এত পানি পৃথিবীতে কোথা থেকে এল?
পৃথিবী নামক গ্রহে আমাদের বাস। এই গ্রহের পৃষ্ঠের ৭০ শতাংশই ঢেকে আছে পানিতে। এই সৌরজগতে আমাদের গ্রহটির অবস্থান সূর্য থেকে, যাকে বলে, একদম নিখুঁত দূরত্বে। ঠিক যেমন দূরত্বে অবস্থান করার কারণে বর্তমান অবস্থায় থাকতে পারে তরল পানি।
এর চেয়ে যদি আমরা একটুও দূরে অবস্থান করতাম, তাহলে জমে বরফ হয়ে যেত পৃথিবীর পানি। আবার যদি সূর্যের আরও খানিকটা কাছে থাকতাম, তাহলে তাপমাত্রা এত বেশি হয়ে যেত যে আমরা পড়তাম অনিয়ন্ত্রিত গ্রিনহাউস ইফেক্টের কবলে, যেমনটি হচ্ছে শুক্র গ্রহের উত্তপ্ত পৃষ্ঠে।
কিন্তু তথাকথিত 'গোল্ডিলকস জোন'-এ এই যে আমাদের খুব বেশি শীতল নয়, খুব বেশি উষ্ণ নয় অবস্থান, এটিই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। কেননা, পানির অপর নামই তো জীবন!
আমাদের গ্রহের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো পানির উপস্থিতি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই পানির অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তাই স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে পৃথিবীর বুকে এল এই পানি?
পৃথিবীতে পানির আগমন কীভাবে ঘটেছে, সেই তথ্যের আলোকে এই গ্রহে কবে ও কীভাবে প্রাণের বিকাশ ঘটল, সেটিও জানা সহজ হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পৃথিবীতে পানির আগমনের ব্যাপারেই আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে কিছু জানি না। বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণার মাধ্যমে ব্যাপারটি বোঝার।
এই গ্রহ গঠনের যে চিত্রটি এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে পরিষ্কার, সেটির শুরু হয় একটি প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের মাধ্যমে। প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক হলো গ্যাস ও ধূলার একটি বিশাল চাকতি, যা নবগঠিত সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। চাকতিতে বিদ্যমান ধূলা ও বরফের যখন নিজেদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া ঘটে, তখন তাদের মিলিত পিণ্ডটি আকারে ক্রমে আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষমেশ তারা এমন একটি পিণ্ড গড়ে তোলে, যাকে আমরা বলি প্ল্যানেটেসিমাল। পাথুরে ও বিশালাকার গ্রহ তৈরি হয় এসব প্ল্যানেটেসিমাল থেকে।
কিন্তু আমাদের সৌরজগৎ গঠনের গোড়ার দিকে, আমাদের পৃথিবী এখন যেখানে অবস্থিত, সেখানে অনেক বেশি উত্তপ্ত ছিল। তাই যেসব ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ডিস্কটি গড়ে উঠেছে, সেখানে পানির অণুর উপস্থিতি থাকলেও অত গরম তাপমাত্রায় পানির পক্ষে ঘনীভূত হয়ে পানিতে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব ছিল না। বরং সেগুলো বাষ্পীভূত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক।
তা ছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, প্রাথমিক অবস্থায় পৃথিবীর আবহাওয়া তরল পানির ফোঁটার শূন্যে জমে থাকার অনুকূলও ছিল না।
তাই এবার আমাদের সামনে এক বিশাল প্রশ্নের উদয় হয়: পৃথিবী যে ডিস্কগুলো দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেগুলোর মাঝে যদি ইতিমধ্যেই সমুদ্রের পানির অস্তিত্ব না থেকে থাকে, তাহলে পরবর্তী সময়ে ওই পানি এল কোথা থেকে?
পৃথিবীর পানি যদি পৃথিবী গঠনের সময় একসঙ্গেই উদ্ভূত না হয়, তাহলে গ্রহবিজ্ঞানীদের অনেকের অদ্ভুত সন্দেহ, নির্ঘাত এই পানি পরবর্তী সময়ে কোনো ভিনগ্রহবাসী এসে দিয়ে গেছে!
পৃথিবীতে প্রায়ই গ্রহাণু ও ধূমকেতুর আগমন ঘটে এবং তারা তাদের অভ্যন্তরে বহন করে বরফ। বস্তুত, গ্রহাণু ও ধূমকেতুর কম্পোজিশন মডেল থেকে এ-ও জানা যায় যে তারা তাদের মাঝে যে পরিমাণ বরফ বহন করে, তা থেকে পৃথিবীর সমুদ্রগুলোর সমান পানি তৈরি হতে পারে।
কিন্তু এখানেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে? একদমই না। গ্রহাণু বা ধূমকেতুই কি তবে পৃথিবীতে পানি নিয়ে এসেছে? ঘটনাটি কি একবারই ঘটেছে, নাকি অনেকবার? এবং ঠিক কত দিন আগেই-বা তা ঘটেছে?
গ্রহাণু বা ধূমকেতুর মাধ্যমে আমাদের পৃথিবীতে সমুদ্রের আগমন ঘটেছে কি না, তা জানার একটি উপায় হলো, এসব মহাজাগতিক বস্তুর রাসায়নিক গঠন যাচাই করা এবং পৃথিবীর গঠনের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করে দেখা যে সেগুলোর মাঝে কতখানি সাদৃশ্য রয়েছে।
যেমন একটি পানির অণুতে সব সময় ১০টি প্রোটন থাকেÑ৮টি অক্সিজেনের অণু থেকে এবং প্রতিটি হাইড্রোজেনের অণু থেকে একটি করে। এ ছাড়া পানিতে সাধারণত ৮টি নিউট্রন থাকে, কেবল অক্সিজেনের অণু থেকে। কিন্তু পানির ভিন্ন আইসোটোপে কিছু অতিরিক্ত নিউট্রন থাকতে পারে। যেমন ধরুন, আমরা ভারী পানি বলে থাকি অক্সিজেন ও ডিউটেরিয়াম থেকে সৃষ্টি পানি। এটি হলো একটি হাইড্রোজেন আইসোটোপ অথবা একটি বাড়তি নিউট্রনসমৃদ্ধ শুধুই হাইড্রোজেন।
২০১৪ সালে জার্নাল সায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় প্রাচীন গ্রহাণু ভেস্তা থেকে পৃথিবীতে পতিত একটি উল্কায় পানির ভিন্ন ভিন্ন আইসোটোপের আপেক্ষিক পরিমাণ যাচাই করা হয়।
ভেস্তার ওই নমুনাটিতে পৃথিবীর পানির ঠিক সমপরিমাণ আইসোটোপের বণ্টন দেখা যায়। এ থেকে অবশ্যই শতভাগ প্রমাণিত হয় না যে ভেস্তাই পৃথিবীতে পানির উৎস। কিন্তু এটুকু তো আন্দাজ করা যেতেই পারে যে ভেস্তার মতো সমবয়সী ও অভিন্ন এক বা একাধিক মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীর পানির নেপথ্যে থাকতে পারে।
কিন্তু এখনো এত সহজে বিতর্কের অবসান ঘটছে না। কিছুদিনের জন্য ধূমকেতুর গবেষণা থেকে অনেকটাই মনে হচ্ছিল যে গ্রহাণু থেকেই পৃথিবীর পানি এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম স্পেসক্র্যাফট হিসেবে রোসেটা একটি ধূমকেতুর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে এবং সেটির পৃষ্ঠে ফিলি নামে একটি ল্যান্ডারও প্রেরণ করে। রোসেটা ও ফিলির কল্যাণে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, পৃথিবীতে ভারী পানি (ডিউটেরিয়াম থেকে সৃষ্ট পানি) ও সাধারণ পানির (হাইড্রোজেন থেকে সৃষ্ট পানি) যে অনুপাত, তার থেকে ধূমকেতুটিতে ওই দুই ধরনের পানির অনুপাত ভিন্ন। এ থেকে অনুমান করা যায়, পৃথিবীর পানির ১০ শতাংশ একটি ধূমকেতু থেকে এসে থাকতে পারে।
কিন্তু ২০১৮ সালে খুব কাছ থেকে যাওয়ার সুবাদে গ্রহবিজ্ঞানীরা সোফিয়ার (টেলিস্কোপসহ একটি জাম্বো জেট) সাহায্যে ৪৬পি/উইরটানেন ধূমকেতুর আইসোটোপ গঠন আরও বিশদে দেখতে পারেন। তারা দেখতে পান, পৃথিবীর ডিউটেরিয়াম ও হাইড্রোজেনের অনুপাতের সঙ্গে ওই ধূমকেতুর মিল রয়েছে। তাহলে রোসেটা ও ফিলি যে ধূমকেতুটি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, সেটির সঙ্গে এই ধূমকেতুটির পার্থক্য কী?
বেশ, সে ব্যাপারটি এবার ব্যাখ্যা করা যাক। ৪৬পি/উইরটানেন ধূমকেতুটি এসেছে এমন এক 'অতিসক্রিয়' ধূমকেতু শ্রেণি থেকে, যারা সূর্যের কাছাকাছি এলে সাধারণ ধূমকেতুর চেয়ে অনেক বেশি পানি ছাড়ে। কীভাবে এ কাজটি করে তারা? একটি সাধারণ ধূমকেতু যখন সূর্যের উত্তাপের কাছে আসে, তখন এটির নিউক্লিয়াস সাবলিমেট থেকে বরফ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়, অথবা সরাসরি জমাট বরফ থেকে গ্যাসে পরিণত হয়। এরপর সেটি যদি কোনো গ্রহের পৃষ্ঠে আসে, তাহলে সেটি ঘনীভূত হয়ে তরল পানিতে পরিণত হতে পারে। কিন্তু একটি অতিসক্রিয় ধূমকেতু এর নিউক্লিয়াস থেকে শুধু বরফই হারায় না। এ ছাড়াও এর নিউক্লিয়াস থেকে আগে উত্তপ্ত হয়ে পরে ছেড়ে দেওয়া বরফসমৃদ্ধ খণ্ডও ছাড়তে থাকে। সম্ভবত ওই সব বরফখণ্ডের কারণেই অতিসক্রিয় ধূমকেতুগুলোর অনুপাত পৃথিবীর পানির অনুপাতের সঙ্গে অনেক বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।
তাই অতিসক্রিয় ধূমকেতু যত বিরলই হোক না কেন, পৃথিবীতে মহাজাগতিক পানি নিয়ে এল কারা, সেই সম্ভাব্য তালিকায় এই ধূমকেতুই এখন পর্যন্ত সবার ওপরে থাকবে। কিন্তু এটাও কোনো সুনিশ্চিত জবাব নয়।