জীবনানন্দের উপন্যাস ও তার জীবনের বিবাহ বহির্ভূত প্রেম
এত সরাসরি জীবনানন্দ দাশ আর কোনও উপন্যাসে নিজের জীবনের বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের কাহিনি লেখেননি।
তবে এমন একটা সময় উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে যখন পুরুষটির মনে পাপ নেই আর। নেই কামনা-আকাঙক্ষা-স্পৃহাও তেমন। প্রেমের দিন মৃদু হয়ে এসেছে জীবনে। প্রেম এখন অবসিত প্রায়। প্রেমের ব্যথাও।
বড়ো রাস্তার মোড়ে এসে যখন পুরুষটি নারীটির হাত ধরতে চাইল, নারীটি তার হাত এমন ভাবে ঘুচিয়ে দিল যেন পাপের হাত থেকে মুক্তি চাইছে।
অথচ পুরুষটির মনে আজ আর কোনও পাপ নেই। তিন বছর আগে হলে, দুই বছর আগে হলে, এক বছর আগে হলে এ বেদনা পুরুষটিকে সারারাত বিহ্বল করে রাখত।
১৯৩২-এ লেখা এই উপন্যাস, তিন বছর আগে, ১৯২৯-এ জীবনানন্দ দাশ এক 'হাওয়ার রাতে' বনের ধারে 'ক্যাম্পে' একজন নারীর সঙ্গে 'রোমশ উচ্ছ্বাস'--এ মেতে উঠেছিলেন তো! আজ তিনি বিবাহিত, তাঁর স্ত্রী 'দেশের বাড়ির কুঁড়েঘরে এই শীতে কত কষ্ট পাচ্ছে'। তবু প্রেম 'বড়ো কঠিন দেবতা'। নইলে এই মেয়েটিকে নিয়ে তার মনে প্রেম কেন দানা বাঁধছে আর নিজের স্ত্রীর প্রতি বাড়ছে অবহেলা!
নারীটি পুরুষটির হাত ঘুচিয়ে দিল লিখে তৃপ্ত হচ্ছেন না জীবনানন্দ।
আবারও লিখছেন:
'যে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সে, মেয়েটি তা অমন ক'রে ফিরিয়ে দিল'।
তারপরই লিখছেন:
এ রিলিজিয়ন। কীসের ধর্ম? প্রেম থকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ধর্ম। প্রেমের মধ্যে রয়েছে যে দেহের অভিলাষ তা থেকে মুক্তি পাওয়ার ধর্ম। শিবলিঙ্গের মতো বা শালগ্রামের মতো 'বিরাট অন্ধকার উদাসীনতা'র ধর্ম।
প্রশ্ন জাগে আপাত তুচ্ছ এই বিবাহ বহির্ভূত প্রেম নিয়ে এত কেন ভেবেছেন জীবনানন্দ।
প্রায় সারাটা জীবন ধরে ডায়েরিতে এই ধরনের প্রেমের ঠিকুজি-কুষ্ঠি তৈরি করছেন।
নিজেকেই নিজে প্রবোধ দিচ্ছেন, কবে নিজের বধূকে মমতা করবেন আর পরের নারীর প্রতি আসক্তি থাকবে না। এই ধরনের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন জীবনানন্দ। এখন তিনি 'বড়ো' হয়েছেন। কত জিনিসের অসার অকিঞ্চিৎকরতা বুঝতে শিখেছেন। উপযাচকের প্রবৃত্তি তাঁর মনের সীমানায় আর খেলছে না।
উপন্যাসের মেয়েটির ডেঙ্গু কী ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল একবার। সারারাত তার হাত-পা- গা অনন্তকাল টেপার ভিতর কালের অনস্তিত্বের পীড়াই বা কী, সেবাই বা কোথায়। খুব সচেতন ভাবেই নায়কের একে মনে হয়েছে 'অক্ষয় অমৃতলোকের সুধা' শুধু। আজ হয়তো মাথা ধরা আছে কিন্তু ফুরিয়ে গেছে সুধা বা 'সুধা খেতে চায় না তেমন'। কী সরাসরি ইঙ্গিত! আমরা হতবাক হয়ে যাই।
নিজের স্ত্রীর কাছে মিথ্যা বলে নায়ক কিন্তু মেয়েটির কাছে সত্য না বলে পারে না। নায়কের সিগারেট খাওয়া নিয়ে স্ত্রীর 'বিব্রত নিষেধ' আর মেয়েটির 'কড়া নিষেধ' সম্পর্কের কড়াপাক আর লঘুপাককে যেন বুঝিয়ে দেয়। এমনকি মেয়েটিকে তার মদ খাওয়ার কথা জানাতেও সঙ্কোচ হয় না। নিজেদের তারা 'একটা উড়ো-পাখির পাশে আরেকটা উড়ো-পাখি দুই মুহূর্তের জন্য এসে বসেছে' বলে মনে করে।
কী এমন ঘটে এমন প্রেমে যে শুধুমাত্র সেই মেয়েটিই জীবনের বরবর্ণিনী শুধু, পৃথিবীর আর কোনও নারীকেই প্রেমাস্পদা বলে চেনা হয়ে ওঠে না। আর সমস্ত সুন্দরীদের পায়ের নখের দিকে তাকিয়েই জীবন কেটে যায়। এই মেয়েটি তাকে প্রেম শিখিয়েছে, শিখিয়েছে সৌন্দর্য কী জিনিস। এরপরই একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন জীবনানন্দ। মেয়েটির কাছে নায়ক শিখেছে কবিতা সাহিত্য রসের একটা বাস্তব মানে।
জীবনানন্দ দাশের 'সমগ্র রচনা'-কে কেউ যদি বিশ্লেষণ করেন তো দেখবেন সারাজীবন ধরে এক দ্বন্দ্ব তার মধ্যে কাজ করেছে। সফলতা-নিষ্ফলতা, পাপ-পুণ্য, আলো- আঁধার সবসময় পাশাপাশি রয়েছে। নারীপ্রেমের সাগাকে কীভাবে দেশপ্রেমের সাগায় পৌঁছে দেওয়া যায় তার তিনি আভাস দিয়েছেন। কিন্তু তার ধাতে দেশপ্রেম ছিল না। বরং নারীপ্রেমের গোলকধাঁধায় আজীবন তিনি ঘুরে মরেছেন।
শেষরাতে স্বপ্ন দেখে জীবনানন্দর নায়ক। মেয়েটির খোঁপা নিয়ে খেলছে সে। গালে ঠোঁটে নাকে মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। আর তারপরই সেই সমবেদনার মুহূর্ত এল। ভালোবাসার চেয়ে ঢের গাঢ় বেদনা এই সমবেদনা। কামনাহীন কামানালোকের জগতে এবার পৌঁছে যাবে তারা। একটা কবরের ভেতর পাশাপাশি শুয়ে রবে তারা। একটা ধনাত্মক বিদ্যুৎ ও একটি ঋণাত্মক বিদ্যুৎ। অক্ষয় কালের জন্য।
পরকীয়ায় কোনও পরিণতি নেই জীবনানন্দ জানতেন। জানতেন দুটো তার জোড়া লাগলেই আলো জ্বলে উঠবে। তবু অনন্তকাল ধরে এই অন্ধকার কবরে পাশাপাশি শুয়ে থাকা। তাই তো একমাত্র জীবনানন্দই লিখতে পারেন:
এখনো নারীর মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।
১৯৩২- এ লেখা 'আমরা বেশ আছি' উপন্যাসটিকে ডায়েরির সূত্র ধরে আত্মজীবনী না বললেও বলা যায় স্মৃতিনির্ভর ও আত্মজৈবনিক। প্রায় ডায়েরির লাইন টুকে দিয়েছেন উপন্যাসে। ডায়েরিতে মেসের যে অভিবাসী উপন্যাসেও সেই অভিবাসী। স্ত্রী লাবণ্য বরিশালে আর প্রেমিকা শোভনা কলকাতার ডায়াশেসন কলেজ হস্টেলে থেকে পড়ছেন। ঘন ঘন জীবনানন্দ শোভনার সঙ্গে দেখা করতে হস্টেলে যাচ্ছেন। কখনও বরিশালের বাড়িতে ফিরছেন স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে।
এক সহবস্থানের খোঁজ করছিলেন আসলে জীবনানন্দ। তীব্র দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি চাইছিলেন। প্রেমিকা ও স্ত্রীর মাঝখানে নিজের অবস্থানটি নির্দিষ্ট করে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
পক্ষপাতিত্ব প্রেমিকার দিকে হলেও শেষে এমন এক উপসংহারে পৌঁছায়:
'জেগে উঠে সত্যেনের মনে হল, ও-রকম হবে এক দিন -- হবেই -- শেফালিকে নিয়ে -- হয়তো মাধুরীকে নিয়ে --দু'জনকে নিয়েই...'।
জীবনানন্দ দাশের লেখা যে আসলে অক্ষরের প্রাণাধর্ম তা বারবার আমরা দেখেছি। জীবনের জটিল অঙ্কগুলো তিনি লেখার মধ্য দিয়ে সমাধান করেছেন। আসলে জীবনানন্দ দাশের পাঠকও স্বয়ং জীবনানন্দ।