ঘুমের কথকতা
নব্বই এর দশকের শুরুর দিকে মনস্তত্ববিদ টমাস উয়ের একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালিয়েছিলেন, যেখানে এক দল মানুষকে প্রতিদিন, ১৪ ঘন্টা করে অন্ধকারে রাখা হয় পুরো এক মাস। পরীক্ষার প্রভাব শুরুতে কম বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু চতুর্থ সপ্তাহ শুরু হতেই তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ঘুমের রুটিনে চলে এল। তারা প্রথমে চার ঘন্টা ঘুমাতেন, আর তারপর এক দুই ঘন্টা জেগে থেকে আবারও ঘুমাতেন চার ঘন্টা।
বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার ফলাফলে চমৎকৃত হয়েছিলেন, তবে সাধারণ মানুষের মনে এখনো বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে টানা আট ঘন্টা ঘুমানোই উত্তম।
২০০১ সালে ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ রজার ইকার্চ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যা তিনি তৈরি করেছিলেন তার ১৬ বছরের কাজের উপর ভিত্তি করে। সেখানে তিনি অসংখ্য ঐতিহাসিক উদাহরণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে আগে মানুষ টানা না ঘুমিয়ে দুই দফায় রাতের ঘুম ঘুমাতেন।
চার বছর পরে প্রকাশিত "এট ডেজ ক্লোজঃ নাইট ইন টাইমস পাস্ট" নামক বইতে তিনি সর্বমোট ৫০০টি সত্য ঘটনা বর্ণনা করেন, যেখানে আগের দিনের মানুষের বিচ্ছিন্নভাবে ঘুমানোর অভ্যাস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। এই ঘটনাগুলো খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ডায়রী, আদালতের দলিল, চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বই ও প্রবন্ধ, হোমারের ওডিসি কাব্য, এবং সবশেষে, আধুনিক নাইজেরিয়ায় বসবাসরত আদিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক লেখনী থেকে।
উয়ের এ গবেষণার মত, বাকি তথ্যসূত্র থেকেও আমরা দুই দফা ঘুমের ব্যাপারে জানতে পারি। প্রথমে সূর্যাস্তের পরে দুই ঘন্টার একটি ঘুম, এবং আরো কয়েকঘন্টা জেগে থাকার পরে দ্বিতীয় ঘুম ছিল সে সময়ের চর্চা।
ইকার্চ বলেন "এটি শুধুমাত্র তথ্যসূত্রের সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং যেভাবে তারা এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছে, তা থেকেও পরিষ্কার বোঝা যায় যে একাধিকবার ঘুমানোর ব্যাপারটা তাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।'
জেগে থাকার সময়টা তারা কাটাতেন কর্মচাঞ্চল্যে। উঠে হাঁটাহাঁটি করা, শৌচাগারে যাওয়া, তামাক সেবন করা, কিংবা প্রতিবেশীদের বাড়ীতে ঘুরতে যাওয়া—এর সবই চলতো। তবে বেশিরভাগ মানুষ বিছানাতেই থাকতেন; পড়া, লেখা কিংবা প্রার্থনা করে সময়টা কাটাতেন। ১৫শ শতাব্দীর শেষের দিকে রচিত বেশ কিছু প্রার্থনার নির্দেশিকা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো দুই ঘুমের মাঝে পড়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
আর এই সময়টা মানুষ সব সময় একা কাটাতেন এমন না, তারা প্রায়ই শয্যাসঙ্গী/শয্যাসঙ্গীনির সাথে কথা বলতেন, কিংবা আরও অন্তরঙ্গ কার্যকলাপে লিপ্ত থাকতেন।
১৬শ শতাব্দীর একজন ফরাসী ডাক্তার, দম্পতিদের উপদেশ দিয়েছিলেন কাজ থেকে ফিরে, ক্লান্ত অবস্থায় বংশবিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত না হয়ে দিনের "প্রথম ঘুম"এর পরবর্তী সময়টাকে কাজে লাগাতে; তাতে ব্যাপারটা আরও উপভোগ্য হবে, এবং তাতে সাফল্যের সম্ভাবনাও বেশি থাকবে।
ইকার্চ আবিষ্কার করেন যে ১৭শ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে প্রথম এবং দ্বিতীয় ঘুম নিয়ে লেখালেখি কমতে শুরু করে। প্রথমে উত্তর ইউরোপের শহুরে উচ্চবিত্তরা এই অভ্যাস পরিত্যাগ করতে শুরু করেন, এবং পরবর্তী ২০০ বছরে তা পাশ্চাত্যের সকল দেশ থেকেই উধাও হয়ে যায়।
১৯২০ সালের মধ্যে প্রথম এবং দ্বিতীয় ঘুমের ধারণাটি আমাদের সামাজিক চিন্তাচেতনা থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়।
এই পরিবর্তিত অভ্যাসের পেছনে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় রাস্তাঘাটে এবং বাসায় উন্নত আলোর ব্যবস্থা, এবং প্রচুর পরিমাণে কফির দোকানের আবির্ভাবকে; যার অনেকগুলোই সারা রাত ধরে খোলা থাকতো। এসব কারণে রাতের বেলাতেও মানুষের স্বাভাবিক ও বৈধ কার্যক্রমের সংখ্যা বেড়ে যায়, এবং বিশ্রামের পেছনে প্রদেয় সময়ের পরিমাণও একইভাবে কমে আসতে থাকে।
ইতিহাসবিদ ক্রেগ কসলফস্কি তার নতুন বই "ইভিনিংস এম্পায়ার" এই পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে আমাদেরকে বিস্তারিত জানিয়েছেন।
তিনি বলেনঃ "১৭শ শতাব্দীর আগে রাতের সাথে ভাল কোন কিছুর সংযুক্তি ছিল না। কথিত ছিল যে রাতে জেগে থাকে শুধু অপরাধী, পতিতা এবং মদিরাসক্ত মানুষজন। এমনকি, যাদের সারা রাত ধরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখার মত আর্থিক সক্ষমতা ছিল, তারাও বিশেষ কোন কারণ ছাড়া রাতের বেলায় জেগে থাকতেন না। রাত জাগার ব্যাপারটির মাঝে কোন বিশেষ মর্যাদা ছিল না।''
তবে এই ধারণাগুলো বদলাতে শুরু করে রিফর্মেশন এবং কাউন্টার রিফর্মেশনের যুগে এসে। নির্যাতনের ভয়ে প্রটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিকরা রাতের আঁধারে তাদের প্রার্থনা সভার আয়োজন করা শুরু করেন। আগে সন্দেহজনক চরিত্ররা রাতকে হাতের মুঠোয় নিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু পরে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষেরাও রাতের আঁধারকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগানো শুরু করেন।
শুরুতে শুধু অবস্থাপন্ন মানুষেরাই এ ধারাকে আঁকড়ে ধরলেও রাস্তার ল্যাম্পের আগমনের পর এটি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
১৬৬৭ সালে, প্যারিস আবির্ভূত হয় পৃথিবীর প্রথম ল্যাম্পের আলোয় আলোকিত শহর হিসেবে। কাঁচের ল্যাম্পগুলোর ভেতরে আলোর উৎস হিসেবে মোমবাতি রাখা হোত। একই বছরে লিলে শহরে এবং দুই বছর পর আমস্টারডামেও ল্যাম্প বসানো হয়েছিল। আমস্টারডামে আরও কার্যকরী, তেল চালিত ল্যাম্প বসানো হয়।
১৬৮৪ সালের আগে লন্ডনের রাস্তায় ল্যাম্প বসেনি, তবে সেই শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইউরোপের ৫০টি প্রধান শহরের রাতগুলো ল্যাম্পের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
রাত একটি হালফ্যাশানের বিষয়ে পরিণত হয়, এবং বিছানায় শুয়ে থেকে রাতের ঘন্টাগুলো পার করাকে সময়ের অপচয় হিসেবেই ধরা হোত।
রজার ইকার্চ বলেন "মানুষের সময় জ্ঞান বেড়ে যাচ্ছিল, এবং ১৯ শতকের আগে দিয়ে মানুষের মাঝে সঠিক ভাবে সময়কে কাজে লাগানোর একটি অদম্য তাগিদ দেখা দেয়। শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে এই মনোভাব আরো দৃঢ়তা পায়।''
১৮২৯ সালের একটি মেডিক্যাল জার্নালে মানুষের এই পরিবর্তিত মনোভাবের ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়, যেখানে পিতামাতাদের প্রতি আর্জি জানানো হয়েছে বাচ্চাদেরকে প্রথম ও দ্বিতীয় ঘুমের অভ্যাস থেকে বের করে আনতে।
বর্তমানে মানুষ আট ঘন্টার ঘুমের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ইকার্চ বিশ্বাস করেন যে যারা ঘুম সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে মানব দেহের একাধিকবার ঘুমাতে চাওয়ার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে অবজ্ঞা করা, এবং কৃত্রিম আলোর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি।
এর সাথে সম্পৃক্ত একটি অসুখ হচ্ছে "স্লিপ মেইনটেন্যান্স ইনসমনিয়া", যেটার কারণে মানুষ রাতের বেলায় না ঘুমিয়ে জেগে থাকে। এই রোগের উল্লেখ আমরা পাই ১৯ শতকের সাহিত্যে; ঠিক যখন থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় ঘুমের ব্যাপারটা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করে।
"মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় জুড়ে আমরা অন্যভাবে ঘুমিয়েছি", বলেন ঘুম মনস্তত্ববিদ গ্রেগ জ্যাকবঃ "রাতের মাঝখানে ঘুম ভেঙে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার"।
তিনি আরও বলেন যে আমাদেরকে "শুধুমাত্র একবারই, এবং একটানা ঘুমাতে হবে"—এ ধারণা খুবই ক্ষতিকারক। এর ফলে যাদের ঘুম ভেঙে যায়, তারা দুঃচিন্তায় ভোগেন, যার নানাবিধ কু-প্রভাব (এর মাঝে "না ঘুমাতে পারা" অন্যতম) তাদের স্বাস্থ্যের উপর পড়ে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাসেল ফস্টার মত প্রকাশ করেন "অনেকেই রাতের বেলায় ঘুম থেকে জেগে গিয়ে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েন। আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি; আমি তাদেরকে জানাই যে এটাই স্বাভাবিক"। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশিরভাগ ডাক্তারই এটা মেনে নিতে পারেন না যে আট ঘন্টা টানা ঘুমানোর ব্যাপারটাই আসলে অস্বাভাবিক।
তিনি জানান "শতকরা ৩০ ভাগ রোগের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে ঘুম সংক্রান্ত সমস্যা। কিন্তু বেশিরভাগ ডাক্তারী প্রশিক্ষণে ঘুমকে অবজ্ঞা করা হয়েছে, এবং খুব কম জায়গাতেই ঘুম নিয়ে গবেষণা চলছে"।
জ্যাকবের মতে, দুই ঘুমের মাঝে কেউ জেগে গেলে, বিশ্রাম নেয়া কিংবা জোর করে নিজেকে বিছানায় রাখার পরিবর্তে সেই সময়টাকে দুঃচিন্তা ও উদ্বেগ কমানোর জন্য কাজে লাগানো উচিত। ইকার্চের অনুসন্ধান থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে প্রাচীণ যুগের মানুষেরা প্রায়শয়ই এই সময়টা ধ্যান করে কাটাতেন, এবং ঘুমানোর সময় দেখা স্বপ্নগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতেন।
আমরা আজ এ ধরণের কাজে কম সময় দেই, এবং এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে আধুনিক সমাজে দুঃচিন্তা, উদ্বেগ, বিষন্নতা, মদ ও মাদকদ্রব্যের প্রতি নেশার প্রকোপ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।
সুতরাং, পরের বার যখন মাঝরাতে আপনার ঘুম ভেঙ্গে যাবে, তখন আপনি আপনার পূর্ব পুরুষদের কথা ভাবুন, এবং আরাম করুন। রাত জাগাও আপনার জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে।