রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া ঠাসাঠাসি বাক্সবাড়ি
আমার খুব কিচেনগার্ডেনের শখ। এই শখটি খুব পুরনো নয়, বছর দশ-বারো হয়। এখন যেহেতু অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নামের অন্ধকার এক বাবুই পাখির বাসার খোপে বাস করি তাই এই শখটিপূরণের কোন চেষ্টা করি না, শুধু মনে মনে এটি নিয়ে ভাবি। যে সময়ে সামনে জমিওয়ালা বাড়িতে থাকতাম তখন কয়েকবার ফুলের গাছ লাগিয়েছি বটে তবে শাকসবজী নৈবনৈবচ। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় একবার নূরুল আমীন স্যারের কোচিং থেকে ফেরার পথে শুঁড় উঁচানো, নীল-সাদা হাতির লোগোওয়ালা গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের সামনের ফুটপাতের গাছের দোকানে একটি কামিনী গাছ দেখে বেশ পছন্দ হয়ে যায়। পকেটের সব পয়সা দিয়ে গাছটি কিনে তিন কিলোমিটার পথ ভারি, মাটিওয়ালা টব সহ হেঁটে বাড়ি ফিরি। আপাতদৃষ্টিতে রিকশা করে বাড়ি ফিরে ভাড়া না দেবার বোকামিটা করেছিলাম কারণ আমার ধারণা ছিল গাছটি দেখে আম্মু রেগে যাবেন এবং রিকশা ভাড়া দেবেন না। কামিনী টবের গাছ নয় বলে শেষপর্যন্ত সেটাকে মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়েছিল। তাতে সে বিশাল আকার ধারণ করে। বর্ষায় গাছের নিচটা ঝরে পড়া সাদা পাপড়িতে ঢেকে যেতো আর সারা বাড়ি কামিনীর সুবাসে ভরে যেতো। আব্বু সুবাসওয়ালা ফুলের গাছ পছন্দ করতেন বলে আমাদের বাসায় বেলি, হাস্নুহেনা, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, কাঁঠালচাঁপা এমন সব গাছ ছিল। ব্যতিক্রম হচ্ছে একটি বিশাল কলকে ফুলের গাছ যেটিতে কোটি কোটি সোনারঙের ফুল ফুটত, রম্বোহেড্রন আকারের বড় বড় ফল ফলতো, সেই ফলের ভেতরে আবার একটি করে অমন আকারেরই বিশাল বীজ থাকতো। আমাদের বাড়িটি তার সামনের রাস্তাটির মতো অসংখ্যবার ভাঙচুর, নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, সংস্কার, বর্ধিতকরণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গেছে বলে তার কোন এক পর্যায়ে কলকে ফুলের গাছটি কাটা পড়ে। এটি নিয়ে বাসার কারো মধ্যে বিশেষ আফসোস কাজ করেনি, কেবল ওই ফুল-ফল-বীজ নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করা একটি বোকা ছেলের বুকের ভেতরের কোথায় যেন একটু ফাঁকা হয়ে গেছে যা আজও পূরণ হয়নি।
বড়আপা কলেজে পড়ার সময় আমার মতো বেকুবি না করে নার্সারি থেকে একটি কমন পাম আর একটি থুজাগাছের টব কিনে রিকশায় করে নিয়ে এসেছিলেন। থুজাটা বাঁচেনি, অবশ্য সেটি কখনো বেঁচে ছিল বলে আমার মনে হয়নি। কেমন যেন প্লাস্টিকের গাছ বলে মনে হতো। পামগাছটি শেকড় বাড়িয়ে টব ফাটিয়ে ফেললে তাকে গেটের ধারে মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়। সে ছানাপোনা গজিয়ে এমন কারবার করে ফেলে যে বছর দশেক পরে লোকে ঐ গাছ দিয়ে আমাদের বাড়ি চিনতে শুরু করে। আমরা মৌসুমে সন্ধ্যামালতী, অপরাজিতা, কুঞ্জলতা, দোপাটি, অ্যাস্টার, দুর্বাফুল, গাঁদা, জিনিয়া, কসমস, নয়নতারা, মোরগ ফুল এমন সব ফুলের গাছ লাগাতাম। দোপাটির ফলটাকে চাপ দিলে পুট করে খুলে দুপাশে চামড়া গুটিয়ে যেত। সন্ধ্যামালতীর বীজের ভেতরের শাঁস চাপ দিলে সাদা ধবধবে, মসৃণ, ক্যারম বোর্ডের পাউডারের মতো হয়ে যেত। মোরগফুলের মুকুটের ভেতর সর্ষে দানার মতো বীজ হতো। অপরাজিতাতে সয়াবিনের মতো ফল ধরতো। ঈদের পরে গোল ফ্রেমের ভারি চশমাপরা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের মালী বখশিশের আশায় কোন কোন ছাত্রীর বাড়িতে এক-আধটা ফুলের চারা নিয়ে হাজির হতেন। আম্মু তাঁকে সেমাই খাইয়ে, নগদ বখশিশ দিয়ে বিদায় করতেন। ওভাবে বাড়িতে ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকার চারা এসেছিল, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ডালিয়া কয়েক দিনের মধ্যেই শুকিয়ে যায়। চন্দ্রমল্লিকা অনেকদিন টিকে ছিল বটে, তবে সেটি একেবারেই বাড়েনি। কোন এক অদ্ভুত কারণে আমাদের বাড়িতে কখনো গোলাপ ফোটেনি। বড় আপা অনেক যত্ম নিয়ে, অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু লাভ হয়নি। অথচ আমাদের উলটো দিকে মনসুর নানা'র বাড়িতে অনাদরে-অবহেলায় রাখা সাদা গোলাপ গাছে হাজার হাজার ফুল ফুটতো। আমাদের প্রতিবেশী শাহীন ভাইদের বাসায় মধুজবা আর জহরবাজ দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছিল। আমরা সুযোগ পেলেই মধুজবার ফুল ছিঁড়ে তার গোড়ায় মুখ লাগিয়ে টেনে এক বিন্দু মধু খেতাম। আমাদের পাড়ায় কেবল সোহেল রানাদের বাড়িতে বিশাল বিশাল সূর্যমুখী আর স্থলপদ্ম ফুটতো। আকারে বড় বলে এই ফুলগুলো কেউ ছিঁড়ে নেবার সাহস করতো না।
শরৎকালে পূজোর মৌসুমে অন্য পাড়া থেকে ছেলেদের দল খুব ভোরে এসে না বলে একেবারে গাছ মুড়িয়ে ফুল নিয়ে যেত। একদিন এটা নিয়ে আমাদের আশেপাশের কয়েক বাসায় কিছুটা অসন্তোষ তৈরি হলো। পরদিন সেই ছেলেদের দলকে ধরা হলো। তারা বললো যে, তার আর সব ফুল ছিঁড়ে নেবে না, গাছও নষ্ট করবে না, কেবল দরকার মতো ফুল নেবে। ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে গেল। লক্ষ্মীপূজোর দিন ছেলেদের দল আমাদের জন্য নারকেলের নাড়ু নিয়ে এলো। যাদের বাড়িতে রক্তজবার গাছ ছিল তারা জানতেন ফুল চুরি হবেই – সেটা পূজোর জন্য হোক, আমাশয়ের বটিকা বানানোর জন্য হোক, আর লিটমাস পেপার বানানোর জন্যই হোক। সেটা নিয়ে কেউ বিশেষ উচ্চবাচ্য করতেন না। ফুল চুরি নিয়ে মাথা ঘামানোটা বড়দের ব্যাপার ছিল, আমাদের মাথাব্যথা ছিল কাদের বাগান কত সুন্দর বা সেখানে কত বিচিত্র গাছ আছে সেটা নিয়ে। কোন কোন বাসায় এই রেষারেষিটা ভাইবোন পর্যায় পর্যন্ত ঠেকতো। দেখা যেত একই পরিবারের ছেলেমেয়েরা নিজেদের বাগান কাঠি পুঁতে জমি ভাগ করে নিয়েছে এবং প্রত্যেক ভাগে একই প্রকারের গাছ লাগানো হয়েছে। রবি বুড়ার কবিতার কথা উলটে দিয়ে 'বসুধারে রেখেছে খণ্ড ক্ষুদ্র করি'র মতো ব্যাপারস্যাপার। বাগান সুন্দর করার জন্য আমরা বাগানের চারপাশে সরু ট্রেঞ্চ কেটে তাতে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে ইট লাগিয়ে সীমানা দিতাম। সেই ইটে কেউ চুণ আর কেউবা রঙ লাগাতো। বাগানের পথে ব্রিকফিল্ড থেকে আনা লালরঙের ইটের গুঁড়ো ওরফে 'রাবিশ' এনে ঢালা হতো তাতে গোটা পথ লাল রঙের হয়ে যেত। ধারে-কাছে রি-রোলিং মিল গড়ে উঠলে কেউ কেউ সেখানকার কালো রঙের 'রাবিশ' এনে কালো রাস্তা বানাতো। কালো রাস্তার সমস্যা হচ্ছে সেখানে ধারালো ধাতব চিপস্ থাকতো যা প্রায়ই আমাদের স্পঞ্জের স্যান্ডেল ভেদ করে পায়ে ফুটতো। মূল বাড়ি থেকে গেট পর্যন্ত রাস্তা বাঁধাইকরা হতো আড়াআড়ি, খাড়াকরা ইটের হেরিংবোন দিয়ে। তার দুপাশেও বাগানের মতো পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে ইট লাগিয়ে রঙ করা হতো। কোন কোন বাড়িতে সে পথের পাশে বুক সমান উঁচু বক্সউডের দেয়াল তোলা হতো।
বাড়িতে ফুলের গাছ ছাড়া নানা রঙের পাতাবাহার, গোড়াচক্কর, ক্যাকটাস আর ফণীমনসা গাছও লাগানো হতো। একটা পাতাবাহারের পাতার রঙের ডিজাইন দেখে আম্মু তার নাম দিয়েছিলেন সিঁথির সিঁদুর। অমন নামকরণের কারণ বোধগম্য।এছাড়া লাগানো হতো মানিপ্ল্যান্ট। ফিউজ হয়ে যাওয়া ইনকেন্ডেসেন্ট লাইট বালবের ভেতরের কাচের অংশ আর ফিলামেন্ট ফেলে দিয়ে তাতে অথবা স্বচ্ছ কাচের বোতলে পানি ভরে মানিপ্ল্যান্ট লাগিয়ে ঘরের ভেতরে দেয়ালে ঝোলানো হতো। দেখার মতো মানিপ্ল্যান্ট ছিল আমাদের পাড়ার পিটার নানা'র বাড়িতে– একেবারে কুলো বা হাতির কানের মতো বড় আকারের পাতা থেকে শুরু করে একেবারে থানকুনি সাইজের পাতা পর্যন্ত। তাঁদের বারান্দার কলাম বেয়ে মোটা অজগর সাপের মতো মানিপ্ল্যান্টের লতা ছাদ পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল।একবার কারো পরামর্শে আমাদের বাড়িতে আনারসের মৌসুমে আনারসের কাটা মাথা লাগানো হয়েছিল। সেটা বেঁচে গিয়েছিল। আমার ধারণা ছিল আনারস মাটির নিচে হয়, কিন্তু সবাই বলতো সেই ধারালো পাতার সিংহাসন ভেদ করে আনারস নাকি মাটির উপরেই হবে। আমরা অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলাম, কিন্তু আনারস আর হয়নি। যেমন আমরা অপেক্ষা করেছিলাম আমাদের বাসার কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল ধরবে বলে, কিন্তু কোনদিনই তাতে কাঁঠাল ধরেনি। গাছটাও বিশেষ বাড়েনি। অথচ আমাদের বাসার পেয়ারা গাছে কোটি কোটি পেয়ারা ধরতো, যেমন মনসুর নানাদের পেঁপে গাছে সারা বছর মিলিয়ন মিলিয়ন পেঁপে ধরতো। পাড়াসুদ্ধ সবাই আমাদের গাছের পেয়ারা খেতেন। পেয়ারার মৌসুমে অনেকদিন খোঁজ নেই এমনসব লোকজন এসে হাজির হতেন। তখন গোটা বাড়ি পাকা পেয়ারার সুবাসে ভরে যেতো। আমাদের বেল, আতা আর নারকেল গাছেও প্রচুর ফলন হতো। বর্ষাকালে আমাদের কদম গাছটা আগুনের গোলায় ভরে যেত। কদম আমাদের খুব পছন্দের ফুল ছিল। এর পরাগদণ্ডের স্ফীত মাথাটা হচ্ছে পোলাও, দণ্ডটা হচ্ছে জর্দা সেমাই, হলুদ পুষ্পাক্ষগুলো হচ্ছে খিচুড়ি, মাঝের গোল বলটির উপরের মিহি সবুজ অংশ হচ্ছে সবজি আর বলের মাঝখানটা কেটে টুকরো টুকরো করলে সেটা হচ্ছে মাংস। পেপারোমিয়া গাছের পাতা মুড়িয়ে হাতের তালুতে রেখে জোরে থাপ্পড় মারলে চেপ্টে গিয়ে পাটিসাপ্টা পিঠা হয়, আর পাতাটা আস্ত রাখলে সেটা হচ্ছে পান, আর তার ফুল হচ্ছে কাঁচামরিচ। দেশি খেজুর গাছের পাতা একটা বিশেষ কায়দায় চিরল চিরল করে একটা আরেকটার ভেতরে ঢুকিয়ে দুজনে মিলে দুহাতে মন্থনের মতো টানাটানি করলে হালকা সবুজ রঙের একগুচ্ছ তন্তু বের হতো যেটা চিবোলে মিষ্টি মিষ্টি লাগে। ঐ তন্তুগুচ্ছকে বলা হতো 'গাঁজা'। আমাদের মধ্যে বেশি সাহসী দুয়েকজন কাঁঠালপাতা মুড়িয়ে বানানো নলে সেই 'গাঁজা' ঢুকিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে সিগারেটের মতো টেনেছেও। আমি সেসব না করলেও কখনো সখনো পাটখড়ি পেলে তাতে আগুন লাগিয়ে সিগারেটের মতো যে টানিনি তা অস্বীকার করবো না।
ঐ সময়ে আমাদের বাড়ি তো বটেই, দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া আশেপাশের সব বাসা ছিল একতলা যার সামনে বা পেছনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা থাকতো। গোটা পাড়ায় হাতে গোনা কয়েকটা চারতলা বাড়ি ছিল – সেগুলোকে অনেক উঁচু বলে মনে হতো। অল্প কিছু বাড়িতে উঁচু সীমানা প্রাচীর ছিল যার উপরে পেরেক অথবা ভাঙা কাচ লাগিয়ে দুর্লঙ্ঘনীয় করা হতো। তবে বেশিরভাগ বাড়ির সীমানা প্রাচীর ছিল মোটামুটি নিয়ম রক্ষার যেটার উপরে উঠে দুদিকে দু'পা ঝুলিয়ে বসে ঘোড়া ঘোড়া খেলা হতো, অথবা স্রেফ পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করতো। বেশি সাহসী কেউ আবার সার্কাসের লোকদের মতো সেটার উপর দিয়ে হেঁটে যেতো।বাড়িতে যে মেইন গেট থাকতো সেটা খুব কম বাড়িতে বন্ধ থাকতো। তাতে আহুত বা অনাহুত অতিথি, ফেরিওয়ালা, ভিখিরি, পথের কুকুর বা ছিঁচকে চোরমূল বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত অবাধে যাতায়ত করতে পারতো। গেটের বাইরে খুব কম বাড়িতে কলিং বেল লাগানো হতো। বেল লাগালে সেটা বাজিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটতো বলে অনেকেই বেল লাগাতে উৎসাহ বোধ করতেন না। যেসব বাড়িতে ফলের গাছ ছিল সেসব বাড়িতে ছেলেপেলের দল ফলের মৌসুমে অবাধে নিয়মিত হানা দিত। সবাই যে এটা পছন্দ করতেন তা নয়। যেমন, আজাদদের বাড়ির বরই গাছগুলোতে অকল্পনীয় পরিমাণে বরই ধরলেও আজাদের মা ও নানী মোটেও চাইতেন না আমরা তাতে ভাগ বসাই। আমরা অবশ্য তাদের আপত্তির বিশেষ পরোয়া করতাম না। ফলে আজাদের মা ও নানীর সৃজনশীল গালির তুবড়ির মধ্যেই আমরা পকেটভরে বরই নিয়ে নির্বিকার মুখে
'আউল্লা গাছের বাউল্লা বরই খাইলো খাইলো
ডাক দিলে শোনে না ধুরো ধুরো'
বলতে বলতে চলে আসতাম। এখন এসব হলে সম্ভবত থানা-পুলিশ হয়ে যেত।
সব বাসায় কম-বেশি জায়গা থাকতো বলে কিছু না কিছু মৌসুমী সবজীর চাষ হতো। সাবেরা খালার বাসায় বেশ অনেকটা জায়গা থাকায় রাশেদ খালু সেখানে বেশ উদ্যোগ নিয়ে শীতের সব সবজী – যেমন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, পালংশাক এসবের চাষ করতেন। খালুর কিচেন গার্ডেনিং-এর বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি ছিল এবং তিনি লোক রেখে চাষের কাজ করাতেন। গাছের চারাতে ছায়া দেবার জন্য কলাগাছের খোল কেটে কাঠি গেঁথে ছোট ছোট শেড বানানো হতো, মুরগী যেন বীজ-চারা নষ্ট করতে না পারে এজন্য বাঁশের খাঁচা বেড়া দেয়া হতো। খালু ছিলেন শৌখিন মানুষ। তিনি ধবধবে পাঞ্জাবী-লুঙ্গি পরে, চেয়ারে বসে ভুরভুরে সুবাসের টি-ব্যাগের চা খেতে খেতে কাজের তদারক করতেন। টি-ব্যাগের কথাটা বললাম এই কারণে, তখন চা বলতে মূলত গ্রেইন আর ডাস্ট বোঝাতো। আজকের মতো টি-ব্যাগ ছ'কড়া ন'কড়া ছিলো না, সুবাসহীনও ছিলো না। আমাদের বাড়ির জায়গা কম এবং কারো বিশেষ উৎসাহ ছিল না বলে এক মৌসুমে একটা সবজীর চাষ হতো, এবং সেটার কখনো পুনরাবৃত্তি হতো না। তবে যা কিছু হতো একেবারে ঝাঁপিয়ে। একবার চালকুমড়ো হলো হাইব্রীড তরমুজের মতো বিশাল বিশাল যার গায়ে সাদা চুণ। আমরা আমিষ-নিরামিষের সাথে চালকুমড়ো খেতে খেতে হদ্দ হয়ে যাবার পর সেটা দিয়ে হালুয়া আর মোরব্বাও বানানো হলো। এভাবে একে একে বরবটি, ধুন্দল, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, কুমড়া, শীম, লাউ, শশা, ডাঁটা এমনসব সবজী একেক বছর ঝাঁপিয়ে হলো। কাঁচামরিচ গাছ সাধারণত তিন মৌসুম পরে আর বিশেষ ফলন না দিলেও আমাদের বাসার ঘন কালচে সবুজরঙা, খাটো, শক্ত, অসম্ভব ঝালের সুবাসী মরিচ গাছ টিকে ছিল অনেক বছর। সেটাতেও সারা বছর ধরে প্রচুর ফলন হতো। অমন মরিচ আমি আর কখনো দেখিনি। সবচে' বিস্ময়কর লাগতো আমাদের লেবু গাছটাকে। কি যে সুন্দর গোল, টেনিস বলের আকারের, হালকা সবুজরঙা লেবু ধরতো! আর সেকি তার সুবাস আর স্বাদ। সুবাসের জন্য আমরা শরবতে বা ছোট মাছ রান্নায় সেটার পাতা পর্যন্ত দিতাম। আমার নিজস্ব স্বর্গে আমাদের লেবু গাছটা, মরিচ গাছটা, পেয়ারা গাছটা আর কলকে ফুলের গাছটা চাইবো।
প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার বিষয়টা কেবল গাছের ফল বা মৌসুমী ফসলে সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেক বাসাতে সংবাদপত্র রাখা হতো না ফলে তারা অন্য বাসা থেকে প্রত্যেকদিন সংবাদপত্র এনে পড়তেন। প্রায়ই দেখা যেত আমাদের বাসায় সংবাদপত্র দেবার সময় হকার বজলু ভাইয়ের কাছ থেকে প্রতিবেশী কেউ সেটা নিয়ে পড়ে পরে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কখনো কখনো দেখা যেত সেই সংবাদপত্র থেকে চাকুরির বিজ্ঞপ্তি বা শব্দজট ধরনের জিনিস কেটে রাখা হয়েছে। বিচিত্রা, সন্ধানী, রোববার, নিপুণ, চিত্রালী, পূর্বাণী, বেগমের মতো পত্রিকাগুলো তো সারা পাড়া ঘুরতো। মা-মামা-খালাদের মধ্যে নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় আর নিমাই ভট্টচার্যের বই হাতবদল হতো। তাঁদের আলোচনায় মেমসাহেব, রাজধানী এক্সপ্রেস, আবার আমি আসব, চিতা বহ্নিমান, শাপমোচন, সিঁথির সিঁদুর, কালো ভ্রমর, কিরীটি রায় থাকতো। তাঁদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীদের আলোচনায় আবার দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম, ক্যাপ্টেন রাজ, ভয়াল, কুয়াশা, মাসুদ রানা থাকতো।
কোন বাসায় কোন এক বেলায় ভালো কোন পদ রান্না করা হলে একেবারে নিকট প্রতিবেশীদের কারো কারো বাসায় এক বাটি তরকারী পাঠানোর একটা ব্যাপার প্রচলিত ছিল। প্রতিবেশীদের সাথে চলা নিয়মিত আড্ডায় কেউ বিশেষ একটা খাবারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখালে এবং অন্য কোন বাসায় সেটা রান্না হলে অবধারিতভাবে তার ভাগ আগ্রহী জনকে পৌঁছে দেয়া হতো। এটা নিয়ে কেউ কিছু মনে করতেন না, বরং এটাকে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা হতো। প্রতিবেশীদের মধ্যে নুন-তেল-চিনি-মশলা ধার নেয়া, গৃহস্থালী কাজের যন্ত্রপাতি নেয়া খুব সাধারণ ও নিয়মিত ব্যাপার ছিল। সত্তরের দশকের অভাবের দিনগুলোতে ধার নেয়ার জিনিসের সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়তে থাকে, কেউ কেউ নগদ টাকাও ধার করতে থাকেন। ঐ সময়ে মুদি দোকানগুলোতে ছোট ছোট প্যাকেটে শুঁটকির পাউডার বিক্রি হতো যা শুকনো খোলায় টেলে লবণ-মরিচ-পেঁয়াজ মাখিয়ে ভর্তা বানানো হতো। অভাবের তাড়নায় অনেক বাড়িতে নিয়মিত মাছ-মাংস কেনা সম্ভব হতো না বলে সেই শুঁটকির পাঊডার দিয়ে ভর্তা বানিয়ে দুয়েক বেলা পার করা হতো।
অভাবের দিনগুলোতে 'গাউন' নামের একটি জিনিস বাজারে এসেছিল। এই গাউন মোটেও ঢিলেঢালা পোশাক নয়, বরং পশ্চিমা দুনিয়া থেকে দান বা সাহায্য বা ত্রাণের আওতায় আসা তাদের ব্যবহৃত কাপড়চোপর। সেখানে অন্তর্বাস থেকে শুরু করে কোট, জ্যাকেট পর্যন্ত সবকিছু ছিল। ফেরিওয়ালারা গাউনের গাঁঠরি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতেন, লোকে সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসটা বের করে কিনতেন। এক জিনিস দুটো পাওয়া যেত না। গাউনের কাপড়গুলো মূলত সিনথেটিক ছিল যা নাইলন, ক্যারোলিন, টেরিলিন, পলিয়েস্টার এমন সব নামে পরিচিত ছিল। প্রথম প্রথম গাউন দানের আওতায় আসলেও পরে বোধকরি সরকারি উদ্যোগে আমদানীও করা হয়। ফলে দেশের বড় বড় শহরগুলোতে গাউন ভিত্তিক এক প্রকারের হকার্স মার্কেট গড়ে ওঠে যা বহুল আলোচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের নামানুসারে 'নিক্সন মার্কেট' নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রথম প্রথম গাউনের পকেটে খুচরো বিদেশী মুদ্রা ও টুকটাক নানা জিনিস, তার গায়ে লাগানো নানা রকমের সেফটি পিন, কোটপিন, ব্রোচ, কারুকাজ করা বড় বোতাম এসব পাওয়া যেত। লোকে সেই লোভেও গাউন কিনতেন। পরে ব্যবসায়ীরা চালাক হয়ে যান। তাঁরা গাউন বিক্রি করার আগে সব আঁতিপাতি করে খুঁজে বের করে আলাদা বিক্রি করতেন। উলের পোশাকগুলো বিক্রি হতো সেগুলো খুলে উলের বল বানিয়ে ব্যবহারের জন্য। শীতকাল আসতে নিলে পাড়াজুড়ে খালা-মাসীরা উল কাঁটায় মাফলার, সোয়েটার, টুপি, মোজা এসব বানাতেন। সেগুলোর নানা রকমের ডিজাইন ছিল হানিকম্ব, ডবল হানিকম্ব, ভুট্টা দানা, সাগু দানা, ময়ুর ইত্যাদি। আম্মু আমাকে সাগুদানা ডিজাইনে একটা ভি-নেক সাদা পুলওভার বানিয়ে দিয়েছিলেন যার সামনে ল্যাভেন্ডাররঙা উলে দুটো কুকুর ছানা নিয়ে দুটো বাচ্চার ডিজাইন করা ছিল। গ্রীষ্মকালে সুতা দিয়ে ক্রুশ কাঁটায় টেবিলম্যাট, গ্লাস জগের ঢাকনি বা মেয়েদের জামার লেস বোনা হতো। অনেক পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সদরুল পাশা আর নুসরাত ইয়াসমিন টিসা অভিনীত একটা নাটক দেখিয়েছিল যেখানে নায়ক গাউন থেকে একটা কোট কিনে তার পকেটে এক হাজার ডলার খুঁজে পেয়ে ভাগ্য বদলে ফেলে।
যেসব বাড়িতে জায়গা একটু বেশি ছিল সেসব বাড়িতে প্রায়ই একটা পুকুর বা ডোবামতো থাকতো। সাধারণত পুকুরকাটা মাটি দিয়ে ভিটি উঁচু করে তাতে বাড়ি তোলা হতো। কিছু কিছু পুকুর ছিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। তাতে অনেকে গোসল করতেন বা সাঁতার কাটতেন। সেসব পুকুরে বিশেষ মাছ থাকতো না, তবে সেগুলোর একটা করে নাম থাকতো। যেমন, লতিফ সাহবের যে পুকুরটিতে আমরা সাঁতার কাটতে যেতাম তার নাম ছিল 'টাগার'। নামটা বোধকরি 'পগাড়'-এর বিবর্তিত রূপ। কেউ একজন পাড়ায় ঢোকার মুখে ডিআইটি'র (রাজউকের পূর্বপুরুষ ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট) বিশাল পুকুরটা লিজ নিয়ে তাতে মাছের চাষ করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন 'মদিনা মৎস্য খামার'। কোন একজন মন্ত্রী এসেছিলেন সেটা উদ্বোধন করতে। আমরা সদলবলে সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়ে বিস্কুট, চানাচুর খেয়েছিলাম। ঐ প্রথম আমরা দেখি কী করে পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ে। তখন মাছ চাষ মানে রুই, কাতলা, মৃগেল মাছের চাষ। তেলাপিয়ার, নাইলোটিকা, কারফু'র নাম তখন সবে শোনা শুরু করেছি। সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, আফ্রিকান মাগুর, পিরানহা আসতে তখনো ঢেড় দেরি আছে। আমরা দেখলাম একজন মানুষ একটা বিশাল ড্রাম ভর্তি পানিতে হাত ডুবিয়ে রুই মাছের পোনা ধরে দশটা দশটা করে গুনে পুকুরে ছাড়ছে। একজন বললেন, আসলে নাকি যত পোনা বলা হয় তত পোনা ছাড়া হয় না। যিনি পোনা ছাড়েন তিনি নাকি কায়দা করে গল্পের কুমীরের বাচ্চা দেখানোর মতো করে এক সেট পোনাই বার বার এমনভাবে দেখান যেন সেগুলো পুকুরে ছাড়া হলো। মদিনা মৎস্য খামারে আমাদের জন্য আকর্ষনীয় বিষয় ছিল একটা ফাইবার গ্লাসের এঞ্জিনবিহীন স্পীডবোট যেটা বৈঠা দিয়ে চালাতে হতো। আমাদের কেউই নৌকা চালাতে পারতাম না। তাই খামারের কর্মীদেরকে সাধ্য সাধনা করে নৌকায় উঠতে পেতাম। পাড়ায় মৎস্য খামার হয়েছে দেখে আমাদেরও ইচ্ছে হলো অমন খামার দেবার। আমার ছোটভাই বাগানে নিড়ানী কাঁচি দিয়ে এক হাত বাই এক হাত একটা গর্ত করে তাতে বালতি দিয়ে পানি ঢেলে পুকুর বানিয়ে ফেললো। বাজার থেকে যে ছোট মাছ আনা হতো তার মধ্যে কালেভদ্রে এক আধটা জ্যান্ত মাছ থাকতো। অমন দুই-তিনটা মাছ সেই পুকুরে ছেড়ে সে তাতে আইসক্রিমের কাঠি আর বোর্ডপেপার দিয়ে সাইনবোর্ড লাগালো 'শরীফ মতস খামার'। খণ্ড-ত লেখার আর য-ফলা দেবার শিক্ষা তখনো ওর হয়নি। একবেলা যেতে না যেতে ওর পুকুরের পানি শুকিয়ে গিয়ে মাছ মরে গেল। তখন বিকল্প হিসাবে কাচের বড় বয়ামে কৈ, শিং, খলসে মাছ পোষা শুরু হলো। অচিরেই আম্মুর হস্তক্ষেপে আমাদের মাছ পালন প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেল।
আমাদের বাসার কাছে একটা সরকারি (খাস) পুকুর ছিল। তার চারপাশে বাড়িঘর উঠে তাতে চলাচলের রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে তার নাম হয়ে গেল 'আন্ধি'। একবার পাড়ার মুরুব্বীরা উদ্যোগ নিয়ে সেটা পরিষ্কার করে তাতে মাছ ছাড়লেন। সেই উদ্যোগে পাড়ার সবার সমান শেয়ার ছিল বলে সেই পুকুর থেকে মাছ চুরি হতো না। কয়েক মাস পরে মাছ বড় হলে জেলে ডেকে বেড়জাল দিয়ে মাছ ধরা হলো। আমরা প্রথমবারের মতো দেখলাম কী করে বেড়জাল দিয়ে মাছ ধরে। আমি কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারিনি বোকা মাছগুলো জালের নিচের খোলা মুখ দিয়ে পালিয়ে যেত না কেন! পাড়ার পুকুরগুলো আকারে ছোট হলেও সেগুলোর পানি বেশ স্বচ্ছ ছিল। তাতে দিনের বেলা ছটফটে চেলি মাছ, সারসের মতো লম্বা ঠোঁটের অর্ধস্বচ্ছ কাকিলা মাছ, রামধনুরঙা খলসে মাছ দেখা যেত। রাতের বেলা টর্চের আলো ফেললে জ্বলজ্বলে চোখের বেলে মাছ দেখা যেত। আমাদের খেলার পুকুর ছিল সাবেরা খালার বাসার পুকুর। সেখানে খালার ছেলে নাঈম, প্রতিবেশী উজ্জ্বল, আমি আর আমার ছোটভাই শরীফ লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়ার মেলা থেকে কেনা ভটভটি লঞ্চ চালাতাম। বরগুনা থেকে আসা নাঈমদের গৃহকর্মী আলী আহমেদ আমাদেরকে পুকুরের পানির ভেতরে দুহাত ঢুকিয়ে কী করেআগ্নেয়গিরির অগ্ন্যৎপাতের মতো কাণ্ড করা যায় সেটা দেখাতো। তার ভাষ্য আইড় মাছ নাকি পুকুরে এমন করে চলাফেরা করে। আলী আহমেদ পানির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে অমন করতে করতে বলতো —
আইড় মাছে খাইড় কাটে
বাইম মাছে প্যাঁচাইয়া ধরে
পুঁটি মাছে ঢ্যাণ্ডেড়া বাজায়
হায় রে প্রাণ উদায়
যারে আল্লায় বেদিশায় ফালায়
একবার বুলু নামের একটা বাচ্চা মেয়ে সবার অলক্ষে ঐ পুকুরে পড়ে গিয়ে মারা যায়। তারপর থেকে পুকুরটার ব্যবহার কমে আসে। আস্তে আস্তে পাড়ার সব পুকুর ভরাট করে তাতে বাড়ি উঠতে থাকে। ফুল আর সবজি বাগানগুলো দখল করে বাড়ি উঠতে থাকে। এরপর আমরা 'রিয়েল এস্টেট' বলে একরকম কোম্পানির নাম শুনি যারা আগের একতলা-দোতলা বাড়িগুলো ভেঙে সারি সারি,উঁচু, কুৎসিত, ঠাসাঠাসি বাক্সবাড়ি তুলে আকাশটাকে ঢেকে ফেলে। এই শহরটা আস্তে আস্তে বাগানহীন, বৃক্ষহীন, পুকুরহীন, মাছহীন, পাখিহীন, প্রতিবেশীহীন নির্মম, নিষ্ঠুর, ভালোবাসাহীন, হৃদয়হীন একটা জঞ্জালের স্তুপে পরিণত হতে থাকে।
-
১০ মার্চ ২০২১