এক নান্দনিক আয়োজনের বিষণ্ণ ইতি
সংবাদপত্রের রিপোর্টার হিসেবে ২০০৭-২০০৯ সালের অমর একুশে বইমেলা কাভার করি। সেই স্মৃতিগুলো এখনও স্পষ্ট। উত্তরে শাহবাগ আর দক্ষিণে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত মানুষের লম্বা লাইন মেলায় প্রবেশের জন্য। কারণ তখন বইমেলার পুরো আয়োজনটি ছিলো বাংলা একাডেমির ভেতরে এবং প্রবেশপথ ছিলো একটি। রিপোর্টার হিসেবে অগ্রাধিকার বা বিশেষ সুবিধা নিয়ে লাইন ছাড়াই ঢুকে যেতাম। কিন্তু দেখতাম, বয়স্ক ও শিশুরা দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। মনে পড়ে, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এভাবে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'বুড়োদের কষ্ট দিও না।'
তখন থেকেই বইমেলার পরিসর বাড়ানোর দাবি উঠছিলো। বিশেষ করে একাডেমির উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলাটিকে নিয়ে যাওয়া যায় কি না—তা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। কিন্তু যেহেতু এই বইমেলাটি একেবারেই বাংলা একাডেমির নিজস্ব আয়োজন এবং অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে যেহেতু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেরও একটি সম্পর্ক আছে, সুতরাং বইমেলাকে বাংলা একাডেমির বাইরে নিয়ে গেলে সেটি সেই আবেগ ও অনুভূতি বা বইমেলার দর্শন বা চেতনাকে ক্ষুণ্ন করবে কি না—এমন প্রশ্নও উঠেছিলো।
বাংলা একাডেমির কাছেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠেও এই আয়োজনটি করা যায় কি না—এমন আলোচনাও ছিলো। যদিও এই আলোচনাটি বেশি দূর এগোয়নি বা হালে পানি পায়নি। তবে লেখক, পাঠক, প্রকাশক এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এটি উপলব্ধি করছিলেন যে, বাংলা একাডেমির ছোট্ট পরিসরে বইমেলার মতো এত বিশাল আয়োজনকে সীমাবদ্ধ করে রাখলে তাতে মানুষের কষ্টই শুরু বাড়বে। এরকম বাস্তব্তায় ধীরে ধীরে মেলাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তর করা হয় এবং শুধুমাত্র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, প্রেস ইনস্টিটিউট, নজরুল ইনস্টিটিউট, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ সরকারি-বেসরকারি এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের স্টলগুলো একাডেমির ভেতরে রেখে মূল মেলাটি নিয়ে যাওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল চত্বরে। গত কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে মেলার পরিধি বাড়লেও এবার, অর্থাৎ করোনাকালীন বইমেলাটি ছিলো অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে অনেক বেশি বিন্যস্ত, গোছানো, সুবিশাল এবং নান্দনিক।
বাংলা একাডেমিতে যখন পুরো বইমেলাটি ছিলো, তখন এখানের প্রতিদিনকার দুর্ভোগের নাম ছিলো ধুলা। ধুলার হাত থেকে বাঁচতে ছিটানো হতো পানি। ফলে তখন মানুষের পায়ে পায়ে ওই পানি ধুলা মিশে হয়ে যেতো কাদা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও প্রথম দিকে এই ধুলার সমস্যা ছিলো। কিন্তু এবার একেবারেই ব্যতিক্রম। উত্তরে স্বাধীনতা স্তম্ভ সংলগ্ন লেকের তিনদিক, অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণের পুরো এলাকাজুড়েই এবার বইয়ের স্টল ও প্যাভিলিয়ন স্থাপন করা হয়। এতে একদিকে যেমন প্রতিটি প্যাভিলিয়নের মাঝখানে যথেষ্ট ফাঁকা রাখা সম্ভব হয়, তেমনি মানুষের চলাচলের জন্যও বিস্তীর্ণ জায়গা থাকে। সবুজ ঘাসের কারণে ধুলার বিড়ম্বনাও ছিল না। তাছাড়া পুরো লেকে এবার টলমলে পানি ও স্বচ্ছ পানির নিচে পাথরগুলো দৃশ্যমান এবং সেখানে নানা রঙের আলোর খেলায় পুরো বইমেলা চত্বরের যে নান্দনিক আবহ ফুটে উঠেছে, অতীতে কখনোই এমনটি চোখে পড়েনি। ২০০৭-০৮ সালের বইমেলার বিড়ম্বনার স্মৃতিগুলো যাদের মনে আছে, তারা এবারের মেলার সঙ্গে পার্থক্যটা খুব পরিস্কার বুঝতে পারবেন।
কিন্তু এতকিছুর পরও এবারের বইমেলাটি একহ্রাস হতাশার গল্পে ভরা। বলা যায় বইমেলা ২০২১ লেখক-পাঠক-প্রকাশক এবং বাংলা একাডেমির জন্যও একটি অপ্রাপ্তির নাম।
শুরু থেকেই সংশয়:
যেহেতু অমর একুশে গ্রন্থমেলা, অতএব এটি শুরু হতো প্রতি বছরের পয়লা ফেব্রুয়ারি এবং চলতো পুরো মাসজুড়ে। কিন্তু এবারই ব্যতিক্রম। এই আয়োজনটিই এবার হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিলো। কারণ করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠে মানুষ যখন ভাবছিলো যে সবকিছু নতুন করে শুরু করবে—তখনই দ্বিতীয় ঢেউ। এরকম বাস্তবতায় বাণিজ্যমেলাও স্থগিত করা হয়। বইমেলাও হবে কি না—তা নিয়ে দোটানা ছিলো খোদ সরকারের ভেতরেই। একবার কথা উঠলো যে, অনলাইনে মেলা হবে। কিন্তু বইমেলা অনলাইনে কী করে হবে, এর ফল কী হবে, খামাখা এই আয়োজনের কোনো মানে আছে কি না—এরকম প্রশ্নও তৈরি হয়। এই করে করে ফেব্রুয়ারি মাস ঘনিয়ে আসে। তখন সিদ্ধান্ত হলো, মেলা হবে মার্চ মাসে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা মার্চ মাসে হয় কী করে—এমন প্রশ্নও একাডেমিকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও করোনার বাস্তবতায় তাদের এরকম একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকেই এগিয়ে যেতে হয়েছে এবং সেই মোতাবেক ১৮ মার্চ মেলা শুরু হয়। বইমেলা চলার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। কিন্তু হঠাৎ করে করোনার প্রকোপ ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাওয়া এবং ১৪ এপ্রিল থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষিত হওয়ায় দুদিন আগে, অর্থাৎ ১২ এপ্রিল মেলার পর্দা নামানো হয়।
বিক্রি মাত্র তিন কোটি টাকা!
মেলার শেষদিন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি জানায়, এবার ৪১৩টি স্টল এবং ৩০টি প্যাভিলিয়নে ২৫ দিনে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ১১ লাখ ৯ হাজার ৯২৮ টাকার বই। অথচ, মেলায় সব প্রকাশনীর লগ্নি করা অর্থের পরিমাণ ৯০ কোটি টাকা। তার মানে প্রায় ৮৬ কোটি টাকা ক্ষতি। অতীতে যেখানে প্রায় একশো কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে, সেখানে মাত্র তিন কোটি টাকার বই বিক্রি খুবই অস্বাভাবিক ও হতাশাব্যঞ্জক। যেহেতু এবার মেলাটি হয়েছে একটি অস্বাভাবিক সময়ে।
এমতাবস্থায় প্রকাশকরা স্টল ভাড়া, স্টল ডেকোরেশন, কর্মচারীদের বেতন, দৈনন্দিন দোকান খরচসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছেন। সেইসাথে ক্ষতিগ্রস্ত ৪১৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ কোটি টাকার বই কেনারও দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে। সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতার জন্য সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ১ হাজার কোটি টাকার ঋণের ব্যবস্থা করা এবং রাষ্ট্র ও সরকারের অন্য যেসব প্রণোদনা বিভিন্ন শিল্প সেক্টরের জন্য রয়েছে, তা প্রকাশক ও বিক্রেতাদের দেয়ারও দাবি রয়েছে।
পাঠকের অপূর্ণতা:
মেলার সময়সূচির বারবার পরিবর্তনের কারণে এবার দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিলো খুবই কম। সবশেষ মেলার সময় নির্ধারণ করা হলো বেলা ১২টা থেকে বিকাল ৫টা, অর্থাৎ কর্মজীবী মানুষের পক্ষে যে সময়টায় মেলায় যাওয়া ছিলো একেবারেই অসম্ভব। অফিস শেষ করে কেউ যদি মেলায় যেতে চাইতেন, তাও এই সময়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উপরন্তু করোনার কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, এটিও মেলায় দর্শক ও পাঠকের সংখ্যা কমিয়েছে। কারণ, অমর একুশে গ্রন্থমেলাটি মূলত জমজমাট থাকে মেলা প্রাঙ্গণ সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পদচারণায়। বইয়ের ক্রেতাদেরও একটি বড় অংশ রাজধানীর ভেতরে অবস্থিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ ছুটির কারণে আবাসিক শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ঢাকার বাইরে, অর্থাৎ নিজেদের বাড়িতে অবস্থান করছেন। অতীতে দেখা গেছে, সারা দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ ঢাকায় আসতেন শুধু অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বই কেনার জন্য। অনেকে নিছক ভালোবাসার তাগিদেও আসতেন। এবার সেই মানুষদের বিপুল অংশই আসতে পারেননি। এটি দর্শক হিসেবে তাদের জন্যও একটি বিশাল অপূর্ণতা।
লেখকের অপূর্ণতা:
বইমেলাকে বলা হয় প্রাণের মেলা। কারণ এই আয়োজনটি লেখক-পাঠক-প্রকাশদের যে মিলন মেলায় পরিণত হয়, সেখানে বিপুল প্রাণের সঞ্চার হয়। নতুন ভাবনা ও যোগাযোগের দ্বার উন্মোচিত হয়। পারস্পরিক সম্পর্কগুলো মজবুত হয়। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচিত হয়। কিন্তু কম মানুষের উপস্থিতির কারণে স্বভাবতই এবারের মেলায় সেই প্রাণের সঞ্চার হয়নি। অর্থাৎ বইমেলা যে প্রাণের মেলা, সেই প্রাণটুকুরই যথেষ্ট অভাববোধ হয়েছে। লেখকদের জন্যও এটি বড় অতৃপ্তি যে, যেহেতু বিপুল সংখ্যক পাঠক আসতে পারেননি, ফলে তাদের সঙ্গে যোগসূত্রতা কম হয়েছে। যে লেখকরা অতীতে পাঁচশো অটোগ্রাফ দিয়েছেন, এবার তিনি হয়তো একশো অটোগ্রাফও দেননি।
আগামী বছর কি এই ক্ষতি পোষানো যাবে?
করোনার অতিমারি কবে কেটে যাবে, তা এখনই বলা মুশকিল। তবে এই প্রত্যাশা করাই সঙ্গত যে, আগামী বছরের অমর একুশে গ্রন্থমেলা এ বছরের ন্যায় অস্বাভাবিক সময়ে বা একটা অস্থির অবস্থার ভেতরে আয়োজিত হবে না। বরং ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই মেলাটি শুরু হবে এবং মাস্ক ছাড়াই করোনাপূর্ব পৃথিবীর আমেজে সবাই মেলায় আসবেন। কিন্তু এ বছর প্রকাশকরা যে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়লেন, সেই ক্ষতি কি তারা পুষিয়ে নিতে পারবেন?
অস্বীকার করার উপায় নেই, বইও একটি পণ্য। কিন্তু আলু-পটলের বা চাল-ডালের ব্যবসার সঙ্গে এর মৌলিক তফাৎ হলো, চাল-ডাল মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করে। এর সঙ্গে মেধা ও মননের, রুচি ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নেই। কিন্তু বই একটি পণ্য হলেও এর উদ্দেশ্য ভিন্ন। যারা বইয়ের ব্যবসা করেন, ধরেই নেয়া হয় যে তারা সমাজের অগ্রসর ও চিন্তাশীল অংশের মানুষ। বই প্রকাশ নিয়ে নানারকম অসুস্থ প্রতিযোগিতা বা অনৈতিক ব্যবসার খবর জানা গেলেও সামগ্রিক বিবেচনায় বই জাতিকে মেধাবী ও মননশীল করার কাজে বড় ভূমিকা রাখে। ডিজিটাল অগ্রগতির কারণে বইয়ের বিক্রি কমে গেছে নাকি নিত্য নতুন অনলাইন প্লাটফর্মের সুবাদে বইয়ের বিক্রি বেড়েছে—সেই তর্ক দূরে রেখেও বলা যায়, যেহেতু বই জাতিকে আলোকিত করে, সুতরাং সেই আলোর ফেরিওয়ালাদের ক্ষতি পোষানোর জন্য রাষ্ট্রের উচিত সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে তাদের ক্ষতি পোষানোর ব্যবস্থা করা। যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলে, সেই দেশে বই ব্যবসায়ীদের জন্য একশো কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া নিশ্চয়ই বড় কোনো দাবি নয়। সেইসাথে একটি ঘোষণা এখনই দেয়া যেতে পারে যে, এ বছর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আগামী বছরের মেলায় তাদের স্টল ভাড়া দিতে হবে না এবং সরকার সারা দেশের গণগ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য যে বিপুল পরিমাণ বই কেনে, সেই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ও দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে নিরপক্ষেভাবে মননশীল বইগুলো কিনে নেবে—এটিও সকলের প্রত্যাশা।