পেঁয়াজকে ঘিরে কিংবদন্তী
প্রাগাধুনিক রন্ধন ঐতিহ্যে পেঁয়াজ মর্যাদার সাথেই আসীন: মোগল সাম্রাজ্যে, দোপিঁয়াজা (দু'টো পেঁয়াজ একসাথে থাকাকেই ফার্সিতে বলে দোপিঁয়াজা) নামে হায়দ্রাবাদ অঞ্চলের এক আঞ্চলিক খাবারের থালি বা ডিশ আছে, বলা হয়ে থাকে যে মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) রাজ দরকারের অন্যতম অমাত্য মুল্লাহ দো পিঁয়াজা (কেমন দৈব সাদৃশ্য, তাই না?) এই রন্ধন শৈলীর প্রদর্শক। মুল্লাহ দোপিঁয়াজার এই চরিত্রটি বাস্তব নাকি কাল্পনিক সে বিষয়ে আলো-আঁধারির দ্বন্দ থাকলেও এটুকু বলা যায় যে নানা লোকগল্পের এই কৌতুকময় চরিত্রটি অনেকসময়ই তাঁর বুদ্ধির জোরে খোদ সম্রাট ও বাকি অমাত্যদের বোকা বানিয়ে ছাড়তেন। দোপিঁয়াজা বানাতে মাংস, আদা ও রসুন দেবার আগে প্রথমে ফালি করা কিছু পেঁয়াজ অন্যান্য নানা মশলায় মাখিয়ে ভাজতে হবে। তারপর মাংস, আদা ও রসুন ছেড়ে দিয়ে পুরো পদটি রান্না হয়ে গেলে আরো খানিকটা ফালি ফালি করে কাটা, মশলাসিক্ত ভাজা পেঁয়াজ ছেড়ে দিতে হবে যেন পুরু ও ঘন আস্তরণের মত দেখায়। এজন্যই এর নাম 'দু'বার পেঁয়াজ' বা 'দো পিঁয়াজা।'
আজ সারা বিশ্বেই 'কারি' বলতে ভারতীয় তরকারির আদলে (যদিও খাঁটি ভারতীয় রান্না অনেক সময়ই নয়) রান্না করা মাংস বা সব্জির তরকারি যা কিনা মশলাদার ঝোলে প্রস্তত- সাধারণত: এতে সূক্ষভাবে কাটা প্রচুর পেঁয়াজ এবং রসুন দেয়া হয়ে থাকে এবং রান্নার পাত্রে ঢেলে দেবার আগে অনেক মশলা ও আদা পিষে একটি তরল দ্রবণের মত তৈরি করা হয়।
পরবর্তী সময়ে বৃটিশ যেখানেই গেছে, সেখানেই এই ভারতীয় রান্না ছাড়িয়ে দিয়েছে এবং আজ আর এতে অবাক হবার কিছু নেই যে এই সব রান্নায় এমন অনেক সব্জি ব্যবহৃত হয় যা বৃটেনে সবসময় পাওয়া যায় এবং প্রত্যেকেই খায়। প্রতিটি স্থানীয় ভারতীয় টেকএ্যাওয়েতে তাই ভুনা, ঝাল ফ্রাই, রসুন মিশ্রিত খাবার মার্কিনী খদ্দেরারও খাচ্ছে।
তবে সব বৈধ ভারতীয় খাবারেই যে পেঁয়াজ বা রসুনের উপস্থিতি রয়েছে এমনটা নয়। বরং উল্টো। আয়ূর্বেদে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী যে ঔষধ ব্যবস্থার কথা সেই সহস্রাব্দ আগেই বলা হয়েছে, সেখানে বলা হচ্ছে যে পুরোহিত বা বৈশ্য (বণিক) সম্প্রদায় যেন পেঁয়াজ বা রসুন না খায়! কারণ পেঁয়াজ ও রসুন আবেগ ও ক্রোধ বাড়ায় যা ধ্যানের জন্য ক্ষতিকর। তবে পেঁয়াজ বা রসুনের ওষধি মূল্য ছিল: নপুংসকত্বের সমস্যা হলে বা অন্য কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যায় একটি রসুন খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায় বলে মনে করা হতো।
ভারতে 'স্বামী নারায়ন' নামে একটি সম্প্রদায়ের মানুষেরা পেঁয়াজ বা রসুন কোনটাই খায় না। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ 'বচনামৃত'তে পেঁয়াজ বা রসুন খাওয়া নিষেধ বলেই এমন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কাশ্মিরী পন্ডিতরাও পেঁয়াজ খায় না। পৃথিবীর অন্যতম পুরণো ধর্ম জৈন মতবাদেও (৩,০০০ বছর পুরনো) পেঁয়াজ বা রসুন খাওয়া নিষেধ। অবশ্য হিন্দু ধর্মের মত পেঁয়াজ বা রসুন খেলে আহারকারীর ক্ষতি হবার আশঙ্কায় নয়, বরং পেঁয়াজ বা রসুন মাটি থেকে তোলার সময় অনেক ছোট ছোট অণুজীবের ক্ষতি হবে বলে তারা পেঁয়াজ-রসুন খায় না। 'অহিংসা' নীতিতে বিশ্বাসী সব জৈনই নিরামিশাষী। শেকড় সুদ্ধ সব্জিগুলোকে 'অনন্তকায়' বলে তারা মনে করে যার শেকড়ে কিনা বহু ছোট ছোট পোকামাকড়, কীট-পতঙ্গ বা অনুজীব রয়েছে বলে তারা মনে করে। এমন সব্জি শেকড় সুদ্ধ উপড়াতে গেলে ছোট ছোট এই প্রাণগুলোরও যে নাশ হবে!
তবে ভারতীয় নানা খাবারে পেঁয়াজ অনেক বেশি ব্যবহার করা হয় তার রোগ প্রতিষেধক গুণের জন্য। ইউরোপে প্রাগাধুনিক যুগ পর্যন্ত খাবার ছিল মূলত: ওষধি গুণে ভরপুর। মধ্যযুগের মতই। যেহেতু তখনো পর্যন্ত মানুষের রসবোধ ছিল প্রবল। ১৬৯৯ সালে প্রকাশিত 'এ্যাসেটারিয়া'য় একথা ঘুরে-ফিরে এসেছে: সালাদে আমরা পেঁয়াজ ব্যবহার করি যা রসুনের মত গরম নয় তবে সেদ্ধ পেঁয়াজ খাবারের রুচি বাড়ায়, কফ কমায়, পাকস্থলীর হজম ক্ষমতা বাড়ায় এবং হাঁপানী কাটায়: তবে বেশি খেলে মাথা ও চোখের ক্ষতি করে।
গ্রিক পুরাণে এ্যাপোলোর মা ল্যাটোনা পেঁয়াজ পছন্দ করেন। পেঁয়াজকে আদি ও মধ্য যুগে মনে করা হতো ফুসফুস ও পাকস্থলীর জন্য উপকারী।
পূর্ব ইউরোপে পেঁয়াজের আচার মৃগী রোগের জন্য ভাল দাওয়্ইা হিসেবে পরিচিত ছিল। আরো পূবে গেলে রাশিয়ায় রয়েছে পৃথিবীর ভেতর সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ প্রভাবিত শিল্প। ষোড়শ শতকে ইভান দ্য টেরিবলের সময়ে পেঁয়াজাকৃতি গম্বুজ নির্মিত হয়। উনিশ শতক অবধি রাশিয়ায় প্রায় প্রতিটি চার্চের আকৃতি ছিল পেঁয়াজের মত। মস্কোর সেন্ট বাসিল ক্যাথেড্রালে এমন গম্বুজ দেখা যায়। তবে দক্ষিণ জার্মানী, অস্ট্রিয়া এবং চেক প্রজাতন্ত্রে আর ভারত ও ইরানে মুঘল স্থাপত্যেও পেঁয়াজের আকারের গম্বুজ আছে।
কিংবদন্তী ও যাদু
মাশরুম বা ব্যঙের ছাতার স্বাদ বাড়াতে একটি পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে সেদ্ধ করতে বলা হয়। যদি পেঁয়াজটি সেদ্ধ করার পরও সাদা থাকে, তবে পেঁয়াজটি ভাল। কিন্ত পেঁয়াজটি কাল বা নীল হয়ে গেলে বিপজ্জনক। টেকো মাথায় পেঁয়াজের রস দিলে নাকি চুল গজায়।
আয়ারল্যান্ডে শীত বা কফ পেলে পেঁয়াজের পুলটিস ব্যবহার করা হতো। বুকে যেন ঠান্ডা না বসে সেজন্য মোজায় বুনো রসুন গুঁজে রাখা হতো। এর বৈজ্ঞানীক কারণও ছিল: পেঁয়াজের ঝাঁজ আসে তার ভেতরের এক ধরণের রাসায়নিক উপাদান এলিসিনের জন্য যা ত্বকের ভেতর দিয়ে হজম হয়। স্বপ্নে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর দৃশ্য দেখলে সেটা গার্হস্থ্য সমস্যা বা অসুখের ইঙ্গিত। তবে পেঁয়াজ খাওয়ার স্বপ্ন দেখলে সেটা শুভ।
বৃটেনে সতেরো শতকে কক্ষের কোন থালায় পচা পেঁয়াজ রাখলে সেটা রোগীকে দেখতে আসা ব্যক্তিদের অসুস্থতা সংক্রমিত করবে না বলে মনে করা হতো। এই ঐতিহ্য চলেছে উনিশ শতক অবধি। আবার বৃটেনে ঘরের বাইরে পেঁয়াজ পুঁতে রাখলে কোন জ্বর আসবে না বলে মনে করা হতো। মন্দ আবহাওয়ার পূর্বাভাস বুঝতেও পেঁয়াজ কাজে লাগতো। একটি ঐতিহ্যবাহী বৃটিশ ছড়ায় বলা হচ্ছে:
পেঁয়াজের খোসা খুব পাতলা
শীত আসছে হাল্কা-পল্কা,
পেঁয়াজের খোসা পুরু ও গাঢ়
শীত আসছে পুরু, জমকালো।
এছাড়াও মাদার বাঞ্চের সৌভাগ্য বয়ানের বই 'ক্লোসেট নিউলি ব্রুক' (১৬৮৫)-এ বলা হয়েছে: 'একটি পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে বালিশের নিচে একটি পাতলা রুমালের উপর রেখে এই ছড়াটি পড়ুন:
শুভ সন্ত টমাস, আমার মঙ্গল করো
আমাকে পাঠাও আজ খাঁটি প্রেম
যেন তাকে পারি দেখতে
আর দু'বাহুতে জড়াতে।
'এই ছড়া পড়ার পর যাকে স্বপ্নে দেখবে সেই হবে তোমার বর- বইটিতে বলা হয়েছে।
পেঁয়াজের গন্ধে যদি ঘুম না ভাঙ্গে, তবে ম্যাজিক ৮-বলের আগের দিন হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই নিজের ভাগ্য গণনা করা যায়। ১৮৭১ সালেও ২০ ডিসেম্বর বা সন্ত টমাস দিবসের আগের দিন একটি বড় লাল পেঁয়াজে নয়টি কাঁটা ফুটিয়ে ঠিক মাঝের কাঁটায় যে ছেলেটিকে বিয়ে করার ইচ্ছা তার নাম লিখে ঐ ছড়াটির দীর্ঘতর সংস্করণ আবৃত্তি করলে রাতে তাকে স্বপ্নে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করা হতো।
এই হলো যুগে যুগে পেঁয়াজকে ঘিরে যত কিংবদন্তী।