পশ্চিমাদের ‘ঐক্য’ ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে
শতাধিক দিন অতিক্রম করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। সংঘাতটি অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সংকটের জন্ম দিয়েছে; একইসাথে পশ্চিমা দুনিয়াকে এক বিপজ্জনক ভ্রমের ঘোরে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।
কয়েক মাস আগেও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ছিল নানান বিষয়ে স্পষ্ট বিভাজন। ইউরোপের নেতৃস্থানীয় দেশ জার্মানি রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিকভাবে লাভজনক সম্পর্ক রক্ষা করে চলতো। রাশিয়াকে মোকাবিলায় বর্তমানে সম্মুখসারির দেশ হয়ে ওঠা পোল্যান্ড তখন স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থা ঠেকাতে দেশটির বিরুদ্ধে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয় ইইউ।
ইউরোপের অন্য প্রান্তের প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাজ্য সে সময় রক্ষণশীল দলের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আয়ত্তে, যার সত্যবাদিতা প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিক, ট্রাম্পবাদ ও মহামারি অব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার আটলান্টিকের অপর পাড়ের যুক্তরাষ্ট্র—আফগান যুদ্ধের লজ্জাজনক পরাজয়ের ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত। দুর্বল হয়ে পড়েছিল সামরিক জোট- ন্যাটো । ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ন্যাটো 'ব্রেইন ডেথের' শিকার বলে মন্তব্য করেন। তিনি বিকল্প একটি সমর জোট গঠনের পরিকল্পনার কথাও জানান।
সব মিলিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার হালচিত্র ছিল উদ্বেগজনক।
যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র এসব সংকট ভোজবাজির মতো উবে গেছে- এমন দাবি করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামলেন পশ্চিমা সাংবাদিকেরা। রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় 'পশ্চিমা দুনিয়ার ঐক্য'কে তারা প্রশংসায় ভাসালেন, এবং একে 'মুক্ত বিশ্বের' পুনরুত্থানের প্রতিচ্ছবি বলে সমর্থন দিলেন। তাদের সংবাদ উপস্থাপন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুতিনের আগ্রাসনের সাথে তাল মিলিয়ে তারা পশ্চিমা দুনিয়ার ক্ষয়প্রাপ্ত ভাবমূর্তিকে পলিশ করে চকচকে করতে সচেষ্ট হন। এবং সেই আলোকে পুতিনকে ঠেকানোর পক্ষে সংবাদ করতে থাকেন।
আত্মসম্মান রক্ষার তৎপরতা থেকে জন্ম নেওয়া অমনোযোগী এসব প্রতিক্রিয়ার ফলাফল নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হতে বাধ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা। একে পুতিনবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তির প্রদর্শন হিসেবে অকুন্ঠ সাধুবাদ জানায় তাদের গণমাধ্যম। অথচ তারা একবারও বলেনি, এর আগে কিউবা, ভেনিজুয়েলা বা উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া কতোটা নিস্ফল হয়েছে। এসব দেশের তুলনায় রাশিয়া অনেক সম্পদশালী এবং একটি বিশ্বশক্তি। পুতিনও নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান আর যুদ্ধ চালিয়ে যান। নিষেধাজ্ঞার একমাত্র অর্জন- আজ বিশ্বের শত শত কোটি মানুষকে চরম মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যাভাবের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত আরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যার প্রধান লক্ষ্যই ছিল পশ্চিমা দুনিয়ার রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখা। বিপরীতে পুরো বিশ্বের ওপর এগুলির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণতিগুলোকে আমলে নেওয়া হয়নি। অথচ পুরো পৃথিবী মহামারির চরম ধবংসাত্মক দুই বছর পার করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল।
পশ্চিমাদের অপরিণামদর্শী আচরণ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশকে ক্ষুদ্ধ করেছে। তাই তাদের রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এমনকী পশ্চিমা দুনিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত ও তুরস্ক বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বাড়াচ্ছে। গোটা দুনিয়ায় গম ও সার সরবরাহকারী কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলোকে নৌ-অবরোধ করে পাল্টা আঘাত হানতেও পিছপা হননি রুষ্ট পুতিন।
পশ্চিমা জোটের শক্তি নিয়ে অতিরঞ্জনকে আদতে সত্যি বলে মানতে শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। মস্কোয় শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন এবং তার মধ্য দিয়ে চরমভাবে দুর্বল রাশিয়ার অভ্যুদয়ের স্বপ্নে বিভোর হলেন। ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ার মতো দেশে সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের এই লক্ষ্যপূরণ যে হয়নি সেকথা তারা একেবারেই বললেন না। একইসময় যুদ্ধের তিনমাস কেটে যাওয়ার পরও ইউক্রেনে পশ্চিমাদের বাস্তবিক লক্ষ্য সম্পর্কে এসব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কোনো সংজ্ঞা দিতে পারছেন না।
তবে বাস্তবতা হলো- যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সামনে ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা বেঁছে নেওয়ার উপায় ছিল।
প্রথমটি হলো, ইউক্রেনের প্রতি তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন এবং আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা—যাতে করে পুতিনের যুদ্ধ যন্ত্রের পেছনের আর্থিক শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায়। আর দ্বিতীয়টি হলো- পরম শত্রুর সাথে আলোচনার অনিবার্য বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া এবং ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়পক্ষকে নানান প্রণোদনার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐক্যমত্যের সমাধান করা।
প্রথম উপায়টিকে আদর্শ বলার উপায় নেই। অনেক জাতি তাদের জ্বালানি ও খাদ্য চাহিদার ওপর রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, পশ্চিমাদের কারণে রাতারাতি দেশটির সাথে সম্পর্কের ইতি টানার উপায় নেই তাদের। এমনকী খোদ জার্মানিও তা পারবে না। তাছাড়া, পরমাণু শক্তিধর একটি রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়ানোও অবিবেচকের মতো কাজ।
দ্বিতীয় উপায়টি- সঠিক প্রতিক্রিয়ার রাস্তা। এনিয়ে জোর চেষ্টা শান্তি ফেরাতে পারত। কিন্তু পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে তেমন চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। ফলে ইউক্রেন পশ্চিমাদের থেকে রাশিয়াকে রণাঙ্গনে আরও কঠিনভাবে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো অস্ত্র যেমন পাচ্ছে না; তেমনই পাচ্ছে না কূটনীতির মাধ্যমে শান্তি অর্জনের উৎসাহ ও সমর্থন।
তার পরিবর্তে আমরা দেখছি বিভ্রান্ত পশ্চিমাদের উন্মাদনার নাটক—তবে হাতেগোণা কয়েকজন রাজনীতিক ও সাংবাদিক পুতিনের বিরুদ্ধে শক্তি ও সম্পদ নিয়োজিত করে জয়ের যে দিবাস্বপ্ন দেখা হচ্ছে—সে বিভ্রান্তি অবসানের চেষ্টা করছেন।
পশ্চিমা দুনিয়া মুক্ত, গণতান্ত্রিক ও যুক্তিচালিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় চালিত- স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে এ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজের চার বছরের মেয়াদে তার গোড়ায় কুঠারাঘাত করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউরোপের কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিবিদরাও প্রকাশ্যে পুতিনের ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিরোধিতাকালে গড়ে ওঠা পশ্চিমা ভাবমুর্তিকে আরও ম্লান করে দিয়েছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে পশ্চিমা দুনিয়ার ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল- একইভাবে তা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছে রাশিয়ার নয়া-সাম্রাজ্যবাদ। ইউক্রেনে যুদ্ধ ও মৃত্যুর তাণ্ডব বয়ে যাওয়ার পরও 'পশ্চিমাদের স্নায়ুশক্ত রাখা উচিত' এমন আহ্বান- বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয় এড়াতে অতি-দরকারি আপোষের গুরুত্ব উপলদ্ধি শুরু হয়েছে এমন সন্দেহের উদ্রেক করে।
বলাবাহুল্য, ঐক্যবধ্য পশ্চিমা বিশ্বের পুরোনো ধ্যানধারণা তাদের ব্যাপক সামর্থ্য, প্রতিপত্তি ও স্নায়বিক শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত—যা বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় টেকসই নয়। কারণ পশ্চিমা দুনিয়ার ঐক্য এখন অভ্যন্তরীণ নানান বিষয়ে বিভাজিত ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। তাদের অসন্তুষ্ট জনগোষ্ঠী ভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক ভবিষ্যৎ গঠনের আদর্শমুখী হয়ে উঠছে।
একথা চরম সত্য যে, পশ্চিমা দুনিয়ার রাজনীতি ও গণমাধ্যমের অভিজাতরা—যাদের অধিকাংশ হলেন শ্বেতাঙ্গ ও পুরুষ—বিশ্বে পশ্চিমাদের রমরমা আধিপত্যকে দেখে এসেছেন তাদের তারুণ্যে। এর বাইরে গিয়ে তারা চিন্তাও করতে পারছেন না। কিন্তু, মনে রাখতে হবে তাদের তরুণ বয়সের অভিজ্ঞতার পর বিশ্বকে পাল্টে দেওয়ার মতো বহু ঘটনা ঘটেছে। উত্থান ঘটেছে চীনের- যে রাষ্ট্রটি পশ্চিমাদের হাতে কয়েক শতাব্দী ধরে লাঞ্চণার স্মৃতি ধারণ করছে। একইসাথে জ্বালানি উৎপাদক পরাশক্তি হিসেবে উদয় হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধে পরাজিত রাশিয়ার।
এই ধরনের বিদ্বেষী ও কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সঙ্গতকারণেই স্নায়ুযুদ্ধের গৌরবযুগের স্লোগান ও বিশ্বাসে ফিরতে চেয়েছে পশ্চিমারা। তাতে কিন্তু পৃথিবীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা হবে না। নানান স্বার্থের অমিলে বিভাজিত আজকের পশ্চিমা বিশ্ব এটি যত দ্রুত উপলদ্ধি করবে ততোই ভালো। সঠিক উপলদ্ধি থেকেই কেবল তারা বাকি বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় অপেক্ষাকৃত কম বিপজ্জনক নীতি নিতে পারবে।
লেখক: পঙ্কজ মিশ্র মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক। তার লেখা বহুল সমাদৃত গ্রন্থের মধ্যে- 'এজ অব অ্যাঙ্গার: এ হিস্টোরি অব প্রেজেন্ট,' 'ফ্রম দ্য রুইনস অব এম্পায়ার: দ্য ইন্টেকেলেকচুয়ালস হু রিমেড এশিয়া' এবং 'টেমটেশন্স অব দ্য ওয়েস্ট: হাউ টু বি মডার্ন ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, তিব্বত অ্যান্ড বিয়ন্ড' অন্যতম।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ