'মা' নামের এক ব্যক্তির আটকের খবরে আলিবাবার ২৬ বিলিয়ন ডলার দরপতন!
'মা' পদবিধারী জনৈক ব্যক্তিকে আটকের খবর প্রকাশের পর চীনা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আলিবাবার শেয়ার ৯ দশমিক ৪ শতাংশ নিচে নেমে গেছে। আলিবাবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা টেক বিলিয়নিয়ার জ্যাক মা'র নামের সাথে মিল থাকার পাশাপাশি, ওই ব্যক্তি আটকও হয়েছেন হ্যাংঝু রাজ্যে, যেখানে আলিবাবার সদর দপ্তর অবস্থিত। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে বলে জানায় দেশটির সরকারি গণমাধ্যম।
চীনা সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম সিসিটিভি সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ এপ্রিল সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তিকে 'বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ'-এর আওতায় ফেলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সরকার পতনের উস্কানি দিতে তিনি চীনবিরোধী বিদেশি শক্তির সাথে আঁতাত করেছেন।
এক লাইনের ওই প্রতিবেদনটি মুহূর্তে লুফে নেয় দেশটির অন্যান্য গণমাধ্যম এবং অসংখ্য চীনা সংবাদমাধ্যমে এটি প্রচারিত হয়। ফলে হংকংজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই আলিবাবার বাজারমূল্য ২৬ বিলিয়ন ডলার কমে যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় এই ক্ষতির পরিমাণ ২ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা!
তবে এ উত্তেজনার মধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত জাতীয় ট্যাবলয়েড 'গ্লোবাল টাইমস' এর সাবেক এডিটর-ইন-চীফ হু শিজিন দ্রুত চীনের টুইটারসদৃশ প্ল্যাটফর্ম ওয়েইবো-তে ছুটে যান। সেখানে তিনি জানান, জনৈক 'মা' নামক ব্যক্তিকে নিয়ে করা প্রতিবেদনটি বিভ্রান্তিকর। কারণ অভিযুক্ত ব্যক্তির নামে তিনটি অংশ রয়েছে, অন্যদিকে বিজনেস ম্যাগনেট জ্যাক মা্'র আসল চীনা নামে আছে দুটি অংশ- মা ইয়ুন।
সংবাদের বিভ্রান্তি দূর করতে গ্লোবাল টাইমস আরো জানায়, অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্ম ১৯৮৫ সালে ওয়েনঝুতে (অন্যদিকে জ্যাক মা'র জন্ম ১৯৬৪ সালে হ্যাংঝু রাজ্যে) এবং তিনি একটি আইটি কোম্পানিতে হার্ডওয়্যার রিসার্চ শাখার পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এদিকে আটককৃত মা'র আসল তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করায় লাভবান হয়েছে আলিবাবা। ইতোমধ্যেই ক্ষতির অনেকাংশ পুষিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু হুট করে আলিবাবার এই বিশাল দরপতন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে খামখেয়ালী বিনিয়োগকারীরা প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধরত চীনের প্রযুক্তি শিল্প খাতের উপর ভরসা হারাচ্ছেন। ২০২০ সাল থেকেই চীনের সরকারি নিয়ন্ত্রকদের টার্গেট হিসেবে রয়েছে এই খাত।
সম্প্রতি আবারও সরকারি ধরপাকড় চালানোর ক্যাম্পেইনটি ফিরিয়ে আনা হবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মঙ্গলবারের এই দরপতন থেকে বোঝা যায়, বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস এখনো নড়বড়ে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ভিক্টর শিহ বলেন, "আমি ভেবেছিলাম এটা একটা খারাপ সময় যাচ্ছে। হয়তো এর মাধ্যমে চীনের প্রযুক্তি খাতকে একটা সতর্কবার্তা দেওয়া হলো, কিংবা ব্যক্তি জ্যাক মা'কেই দেওয়া হলো। কে জানে? কিন্তু এ থেকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হলো- একটি প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ধ্বস নামাতে সরকারকে আসল সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করারও প্রয়োজন নেই, শুধু তার নাম দিয়ে কিছু একটা খবর রটিয়ে দিলেই চলে!"
ভিক্টর শিহ মনে করেন, "এটা খুবই শক্তিশালী। আরোপিত হোক বা না হোক, মঙ্গলবার যা হয়েছে তা সেই ক্ষমতা বা শক্তিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।"
কিন্তু চীনের একসময়কার হাই-প্রোফাইল বিলিয়নিয়ার জ্যাক মা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করে ধরা পড়বেন- তা বিনিয়োগকারীরা এত দ্রুত বিশ্বাস করে নেওয়ায় চীনের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো একটু উন্মোচিত হয়ে গেছে। চলমান এই ভীতিকর পরিস্থিতির চাপে আছেন দেশের অন্যান্য বিজনেস টাইকুনরা।
চীনের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ওয়েইবোতে একজন মন্তব্য করেন, "অভিযুক্ত লোকটা জ্যাক মা ছিল নাকি ছিল না, তাতে কিছু যায় আসে না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, বহু মানুষ ভেবেছে আসল জ্যাক মা আটক হয়েছেন, বহু মানুষ মন থেকে চেয়েছেন যেন জ্যাক মা-ই আটক হন এবং এটাই মজার।" ওয়েইবোতে এই মন্তব্যে ৫৭০০০ লাইক পড়েছে।
জ্যাক মা'র বিরুদ্ধে এই জনমত অনেকটা তার 'জিরো থেকে হিরো' হওয়ার কাহিনীর মতোই মুখরোচক! সামান্য ইংরেজির শিক্ষক থেকে বিলিয়নিয়ার বনে যাওয়া জ্যাক মা বছর তিনেক আগেও নিজ দেশে পরম পূজনীয় ব্যক্তি ছিলেন। তার ক্যারিশমা, আত্মবিশ্বাস ও স্বনির্মিত সাফল্যের জন্য মানুষ তাকে ভালোবাসতো। শোনা যায়, কোনো কোনো ভক্ত তাকে আদর করে 'ড্যাডি মা'-ও ডাকতেন।
কিন্তু জ্যাক মা'র প্রতিষ্ঠান আলিবাবা তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করার পরপরই চীনা তরুণদের ক্ষোভ-হতাশার টার্গেটে পরিণত হয় এটি। দীর্ঘ কর্মঘন্টা, কাজের চাপ এবং অপরিবর্তিত পারিশ্রমিকের কারণে তাদের মধ্যে এই ক্ষোভ জন্ম নেয়। জ্যাক মা চীনের 'নয়টা থেকে ছয়টা' কর্মঘন্টার ঐতিহ্যকে অনুসরণ করায় ২০১৯ সালে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।
টেক জায়ান্টদের ক্ষমতার কমাতে সরকারি উদ্যোগ আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই 'দুষ্ট পুঁজিবাদীদের' উপর নানা অভিযোগ আসতে থাকে। নিরন্তর প্রতিযোগিতা, সম্পদের আকাশচুম্বী দাম থেকে শুরু করে সামাজিক গতিশীলতার পথে অন্তরায়সহ নানা সামাজিক অবক্ষয়ের দায় দেওয়া তাদের।
শিয়াং ডংলিয়াং নামক জনৈক ব্লগার উইচ্যাটে লেখেন, "মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই 'ড্যাডি মা' মানুষের কাছে একজন 'জঘন্য পুঁজিপতি'তে পরিণত হন। অনেকেই এখন তার পতন কামনা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পুঁজিপতিদের টেনে নামালে এবং তথাকথিত বিদেশী শক্তি বিদায় করলেই কি আমাদের সবার জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে?"
২০২০ সালের শেষদিকে চীনা নিয়ন্ত্রকেরা যুক্তরাষ্ট্রে অ্যান্ট গ্রুপের আইপিওর উদ্যোগটি থামিয়ে দেওয়ার পর থেকে খুব একটা জনসম্মুখে আসেননি জ্যাক মা। একসময় চীনের সবচেয়ে স্পষ্টভাষী হিসেবে খ্যাত এই বিলিয়নিয়ার ২০২০ সালের অক্টোবরের পর থেকে ওয়েইবোতে-ও কিছুই পোস্ট করেননি।
সূত্র: সিএনএন