ঢাকা ও কলেরার ভ্যাকসিন কাহিনী
১৯৬৩ সালে ঢাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান/সিয়াটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবেরেটরির অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের মতলব থানায় পূর্ণ কোষীয় কলেরা ভ্যাকসিনের মাঠ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ শুরু হয়। দুটো পরীক্ষাই কলেরার বিরুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু স্বল্পায়ু প্রতিরক্ষা তুলে ধরে। পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অতি মহামারি প্রবণ গ্রামীণ এলাকায় সুপ্ত পূর্ণ কোষীয় ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রথম বছর শেষে কলেরার বিরুদ্ধে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভেতর ৭০%এরও বেশি সুরক্ষার সৃষ্টি করে এবং পরবর্তী দুই বছরে সুরক্ষামূলক ফলপ্রসূতায় ক্রমাবনতি দেখা দেয়।
১৮৮৬ সালে মার্কিন কৃষি দপ্তরে কাজ করার সময় থিওবল্ড স্মিথ এবং তার ল্যাবরেটরি প্রধান ড্যানিয়েল সালমন তর্কসাপেক্ষে প্রথম বারের মতো শূকরের কলেরার সুপ্ত ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেন। উনিশ শতকের শেষদিকের বছরগুলোয় অণূজীববিজ্ঞান এবং সহযোগী রোগ প্রতিরোধ-বিদ্যার চোখ ধাঁধানো বিকাশের সাথে তাল মিলিয়ে উনিশ শতকের আদিম পয়ঃব্যবস্থা ও অনুন্নত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে বিস্তার লাভ করা প্রধান তিনটি মানবীয় দুর্ভোগ ও মৃত্যুর ব্যাক্টেরিয়া সম্পর্কিত কারণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সুপ্ত ভ্যাকসিনের বিকাশ ঘটে: কলেরা, টাইফয়েড এবং প্লেগ।
হিপ্পোক্রেটের প্রাচীন রচনা এবং শুশ্রত আয়ুর্বেদের সংস্কৃত ভাষ্যেও কলেরার মতো রোগের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে এই রোগের পৌনপুনিক প্রাদুর্ভাবের কথা বহু বছর ধরে লিখিত হয়ে এলেও ১৯১৭ সালের গোড়ার দিকেই কলেরাকে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী হুমকি হিসাবে শনাক্ত করা হয়। এশিয়ার এক বিশাল এলাকা, ইন্দোনেশিয় আর্কিপোলেগো, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগরীয় বেসিন, উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বহু এলাকাতেই রোগটি মৌসুমী মহামারি হয়ে টিকেছিল। ১৮২৯ সালে দ্বিতীয় প্রাদুর্ভাব দিয়ে শুরু হয়ে বিশ শতকের প্রথম দুটি দশকে ষষ্ঠটির ভেতর দিয়ে অবসান ঘটা পরবতী পাঁচটি কলেরা মহামারি ওই ১০০ বছরের প্রায় প্রতিটি দশকেই বিস্তৃত ছিল। ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ার আগে এশিয়ার বিরাট অংশকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল রোগটি। এইসব প্রাদুর্ভাব লাখো মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে। অবশ্য পঞ্চম ও ষষ্ঠ মহামারিতে গ্রেট ব্রিটেন ও উত্তর আমেরিকায় বেশ কম মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। এসব অঞ্চলে পয়ঃব্যবস্থা ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতিকে কারণ বলে অনুমান করা যায়। ১৯১১ সালের পর উত্তর আমেরিকায় কিংবা ১৯২৫ সালের পর ইউরোপে স্বীকৃত কোনও স্থানীয় রোগীর কথা জানা না গেলেও ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে হর বছরই কলেরা মহমারি লেগে ছিল।
১৯৬১ সালে সপ্তম এবং সর্বশেষ মহামারির ঘটনাটি ঘটে। ভিব্রিও কলেরা ০১, বায়ো টাইপ এল টোর ছিল এর কারণ। মূলত ১৯০৬ সালে মক্কায় হজ্জের সময় এল টোর কোয়ারেন্টিনে এই ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে ঢাকা ও কোলকাতায় ধ্রপদী কলেরা বায়ো টাইপের সাথে এল টোরের সহাবস্থান ছিল। এরপর এক বছরের ভেতর এইসব এলাকায় বার্ষিক ভিত্তিতে এটি মহামারিতে পরিণত হয়। পরবর্তী ৩০ বছরে এল টোর ধরনটি দুর্বল পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থার অস্তিত্ব আছে এমন প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রধান মহামারির কারণ হয়েছে। সাবসাহারান বহু দেশে এটি মহামারির মতো সংক্রমণে পরিণত হয়। বিশেষ করে ১৯৯৩ সালের গ্রীষ্মে পূর্ব কঙ্গোর গোমা শরণার্থী শিবিরে রোয়ান্ডান শরণার্থীদের ভেতর এর প্রাদুর্ভাব ছিল বিপর্যয়কর। এখানে এক সপ্তাহয় ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৯১ সালে লিমায় প্রথম এল টোর কলেরা দেখা দেয়, অতীতে দক্ষিণ আমেরিকায় এটি অশনাক্ত ছিল। পেরুতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর বিভিন্ন মাত্রার আক্রমণের ভেতর দিয়ে ১৯৯৩ সাল নাগাদ এটি পুরো দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে শতকের শেষ নাগাদ উধাও হয়ে যায়।
মহামারির পুরো ইতিহাস জুড়ে কলেরা যুগপৎ সাধারণ মানুষ এবং চিকিৎসা পেশার পক্ষে ভয়ঙ্কর রোগ ছিল। বিস্ফোরক ও অভাবনীয় ধরনে প্রাদুর্ভাব এবং চিকিৎসার অভাবে বিশাল সংখ্যক মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া মারাত্মক অসুস্থাতই ছিল এর বৈশিষ্ট্য। উনিশ শতকের গোড়ায় কলেরাকে 'অন্য রোগে যেখানে শেষ হয় সেখানেই মরণ দিয়ে শুরু' রোগ হিসাবে বর্ণনা করা হতো। মহামারির সময় সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছে।
১৮৩১ সালে ব্রিটিশ আইলসে কলেরা দেখা দেওয়ার পর আইরিশ চিকিৎসক উইলিয়াম ব্রুক ও'শ্যাগনেসি অন্ত্র দিয়ে বিপুল পরিমাণ তরল ও ইলেক্টোলাইট হ্রাসকে কলেরার মূল সমস্যা বলে উল্লেখ করেন। এর পরপরই এই ধারণার ভিত্তিতে স্কটিশ চিকিৎসক টমাস লাট্টা শিরার মাধ্যমে স্যালাইন প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসার বিষয়টি তুলে ধরেন। রাশিয়াতেও একই ধরনের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এমনি সুস্পষ্ট পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও কেউ কেউ সেসময়ের ব্যাপক প্রশংসিত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যান্সলেটে চিকিৎসা জগতের স্যালাইন-চিকিৎসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে মর্মে সংবাদ প্রকাশ করেন। বিশ শতকের প্রথম দুটি দশকের পরেই কেবল কোলকাতায় চালানো ফিল্ডওয়ার্কের মাধ্যমে জোরালোভাবে এর কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠিত হয়। তরলের অভাব পূরণে মৌখিক রিহাইড্রেশন থেরাপি ব্যাপকভাবে গৃহীত হতে আরও ৫০ বছর সময় লেগে গেছে। এদিকে, উনিশ শতকর জুড়ে বিশ্বব্যাপী বেশ কয়েকটি লাগাতার মহামারির ভেতর দিয়ে কলেরা মহামারি সুলভ ব্যাক্টেরিয়া বাহিত রোগগুলোর ভেতর সবচেয়ে কুখ্যাত ঘাতকের তকমা পেয়ে বিউবোনিক প্লেগকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
ভ্যাকসিন উদ্ভাবন
ভারতে শত শত বছর ধরে কলেরা মহামারির অস্তিত্ব থাকলেও এবং মহামারি এর প্রথম চক্র শেষ করলেও ১৮৪৯ সালেই কেবল দ্বিতীয় মহামারির শেষেদিকে স্যার জন স্নো প্রথম পানির মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটার কথা উল্লেখ করেন। স্নো তার ধ্রুপদী মহামারি সংক্রান্ত গবেষণায় পাম্পের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি এবং কলেরার ভেতর সম্পর্কে বের করেন। ১৮৫৪ সালে লন্ডনে মহামারি দেখা দিলে এই সংক্রমণের ভিত্তি নির্ধারণ করেছিলেন তিনি। স্নোর গবেষণা সন্দেহাতীভাবে কলেরার পানি বাহিত বিস্তার তুলে ধরলেও তিনি জ্যান্ত অণুজীবকেই এর জন্যে দায়ী শক্তি বলে রোগের জীবাণূ তত্ত্বের এক দশক আগেই যে প্রকল্প প্রস্তাব করেছিলেন সেটি সেভাবে গৃহীত হয়নি। পরে পাস্তুরের গবেষণার ভেতর দিয়ে এটি বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপক আনুকূল্য পায়।
স্নোর গবেষণা সম্পর্কে অনওয়াকিবহাল, কিন্তু একই সময়ে ইতালিয় অ্যানাটমিস্ট ফিলিপ্পো পাচিনি কলেরায় মৃত্যুবরণকারী এক লোকের অন্ত্রে ইংরেজি 'কমা' আকৃতির অণুজীব লক্ষ করেন। অন্য রোগে নিহত লোকদের ভেতর তিনি এই জিনিস দেখেননি। 'কমা বেসিলাস'ই কলেরার পেছনে দায়ী শক্তি বলে প্রস্তাব রাখেন তিনি। কিন্তু তার এই পর্যবেক্ষণ একটি গোপন ইতালিয় মেডিকেল সাময়িকীতে প্রকাশ করায় সেটি উনিশ শতকের শেষার্ধে উদীয়মান অণূজীববিজ্ঞান আবিষ্কারের প্রাণকেন্দ্র প্যারিস, বার্লিন এবং লন্ডনের বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকদের স্বীকৃতি পায়নি। পাচিনি 'কমা ব্যাসিলি'কে সজীব অণূজীব বলে উল্লেখ করে প্রস্তাব রাখলেও তা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করতে সক্ষম হননি।
জার্মান চিকিৎসক-বিজ্ঞানী রবার্ট কচ ১৮৭৬ সালে অ্যান্থ্রাক্সের কারণ হিসাবে ব্যাসিলাস অ্যান্থাক্স এবং ১৮৮২ সালে যক্ষ্মার কারণ মাইক্রোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস শনাক্ত করার সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি পান। এর পর্পরই কলেরা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। মূলত পাস্তুরের তত্ত্বতালাশের পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে মিশরে দেখা দেওয়া প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধানে জার্মান সরকারের অর্থপুষ্ট প্রকল্প হিসাবে শুরু হলেও শেষে এটি রোগের ব্যাক্টেরিয়া সংক্রান্ত কারণ শনাক্তের গবেষণায় পরিণত হয়। কলেরা রোগেীদের অন্ত্রে 'কমা'র মতো ভাইব্রোর উপস্থিতি তুলে ধরা সত্ত্বেও, যেমনটা ৩০ বছর আগেই ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পাচিনি করেছিলেন, কচের দল মিশরে থাকার সময় অণূজীব তৈরি করতে পারেননি। কলেরার আদি নিবাস কোলকাতায় চলে আসেন তিনি। এখানেই টাটকা উপকরণ ব্যবহার করে অণূজীব তৈরিতে সফল হন।
কচের এই আবিষ্কার ভ্যাকসিনের বিকাশ ত্বরান্বিত করে। ১৮৮৪ সালের মাঝামাঝি কাতালান প্রফেসর জেইমি ফারেন ই ক্লুয়া (১৮৫২-১৯২৯) মার্সেইয়ে কলেরা রোগীর শরীর থেকে নেওয়া অণুজীব কালচারের মাধ্যমে সক্রিয় ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন। স্পেনের ১৮৮৪ সালের মহামারির সময় তিনি ৩০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির শরীরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেছেন। কলেরার বিরুদ্ধে এই ভ্যাকসিনের উচ্চমাত্রার সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হলেও এর ব্যাপক প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ডাক্তারি পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়নি। ফেররান প্রথামিকভাবে কেবল তার নিজের এবং একজন সহকারীর শরীরে এটি প্রয়োগ করেন। তিনি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে সামান্য ব্যথা ও জ্বরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৮৫৪ সালে পাচানির উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সীমিত কৌতূহলের বিপরীতে ফেররানের কাজ অচিরেই বিশ্বব্যাপী আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস সাময়িকীতে অনুকূল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন ইউরোপিয় দেশের বৈজ্ঞানিক দল ফেররানের কাজ নিয়ে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে স্পেনে হাজির হয়। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল বিভিন্নমুখী। পাস্তুর ইন্সটিটিউটের একটি সুপ্রশংসিত দল ভ্যাকসিনের ফলপ্রসূতার ব্যাপারে নিরেট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় স্থানীয় পর্যায়ে প্রকট বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে। তাদের তথ্য অপরিবর্তনীয়ভাবে ভ্যাকসিনের খ্যাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাসত্ত্বেও এইসব আনাড়ী প্রয়াস ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষকে সক্ষম করে তোলার প্রথম প্রয়াসের কথা তুলে ধরে। সত্যি বলতে, পাস্তুরের আবিষ্কৃত সুপ্ত পশুর দেহের অ্যান্থ্রাক্সের ভ্যাকসিনই ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর হতে দেখা গেছে। ১৮৮১ সালে পৌলি-লে-ফোর্টে প্রথম এই টিকা প্রয়োগের দর্শনীয় প্রদর্শনী হয়।
১৮৯০ দশকের গোড়ার দিকে স্পেনের ঘটনা সত্ত্বেও পাস্তুর কলেরার কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার সম্ভব বলে বিশ্বাস ধরে রাখেন। তার প্রতিষ্ঠানের জনৈক নবাগত সদস্যকে এই ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ব্যাপক বিস্তৃত ইহুদি বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে এবং সিজারের রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে কিছু সময় কাটানো ইউক্রেনে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী ভালদেমার হাফকিন (১৮৬০-১৯৩০) ১৮৮৯ সালে প্যারিসে পাস্তুর ইন্সটিটিউটে তার গুরু এবং স্বদেশী ইলিয়া মেচনিকফের সাথে যোগ দিতে দেশ থেকে পালান। মেচনিকফই ইমিউনোলজির প্রতিষ্ঠাতা হয়ে দাঁড়াবেন। হাফকিন দুটো ভি. কলেরার ধরন ব্যবহার করে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজে হাত দেন। তার পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণ করা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ফেররানের পরীক্ষার তুলনায় কম মারাত্মক প্রমাণিত হয়।
বেশ কিছু 'রাজনৈতিক' ও ব্যক্তিগত কারণে হাফকিন কোলকাতায় প্রথম ব্যাপক ভিত্তিক অনিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা চালান। ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতে ৪০ হাজারেরও বেশি লোককে কলেরা রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন দেন। ভ্য্কাসিন প্রযুক্ত ও অপ্রযুক্তদের ভেতর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, পরিসংখ্যানগত দিক থেকে নিরেট তুলনার লক্ষ্যে ১৮৯৪ সালে সূচিত ভ্যাকসিনের পরীক্ষাটি কারাবন্দী, চা-বাগানের শ্রমিক এবং অন্যান্য সুসংজ্ঞায়িত জনগোষ্ঠীর ভেতর পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়। এই ভ্যাকসিনের মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও সংক্রমণের বিরুদ্ধে লক্ষণীয় সুরক্ষা দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ভারতে হাফকিনের কলেরা পরীক্ষাকে যৌক্তিকভাবেই মানবদেহে প্রথম নিয়ন্ত্রিত ভ্যাকসিন পরীক্ষা মনে করা হয়।
১৮৯৬ সালে বার্লিনে কচের ইন্সটিটিউট ফর ইনফেকশাস ডিসিজেস এর একজন সহকারী ভিলহেম কোল (১৮৬৮-১৯৩৫) একটি সামগ্রিক ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন। এটির উৎপাদন ও প্রমিতকরণ হাফকিনের ভ্যাকসিনের চেয়ে সহজতর ছিল। জাপানে ১৯০২ সালে কোলের ভ্যাকিসনের ব্যাপক ভিত্তিক প্রয়োগ করা হয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিত গবেষণায় একে ৮০%-র বেশি ফলপ্রসূ বলে উল্লেখ করা হয়। কৌতূহলোদ্দীপকভাবে, সক্রিয় ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে অনুকূল ফল সত্ত্বেও হাফকিন পরে কলেরা চিকিৎসায় তাপে সুপ্ত ভ্যাকসিন ব্যবহারেই সমর্থন দেন। সত্যি বলতে নিজস্ব ভ্যাকসিন উদ্ভাবন কাজেও সুপ্ত ভ্যাকসিন বেছে নেন। সেটা ছিল প্লেগের ভ্যাকসিন। কোলের সুপ্ত কলেরা ভ্যাকসিনের বিভিন্ন ধরনই বিশ্বজুড়ে মূল ভ্যাকসিন চিকিৎসা হিসাবে বজায় থাকে।
১৯২০ এবং ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি কলেরা মহামারি সুপ্ত অবস্থায় ছিল। এই সময় বিভিন্ন ধরনের সুপ্ত, পূর্ণ কোষীয় ভ্যাকসিন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। তবে নতুন কোনও কৌশল দেখা যায়নি। কার্যকারিতার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ডেটা না থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলেরা মহামারির বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনীর বেশিরভাগ সৈনিককে এই ধরনের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর ভেতর কলেরার অল্প কিছু প্রাদুর্ভাব দেখা গেলেও তার কৃতিত্ব পুরোপুরি ভ্যাকসিনেশনকে দেওয়া যাবে না। পয়ঃনিষ্কাষণ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি এবং এই সময় মহামারি জাতীয় রোগের অনুপস্থিতি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।
১৯৬০-র দশকের গোড়ার দিকে গাঙ্গেয় অববাহিকায় এল টোর ধরন এবং মারাত্মক মহামারির আবির্ভাবের ফলে ১৯৬৩ সালে ঢাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান/সিয়াটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবেরেটরির অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের মতলব থানায় এবং জাপান সরকারের বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় ম্যানিলায় সুপ্ত, পূর্ণ কোষীয় কলেরা ভ্যাকসিনের মাঠ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ শুরু হয়। দুটো পরীক্ষাই কলেরার বিরুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু স্বল্পায়ু প্রতিরক্ষা তুলে ধরে। পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অতি মহামারি প্রবণ গ্রামীণ এলাকায় সুপ্ত পূর্ণ কোষীয় ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রথম বছর শেষে কলেরার বিরুদ্ধে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভেতর ৭০%এরও বেশি সুরক্ষার সৃষ্টি করে এবং পরবর্তী দুই বছরে সুরক্ষামূলক ফলপ্রসূতায় ক্রমাবনতি দেখা দেয়। পঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সুরক্ষা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কম ছিল। প্রথম বছরে আনুমানিক ৩০% এবং পরের বছরগুলোয় তাৎপর্যহীন। ফিলিপিন্সে মাঠ পর্যায়ে দুই দশকের বেশি সময় ধরে কলেরার প্রাদুর্ভাবহীন এলাকায় ৫ লক্ষের বেশি লোকের ভেতর পরীক্ষা চালানো হয়। এতে দেখা যায় সামগ্রিক সুপ্ত পূর্ণ কোষীয় কলেরা ভ্যাকসিন এল টোর ধরনের প্রাদুর্ভাবের সময় স্বল্প মেয়াদে নিচু মাত্রার ২০% সুরক্ষা দিয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানে প্রাপ্ত ফল ৬০ বছর আগে ভারতে প্রয়োগ করা হাফকিনের সক্রিয় ভ্যাকসিন এবং জাপানে কোলের ব্যবহৃত তাপে সুপ্ত ভ্যাকসিনে প্রাপ্ত ফলের অনুরূপ ছিল। ভ্যাকসিন প্রযুক্ত রোগ প্রতিরোধ শক্তি প্রাপ্ত বয়স্কদের ভেতর সবচেয়ে বেশি এবং শিশুদের ক্ষেত্রে কম নির্ভরযোগ্য এবং স্বল্পায়ু। শত বছরেরও বেশি সময় পাকিস্তানে কলেরা অব্যাহত মহামারি ছিল বলেই ফিলিপিন্সের তুলনায় এই অঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্কদের ভেতর ভ্যাকসিন বেশি কার্যকর হয়েছে বলে মনে করা হয়েছে। এভাবে জনগণের ভেতর হয়তো কোনও ধরনের রোগ প্রতিরোধসূচক স্মৃতি তৈরি হয়েছে, কিন্তু ফিলিপিন্সে মহামারি ছিল বিক্ষিপ্ত এবং সেকারণে বেশির ভাগ মানুষই রোগ প্রতিরোধ শক্তিতে অক্ষম ছিল।
পরবর্তী চার দশকে কলেরা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন সম্ভাবনার অনুসন্ধান করা হয়েছে। সম্প্রতি সুপ্ত পূর্ণ কোষীয় ব্যাক্টেরিয়া কোষ এবং কলেরা এক্সেটোরেটক্সিনের বি-সাবইউনিট মিলিয়ে খাওয়ার ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের এক বিরাট আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে পরিচালিত দ্বিযোজী ভ্যাকসিনের মাঠ পর্যায়ের ব্যাপক পরীক্ষায় প্রাপ্ত বয়স্ক এবং শিশু, উভয় ক্ষেত্রেই অন্তত দুই বছরের জন্যে ৮৫%-এরও বেশি সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি লক্ষ করা গেছে। কেবল সুপ্ত ভ্যাকসিনের সাথে সম্পর্কিত সুরক্ষার তুলনায় এটা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি।
ব্যাক্টেরিয়াল প্যাথোজেন অর্থাৎ কলেরার বিরুদ্ধে মানুষকে সুরক্ষাদানের প্রথম প্রয়াসের এক শো বছরেরও বেশি সময় পরেও শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে বিশ্বস্ত ও দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ ক্ষমতা যোগানোর লক্ষ্যে আরও কার্যকর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন একাধারে এক বিরাট বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ এবং মানবীয় চাহিদা হয়ে আছে।
[ঈষৎ সংক্ষেপিত]
সূত্র: Killed Vaccines: Cholera, Typhoid, and Plague by Charles C. J. Carpenter and Richard B. Hornick