ চীনে বেশ কয়েক মাস ধরেই এমন অনেকদিন যাচ্ছে, যেসব দিনে কোনো নতুন মৃত্যুর ঘটনাই ঘটেনি। এর কারণ, তারা 'জিরো কোভিড' নীতিমালা গ্রহণ করেছে।
সর্বশেষ এই এডেলম্যান জরিপের ফলাফল তাঁদের সাম্প্রতিক বছরগুলোর ফলাফলের সঙ্গে বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। এ সময়ে তারা বারবারই পুঁজিবাদ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও গণমাধ্যমের ব্যাপারে জনগণের মোহভঙ্গের চিত্র তুলে ধরেছে।
এই সময়ে ভুয়া সংবাদের ব্যাপারে জনগণের উদ্বেগের পরিমাণও সর্বকালের সর্বোচ্চ উচ্চতায় গিয়ে ঠেকেছে। বিশ্বব্যাপী জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই বলেছেন, তারা গণমাধ্যম কর্তৃক 'অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া' নিয়ে চিন্তিত। এছাড়া সামাজিক ভীতিগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন এখন কর্মসংস্থান হ্রাসের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।
ব্যবসায়ী নেতাদের উপর আকাঙ্ক্ষার বোঝা এখনো যথেষ্ট ভারি। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশগ্রহণকারীই জানিয়েছেন, তারা ব্যবসায়ী নেতাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধে প্রভাবিত হয়েই তাদের পণ্য কিনেছেন, চাকরির প্রস্তাবে হ্যাঁ বলেছেন এবং তাদের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন।
অবশ্য পাঁচ ভাগের দুই ভাগ অংশগ্রহণকারী এ অভিযোগও তুলেছেন যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং কর্মক্ষেত্রে অটোমেশনের মতো সমস্যাগুলোর ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
- (সূত্র: রয়টার্স)