তাজমহল বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি!
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (১৭৭৪-১৮৩৯) নামটির সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচিত আপনি? ওই যে, ভারতের যে গভর্নর-জেনারেল রদ করেছিলেন সতীদাহ প্রথা, তার কথাই বলছি।
ভারতীয়দের চোখে লর্ড বেন্টিঙ্ক আজ সম্মানের আসনে আসীন বটে, কিন্তু তিনি সম্ভবত এমন এক পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িত, যার দরুণ তাকে অভিহিত করা যেতে পারে 'বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বোকা ব্যক্তি' হিসেবেও!
কেন বলছি এ কথা? শুনুন তাহলে।
১৮৩০-র দশকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নীলনকশা আঁকতে শুরু করে বিশ্বখ্যাত তাজমহলকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে এর মূল্যবান মার্বেল পাথর লন্ডনে বিক্রির। আর এই অবিশ্বাস্য নীলনকশার নেপথ্যের ব্যক্তিটিই নাকি লর্ড বেন্টিঙ্ক।
বহুদিন ধরেই অবশ্য অনেক স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ-শাসন ইতিহাসের এই বিশেষ অধ্যায়টিকে অস্বীকারের চেষ্টা করে এসেছেন। এবং বলাই বাহুল্য, ওই ইতিহাসবিদরা নিজেরাও সকলেই ব্রিটিশ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন স্যার পারসিভাল স্পিয়ার, আর্নেস্ট উডওয়ার্ড ও জন রসেল্লি।
তারা দাবি করেছেন, তাজমহল ভেঙে মার্বেল বিক্রির এই ব্যাপারটা নিছকই গুজব, এটিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার মতো কোনো তথ্য-প্রমাণই নেই। এমনকী তাজমহলকে ভাঙার ব্যাপারে কখনো কোনো প্রস্তাবও উত্থাপিত হয়নি।
এমন দাবির পেছনে যে বিষয়টিকে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো : প্রকৃতপক্ষেই যদি এমন কোনো পরিকল্পনা করা হতো, তাহলে সরকারি দলিল-দস্তাবেজে নিশ্চয়ই এ বিষয়ক কোনো না কোনো উল্লেখ পাওয়া যেত। যেহেতু তা যায়নি, তাই তারা বলেছেন, এগুলো সবই মিথ্যা প্রচারণা, লর্ড বেন্টিঙ্কের সম্মানহানির লক্ষ্যে।
তবে সরাসরি তথ্য-প্রমাণের বাইরে সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স বলেও কিন্তু একটা কথা আছে। সেই সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স ও সমসাময়িক বিভিন্ন তথ্যের আলোকে এটুকু নিঃসন্দেহে বলাই যায় : তাজমহল ভাঙা নিয়ে যে ধোঁয়া, তার আড়ালে কিছুটা হলেও আগুনের অস্তিত্ব অবশ্যই রয়েছে।
আর তাই আপনার কাছে যত অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয়ই মনে হোক না কেন, বর্তমান সময়ের কোনো কোনো ইতিহাসবিদ সত্যিই মনে করেন যে লর্ড বেন্টিঙ্ক তাজমহল ভেঙে এর মার্বেল পাথর বিক্রি করতে চেয়েছিলেন!
সেরকম একজন ইতিহাসবিদ হলেন কবিতা সিং। তিনি দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ইতিহাসের অধ্যাপক। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাজমহল ধ্বংস করতে চেয়েছিল কি না, তা নিশ্চিত হতে এর পারিপার্শ্বিক নানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলির উপর বিস্তর গবেষণা করেছেন তিনি। সেই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ফলাফল তিনি উপস্থাপন করেছেন ২০১৭ সালে মুম্বাই ও লন্ডনের বেশ কিছু পাবলিক লেকচারে।
ভারত ও যুক্তরাজ্য চষে বেড়িয়ে উদ্ঘাটিত তথ্যসমূহকে একত্র করে অধ্যাপক সিং দাবি করেছেন, ব্রিটিশ লেখকরা এত সহজেই আলোচ্য ঘটনাটিকে 'গল্প-আখ্যান' হিসেবে উড়িয়ে দিতে পারেন না।
তিনি যে ঘটনার উপর আলোকপাত করেন, সেটির সূচনা অবশ্যই আগ্রাতে। তবে তাজমহলে নয়, বরং আগ্রা দুর্গে।
আপনি যদি দিওয়ান-ই-খাসের চত্বরে প্রবেশ করেন, তাহলে 'কিছু একটার অভাব' অনুভব করতে শুরু করবেন। কেননা, একদিকে তাকিয়ে আপনি দেখতে পাবেন সমানভাবে চুনকাম করা দেয়াল; অথচ সেটির সঙ্গে দুইটি দরজা, যেগুলোকে দেখলে মনে হয় নির্মাণে কোথাও একটা খামতি বা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে।
এর পেছনে সঙ্গত কারণও রয়েছে। আপনার অসম্পূর্ণ মনে হওয়া ওই জায়গাটিতে একসময় অবস্থিত ছিল মার্বেলের তৈরি শাহী হাম্মাম বা মুঘল সম্রাটদের গোসলখানা। প্রথমে ওই গোসলখানাকেই ভেঙে মার্বেলগুলো বিক্রি হয়ে দেয়া হয়, তাজমহল ভাঙার 'টেস্ট রান' বা 'পাইলট প্রজেক্ট' হিসেবে।
১৮২৮ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক প্রথমে বাংলার, এবং ১৮৩৩ সালে সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের, গভর্নর-জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। গভর্নর-জেনারেল হিসেবে তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল বার্মায় যুদ্ধের ফলে ভুগতে থাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খরচ কমিয়ে অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থা ফিরিয়ে আনা।
১৮৩০ সালে একবার আগ্রা সফরকালে তিনি শাহী হাম্মাম দেখতে যান, এবং সেটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে নির্দেশ দেন যেন গোসলখানার পুরো অংশসহ আগ্রা দুর্গের অন্যান্য বিভিন্ন অংশ ভেঙে সেখানকার মার্বেল খুলে নেয়া হয়। তার উদ্দেশ্য ছিল ওইসব মার্বেল বিক্রি করে সরকার পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। এবং সেবার তার নির্দেশ যথাযথভাবেই পালিত হয়।
যেমনটি আগেই বলেছি, লর্ড বেন্টিঙ্কের মনোবাসনা ছিল শাহী হাম্মামের মার্বেল বিক্রির 'টেস্ট রান' সফল হলে, তিনি আরো বড় দাঁও মারবেন গোটা তাজমহল ভেঙে ফেলার মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আগ্রা দুর্গ থেকে সংগৃহীত মার্বেলগুলোকে নিলামে তোলা হলে, সেগুলো থেকে খুব বেশি দাম পাওয়া যায়নি।
এদিকে আগ্রা দুর্গে সংঘটিত ধ্বংসলীলার কথা জানাজানি হলে তীব্র প্রতিবাদ আসে স্বয়ং ভারতে বসবাসরত ব্রিটিশ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। তবে সেই প্রতিবাদের পেছনে যুক্তি ছিল বিবিধ।
যেমন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ লর্ড মার্কাস বেরেসফোর্ড তার 'জার্নাল অভ মাই লাইফ ইন ইন্ডিয়া'-তে লেখেন :
"দুর্গ হতে সংগৃহীত এসব মার্বেল আধুনিক বাসস্থান নির্মাণের ক্ষেত্রে একেবারেই উপযুক্ত নয়। এগুলো কেবল অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন মার্বেলের একটা বড় অংশই কিনেছে পেপারওয়েট নির্মাতারা। এছাড়া সাহেবদের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য অতি সামান্য জিনিস নির্মাণের কাজেও ব্যবহৃত হয়েছে মার্বেলগুলো। এদিকে লাল বেলেবাথর দিয়ে বানানো হয়েছে কারি স্টোন। আমি শুনেছি, যে পরিমাণ মার্বেল পাথর নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা থেকে নাকি পাঁচশো পাউন্ডও পাওয়া যায়নি। আমাদের তো বিশ্বাসই হয় না যে এমন একটি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তবে সেই নির্দেশের একটি কপি পাওয়া গেছে, এবং স্যার এইচ ফেইনের (ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ) কাছে সেটি রয়েছে। সেই কপিতে লেখা রয়েছে, তিনি (লর্ড বেন্টিঙ্ক) নাকি তাজমহল বিক্রিরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাজমহলের প্রকৃত মূল্য যা, নিলামে তারচেয়ে অনেক কম দর হাঁকানো হয়েছিল। এবং এভাবেই, ভালো দরের অভাব এমন অসাধারণ একটি স্থাপত্যকে একজন শাসকের লোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।"
লর্ড বেরেসফোর্ডই একমাত্র বিশিষ্ট ইংরেজ নন যিনি তাজমহলের বিক্রি-প্রস্তাব সম্পর্কে লিখেছেন। ব্রিটিশ প্রশাসনিক স্যার উইলিয়াম স্লিম্যান, যিনি বাংলায় ঠগী নিধনের নায়ক, তার আত্মজীবনী 'র্যাম্বলস অ্যান্ড রিকালেকশনস অভ অ্যান ইন্ডিয়ান অফিসিয়াল' বইয়ে আগ্রা দুর্গ থেকে মার্বেল পাচার প্রসঙ্গে একই ধরনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
তিনি লিখেছেন, "যদি এগুলো (আগ্রা দুর্গের মার্বেল) থেকে আশানুরূপ দাম পাওয়া যেত, তাহলে সম্ভাবনা ছিল যে গোটা দুর্গটিই, এমনকী তাজমহলও, ভেঙে ফেলা হতো, এবং একইভাবে বিক্রি করে দেয়া হতো।"
বিষয়টি মোটেই এমন নয় যে হুট করে 'কথার কথা' হিসেবে তাজমহল বিক্রির কথা উল্লেখ করেছেন লর্ড বেরেসফোর্ড বা স্যার স্লিম্যান। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা যায় ফ্যানি পার্কসের সফরনামায়। পার্কস ছিলেন একজন ওয়েলশ পর্যটক ও লেখক, যিনি তার ভারত ভ্রমণ সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। ১৮৫০ সালে প্রকাশিত হয় তার বই 'ওয়েন্ডারিংস অভ আ পিলগ্রিম ইন সার্চ অভ দ্য পিকচারেস্ক'। সেখানে তিনি কলকাতা ভিত্তিক ব্রিটিশ সংবাদপত্র 'জন বুল' (যেটি পরে পরিণত হয় 'দ্য স্টেটসম্যান'-এ) থেকে একটি আর্টিকেলের অংশবিশেষ তুলে ধরেন।
১৮৩১ সালের ২৬ জুলাই প্রকাশিত সেই আর্টিকেলে লেখা হয়েছিল :
"তাজমহলও বিক্রির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে! কিন্তু এর জন্য আকাঙ্ক্ষিত অর্থ পাওয়া যায়নি। তবে, এর জন্য দুই লাখের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গুঞ্জন উঠেছে যে তাজমহল ভেঙে ফেলা হলে নেটিভরা বিক্ষোভ শুরু করবে।"
অন্যান্য ব্রিটিশদের মতো ফ্যানি পার্কসও চটে যান তাজমহল ভাঙার খবরে। তিনি লেখেন :
"কোন অধিকার বলে গভর্নর-জেনারেল তাজমহল বিক্রির প্রস্তাব দেন? তার কি কোনো অধিকার আছে এভাবে মৃতের সম্মানহানির? কীভাবে তিনি একটি সমাধিসৌধকে বিক্রির কথা চিন্তা করেন, যেটি একজন সম্রাজ্ঞীর নামে গড়ে উঠেছে, এবং যেটির সৌন্দর্য গোটা বিশ্বেরই এক পরম আশ্চর্য? এটি অসম্ভব ব্যাপার যে কিছু মার্বেল ও রত্নের জন্য কোর্ট অভ ডিরেক্টরস তাজমহল বিক্রির অনুমোদন দেবে। এ-ও বলা হচ্ছে যে এক হিন্দু নাকি চেয়েছেন তাজমহল কিনে এর মার্বেলগুলো নিয়ে যেতে, যেন তিনি বৃন্দাবনে তাদের নিজেদের দেবীর মন্দির নির্মাণ করতে পারেন!"
তাজমহল ক্রয়ে ইচ্ছুক যে হিন্দুর কথা এখানে বলা হচ্ছে, তিনি হলেন মথুরার শেঠ লক্ষ্মীচাঁদ জৈন (১৮১০-১৮৬৬), উত্তর ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যাঙ্কারদের একজন। জয়পুরের মালপুরায় আদিনিবাস ছিল তার। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন ভারতীয় মহারাজাদের একজন ব্যাঙ্কার, এবং লন্ডনের পত্রিকা 'দ্য টাইমস' তাকে দেয় 'দ্য রথসচাইল্ড অভ ইন্ডিয়া' খেতাব।
১৮৩১ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার তাজমহলকে বিক্রির জন্য নিলামে তোলে, তখন শেঠ লক্ষ্মীচাঁদই সর্বোচ্চ দুই লাখ দর হাঁকেন। কিন্তু খুব কম দাম ওঠায় এই নিলামকে বাতিল করা হয়। তাই কয়েক মাস পর যখন আরেক নিলামের আয়োজন করা হয়, সেখানেও সাত লাখ দর হেঁকে বিজয়ী হন শেঠ লক্ষ্মীচাঁদই। কিন্তু ততদিনে একদিকে ভারতে বসবাসরত ব্রিটিশ সম্প্রদায় ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায় তাজমহল।
এ বিষয়ে আরো জানা যায় বিনয় কুমার জৈনের 'মথুরা শেঠ' বই থেকে। উল্লেখ্য, তিনি উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন আইন-প্রণেতা ও শেঠ লক্ষ্মীচাঁদের বংশধর। ২০০৫ সালেও তাজমহলের প্রস্তাবিত বিক্রির ব্যাপারে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন উত্তর প্রদেশের ওয়াকফ বোর্ড তাজমহলের মালিকানা দাবি করলে তাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়া (এএসআই)। তখন এএসআই সুপ্রিম কোর্টে তাজমহলের ইতিহাস সম্বলিত একটি হলফনামা পেশ করে। সেই হলফনামাতেও তাজমহল ভাঙা ও বিক্রির কথা উল্লেখ ছিল।
কিন্তু তারপরও, এখনো নিশ্চয়ই ভারত ও লন্ডনে কাগজের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে অমূল্য সব নথি, যেগুলো প্রকাশ্যে এলে তাজমহল বিক্রির ইতিহাস সম্পর্কে সকলের ধারণা আরো পরিষ্কার হবে।
প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাজমহল দেখতে যায়। কিন্তু এমনই তার রূপবৈচিত্র্য যে হাজারবার দেখার পরও ফুরোয় না সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের তৃষ্ণা। অথচ এই তাজমহলকেই নাকি একদিন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল সামান্য কিছু অর্থের লোভে!
যুগে যুগে এভাবেই জাগতিক লালসা কিংবা বস্তুগত স্বার্থের বিষ বাষ্প এসে বিলীন করে দেয় পৃথিবীর বুকে সদম্ভে দাঁড়িয়ে থাকা অপার্থিব সৌন্দর্যের নানা আধারকে। নইলে মানবসভ্যতার আরো কত নিদর্শনই আজো টিকে থাকত আপন কালকে জয় করে। আর তাদের রূপসুধা পানের সুযোগ পেলে মানবজাতিও নিশ্চয়ই কিছুটা আত্মিক পুষ্টি লাভ করত, তাই না?