‘ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থন সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছে’- এবার কমার পালা!
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির উত্তপ্ত ইস্যু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। সেখানে পশ্চিমা দেশ ও তাদের জনগণ নিয়েছে কিয়েভের পক্ষ। মস্কোকে যেকোনো মূল্যে ঠেকানো হবে- এই ছিল পণ। সে দৃঢ়চিত্তে সম্ভবত ফাটল ধরবে এবার। কারণ ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে এবং অচিরেই তা কমতে থাকবে বলে এক বিশ্লেষণে জানিয়েছেন দ্য আটলান্টিক- এর নিয়মিত লেখক আন্ড্রু এক্সুম। তিনি ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক উপ-সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদে ছিলেন। নিবন্ধটির অনূদিত অংশ এখানে তুলে ধরা হলো-
রাশিয়ার বিপক্ষে পশ্চিমাদের ঐক্যকে কী বলা যেতে পারে? তা কি শুধুই মামুলি জোট? নাকি এমন এক মহাজোট যার একমাত্র লক্ষ্য- রাশিয়ার সর্বনাশ; ইউক্রেনে মস্কোকে নাকেখত দিতে বাধ্য করা; রাশিয়ার অর্থনীতি, ক্ষমতার মসনদ সব বদলে দেওয়া এক ধাক্কায়।
আটলান্টিকের দুই পাড়ের এ মহাজোট অনেক শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে। দিচ্ছে আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র। তারপরও একটি বিষয় স্পষ্ট। তাদের অভিষ্ট রাশিয়ার পরাজয় ঘটছে না এবং মহাজোট তাদের ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।
সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর অর্থ- আগামী মাসগুলোয় ইউক্রেন সরকারের সাথে তাদের বৈদেশিক বন্ধু ও সমর্থকদের সম্পর্কে চিড় ধরবে। এর জন্য প্রধানত দায়ী যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিরোধে ইউক্রেনের জনগণকে অস্ত্র দিতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা শক্তিগুলো যে অবিশ্বাস্য গতি ও সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছে—আগামী প্রজন্মের শিশুরা সে ইতিহাস পড়ে চমকিত হবে। সে তুলনায়, ১৯৩৯-৪০ সালে রাশিয়া যখন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে তখন পশ্চিমা বিশ্ব আক্রান্ত দেশকে নামেমাত্র সাহায্য দেয়। অথচ এবার ইউক্রেনকে মারণাস্ত্র দিতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমেছে ইউরোপীয়রা।
ত্রাণ হিসেবে মারণাস্ত্রের চালান আমাকে বিস্মিত করে। আমি সিরিয়ায় পশ্চিমা মিত্রদের সাথে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সরাসরি সংঘাত এড়ানোর চেষ্টায় যুক্ত ছিলাম। ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালনকালে দুই পক্ষকে দূরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কারণ আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম যে, রুশ সেনাদের হত্যা করলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হবে।
আজকের চিত্র তার পুরো বিপরীত। ইউক্রেনকে সর্বাধুনিক ট্যাংক ও বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে, যাতে তারা যত বেশি সম্ভব রাশিয়ানকে হত্যা করতে পারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়; যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডস থেকে শুরু করে এমনকী সুইডেনও যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে ট্যাংক- বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। রাশিয়ার উত্তর সীমান্তের প্রতিবেশী দেশ হয়েও ঝুঁকি নিতে পিছপা হয়নি সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। দেশদুটি এখন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদ লাভের চেষ্টা করছে।
তবে পশ্চিমাদের অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির তার হিসাবে ভুল করেছেন। হয়তো তা অহেতুক করেননি। এর আগে, ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সময় নীরব দর্শক ছিল পশ্চিমারা। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ মস্কো দখলে নেওয়ার সময়ও হয় একই ঘটনা। আলোচ্য দুটি সংঘাতের সময়েই, রাশিয়ার ওপর এমনকী নিষেধাজ্ঞা দিতেও গড়িমসি করেছে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো। পদক্ষেপ নিতে তাদের এই অনাগ্রহ- ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর আগে রাশিয়ার সমীকরণকে প্রভাবিত করেছে। রুশ নেতৃত্ব হয়তো ধরে নিয়েছিলেন পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া- বড়জোর নিন্দাজ্ঞাপন এবং আরও কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি বলে, ইউক্রেন রাশিয়ার দখল করা এলাকায় মস্কোর কর্তৃত্ব মেনে নিবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। ইউক্রেনীয়রা হয়তো মনে করছে, সাম্প্রতিক সময়ে বড় ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েও তারা শেষপর্যন্ত জয়লাভ করবে।
তাই পশ্চিমা মিত্রদের আরও বেশি সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে কিয়েভ। ইউক্রেনীয়রা এখন যে সহায়তা চাইছে তা সামরিক দিক থেকে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। কিয়েভ শুধু রাশিয়ার অগ্রযাত্রা রুখতে নয়; বরং রাশিয়ার শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনীকে টেক্কা দিয়ে দখলীকৃত এলাকা মুক্ত করতে চায়।
ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে হলেও বাইডেন প্রশাসনের মধ্যে স্পষ্ট সংকোচ দেখা যাচ্ছে। অথচ আটলান্টিকের অপরপাড়ের আমেরিকা ছাড়া ইউরোপের দেশগুলি এতটা সাহায্যের হাত হয়তো বাড়িয়ে দেবে না।
ইউরোপের মিত্রদের সংকোচের কারণ- যুদ্ধের অর্থনৈতিক মূল্য থেকে উদ্ভূত। এরমধ্যেই তা আমেরিকার নীতিনির্ধারকদের কাছেও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজ কথায়, পশ্চিমা শিবিরে শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে ইউক্রেনে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের বৈশ্বিক অভিঘাত।
ইউরো জোনে মূল্যস্ফীতি চলতি বছরের মে'তে ৮.১ শতাংশের রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী বছরই মন্দার আশঙ্কা করছেন শীর্ষ অর্থনীতিবিদেরা। অনেক ব্যবসায়ী নেতা আবার তার আগেই মন্দা দেখা দেওয়ার ভয়ে রয়েছেন।
পুতিনের যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির নাজেহাল অবস্থা সৃষ্টি করেছে, পুরোপুরি তেমন আরোপ করা যায় না। তবে নিশ্চিতভাবে বিকাশের গতিকে রুদ্ধ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহে নজিরবিহীন চাপ সৃষ্টি করছে। উন্নয়নশীল দেশে নিত্যখাদ্যের চড়া দাম নাভিশ্বাস ওঠাচ্ছে আপামর জনতার। তার সাথে জ্বালানি কেনার চড়া খরচ ধস নামাচ্ছে মুদ্রারিজার্ভে।
বিশ্বের প্রায় সকল স্বল্পোন্নত দেশ এই যন্ত্রণার শিকার। অনেক দেশের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার যার ফলে অস্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় লোকরঞ্জনবাদ বা পপুলিজমের রাজনীতি যারা করে তাদের হাত শক্তিশালী হচ্ছে। মানুষও সেদিকে ঝুঁকছে। কলম্বিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির সাম্প্রতিক নির্বাচনে সেজন্যই মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন কমতে দেখা গেছে।
দুর্বল অর্থনীতি ও লোকরঞ্জনবাদের উত্থানের 'শাখের করাত' পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। যুদ্ধ যতদিন চলবে- ততো বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে বিশ্ব অর্থনীতির। লোকরঞ্জনবাদ প্রথাগত রাজনীতিকে কোণঠাসা করবে। ফলত; এ দুটি বিষয় নিয়ে পশ্চিমা সরকারগুলো আরও বেশি ভাববে এবং তার ফলে কমতে পারে ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্র সাহায্য।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক