কাবুলি বইওয়ালা: দুই শত্রু, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী
পঁচিশ বছর ধরে কাবুলের গ্র্যান্ড বাজারে বাগ-ই-ওমুমি সেতুর কাছে পাশাপাশি বসে বই বিক্রি করছেন শামস উল-হক ও হাজি সিরাজউদ্দিন। প্রথমজন সাবেক কমিউনিস্ট, অপরজন সাবেক মুজাহিদ। দুজনেই গত অর্ধশতাব্দীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, রক্তাক্ত আফগান ইতিহাসের সাক্ষী। একাধিক শাসকের উত্থান-পতন চাক্ষুষ করেছেন তাঁরা। এখন ওইসব শাসক ও শাসনকাল নিয়ে লেখা বই বিক্রি করেন।
শামসের বয়স ষাটের কোঠায়, মুখভর্তি সফেদ শ্মশ্রু। তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জীবনী ও ইতিহাসের বই বিক্রি করেন। তাঁর বইয়ের তাকে থরে থরে সাজানো আফগানিস্তানের ইতিহাস, যে ইতিহাসের সাক্ষী তিনি নিজেও। এখানে মুজাহিদিন যোদ্ধা আহমদ শাহ মাসুদের জীবনীর পাশেই থাকে কমিউনিস্ট একনায়ক ড. মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর জীবনী। এ ছাড়া শামসের সংগ্রহে আছে আফগানিস্তানের শেষ রাজা মোহাম্মদ জহির শাহসহ দেশ-বিদেশের আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী। চে গুয়েভারার বলিভিয়ান ডায়েরির পাশেই রাখা হিটলারের মাইন ক্যাম্প-এর পশতু অনুবাদ। দেখে মনে হবে, যেন অসংখ্য বিপরীত চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে এক জায়গায়।
শামস জানান, আজকাল তাঁর বইয়ের বিক্রি প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। সিরাজউদ্দিন অবশ্য শুরু থেকেই পাঠ্যবই বিক্রি করছেন।
তালেবান আমলে এই দুজনে পাশাপাশি দোকান খোলেন। সে সময় তাঁদের বই আসত ইরানি ও পাকিস্তানি পরিবেশকদের কাছ থেকে। এখন অবশ্য সিংহভাগ বই-ই আফগানিস্তানে ছাপা। নব্বইয়ের দশকের তালেবান আমলে বই বিক্রির ওপর নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ ছিল। সিরাজউদ্দিন জানান, সেকুলারিজম, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম-সংক্রান্ত বই পছন্দ করে না তালেবানরা। শিয়া রাষ্ট্র ইরানের বইও ছিল গোষ্ঠীটির অপছন্দের তালিকায়। এ ছাড়া মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর লেখা বইপত্রও ছিল নিষিদ্ধ।
শামস ও সিরাজউদ্দিনের বেশির ভাগ ক্রেতাই তরুণ আফগান, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা। শামস বলেন, 'কাবুলে এখন অনেক স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়। সে জন্য আমাদের উপকারই হয়েছে।'
তাঁদের বাকি ক্রেতারা বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী কিংবা সাবেক রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তা। তাঁদের চাহিদার সুবাদে শামসের দৈনিক আয় ৫০০-৬০০ আফগানি (৫০০-৬০০ টাকা)। এই উপার্জন দিয়ে শামস তাঁর দশ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ ভালোভাবেই করতে পারেন। মাঝেমধ্যে শামসের ছেলেরা তাঁকে দোকান চালাতে সাহায্য করেন।
প্রথম প্রথম দুই বই বিক্রেতার মধ্যে বনিবনা হতো না। শামস হাসতে হাসতে বলেন, 'ও জোর করেই আমার পাশে দোকান নিয়ে বসেছিল, মুজাহিদিনরা বরাবর যা করে আরকি। নিয়তির চক্রে আমরা দুই সাবেক শত্রু পাশাপাশি ব্যবসা শুরু করেছি। আমরা দুজনে যদি শান্তি স্থাপন করতে পারি, তাহলে অন্য আফগানরাও পারবে।'
আশির দশকে আফগান কমিউনিস্ট সরকারের সেনাবাহিনীতে নিরীক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন শামস। পার্টির সদস্য না হলেও ১৯৭৮ সালের কমিউনিস্ট অভ্যুত্থান তথা সাওর বিপ্লবের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বেশ নরম। তিনি জানান, তাঁর মতোই কাবুলের আরও বহু তরুণ এই অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিয়েছিল।
শহুরে তরুণ হিসেবে শামসের বিশ্বাস ছিল, মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই কেবল সত্যিকারের উন্নয়ন আসতে পারে। অনেক কাবুলবাসীর মতোই তিনিও প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খানের দেশ শাসন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। রাজা মোহাম্মদ জহির শাহকে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশের শাসনক্ষমতায় আসেন তিনি। ইসলামপন্থী ও কমিউনিস্ট, দুই পক্ষকেই দূরে ঠেলে দেন দাউদ। দুই পক্ষেরই বহু মানুষকে বন্দী করেন তিনি।
দাউদকে হত্যার পর শুরু হয় কমিউনিস্টদের আতঙ্কের শাসনকাল। বহু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মী, লেখক ও ধর্মীয় নেতা ধরপাকড় ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। আফগানিস্তানের প্রথম কমিউনিস্ট একনায়ক নুর মোহাম্মদ তারাকি ঘোষণা দেন, 'বিপ্লবের সব শত্রুকে' খতম করতে হবে। হাফিজুল্লাহ আমিন তারাকিকে হত্যা করার পর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। বেড়ে যায় ধরপাকড় ও হত্যাকাণ্ড। শেষে, ১৯৭৯ সালের বড়দিনে আফগানিস্তানে হামলা চালায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর জায়গায় বসায় তুলনামূলক নমনীয় বাবরাক কারমালকে।
শামস বলেন, ২০০১ সালে আমেরিকা ও তাঁর মিত্ররা আফগানিস্তান আক্রমণের সময় পরিস্থিতি যেমন ছিল, ১৯৭৯ সালের পরিস্থিতিও তেমনই ছিল। কাবুলের অনেকেই খুশি হয়েছিল আমিনকে ক্ষমতাচ্যুত করায়। কিন্তু দশ বছরের সোভিয়েত দখলদারিত্বের কালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। কারমাল ও ক্রেমলিনের প্রভাবশালীরা কাবুলে বসে দেশ চালাতেন। আর সে সময় সোভিয়েতের নেতৃত্বে চালানো জঙ্গিবাদ-বিরোধী অভিযানে বিধ্বস্ত হচ্ছিল আফগানিস্তানের গ্রামীণ অঞ্চল। বিদ্রোহ বেড়ে যায়। ধনী ইউরোপ, আমেরিকা, পাকিস্তান ও উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছ থেকে বৈশ্বিক সমর্থন পায় মুজাহিদিন।
শামস জানান, 'আমি মুজাহিদিনকে পছন্দ করতাম না। রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা বিশ্বাস করেছিলাম। ভেবেছিলাম, শাসকেরা নয়, ওরাই মূল সমস্যা।'
কিন্তু পরে আরও হাজার হাজার কমিউনিস্টপন্থীর মতো তিনিও পক্ষ বদলান। আশির দশকে কাবুল সরকারের অনেক কর্মচারীই গোপনে বৃহত্তম মুজাহিদিন গোষ্ঠী হিজব-ই-ইসলামির সদস্য ছিলেন। এই গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার।
সিরাজউদ্দিনের জন্ম কাবুলের চারদি এলাকায়। তিনি মৌলভি মোহাম্মদ্দ নবি মোহাম্মদির নেতৃত্বাধীন মুজাহিদিন গোষ্ঠী হারাকাত-ই ইনকিলাব-ই ইসলামিতে যোগ দেন। তখন তাঁর বয়স সতেরো। সওর বিপ্লবের পর তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য বন্দী ও হত্যাকা-ের শিকার হন। এর ফলে আরও হাজারো আফগানের মতোই বাধ্য হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেন সিরাজউদ্দিন। অল্প দিনের মধ্যেই দুঃসাহসী যোদ্ধা হিসেবে সুনাম কুড়ান তিনি।
সিরাজউদ্দিন বলেন, তাঁর চোখে সোভিয়েতবিরোধীরা ছিল জঘন্য মানুষ। কিন্তু পরে তিনি বুঝতে পারেন যে ঘটনা আসলে তাঁদের বোধগম্যতার চেয়েও অনেক বেশি জটিল ও প্যাঁচালো।
সিরাজউদ্দিন মূলত দক্ষিণ-পশ্চিমের দুই প্রদেশ লোগার ও পাকতিয়ায় যুদ্ধ করেছেন। এ দুই অঞ্চল পরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সিরাজউদ্দিনের অনেক সহযোদ্ধাই জীবনে কখনো আফগানিস্তানের রাজধানী দেখেননি। তাঁদের ধারণা ছিল, কাবুলের সব বাসিন্দাই ভোগবাদী ধর্মভ্রষ্ট। তাদের দিন কাটে মদ্যপান ও ব্যভিচারে। অন্যদিকে অনেক কাবুলবাসীর ধারণা ছিল, সিরাজউদ্দিনরা ছিলেন পাশবিক লোক। তারা প্রতিপক্ষের লোকজনকে হত্যা করে তাদের রক্ত পান করত।
১৯৮৯ সালে রেড আর্মির বিদায়ের পর ক্ষমতায় রইল মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর কমিউনিস্ট সরকার। সোভিয়েত সহায়তা ও পরামর্শ নিয়ে নাজিবল্লাহর সরকার তিন বছর টিকে থাকে। ১৯৯২ সালে মুজাহিদিনরা কাবুল দখল করে নেয়। তারপরই রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় মুজাহিদিনদের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে। কিন্তু সিরাজউদ্দিনের মতো অনেক সাবেক বিদ্রোহীই সেই ভ্রাতৃহত্যার যজ্ঞে অংশ নেননি। তাঁরা বাড়ি ফিরে আসেন।
এ কারণে শামস তাঁর এই বন্ধুটিকে 'সত্যিকারের মুজাহিদ' বলেন। তিনি বলেন, 'সে ছিল কাবুলের জনগণের জন্য এক অন্ধকার সময়। আর সাবেক মুজাহিদিনদের অপকর্মের কারণে তালেবানরা দেশের দখল নেওয়ার সুযোগ ও অজুহাত পেয়ে যায়। আমিসহ অনেকেই ওদের সাদরে বরণ করে নিয়েছিলাম।'
লাখো আফগানের মতো শামসের সামনেও এখন অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তার পরিবারের কিছু সদস্য ও বন্ধুবান্ধব ইতিমধ্যে আফগানিস্তান ছেড়েছে। সুযোগ ও উপায় থাকলে তিনিও পালাতেন। কিন্তু বেশ কিছু কারণে তা পারছেন না। তাঁর দোকান থেকে খানিক দূরেই একটা হোটেলে ইউরোপ থেকে ফেরত পাঠানো আফগান শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়শিবির খুলেছিল আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা। শামস স্মরণ করতে পারেন, আফগানিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার কারণে ওই হোটেলে আত্মহত্যা করেছিল এক যুবক।
আফগানিস্তানের সঙ্গে দোহা চুক্তি করার পর তালেবান আর মার্কিন সেনাদের ওপর চালায়নি। এরপর থেকে তারা পশ্চিমা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়া আফগানদের ওপর হামলা চালিয়েছে। অথচ এই আফগানদের বড় একটা সংখ্যা পশ্চিমা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে।
এর মধ্যে গত ১৫ আগস্ট কাবুলের দখল নিয়েছে তালেবান। আগস্টের শেষ দিনের মধ্যে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে আফগানিস্তান থেকে।
শামসের কণ্ঠে এখন শুধুই হাহাকার। 'ওদের ছাড়া আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, কিন্তু ওরা থাকলেও আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। এমনই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছি আমরা।'
সিরাজউদ্দিনের মত অবশ্য ভিন্ন। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশ ছেড়ে ওদের চলে যাওয়া উচিত। এটা মুসলিম দেশ। এই দেশ কখনো বিদেশি দখলদারদের গ্রহণ করবে না।'
শামস মনে করেন, আফগানরা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে গেছে। তিনি বলেন, 'অনেক কিছুই আমাদের হাতে আছে। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেরা হানাহানি করছি। এটা থামানো আমাদেরই দায়িত্ব। আমাদের দরকার এমন মানুষ, যারা একে ওপরের সাথে মন খুলে কথা বলতে পারবে, যেমনটা বলেছি আমি আর সিরাজউদ্দিন। আফগানিস্তানকে ফের গড়ে তোলার এটাই একমাত্র উপায়।'