কে এই দলীপ সিং: রাশিয়ার ওপর কঠোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার রূপকার?
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ঘোষণার মঞ্চে আসছেন এক জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা দলীপ সিং। ভারতীয় বংশদ্ভূত দলীপ হোয়াইট হাউসের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি-বিষয়ক সহকারী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং একইসাথে আমেরিকার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের উপ-পরিচালক।
৪৭ বছরের দলীপ একজন অভিজ্ঞ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। আর্থিক খাতে তার সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিনের। এর আগে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের (সংক্ষেপে, ফেড) হেড অব মার্কেটস গ্রুপের প্রধান হিসেবে। ছিলেন ফেডের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট।
একজন অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে এতদিন দলীপের বিচরণ ছিল পাদপ্রদীপের বাইরে, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান যা বদলে দিয়েছে। তিনি এখন নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিং করছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে রাখছেন সবচেয়ে নির্ণয়ী ভূমিকা।
যেমন ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরু হতেই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে মস্কোর ওপর এযাবৎকালের সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞার রূপকাঠামো তুলে ধরেন দলীপ।
নিষেধাজ্ঞার খুঁটিনাটি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল হোয়াইট হাউস। সে কথা স্পষ্ট হয় হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব জেন সাকির মন্তব্যে। সাকি বলেছেন, "কোনোদিন তিনি অর্থনীতি বিশারদের ভার ছাড়তে চাইলে, আমাদের প্রেস অফিসে তার জন্য উজ্জ্বল ক্যারিয়ার অপেক্ষা করছে।"
নিষেধাজ্ঞামালা ঘোষণার সময় দলীপ অনেকটা স্বগোক্তির সুরেই বলেন, "এমন ব্রিফিং আমি কখনো দেওয়ার কথা ভাবিনি"- এরপর তিনি রাশিয়ার অর্থনীতিকে পর্যদুস্ত করতে বাইডেন প্রশাসনের অনুমোদিত দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞাকে ব্যাখ্যা করেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালালে রাশিয়াকে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হবে এমন হুঁশিয়ারি দেন। আর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণাকালে দলীপ বাইডেনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, "রাশিয়াকে এ আগ্রাসনের তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী মূল্য দিতে হবে। দেশটির অর্থনীতি, আর্থিক খাত, প্রযুক্তি খাত এবং বিশ্বে কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করবে আমেরিকার সিদ্ধান্ত।"
পুতিনের সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিক আইনের 'ঘোর লঙ্ঘণ' বলে উল্লেখ করে দলীপ সিং আরো জানান, এখন 'তার এই সিদ্ধান্ত যেন কৌশলগত ব্যর্থতায় রূপ নেয়' – তা নিশ্চিত করতে আমেরিকা কাজ করবে।
"আমেরিকা আজ নজিরবিহীন মাত্রার প্যাকেজ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করছে। মিত্র ও সহযোগীদের সাথে আমরা একযোগে রাশিয়াকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সরঞ্জাম পাওয়ার পথও বন্ধ করা হলো। ফলে নিজ দেশের অর্থনীতিকে আধুনিকায়নের যে কৌশলগত উচ্চাভিলাষ পুতিনের রয়েছে তা ব্যর্থ হবে।"
তবে ওই ব্রিফিংয়ে রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানি খাতকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়, খুব সম্ভবত আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের কথা ভেবেই। রাশিয়ার ওপর জ্বালানি নির্ভর বিশ্বের অন্যান্য দেশ যাতে তাৎক্ষণিকভাবে রুষ্ট না হয়- সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়েছে দলীপকে । কারণ, রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ খনিজ তেল উত্তোলক।
অপরদিকে, রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দুটি আর্থিক সংস্থা- সেবেরব্যাংক ও ভিটিবির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ দুটি প্রতিষ্ঠান রুশ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় থাকা সম্পদের অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে, যার বাজারমূল্য কমপক্ষে ৭৫ হাজার কোটি ডলার।
রাশিয়ার আরো তিনটি ব্যাংকের মোট ৭ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ জব্দ করা হয়। রাশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ে বা তাদের ঋণদানকে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এসব কোম্পানির মিলিত সম্পদমূল্য প্রায় দেড় লাখ কোটি ডলার।
একইসাথে, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর নির্বাহীরাও পড়েন নিষেধাজ্ঞার আওতায়, পুতিন ঘনিষ্ঠ অভিজাত ধনকুবের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপরও নেমে আসে বিধিনিষেধের খড়্গহস্ত।
পরবর্তীতে রুশ বাহিনী যখন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কাছাকাছি পৌঁছায় তখন এক ব্রিফিংয়ে দলীপ জানান, নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ অস্ত্রের ক্রেতা অনেক দেশ সমরাস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে সমস্যায় পড়বে। ফলে মস্কোর অস্ত্র রপ্তানি কমবে। প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞার কারণ রুশ প্রতিরক্ষা খাতের এরোস্পেস ও নৌ সেক্টরের উন্নয়ন সীমিত হয়ে পড়বে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ওপরও প্রবল নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এভাবে রাশিয়াকে আর্থিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে পরাস্ত করার এই কৌশলের রূপকার হিসেবে দলীপ সিংকেই কৃতিত্ব দিয়েছে প্রভাবশালী গণমাধ্যম পলিটিকো। এই কৌশলকে 'দলীপ ডকট্রিন' নামেও আখ্যায়িত করে গণমাধ্যমটি।
২৪ ফেব্রুয়ারি দলীপ বলেছিলেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার পুঁজিবাজারে আরো নজিরবিহীন ধস নামবে, দুর্বল হবে মুদ্রা- রুবল এবং বাড়বে দেশটির ঋণ গ্রহণের খরচ। ফলতঃ নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও জীবনমান নেমে আসবে রাশিয়া জুড়ে।
এই পরিণতি তিনি না চাইলেও, এখন পুতিনের যুদ্ধের কারণে রুশ জনগণকে এই দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হলো বলে উল্লেখ করেন দলীপ।
পলিটিকো দলীপ সিংকে একজন অপেক্ষাকৃত স্বল্প-পরিচিত মার্কিন কর্মকর্তা বলে উল্লেখ করে জানায়, ইউক্রেন যুদ্ধের পর তিনি হোয়াইট হাউসের একজন অপরিহার্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযানের বর্শাফলকই হয়েছেন দলীপ।
পলিটিকোর বিশ্লেষণ অনুসারে, "যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন দলীপের কৌশলের প্রতিটি পদক্ষেপকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছেন।"
রাশিয়ার অর্থনীতিতে চরম দুর্দশা নিশ্চিত করাই বাইডেন প্রশাসনের অন্তিম লক্ষ্য, যার গুরুভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন এই ভারতীয়-আমেরিকান।
উল্লেখ্য, এর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের অর্থ মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন দলীপ সিং। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নেওয়ার পর দেশটির বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রণয়নেও অন্যতম নীতি-নির্মাতার ভূমিকা পালন করেছিলেন।
- সূত্র: নিউজ ইন্ডিয়া