স্নেক আইল্যান্ড: রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে যে দ্বীপের দখল
ইউক্রেন আক্রমণের শুরু থেকেই স্নেক আইল্যান্ডকে টার্গেট বানিয়েছে রাশিয়া। কৃষ্ণ সাগরের এই পাথুরে দ্বীপটি রাশিয়া ইতোমধ্যেই দখল করেছে। তবে যুদ্ধে কৌশলগত অবস্থানের কারণে এই দ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেতে এখনও তুমুল লড়াই চলছে রুশ ও ইউক্রেনীয় বাহিনীর মধ্যে।
রাশিয়া দাবি, ইউক্রেন তার বিশেষ বাহিনী, যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার এবং অত্যাধুনিক ড্রোনের ব্যবহার করেও দ্বীপটি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। উপরন্তু, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে তাদের। অন্যদিকে ইউক্রেন জোর দিয়ে বলছে, তারা দ্বীপ এবং নৌযানে হামলার ক্ষেত্রে তাদের অভিযান ইচ্ছাকৃতভাবেই সীমিত করেছে।
তবে সংঘাত শেষ হয়নি; রাশিয়া সেখানে তার নতুন স্থাপিত গ্যারিসনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এমনটিই বলছে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা তথ্য।
স্নেক আইল্যান্ড, যা স্থানীয়ভাবে ঝামিনি দ্বীপ নামেও পরিচিত, আকারে মাত্র এক বর্গকিলোমিটার। নামানুসারে সেখানে কোনো সাপ থাকলেও পশ্চিম কৃষ্ণ সাগরের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে উভয় বাহিনীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই দ্বীপ।
ইউক্রেনের সমর বিশেষজ্ঞ ওলেহ ঝদানভ বিবিসিকে বলেন, "যদি রুশ বাহিনী স্নেক আইল্যান্ড দখল করতে সফল হয় এবং সেখানে তাদের দূরপাল্লার বিমান-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করে, তাহলে তারা কৃষ্ণ সাগরের উত্তর-পশ্চিম অংশে এবং ইউক্রেনের দক্ষিণে সমুদ্র, স্থল এবং আকাশপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম হবে।"
মূলত এ কারণেই যুদ্ধ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজ মস্কভা ওই দ্বীপে গিয়ে সেখানে অবস্থারত ইউক্রেনীয় সেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল। তবে তাতে কর্ণোপাত করেনি ইউক্রেন, বরং এর কিছুদিনের মধ্যেই ডুবে যায় মস্কভা। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে একটি বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া ছিল মস্কভা ডুবির এই ঘটনা।
পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, মস্কভা হারিয়ে রাশিয়ার অন্যান্য সরবরাহকারী জাহাজগুলো এখন অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তবে যদি এটি পুনরায় সুসংহত অবস্থায় ফিরতে পারে, তাহলে কৃষ্ণ সাগরের একটি বড় অংশে আধিপত্য জুড়ে বসবে রাশিয়া।
ইউক্রেন, প্রতিবেশী দেশ ও ন্যাটোর ওপর হুমকি!
স্নেক দ্বীপ তথা কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার উপস্থিতি ইউক্রেনের জন্য কৌশলগত তো বটেই, অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যয়কর হতে পারে।
ইতোমধ্যে ওডেসা বন্দর বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে ইউক্রেন। এর ফলে ওই পথ দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে পণ্য রপ্তানিও। এদিকে ঝদানভের আশঙ্কা, দ্বীপটি যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্টলাইন হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
তিনি বলেন, "যদি রাশিয়ানরা দূরপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করেই ফেলে, তহলে তারা সেখানে নিজেদের ঘাঁটি রক্ষা করতে সক্ষম হবে। আর এর মাধ্যমে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের উপকূল পর্যন্তও পৌঁছে যেতে পারে।"
এমনকি এই স্নেক আইল্যান্ডের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা সফল হলে রুশ সেনারা ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতেও প্রবেশের সুযোগ পাবে বলে আশঙ্কা করছেন পশ্চিমের সমর বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য, রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন মলদোভার বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল ট্রান্সনিস্ট্রিয়া, যা ইউক্রেনের পাশেই অবস্থিত এবং ওডেসা থেকেও খুব বেশি দূরে নয়।
অন্যদিকে, স্নেক আইল্যান্ড ন্যাটোসদস্য রোমানিয়ার উপকূল থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার (২৮ মাইল) দূরে অবস্থিত।
যুক্তরাজ্যের নৌ বিশ্লেষক জোনাথন বেন্থাম মনে করেন, স্নেক দ্বীপে রাশিয়ার একটি এস-৪০০ এয়ার মিসাইল সিস্টেম বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিতে পারে চলমান যুদ্ধের সমীকরণে। রাশিয়া যদি এখানে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা স্থাপনে সক্ষম হয়, তাহলে সেটি কেবল ওডেসাতেই হুমকি হয়ে দাড়েব না বরং ন্যাটোর দক্ষিণ অঞ্চলের জন্যও বিপদ বয়ে আনবে।
এ ব্যাপারে রোমানির ইতিহাসবিদ ডোরিন ডোব্রিঙ্কু সতর্ক করে বলেন, "এটি রোমানিয়ার সরকার এবং জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও পুরো জোটের জন্যই একটি চিন্তার বিষয়। এখানে (রুশ বাহিনী) সফল হলে আমাদের পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ড ও শহরগুলোর সামরিক সক্ষমতা ধ্বংসের ক্ষমতা থাকবে রাশিয়া হাতে।"
যুদ্ধের শুরুতেই ন্যাটোর পক্ষ থেকে বেলজিয়ান এবং ফরাসি বাহিনী পাঠানো হয়েছে রোমানিয়ায়, যেন দেশটির সীমানা সুরক্ষিত থাকে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোমানিয়ার জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকি রয়েছে এখানে। ইউক্রেন ও রোমানিয়ার সীমান্ত নির্ধারণকারী দানিউব নদীর মুখেই অবস্থিত এই স্নেক আইল্যান্ড। রোমানিয়ার কৃষ্ণ সাগরের কনস্টান্টা বন্দর থেকে ইতোমধ্যেই ওডেসা বন্দরের মাঝে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
রুশ সমর-রাজনীতি বিশ্লেষক আলেকজান্ডার মিখাইলভের মতে, স্নেক দ্বীপে অবস্থারত রুশ সেনারা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত উত্তর-পশ্চিম কৃষ্ণ সাগর এবং দানিউব ব-দ্বীপে নৌ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে অবস্থান নিতে পারে।
রুশ মিডিয়াকে তিনি বলেছেন, "যদি সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি বা সামরিক অবকাঠামো থাকে, তাহলে নদীতে প্রবেশের পাশাপাশি ছেড়ে যাওয়া জাহাজগুলোকেও আটকানো সম্ভব হবে।"
এছাড়া রোমানিয়ার ইউরো-আটলান্টিক রেজিলিয়েন্স সেন্টার বিশ্বাস করে, রাশিয়া যথাসম্ভব দ্বীপটিকে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেইসঙ্গে, তুরস্কের বসফরাস প্রণালী মুখী কৃষ্ণ সাগরের শিপিং রুটগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে, স্নেক আইল্যান্ড রোমানিয়ারই অংশ ছিল। তবে পরবর্তীতে, ১৯৪৮ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে দ্বীপটি হস্তান্তর করে বুখারেস্ট। এরপর থেকে দ্বীপটি রাশিয়ার 'রাডার বেস' হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কারণ ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত সোভিয়েত প্রভাবের অধীনেই ছিল রোমানিয়া।
এরপর ধীরে ধীরে কমিউনিজমের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্নেক দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ইউক্রেন। অবশেষে, ২০০৯ সালে হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এই ভূ-খণ্ডের আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। দ্বীপটির কৃষ্ণ সাগরের কাছাকাছি মহাদেশীয় অংশের প্রায় ৮০ শতাংশ পায় রোমানিয়া এবং বাকি অংশ পায় ইউক্রেন।
চলমান যুদ্ধে কৌশলগত অবস্থানের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব রয়েছে স্নেক আইল্যান্ডের। কারণ কৃষ্ণ সাগরের এই অংশটি হাইড্রোকার্বন সম্পদে সমৃদ্ধ। ইউক্রেন ও রোমানিয়া, উভয় দেশেরই পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাস সম্পদের বড় একটি অংশের মজুদ রয়েছে এই দ্বীপে।
তাই একে ছোট্ট একটি পাথুরে দ্বীপ মনে হলেও সমর বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে এই দ্বীপের দখল।
- বিবিসি থেকে অনূদিত