জীবনানন্দের বন্ধু শামসুদ্দীন আবুল কালামের বাড়ির সন্ধানে
ব্রজমোহন কলেজে জীবনানন্দ দাশের ছাত্র ও সুহৃদ, পরবর্তীকালে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালামের জন্ম বরিশালের পার্শ্ববর্তী জেলা ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার কামদেবপুর গ্রামে। নিজের জীবনীনির্ভর অগ্রন্থিত উপন্যাস 'ঈষদাভাস'-এ তিনি গ্রামটিকে 'কাহ্নবপুর' বলে উল্লেখ করেছেন।
লিখেছেন: 'কোথায় কোন ব্রহ্মপুত্রের ভেলায় ভেসে আমার মাতামহকুল সেই দেশাভ্যন্তরে কামদেবপুরে বা কাহ্নবপুরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন।' প্রসঙ্গত, নলছিটির নামটিও তিনি লিখেছেন 'নলসিঁড়ি'। 'নলসিঁড়ি' পরবর্তীকালে নলছিটি হয়েছে নাকি কামদেবপুরকে কাহ্নবপুর বলার মতোই তিনি নলছিটিকে 'নলসিঁড়ি' উল্লেখ করেছেন, সেই তর্ক আপাতত তুলে রাখা হলো।
তবে গ্রামে, অর্থাৎ কামদেবপুর বা কাহ্নবপুরে তিনি বেশিদিন থাকেননি। পড়াশোনার জন্য শৈশবেই চলে আসেন বরিশাল শহরে। পেছনে ফেলে আসেন প্রিয় গ্রাম। তার ভাষায়: 'সকল কিছু অস্বীকার করে নয়, বরং অগ্রাহ্য করে বরিশাল শহরের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। পথ ছিল না। পথ করে চলেছি।'
বরিশাল শহরে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেটি ছিল তার বাবার। বাড়িটার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: 'শহরের এক নিভৃত এলাকায় নতুন বাসা করেছেন বাবা। জাহাজঘাটের পর থেকে খালের পর খাল। পাশ দিয়ে লাল সুরকিঢালা পথে পথে সেই বাসায় পৌঁছেছিলাম। এই এখনকার বিচারেও তা এক তুলনাহীন ঠাঁই। মাটির ভিতের উপর চার চালের টিনের বাড়ি, একপাশে বৈঠকখানা, পেছনে কিছু গাছগাছালির বাগানের পর পুকুরঘাট। বৈঠকখানার একধারে জায়গীর থেকে স্কুল কলেজে পড়াশোনা করছে কয়েকজন ছাত্র।'
আরও লিখেছেন: 'গাঙ থেকে ভাটার খাল, সেই খাল প্রকাণ্ড সরকারি বাড়ি সার্কিট হাউজের পাশ দিয়ে বিরাট গেটওয়ালা জমিদারবাড়ি, ব্রাউন সাহেবের প্রাসাদ, জমিদার গোরাচাঁদ দাসের বাড়ি এবং বেশ কয়েকটি সুন্দর সুন্দর হিন্দুবাড়ির ঘাট বাড়িয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য দিকটা ঘুরে গিয়েছিল স্বদেশী যাত্রাগানের জন্য বিখ্যাত কবি মুকুন্দ দাসের কাশিপুর গ্রামের বাড়ির দিকে।'
শামসুদ্দীন জানাচ্ছেন, একটা বেশ স্রোতে ভরা ভরা খালের ধারেই একটা চৌচালা টিনের ঘরে এসে তিনি উঠেছিলেন। ঢেউ দেওয়া টিনের বাড়িই তখন ছেয়ে ফেলছে সকল মুলুক। শণ, খড়, কাঠের ঘরবাড়ি তখন উড়ে পড়ে গিয়েছে সবখান থেকে। শণের ঘর-ঘরামির পেশাও আর নেই। ভিত মাটিরই হোক, কিন্তু সেই টিনের চাল সাহেবি চলনেরই এক বড় উত্তরণ।
বাড়ির সন্ধানে...
বরিশাল শহরের গোরাচাঁদ দাস রোডের ঠিক কোন জায়গায় শামসুদদীনের বাড়ি ছিল বা কোন বাড়িটায় তিনি থাকতেন, সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কারণ তার সাথে এই শহরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে সম্ভবত চল্লিশের শেষ বা পঞ্চাশের দশকে। তাছাড়া তাকে এই শহরে দেখেছেন, এমন কাউকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে সেই বাড়ি কিংবা ভিটা চিহ্নিত করা কঠিন। স্থানীয়রাও নিশ্চিত নন।
আত্মজীবনীতে উল্লিখিত পথনকশা ধরে এগোলে দেখা যাবে, তিনি যে জমিদার বাড়ির কথা লিখেছেন, সেটি মূলত গোরাচাঁদ দাসেরই এবং বাড়িটা এখনও আছে। তবে জরাজীর্ণ। এটি এখন বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের কবি সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাস।
যেসব খালের কথা তিনি লিখেছেন, তার মধ্যে প্রধান খালটি একসময় বয়ে গিয়েছিলো এই গোরাচাঁদ দাস রোডের ভেতর দিয়ে, যেটির নাম ভাটার খাল। কীর্তনখোলা নদীর তীরে স্টিমার ঘাটের কাছ দিয়ে খালটি শহরের ভেতরে চলে গেছে। কিন্তু গোরাচাঁদ দাস রোডে এখন খালটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোথাও নর্দমার মতো এর ক্ষীণরেখা, কোথাও অস্তিত্বই নেই।
বরিশালের সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিজন স্বপন খন্দকার কৈশরের স্মৃতি হাতড়ে বলছেন, তারা আশির দশকেও গোরাচাঁদ দাস রোডের পাশে ভাটার খালের বিভিন্ন জায়গায় শানবাঁধানো ঘাট দেখেছেন। কিন্তু ঘাটলার উপরে ময়লা ফেলে ফেলে এগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী করা হয় এবং একপর্যায়ে খালটি ভরাট হয়ে যায় অথবা ভরাট করে ফেলা হয়। এখন অনেক জায়গায় খালের উপরেই ভবন উঠে গেছে।
বরিশাল শহরের কয়েকটি সড়ক দিয়েই গোরাচাঁদ দাস রোডে প্রবেশ করা যায়। তবে জিলা স্কুলের পাশ দিয়ে সদর রোডে ঢুকতেই শহীদ মিনারের উল্টো দিকে, অর্থাৎ পশ্চিম দিকে যে সরু রাস্তাটি ঢুকে গেছে, সেটি দিয়ে ঢুকলে প্রথমে ব্রাউন কম্পাউন্ডের একাংশ এবং এরপরে গোরাচাঁদ দাস রোড। সদর রোডের যে অংশে একসময় কাকলী সিনেমা হল ছিলো, তার পাশ দিয়েও একটি গলি ঢুকে গেছে গোরাচাঁদ দাস রোডে।
ব্রাউন্ড কম্পাউন্ড ও গোরাচাঁদ দাস রোড পাশাপাশি আবাসিক এলাকা। ছিমছাম, নিরিবিলি। নতুন আধুনিক ভবনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি একতলা দোতলা টিনের ঘরও চোখে পড়ে। কয়েকটি পুরনো বাড়িরও দেখা মিলবে। এরই কোনো একটি বাড়িতে শামসুদ্দীন আবুল কালাম থাকতেন কি না, তা হলফ করে বলা কঠিন। তবে সাংবাদিক স্বপন খন্দকার বিভিন্ন সূত্রে জেনেছেন, তিনি গোরাচাঁদ রোডের শ্যামবাবু লেনের কোনো একটি বাড়িতে থাকতেন। এই লেনে এখনও কয়েকটি পুরানো বাড়ি চোখে পড়ে। তবে ঠিক কোন বাড়িটায় বা লেনের ঠিক কোন অংশে তার বাড়ি ছিল, সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
শামসুদ্দীন বাড়িটার ভেতরের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা এরকম: 'বেশ বড় প্রশস্ত উঠানের এক ধারে খড়ের চালের রান্নাঘর, মাঝখানে বাস্তবিকই এক অপূর্ব স্বাদের সবরির (পেয়ারা) গাছ, একধারে আরও একটি উঠতি ছোট টিনের ঘর, তারপর হিজলে তেঁতুলে প্রায় ঢাকা এক পুকুরের ঘাট।' অর্থাৎ সব মিলিয়ে গ্রামেরই আবহ—যে গ্রাম ছেড়ে শামসুদ্দীন এসেছেন। তিনি ঠিক কবে পাকাপাকিভাবে বরিশাল ছেড়ে যান, তা সঠিক জানা যায় না। তাছাড় সেই বাড়িটি পরবর্তীকালে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল কি না, তাও জানা যায় না।
ব্রাউন সাহেবের যে প্রাসাদের কথা শামসুদ্দীন লিখেছেন, সেটিরও অস্তিত্ব নেই। কারণ ওই জায়গায় এখন গড়ে উঠেছে আরেকটি আধুনিক ভবন—নাম বীর উত্তম ভবন ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স। যেটি নির্মাণ করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমর বীরউত্তম।
শামসুদ্দীন আবুল কালামের জন্ম যে ১৯২৬ সালে, সেই একই বছর জন্ম প্রখ্যাত ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীর। তারও শৈশব কৈশরের একটি বড় অংশ কেটেছে এই বরিশাল শহরে এবং তিনিও থাকতেন এই ব্রাউন কম্পাউন্ড ও গোরাচাঁদ দাস রোড সংলগ্ন এলাকাতেই। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'বাঙালনামা'য় ব্রাউনদের সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায়—'একদিকে কীর্তনখোলা নদী, আর এক দিকে নদীর পাড় ধরেই মানুষের বসতি। তৃতীয় দিকে ব্রাউন সাহেবের বাড়ি এবং বাগান। ঔপনিবেশিক জগতের অলিখিত জাতিভেদ প্রধা অনুযায়ী ব্রাউন পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বা যাতায়াত ছিল না। শুনেছি ব্রাউনরা পর্তুগিজ বংশাবতংস ফিরিঙ্গি। কিছু পয়সা হওয়ায় ইংরাজি ব্রাউন নাম গ্রহণ করে (যা তাদের গাত্রবর্ণেরও সুষ্ঠু বর্ণনা) এবং নেটিভদের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ত্যাগ।'
শামসুদ্দীন প্রসঙ্গে:
শামসুদ্দীন আবুল কালামের 'কুসুমেষু' গ্রন্থে উল্লিখত তথ্য অনুযায়ী, তিনি বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৪১), ব্রজমোহন কলেজ থেকে আই.এ (১৯৪৩) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ (১৯৪৬) পাস করেন। এরপর তিনি এম.এ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও পাঠ অসমাপ্ত রেখে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন।
জাতীয় জ্ঞানকোষ 'বাংলাপিডিয়া'র তথ্য বলছে, শামসুদ্দীন কলেজ-জীবনে নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন এবং আরএসপি পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকায় এসে প্রথমে পূর্বপাকিস্তান সরকারের প্রচার ও তথ্য দপ্তরে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। পরে ওই অফিসেই 'মাহে নও' পত্রিকার সম্পাদক হন। ষাটের দশকে তিনি রোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট উপাধি এবং রোমের এক্সপেরিমেন্টাল সেন্টার অব সিনেমাটোগ্রাফি থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ক ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৫৯ সালের পর কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করে শেষে ইতালির রোমে স্থায়ী ভাবে অবস্থান করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
সত্তরের দশকে শামসুদ্দীন আবুল কালাম কর্মরত ছিলেন রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদর দপ্তরে এবং স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাসে। ইতালিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও ছিলো তার পদচারণা। ইতালিতে আসার আগেই পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হয় তার বেশ কয়েকটি উপন্যাস—যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'কাশবনের কন্যা' (১৯৫৪), দুই মহল (১৯৫৫), কাঞ্চনমালা (১৯৫৬), জীবন কা- (১৯৫৬), জাইজঙ্গল (১৯৭৮), মনের মতো স্থান (১৯৮৫), সমুদ্রবাসর (১৯৮৬), যার সঙ্গে যার (১৯৮৬), নবান্ন (১৯৮৭) ও কাঞ্চনগ্রাম (১৯৮৭)। ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্প সংগ্রহ 'অনেক দিনের আশা'। জীবনের শেষদিকে শামসুদ্দীন ইউনেস্কোর কিছু ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেন। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক ভিক্টর ডি সিফার সহযোগী ছিলেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৪ সালে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার' লাভ করেন।
জীবনানন্দের সঙ্গে:
শামসুদ্দীন তার শিক্ষক ও বন্ধুমহলে আবুল কালাম এবং শামসুদ্দীন—দুভাবেই পরিচিত ছিলেন। জন্ম ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসে। জীবনানন্দ দাশ যখন বরিশাল শহরে ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষকতা করেন, শামসুদ্দীন তখন এই কলেজের ছাত্রই শুধু নন, বরং জীবনানন্দের অত্যন্ত স্নেহভাজন ও বন্ধু। বয়সে জীবনানন্দের চেয়ে ২৭ বছরের ছোট হলেও শামসুদ্দীন তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন 'অতি শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও বন্ধু' হিসেবে (ঈষদাভাস, জয়তী, প্রকাশ ২০১৬, পৃষ্ঠা ৫২)। শামসুদ্দীন ব্রজমোহন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হন ১৯৪৬ সালে, অর্থাৎ এই কলেজে জীবনানন্দের শেষ বছরে। এরপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে চলে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে—যেখানে জীবনানন্দও পড়েছেন।
বরিশালে থাকাকালীন প্রিয় ছাত্র শামসুদদীনের বাসায় যে জীবনানন্দ এসেছেন, তা শামসুদ্দীন নিজেই জানিয়েছেন। কলকাতায় গিয়েও ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্পর্ক অটুট ছিল।
অরবিন্দ গুহ (জীবনানন্দ এবং আরো কয়েকজন, বিভাব, জীবনানন্দ জন্মশতবর্ষ সংখ্যা, ১৯৯৮) লিখেছেন, 'আমার ধারণা যে শামসুদ্দীনদা সে সময়ে বরিশালে জীবনানদের পয়লা নম্বরের ভক্ত ছিলেন।'
শামসুদ্দীন আবুল কালাম নিজেই লিখছেন (কবি জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে, উত্তরাধিকার, এপ্রিল-ডিসেম্বর ১৯৯৯), 'তিনি (জীবনানন্দ) আমার বরিশালের বাসায় এসেছেন অনেকদিন। আমাদের ছোট টিনের ঘরের দোতলায় ওকে সাহিত্যের আড্ডাতেও পেয়েছি। একদিন সেই আড্ডায় অচিন্ত্যকুমারকে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে পড়ছে। মনে তার কোনো ঘোরপ্যাঁচ বা সংকীর্ণতা ছিল না—সহজ সরল সাদাসিদে এবং নিরহংকার ছিলেন। আরো ছিলেন বিনয়ী।'
জীবনানন্দের সঙ্গে শামসুদদীনের একটি গল্প বেশ জনপ্রিয়। অরবিন্দ গুহর (প্রাগুক্ত) জবানিতে গল্পটি এরকম: 'পটুয়াখালির মুন্সেফ তখন অচিন্ত্যকুমার। লেখালেখির সূত্রে শামসুদ্দীনের সঙ্গে তার পরিচয়। নিজেই একদিন প্রস্তাব দিলেন তার বাড়িতে আসবেন। কথামতো এলেনও। অরবিন্দ গুহ তাকে রিকশায় করে শামসুদদীনের বাড়িতে নিয়ে আসছিলেন। পথিমধ্যে অচিন্ত্য সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ঠিক করলেন আগে জীবনানন্দের বাড়িতে যাবেন। তাই রিকশা ঘুরিয়ে বগুড়া রোডে জীবনানন্দের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। রিকশা সর্বানন্দ ভবনের সামনে এসে থামতেই অচিন্ত্য বাড়ির উঠোনে বসেই 'জীবন জীবন' বলে ডাকতে লাগলেন। জীবনানন্দ খালি গায়ে বেরিয়ে এসে দেখেন অচিন্ত্যকুমারকে। অনেকটা হকচকিয়ে গেলেন। একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অচিন্ত্য বললেন, তার সঙ্গে রিকশায় উঠতে। তারা দুজন এক রিকশায় এবং অরবিন্দ পেছন পেছন আরেকটি রিকশায়। রিকশা থামলো শামসুদদীনের বাড়ির সামনে।'
প্রসঙ্গত, বরিশাল শহরের বগুড়া রোডে জীবনানন্দের পৈত্রিক বাড়ি 'সর্বানন্দ ভবন' থেকে শামসুদ্দীন আবুল কালামের বাড়ির দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়।
দোতলায় খাটের উপরে সতরঞ্জি পেতে অতিথিদের জন্য বসার জায়গা করা হলো। চা-জল খাবারের পরে শামসুদদীনের রাখা এক প্যাকেট সিগারেট এগিয়ে দিয়ে জীবনানন্দ বললনে-নাও সিগারেট খাও। অচিন্ত্য ঘাড় নেড়ে জানালেন তিনি এসব ছেড়ে দিয়েছেন। জীবনানন্দ যেন এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বেশ আশ্চর্য হলেন। অনেকটা আকাশ থেকে পড়ার মতই জিজ্ঞেস করলেন-সিগারেট পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছ অচিন্ত্য? তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন: তুমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছ? সবকিছু ছেড়ে দিয়েছ? অচিন্ত্য কয়েকবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে একটি ঢাউস সাইজের মাসিক পত্রিকার পাতা উল্টাতে লাগলেন। তারপর উপস্থিত সবাইকে বেশ অবাক করে দিয়ে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে জীবনানন্দ নিজেই মুখে দিলেন। বললেন,'ঠিক আছে, তাহলে আমিই একটা খাই'। অনভ্যস্ত হাতে কোনোরকম দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরালেন অথবা কেউ ধরিয়ে দিলেন। বোঝাই যায়, সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত। লালায় ভিজে যাচ্ছে সিগারেট। আর এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করে নিজেই যেন কিছুটা অপ্রস্তুত। অচিন্ত্যর দিকে তাকিয়ে সেই একই প্রশ্ন করতে করতে তার সেই বহু পরিচিত গমকের হাসি হেসে, কিছুটা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে, অবশেষে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।
জীবনানন্দের এই হাসিমাখা পাগলাটে চেহারা জীবনে খুব বেশিবার উন্মোচিত হয়নি। কারণ, হাসির আবেগকে তিনি লুকিয়ে রাখতে চাইতেন। অনেক সময় নাকি দেখা যেতো যে, হাসির প্রসঙ্গটি উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, সেইকালে অকস্মাৎ বাঁধভাঙার মতো করে বেরিয়ে পড়ছে তার হাসি। তবে এমন হাসি তার খুব ঘনিষ্ঠজনেরা ছাড়া অন্যেরা দেখেনি।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (অন্তরঙ্গ জীবনানন্দ, ময়ূখ, পৌষ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১-৬২) লিখেছেন: 'চিরদিন যে সভা-সমিতিকে এড়িয়ে গেছে, তাকে সেদিন নিয়ে গিয়েছিলাম দলের মধ্যে, যতদূর মনে পড়ে প্রাণখোলা প্রচুর হাসি সে সেদিন ছড়িয়ে দিয়েছিল মুঠো মুঠো। যদিও, যতদূর জানি, সিগারেট খেত না, সেদিন কিসের আনন্দে ছেলেমানুষের মতো পাখির মতন ঠোঁটে টেনেছিল একটা সিগারেট।'
সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে জীবনানন্দের সঙ্গে শামসুদদীনের যোগাযোগ শিথীল হয়ে যায়। সম্ভবত তাদের মধ্যে আর দেখা হয়নি। শামসুদ্দীন জানাচ্ছেন, দেশভাগের অব্যাবহিত পরেই কলকাতার অর্থনৈতিক জীবনে যে আলোড়ন এসে পড়েছিল—তাতে করে বেশিদিন আর সম্পর্ক রাখা চললো না। ঢাকায় আসার পর আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।
১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে মারা যান জীবনানন্দ দাশ। তখন শামসুদ্দীন ঢাকায়। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমানসহ ঢাকার তরুণ কবি-সাহিত্যিকেরা একটি শোকসভার আয়োজন করেন। সেখানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন শামসুদ্দীন আবুল কালাম। তাতে তিনি বলেছিলেন: 'বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় প্রথম জীবনানন্দের কবিতা পড়েছিলাম। তারপর কলকাতায় কবিতার পুরনো সংখ্যাগুলো কেনার জন্য একদিন 'কবিতা ভবনে' যাই। তখন বুদ্ধদেববাবুই প্রথম তাঁর আশ্চর্য কবিত্বশক্তির কথা বারংবার উল্লেখ করেছিলেন। স্কুলে পড়ি তখন, ম্যাট্রিক দেব। সেই কালে আমরা দুই বন্ধু তাঁর অনুসরণে কবিতা লেখার প্রয়াস করেছিলাম।'
সৈয়দ আবুল মকসুদ (শামসুদ্দীন আবুল কালামের কথা, দৈনিক যুগান্তর, ১৩ নভেম্বর ২০১৫) জানাচ্ছেন, জীবনানন্দের স্মৃতিচারণ করে শামসুদ্দীন সেদিন আরও বলেছিলেন:
'তারপর তাঁকে প্রথম দেখি যখন আমরা আইএ ক্লাসের ছাত্র। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজি অধ্যাপক ছিলেন তিনি। শ্যাম রঙের স্বাস্থ্যবান মানুষ। চল্লিশোত্তর বয়স তখন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পাম্প-সু। কাঁধে পাট করে রাখা একখানা চাদর, হাতে একটি কি দুটি বই। মুখ তাঁর সর্বদা ভারি, গম্ভীর, চোখে আশ্চর্য সারল্য এবং তীক্ষ্ণতা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতেন। আমি আর আমার আর এক বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায় তাঁকে অবাক হয়ে দেখতাম। কখনও ক্লাসের অবকাশে মাঠের ধারে শুয়ে শুয়ে পড়তাম তাঁর কবিতা। তখনও পর্যন্ত তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'। কিছুদিন পরে 'কবিতা ভবন' থেকে 'এক পয়সায় একটি' কবিতা সিরিজে প্রকাশিত হল তাঁর 'বনলতা সেন'। আমাদের মধ্যে সেদিন রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। নতুন বয়সের অনভিজ্ঞ মনের কাছে 'ধূসর পা-ুলিপি' যে সাড়া জাগাতে পারেনি, 'বনলতা সেন' দ্বারা তা সম্ভব হয়েছিল। 'বনলতা সেন' কবিতাটি আমরা যত্রতত্র মুখে মুখে আবৃত্তি করে বেড়াতাম। কলেজের এক অনুষ্ঠানেও আবৃত্তি করলাম একদিন।'
ট্র্যাজেডির নায়ক:
শামসুদদীনের পুরো জীবনই ট্র্যাজেডিতে ভরা। শিক্ষক জীবনানন্দের চেয়ে যা মোটেও কম নয়। তিনি প্রথমে লিখতেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন নামে। কিন্তু আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদদীনের সঙ্গে নাম মিলে যাওয়ায় বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে তিনি নাম পরিবর্তন করেন। ডিভোর্স হয়ে গেলে তার স্ত্রী বিয়ে করেন অভিনেতা ও আবৃত্তিকার গোলাম মোস্তফাকে। দাম্পত্য জীবনের এই ট্র্যাজেডিতে শামসুদ্দীন প্রচণ্ড ব্যথা পান।
সৈয়দ আবুল মকসুদ (শামসুদ্দীন আবুল কালামের কথা, দৈনিক যুগান্তর, ২০ নভেম্বর ২০১৫) লিখেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শামসুদ্দীন স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্যারিসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শামসুদ্দীন ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী। কলকাতা থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। তার যে সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহ রয়েছে তা শেখ মুজিব জানতেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে যান, তখন শামসুদ্দীন রোম থেকে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। তাকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনি দেশে চলে আসেন। আপনাকে চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের পরিচালক নিয়োগ দেব।
বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে শামসুদ্দীন ঢাকায় এসেছিলেন। এক মাস প্রায় ছিলেন। লেখক সমাজ থেকে কোনো অভ্যর্থনা পাননি। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে প্রভাবশালীরা সরকারের আনুকূল্য পেতে ব্যস্ত ছিলেন। গণভবনে এবং ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে কয়েকদিন শামসুদ্দীন গিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকে কেউ দেখা করার ব্যবস্থা করে দেননি। চেনাজানা মানুষগুলোও যে তখন পাশে দাঁড়াননি, সে কথা তিনি ফজিলা রহমান নামে তার এক প্রিয় মানুষকে লেখা অনেক চিঠিতে (কুসুমেষু, ম্যাগনাম ওপাস, প্রকাশ ২০০৬) উল্লেখ করেছেন।
পারিবারিক ও পেশাগত নানারকম ট্র্যাজেডির কারণে ইতালির রাজধানী ইতালির রাজধানী রোমে প্রায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপশুরু করেন শামসুদ্দীন আবুল কালাম। লেখালেখিতেই বেশি সময় ব্যয় করতেন। এক অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতেন। নিজেই রান্নাবান্না করতন। জীবনের শেষটি ছিল আরও করুণ। একা ঘরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী হৃৎপিন্ডে অপরিমিত রক্ত সরবরাহ এবং কিডনির অসুস্থতাজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়। তবে তার মৃত্যুটি স্বাভাবিক ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
নির্জন অ্যাপার্টমেন্টে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তার মৃত্যু হয়। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ১০ জানুয়ারি। 'ঈষদাভাষ'-এর ভূমিকায় সৌমিত্র দেব লিখেছেন:
শামসুদ্দীন এই গ্রন্থে মৃত্যুর পূর্ববর্তী বছর, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। এ সময় তিনি সুস্থ ছিলেন না। মনের দিক থেকেও হয়ে পড়েছিলেন নিঃস্ব। আপনজন বলতে তার কাছে কেউ ছিল না। ইতালির নিঃসঙ্গ প্রবাসজীবনের যন্ত্রণা তাকে হতাশ্বাস করে ফেলেছিল। সেই দুর্বিসহ যন্ত্রণা তাকে আত্মজীবনীটিও লিখতে দেয়নি।
২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলানিউজের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, শামসুদ্দীন আবুল কালামের মরদেহ উদ্ধারের পর ডকুমেন্টে বা অন্য কোথাও ধর্মীয় পরিচয় না থাকায় এবং আত্মীয় বা নিকটজন কারো কোনো সন্ধান পুলিশ না পেয়ে 'বেওয়ারিশ' মরদেহ হিসেবে তাকে রোমের এক প্রান্তে 'প্রিমাপর্তা' এলাকায় জানাজা ছাড়াই খ্রিষ্টান গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। পাশেই মুসলিম গোরস্থান থাকলেও 'রক্ত-সম্পর্কীয়' নিকটজনের অনুমতি না পাওয়ায় সেখানে মরদেহ স্থানান্তর করা যায়নি। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালের ৩ এপ্রিল ইতালি থেকে ফজিলা রহমানকে এক চিঠিতে শামসুদ্দীন লিখেছিলেন: 'দেশ এবং তার মানুষ মহাশূন্যের বিবর্তন-আবর্তনে আরো দূরে সরে যাচ্ছে।'