এটা একটা প্রেমের গল্প হতে পারতো
দিবার সাথে প্রথম দেখা হবার দিন পর পর এত সব কান্ড ঘটে গেলো যে শুরুতে ওর সাথে কী কথা হয়েছিলো তা আর মনেই করতে পারে না রোমেল। আগের দিন ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েশন সিরিমনি ছিল। সবাই মিলে ক্যাম্পাসে সেজেগুজে অনেক ছবি টবি তুলেছিলো, মজা করেছিলো, এক সাথে খেয়েছিলো।
এর পর কবে কোথায় দেখা হবে, কে কোথায় হারিয়ে যাবে তা নিয়ে আফসোসও করেছিলো সবাই। তারপর ঠিক হয়েছিল যে পরদিন রাতে রুশোর বাড়িতে ফেয়ারওয়েল পার্টি হবে। রুশোর বাবা মা দেশের বাইরে গেছেন, বাসা প্রায় খালি, তাই জম্পেশ এক আড্ডা দেয়া যাবে রাত ভর। খাবার কিছু অর্ডার দেয়া হবে,আর যে যা পারে কিছু নিয়ে আসবে।
রোমেলের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ড্রিংকস এর। বিকেল বেলাতেই রোমেল গাড়ির পেছনের সিটে একটা ভদকা, একটা বোম্বে স্যাফায়ার আর একটা রেড ওয়াইনের বোতল খবরের কাগজে মুড়ে রেখে দিয়েছিল। দিবাও এসেছিলো ওই পার্টিতে, যদিও সে তাদের ক্লাসমেট নয়, দিবা এসেছিল আমিনের সাথে।পার্টিতে বন্ধু বা সঙ্গী নিয়ে আসার অনুমতি ছিলো। সেজন্যই আমিন তার নতুন বান্ধবী একই ভার্সিটির দুই বছরের জুনিয়র দিবাকে নিয়ে এসেছিলো সাথে। কিন্তু আমিন জানতো না যে রুশোর বাসায় ওর প্রাক্তন প্রেমিকা রিমলিও থাকবে। রিমলিকে দেখে আমিন একটু ভড়কে গিয়েছিল প্রথমে।
তারপর ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠছিল রিমলির সাথে। রিমলির সম্প্রতি ডিভোর্স হয়ে গেছে জানার পর থেকে আরেকটু সপ্রতিভ দেখাচ্ছিলো তাকে। ওরা সবাই যখন ড্রইংরুমে আড্ডায় হাসিতে মশগুল, তখন রিমলি আর আমিনকে দেখা গেল রুশোর বেডরুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলেছে। ব্যস, তারপরই শুরু হয়ে গেল বিশ্রি গন্ডগোল। দিবা বেশ খানিকটা মাতাল হয়ে গিয়েছিলো ততক্ষণে। যা মুখে আসে তাই বলে গালাগাল করতে শুরু করেছিল আমিনকে।
আমিনও কম যায় না। বাজে কথার তুবড়ি ছুটে ছিলো ওর মুখেও। বন্ধুরা থামাতে চেষ্টা করছিলো দুজনকে কিন্তু কেউ থামতে রাজি না। অবস্থা বেগতিক দেখে বিরক্ত হয়ে মেয়েরা যার যার বন্ধু নিয়ে পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। দিবা চিৎকার করে বলছিল-ইউ সান অফ আ বিচ। পুরান প্রেম উথলায়ে উঠছে তোমার? শরীর গরম হয়ে গেছে? অ্যান্ড দ্যাট আগলি উইমেন-
আমিনও হিংস্র হয়ে উঠছিল-ইউ শাট আপ। হোর কোথাকার! তোর মা একটা হোর, তুই ও!
অমনি দিবা ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল আমিনের গালে। আমিনও ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো যদি না রুশো আর রোমেল মিলে তাকে ধরে না রাখতো। তো বিচ্ছিরি এই ঝগড়ার শেষে আমিন মাতাল হয়ে ড্রইংরুমের সোফায় শুয়ে পড়লো। আর দিবা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। রুশো টেবিল সাফ করতে করতে বললো-দোস্ত, তুই ওরে বাসায় দিয়া আয়। হোয়াট আ নুইসেন্স। আশপাশের মানুষ শুনছে সব। ছিঃ।
-আমি? আমি কেন?-রোমেল আঁতকে উঠেছিল।
-তো আর কে? মেয়েগুলা তো সব চম্পট দিলো। এখন এই মেয়েকে এত রাতে কি করবো? আমিন শালাটা আজকে এইখানে থাকুক। ধুর, পার্টিটাই মাটি করে দিলো এই দুইজন।
তো রোমেলের গাড়িতে উঠেও দিবা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতেই থাকলো। ভীষন বিরক্ত লাগছিলো রোমেলের।সে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো-ঠিকানা বলো। কোনদিকে যাবো?
-টু দ্য হেল।–ঘাড় পর্যন্ত চুল ঝাকিয়েঁ রাগী গলায় উত্তর দিলো দিবা।
-ফালতু কথা শোনার টাইম নাই। রাত প্রায় একটা বাজে। -বিরক্ত হয়ে বললো রোমেল। শুনে দিবা আবার কাঁদতে শুরু করলো।–দ্যাট স্কাউন্ড্রেল। আমার মাকে নিয়ে বাজে কথা বলে। তুই নিজে কি? তোর বাপ কি? ওর বাপ যে অফিসের মেয়েদেরকে নিয়ে দুই দিন পর পর ব্যাংকক যায় তখন কি?
রোমেল ধমকে উঠলো-এসব কথা বলার মানে কি এত রাতে? বলো কোনদিকে যাবে, তোমাকে নামিয়ে তারপর আমি বাড়ি যাবো। অনেক রাত হইছে।
দিবা চোখ মুছে শান্ত কন্ঠে বললো-বারিধারা ডিওএইচএস।
ইস্কাটন থেকে বেরিয়ে হলুদ আলো জ্বলা নির্জন রাস্তায় নেমে রোমেলের একটু মায়া লাগতে শুরু করেছিলো এরপর। আমিনটা সত্যি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এই ভাবে বলতে হয়? বাংলামটর পেরিয়ে রাস্তা আবার জমজমাট। কারওয়ানবাজারের সামনে বড় বড় ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে এত রাতে। ফুটপাতে শুয়ে আছে ভাসমান মানুষ। এত হই হট্টগোল আওয়াজেও তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। জোরে বাতাস বইছে এই চৈত্রের রাতে। ছেঁড়া কাগজ, পলিথিন, শুকনো পাতা গোল হয়ে উড়ছে রাস্তার ওপর। সোনারগাঁও হোটেলের পাশে সারি বাঁধা নারকেল গাছগুলো দুলছে মাথা নেড়ে নেড়ে।মোড়টা ঘোরার পর দিবা গাড়ির জানালা খুলে বমি করতে শুরু করলো। রোমেল সেদিকে তাকিয়ে বললো-খারাপ লাগছে বেশি? পানি খাবা?
দিবা মাথা নেড়ে না বললো। গাড়ির কাঁচ তুলে সিটে মাথা হেলিয়ে দিলো ক্লান্ত ভঙ্গিতে। চোখ বন্ধ করে আছে এখন। রোমেল বললো-দাঁড়াও হাতির ঝিলে গিয়ে গাড়ি থামাচ্ছি। একটু বাতাসে দাঁড়াও। ভালো লাগবে।
একটু আগে মনে হয় শহরে বৃষ্টি নেমেছিলো, রাস্তা ভেজা। কালচে ছাই রঙের।রাস্তার দুপাশে জমেছে নোংরা পানি। হাতির ঝিলের ব্রিজগুলোর রঙিন আলো এখনও নিভে যায় নি। খাবার দোকানগুলোও কোন কোনটা খোলা। অন্ধকারে এখানে ওখানে মানুষের কালো মাথা দেখা যায়। ভবঘুরে মানুষ আর টোকাই শিশুরা শুয়ে আছে ঘাসের ওপর। কয়েকজন সাজ গোজ করা মেয়ে লাইটপোস্টের নিচে দাড়িয়েঁ আছে। তাদেরকে পেরিয়ে একটা নির্জন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে রোমেল নামলো। ঝিল থেকে ঠান্ডা ঝিরঝিরে বাতাস বইছে এখন। বৃষ্টি ভেজা সোঁদা গন্ধ চারদিকে। আকাশে মেঘ, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। আবছা একটা অন্ধকার তারাহীন আকাশ মাথার ওপর। গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে একটা সিগ্রেট ধরালো রোমেল। দিবাও চাইলো একটা। সিগ্রেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললো-ধুর, কিছু নাই এতে? পানসে।
তারপর আবার নিজের মনেই বললো-আমার মা এক সময় নায়িকা ছিলো জানেন?
-তাই? কি নাম ওনার?-আগ্রহী হলো রোমেল শুনে।
-আসল নাম আতিয়া। সিনেমার নাম অন্য। মা খুব সুন্দরী ছিল। এখনও আছে। মাকে দেখে এখনও অনেকে টাসকি খায়।–বলে হা হা করে হাসতে শুরু করলো দিবা। রোমেল বললো-একদিন দেখতে যাবো তোমার মাকে। পরিচয় করায়ে দিও। আমি কখনো স্বচক্ষে নায়িকা দেখি নাই।
দিবা হাসতে থাকলো-দিবো। বাট ডোন্ট ফল ফর হার। জানেন, মানুষ মাকে দেখলে আর আমার দিকে ফিরেও তাকায় না!এখনও মার অনেক ভক্ত। বাট শি ইজ নট আ হোর। শি ক্যান ম্যানেজ বয়েজ। -বলে দিবা হঠাৎ এগিয়ে যেতে থাকলো ব্রিজের দিকে। চেঁচিয়ে বললো-হোয়াট ইফ আই জাম্প ফ্রম হিয়ার? দেখেন পানিটা কি সুন্দর! কেমন লাইট পড়ে ঝিকমিক করছে পানিতে। লাল নীল হলুদ। দেখেই মনে হয় লাফ দেই।
রোমেল পেছন থেকে ডাকলো-দিবা সিন ক্রিয়েট করো না। চলো ফিরে যাই। অনেক রাত হইছে।
দিবা হাত ওপরে তুলে হা হা করে হাসতে থাকলো-ঝাঁপ দিবো? দেই? আপনিও আসবেন? আপনার জীবনের ওপর কি কোন রাগ নাই? সো কুল ইউ আর! স্ট্রেন্জ!
রোমেল এবার বিরক্ত হয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো ওর দিকে। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেলো তো! আর ঠিক তখনই ওর চোখে পড়লো ওপাশ থেকে এগিয়ে আসছে দুজন পুলিশ। দিবা মাঝখানে, রোমেলের থেকে কয়েক হাত দূরে, ব্রিজ থেকে মাথা বের করে ঝুকেঁ পড়ে হি হি করে হাসছে আর দুদিকে হাত প্রসারিত করে দুলছে।পুলিশ দুজন হু্ইসেল বাজালো জোরে।–অ্যাই। অ্যাই। কি হচ্ছে? দেখি, মুখ তোলেন।
দিবা মুখ তুললে পুলিশগুলো তার মুখে টর্চ এর আলো ফেললো। তীব্র আলোয় চোখ কুঁচকে তাকালো দিবা। বিরক্ত হয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ঢাকলো। ততক্ষণে রোমেল পৌছেঁ গেছে। দিবার হাত ধরে টানতে শুরু করলো সে-চলো। চলো। যাই।
পুলিশ হুংকার ছাড়লো এবার-কই যাবেন? এই সব কি হইতেছে? এত রাতে এইখানে কি করতেছেন?
রোমেল নার্ভাস গলায় বললো-না মানে আমরা বাসায় যাচ্ছি। ওর একটু খারাপ লাগছিলো, তাই গাড়ি থামিয়ে বাতাস খাচ্ছিলাম।
একজন চোখ সরু করে বললো-খারাপ লাগবে ক্যান? ড্রাগ নিছে? অ্যাই গাড়িটা চেক কর।
অন্য পুলিশটা গাড়ির ভেতর আলো ফেলে খোঁজাখুজিঁ করে পেছনের সিট থেকে বের করে আনলো একটা ভদকার বোতল। এবার প্রথম জন ধমক দিয়ে বললো-আর কি আছে? ইয়াবা টাবা আছে? গান্জা? ঠিক কইরা কন।
-আর কিচ্ছু নাই। আমাদের যেতে দেন। প্লিজ।–রোমেল আর কিছু বলার আগে পুলিশ দুজন তাদের ঠেলতে শুরু করলো। -ভ্যানে ওঠ। থানায় চল। তারপর দেখা যাবে। এই বলে ওদের দুজনকে ঠেলে ধাক্কা দিয়ে নীল ভ্যানে ওঠালো তারা। রোমেলের মাথা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছিলো। এই একটু আগে সে শিস বাজাতে বাজাতে যাচ্ছিলো রুশোর বাসায় আড্ডা দিতে, নতুন কেনা এডিডাসের স্পোর্টস শু পরেছিলো শখ করে। কতদিন পর বন্ধুদের সাথে এমন আড্ডা হবে ভেবে মন আকুল হয়েছিলো তার। বৃটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন হয়ে গেছে ওর, ভিসার কাজ শেষ, সামনের মাসে টিকিট বুকিং দেয়া হয়ে গেছে, এখন খালি গোছগাছ করা বাকি। অথচ এখন এই এত রাতে এই অপরিচিত আধ পাগলা মেয়েটার সাথে সে পুলিশ ভ্যানে করে থানায় যাচ্ছে? এই সব কি সত্যি? নাকি কোন ফ্যান্টাসি গল্প?
থানায় কী কী ঘটেছিলো তাও এখন আর ভালো করে মনে করতে পারে না রোমেল। তবে অবশেষে রাত প্রায় তিনটায় গুলশান থানায় এসে ঢুকেছিলেন রোমেলের মা। তাকেঁ দেখে থানার ইনচার্জ উঠে দাড়িয়েঁছিলেন-স্লামালেকুম ম্যাডাম।
রোমেলের মা গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন-কোথায় সাইন করতে হবে?
ইনচার্জ তড়িঘড়ি করে বলেছিলো-লাগবে না ম্যাডাম। কেইসটা আমরা নেই নাই। উনি যদি আগে বলতেন-
রোমেলের মা, যিনি একজন সংসদ সদস্য ও একটি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, অচিরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে সরকারের উর্দ্ধতন মহলে কানা ঘুষা চলছে তাকে নিয়ে, যদিও এসব ব্যাপারে শেষ কথা কখনোই বলা যায় না, কে যে কোন ফাকেঁ ল্যাং মেরে বসে কেউ জানে না, তিনি অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন-প্রেস কিছু জানে?
-না ম্যাডাম। ওনারা হাতির ঝিলে এত রাতে ঘোরাঘুরি করছিলেন, আমাদের টহল পুলিশ তখন-
-ঠিক আছে। এগুলা তো আপনাদের রেগুলার জব। থ্যাংক ইউ।–মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর কিছু জানার তাঁর আগ্রহ নেই। দিবার মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল ভয়ে আর আতংকে। এতক্ষণ এই লোকগুলো এত জঘন্য আর অশ্লীল ভাষায় ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলো, নানা রকম ভয় দেখাচ্ছিলো, হুমকি দিচ্ছিলো, অথচ উনি আসতেই সবার চেহারা আর কথা বলার ভঙ্গি কেমন পালটে গেলো! কী আশ্চর্য! রোমেল আর তার মার সাথে দিবাও নীরবে উঠে দাঁড়ালো। নিজের পাজেরোর কাছাকাছি এসে রোমেলের মা ড্রাইভারকে বললেন-তুমি মেয়েটাকে ওর বাসায় পৌছেঁ দাও। বাসার ভেতর পর্যন্ত দিয়ে আসবে-বলে পিএ র দিকে তাকালেন তিনি-তুমিও যাও ওর সাথে শওকত। আমরা রোমেলের গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।
ফেরার পথে একটি কথাও বললেন না রোমেলের মা। রোমেলও না। সেদিন বাড়ি ফেরার একটু পর ভোর হয়ে গিয়েছিলো। তাদের বনানীর বাসার পেছনেই লেক, সেই লেকের পাড়ে গাছগুলোতে কিচির মিচির করছিলো অনেক পাখি। আশ্চর্য, কোনদিন ভোরে এত পাখির ডাক শুনতে পায় না রোমেল। লেকের ওপারে টকটকে লাল সূর্য ওঠা দেখে সেই প্রথম মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো সে। মা গোসল করে ফজরের নামাজ পড়ে একটা জরুরি মিটিং এর জন্য তৈরি হতে শুরু করলেন। সাত সকাল থেকেই তাঁর ফোন অবিরত বাজতে শুরু করেছে। মা এর ওর কথার জবাব দিচ্ছেন, কাউকে নির্দেশ দিচ্ছেন, কখনো সাক্ষাতকার দিচ্ছেন। রোমেল নিজের ঘরে ঢুকে জামা কাপড় না পালটেই বিছানায় পড়ে একটা ঘুম দিলো। একেবারে দুপুর একটা পর্যন্ত মরার মতো ঘুমালো সে। তারপর ঘুম থেকে উঠে ভাবতে লাগলো সে কি স্বপ্ন দেখছিলো কাল রাতে? এরকম অদ্ভুত একটা রাত কি সত্যি তার জীবনে এসেছিলো?
তিন দিন পর রুশোর কাছে দিবার ফোন নাম্বার চাইলে রুশো খেপে উঠেছিলো-ওই অসভ্য মেয়েটার নাম্বার দিয়ে কি করবি? কী ডিজাস্টারটা করলো সেই দিন। একদম বেইজ্জতি!
-সে একা কেন, আমিনও এর জন্য দায়ী।–রোমেল মনে করিয়ে দিলো। রুশো হাত তুলে উড়িয়ে দিলো ওর কথা-বাদ দে দোস্ত। তোর এখন এসব দিয়ে কি হবে? এত ভালো একটা জায়গায় যাচ্ছিস। থিংক অ্যাবাউট ইউরসেলফ।
রোমেল গম্ভীর গলায় বললো-আয়াম থিংকিং অ্যাবাউট মাইসেলফ! দ্যাটস হোয়াই আই নিড হার।
দিবাকে খুজেঁ বের করতে সমস্যা হয় নি রোমেলের। এই ডিজিটাল যুগে এটা কোন ব্যাপার না। একই বিশ্ববিদ্যারয়ের ছাত্রী। বেশ কয়েকজন মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে ফেসবুকে। তাছাড়া তাদের ইউনিভার্সিটির কয়েকটা গ্রুপও আছে। সহজেই পাওয়া গেলো ওকে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার পর দিবা ছোট্ট করে ইনবক্স করেছিলো-সরি ফর এভরিথিং অ্যাট দ্যাট নাইট।
রোমেল জবাবে লিখেছিলো-ক্যান উই মিট?
-হোয়াট ফর?
-তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করানোর কথা ছিলো।
-ইউ ডোন্ট নিড টু। শি হ্যাজ আ বাঞ্চ অফ অ্যাডমায়ারারস।
-আই নিড টু অ্যাডমায়ার সামওয়ান ব্যাডলি।
রোমেল কখনো নিজেকে নিয়ে কিছু ভাবে নি। সে কেবল এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলো। একবার, একবার শুধু যদি সে বেরিয়ে পড়তে পারে, তবে এই বিশাল অজানা পৃথিবীতে সে হারিয়ে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছিলো। একজন ভবঘুরে পথিকের মতো। একজন জিপসি যুবকের মতো। একজন নৌকায় ভাসতে থাকা অভিবাসীর মতো জীবনটা কাটিয়ে দেবে ভেবেছিলো। জীবন নিয়ে এর চেয়ে বেশি আর কোন ভাবনা সে ভাবে নি। কিন্তু ওই যে ব্রিজের রেলিং ধরে মেয়েটা সেদিন খল খল করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো-জীবন নিয়ে তার কোন রাগ আছে কিনা! কী মুশকিল! কে কবে ওর কাছে এই সব জানতে চেয়েছে?
একদিন নাশতার টেবিলে মা গম্ভীর গলায় বলেন-তোমার ফ্লাইট কবে?
-কনফার্ম করি নি-উদাস গলায় বলে রোমেল।
-চেক রেখে যাচ্ছি। শওকতকে বলো, কনফার্ম করে ফেলবে।
-দেখি। -রোমেলের কন্ঠ নিরুত্তাপ।
মা ওর চোখের দিকে তাকালেন-ওই মেয়েটার সাথে দেখা হয়?
-কোন মেয়েটা?
-দিবা। শাহনাজ রুবাইয়াতের মেয়ে।
-তুমি চেনো ওর মাকে? ওনার নাম তো আতিয়া।
মা রুটিতে সানফ্লাওয়ার মার্জারিন লাগাতে লাগাতে বলেন-আমরা তো শাহনাজ নামে চিনতাম। সিনেমা দেখেছি ওর। খুব সুন্দরী ছিলো। রাজ্জাকের সাথেও একটা সিনেমা করেছে।
কিছু না বলে মুখ নিচু করে খেতে থাকে রোমেল।
মা বলেন-মেয়েটা মনে হয় মানসিক ভাবে অসুস্থ। অফিসার বলছিলো মেয়েটা সেদিন লেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করছিলো।
-সিরিয়াসলি করে নি মনে হয়। মজা করছিলো।
-এটা মজার বিষয় না।-মা সোজা হয়ে বসলেন-আমি মনে করি বন্ধু হিসেবে তোমার উচিত ওকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো। তুমি যদি বলো আমি ডাক্তার আজিমকে বলে দিতে পারি।
দিবাকে নিয়ে মায়ের এই কনসার্নে একটু আশ্চর্য হয়েছিলো রোমেল। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, দিবাকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেলো। তার যে মানসিক সমস্যা আছে সেটা মেনে নিতে একটুও দ্বিধা করলো না সে। আজিম আংকেল এক ঘন্টা কথা বলার পর তার প্রেসক্রিপশনের ওপর লিখলেন-মেজর ডিপ্রেশন। সুইসাইডাল এটেম্পট। হিস্ট্রি অফ ড্রাগ এবিউজ। ক্যানাবিস স্মোকার। তারপর খস খস করে কিছু ওষুধ লিখলেন। তার নিচে লিখলেন-অ্যাডভাইস অ্যাডমিশন। অবিশ্বাস্য ও আশাতীত ব্যাপার, রোমেলের মা, যিনি রোমেলের খবরও নেবার সময় পেতেন না, তিনি এত ব্যস্ততার মধ্যেও দিবার খোঁজ খবর নিলেন। সংসদে অধিবেশন চলছিলো বলে সেরাতে দেরি করে ফিরেছিলেন, কিন্তু ফিরেই সোজা রোমেলের ঘরে এলেন-ডাক্তার কি বললো?
রোমেল জানালো বিস্তারিত। মা চিন্তিত মুখে বললেন-ভর্তি করাই বোধ হয় ভালো হবে। বাড়িতে কি আর ও ওষুধগুলো ঠিক ঠাক খাবে? যদি আবার ড্রাগস নেয়?
রোমেলেরও ভরসা নেই দিবার ওপর। মেয়েটার মাথায় তো ছিট আছে। মা বললেন-আজিমের ক্লিনিকে ভর্তি করে দাও। কিছুদিন থাকুক। অ্যান্ড ইফ শি গেটস ওয়েল সুন-
মা কথা শেষ করলেন না। রোমেল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মার দিকে। মা কি মিন করছেন? কিন্তু মা কথাটা শেষ না করেই বেরিয়ে গেলেন।
দিবা আজিম আংকেলের ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে গেলো। অভিজাত রিহ্যাব ক্লিনিক। ঝকঝকে ফ্লোর। ফিটফাট নার্স।সেন্ট্রাল এসি। কিন্তু ওখানে দেখা সাক্ষাতে খুব কড়াকড়ি। যে কদিন ভিজিটিং আওয়ারে গেছে রোমেল, দিবা ঘুমিয়েই ছিল। ওষুধের প্রভাব, আজিম আংকেল বলেছেন। রোমেলের যাবার সময়ও ঘনিয়ে এলো।একটা সেমিস্টার পিছিয়ে দিলে কি হয়? তেমন কিছুই আসে যায় না। আসলে তো পড়াশোনা নিয়ে তার কোন উচ্চাশা নেই। রোমেলের মধ্যে আবার সেই গা ছাড়া ভাব এসে গেছিলো। তারপরই এলো সেই খবর। ক্লিনিকের তিন তলার ছাদ থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়েছে দিবা। নিচে ছিলো ইটের গাদা, রড আর লোহা লক্কর। তাতে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে গুরুতর। ঢাকা মেডিকেলের নিউরোসার্জারিতে নিয়ে যাবার পর ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করেছেন ওকে। মেজর ডিপ্রেশনের রোগীদের পক্ষে অসম্ভব নয় এমনটা ঘটানো। আর সে তো আগেও সুইসাইডাল এটেম্পট নিয়েছিলো। যারা একবার আত্নহত্যা করতে চেষ্টা করে তাদের মধ্যে বার বার সেই প্রবণতা জাগে। এতে অবাক হবার কিছু নেই।শাহনাজ রুবাইয়াত তাই পোস্ট মর্টেম না করেই মেয়ের লাশ নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করেন। কী হবে মৃত্যুর কারণ জেনে? মৃত্যু একটা নি:শব্দ সাদা বেড়ালের মতো, নিত্য পায়ে পায়ে ঘোরে আমাদের। তার আসার জন্য কোন নির্দিষ্ট কারণ লাগে না। একটা সাদা লখনৌ চিকেনের সালোয়ার কামিজ গায়ে আর সাদা জর্জেট ওড়নায় মাথা ঢাকা প্রসাধনহীন শাহনাজকে লাগছিলো দেবীর মতো। কালো চশমায় চোখ ঢাকা। টকটকে ফর্সা মুখ। পারফিউমের সুগন্ধ সারা শরিরে। মুখ কঠিন আর নির্বিকার। ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে দিবার কফিনটা এম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে তিনি রোমেলের দিকে ফিরলেন। জিজ্ঞেস করলেন-তুমি কবে যাচ্ছ আমেরিকায়?
রোমেল শুন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। শাহনাজ একটু হাসলেন। তারপর কালো সানগ্লাস খুলে একটা রুমাল দিয়ে চোখের কোণ মুছে বললেন-এখন আর কোন বাধা নেই। গো মেক ইওর লাইফ, মাই চাইল্ড।
রোমেল সারা দিন এদিক ওদিক ঘুরলো, রাস্তায় অকারণ হাঁটলো, কফি শপে বসে একা একা কফি খেলো, বই এর দোকানে গিয়ে শুধু শুধু বই দেখলো, তারপর অবশেষে ঘরেই ফিরে এলো। ঘরে ফিরে দেখলো মা আজ সব মিটিং ক্যানসেল করে বাড়িতেই বসে আছেন। টেলিভিশনে তাঁর মন্ত্রীত্ব প্রাপ্তির কনফার্ম খবর স্ক্রলে দেখাচ্ছে। অভিনন্দন জানিয়ে ফুলের তোড়া আসতে শুরু করেছে বাড়িতে। ফোন বাজছে ঘন ঘন। শওকত নিচতলায় সব ফুল আর উপহার রিসিভ করছে। রোমেলকে দেখে শওকত বললো-ভাইয়া আপনার টিকেট কনফার্ম করা হয়ে গেছে। আগামি রবিবার রাতে। কাতার ওয়ারওয়েজ।
রোমেল উঠে এলো ওপরে। ড্রইংরুমের এক কোণে টার্কিশ স্ট্যান্ড ল্যাম্প থেকে রহস্যময় তেরছা হলদেটে আলো ছড়িয়ে পড়ছিলো সারা ঘরে। এসির ঠান্ডা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিলো টেবিলের ওপর ফ্লাওয়ার ভাসে রাখা থাই লোটাসের সুন্দর সুবাস। মা টিভি ছেড়ে বসে ছিলেন সাদা সোফায়। আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী, তৃপ্ত আর কনফিডেন্ট লাগছিলো মাকে। শাহনাজ রুবাইয়াতের শূন্যপরাজিত চেহারাটা মনে পড়লো রোমেলের। মার দিকে তাকিয়ে রোমেল একটু হেসে বললো-কনগ্রাচুলেশনস মা। ইউ ডিড ইট।