প্রাণীকুল, তারাও আছেন
[প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথরের গায়ে এঁকে রাখা চিত্রকর্ম থেকে মানুষের সঙ্গে প্রাণীর সম্পর্কের ইতিহাস জানা যায়। মানুষের সঙ্গে পশুপাখির সহাবস্থানের ইতিহাস বহু কালের। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সৃষ্টি সংক্রান্ত যত লোক কথা, ছড়া, মিথ-- তার বিশ্লেষণে যে স্বর্ণযুগের সন্ধান পাওয়া য়ায়, সেখানে দেবতা, প্রাণীকুল মানুষের বসবাস একসঙ্গে, এক কাতারে। তারা এক ভাষায় কথা বলত।
প্রাচীন মানুষ বা শিকারী মানুষের সেই শিকারী সমাজও যথেচ্ছ প্রাণী হত্যা করেনি আজকের মতো। সে তার যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই সংগ্রহ করেছে। অকারণ প্রাণী হত্যা তখনও মানুষের স্বভাবে ঢোকেনি। পরিবেশ ধ্বংসের খেলাও না।
একসময় মানুষের আচরণেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, মানুষ প্রাণীর প্রতি অনুরাগী হল, কৃষিকাজের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু জানোয়ারও তার জীবন যাপনের নিত্যসঙ্গীতে পরিণত হল। পশু পালনের সূচনা হল তখন থেকেই।
তারপরও মানুষ ও প্রাণীর মধ্যকার সম্পর্ক বিচার করা সহজ নয়। সমাজে পশুপাখির প্রভাব নানাভাবে, নানা স্তরে। সে আছে আমাদের শিল্পে-সাহিত্যে, ধর্মে, চলচ্চিত্রে, লোক কথায়। আছে গবেষণায়। মানুষ প্রাণী নিয়ে গবেষণা করছে, তাকে বোঝার চেষ্টা করছে নিয়ত, নিজের মতো করেই। আর পশুপাখিতে মানুষ আলোড়িত হয় কখনও ভালোবাসায়, কখনও ভীতিতে, কখনও নিষ্ঠুরতায়-- তাই এই সময়ে এসেও মানুষ ও পশুপাখির সঙ্গে সম্পর্ক এখন জটিল, কিন্তু তারা আছে আমাদের সহযাত্রী হয়েও, তাদের বাদ দিয়ে মানুষও টিকে থাকতে পারবে না, এই সত্যটাই বোঝা জরুরি...]
প্রবাদ-প্রবচন-ছড়া-লোককথার প্রাণী ভুবন
ভারতীয় পরিসংখ্যান ইন্সটিউট, কলকাতার দুই গবেষক ড:নীলাদ্রি সরকার দাশ ও অর্পিতা রায় ২০১৪ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সময়কালীন ভাষা বিষয়ক এক গবেষণা প্রবন্ধে লোকায়ত বাংলার নানা প্রবাদ-প্রবচন-ছড়া-লোককথা বা রূপকথায় বিভিন্ন প্রাণি বা পশু-পাখির ব্যবহৃত অসংখ্য নাম নিয়ে এক চমকপ্রদ অবলোকন করেছেন। 'ইনভেস্টিগেটিং দ্য নেচার অফ ইউজ অফ এ্যানিম্যাল নেমস ইন বেঙ্গলী রিটেন টেক্সটস' নামের এই ইংরেজি নিবন্ধের শুরুতেই সারাংশ কথনে দুই গবেষক জানিয়ে দেন যে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে বাঙ্গালী নর-নারী কিভাবে হাজার বছর ধরে অপর কোন নর বা নারীকে নানা প্রাণির নামে ডেকেছে। আর একাজে গবেষকদ্বয় বিশ হাজার বাংলা বাক্যের একটি ডাটা বেইজ তৈরি করেছেন যে বাক্যগুলোয় অন্তত: একটি করে প্রাণির নাম আছে। এই বিশ হাজার বাক্য আবার আধুনিক বাংলা গদ্যে মোট একশটি বিচিত্র প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত দশ লক্ষ বাক্যের এক বিপুল সম্ভার থেকে চয়িত হয়েছে। ঠিক কোন্ মনস্তাত্বিক প্রেক্ষিত থেকে বা ঠিক কোন্ মানসিক অবস্থা থেকে এক জন নারী বা পুরুষ অপর এক নারী বা পুরুষকে কোন 'প্রাণি'র নাম ধরে ডাকছে তা' এই গবেষণায় বিধৃত হয়েছে। এছাড়াও বাঙালীর জীবন যাপন, সংস্কৃতি, প্রথা, অভ্যাস, বিশ্বাস ও নানা আচার-অনুষ্ঠানও এই গবেষণায় উঠে আসে। এছাড়াও ভাষায় নিহিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের আন্ত:ক্রিড়াও এই গবেষণায় সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বাংলার বিশেষ ভৌগোলিক-জলবায়ুগত কাঠামো কিভাবে আমাদের ভাষিক ভাবনা ও ভাষা ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই দিকটিও।
শুধু বাংলাতেই নয়, পৃথিবীর সব ভাষাতেই এক মানুষ অপর কাউকে প্রায়ই কোনো পশু বা প্রাণির সাথে তুলনা করছে। কখনো সেটা সেই ব্যক্তিকে 'ছোট' করতে আবার কখনো 'বড়' করতেও। 'গাধার মত ছাত্র' বললে যেমন একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্র বা ছাত্রীকে বোঝায়, ঠিক একইভাবে কারো বিষয়ে যখন বলা হয় যে 'ও ত' ঘোড়ার মত দৌড়ায়', তখন কিন্ত তাকে প্রশংসাই করা হয়। ভয়ানক রেগে গিয়ে কাউকে 'কুকুর' বললে সেটা যেমন প্রচন্ড অপমান আবার সেই একই ব্যক্তিকে 'কুকুরের মত ঘ্রাণশক্তিসম্পন্ন' বলা কিন্ত প্রশংসা। 'কাকের মত গলা' বললে অমধুর গলার কাউকে যেমন বোঝায়, একইভাবে 'কোকিলকণ্ঠী' বললে মিষ্টি গলার কাউকে বোঝায়। আবার 'কাক হয়ে ময়ূর পুচ্ছ পরিধান' বলতে আমরা কারো নিজস্বতা বাদ দিয়ে অপরকে নিষ্ফল অনুকরণকে বোঝানো হয়ে থাকে।
'শৃগালের মত চতুর' বা 'হরিণীর মত ভীতা' বলতে দুই ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গ মনে পড়ে। 'অপণা মাঁসে হরিণা বৈরী' হয়েছিল বা নারীর নিজের রূপই তার বড়শত্রু এমন অবলোকন হাজার বছর আগেই করে গেছেন বৌদ্ধ সহজিয়া কবিরা।
সংসার সেই বিষম জায়গা যেখানে 'নিতি নব শিয়ালা সিংহ সনে যোঝে' বলে দু:খ করেছেন এই নাথপন্থী কবিরা। সান্ধ্যভাষায় লেখা তাঁদের কবিতায় 'দোয়ানো দুধ পুনরায় গাভির বাঁটে প্রবেশ করে।' সেখানে এক শবরী বালিকা উঁচু পাহাড়ে বাস করে- 'উঁচা পাহাড়েতে বসতি করিছে শবরী নামেতে বালা/ময়ূরের পাখ করি পরিধান/গলেতে গুঞ্জর মালা।' শবরীর সেই রাজ্যে 'কায়া তরু' বা 'দেহ বৃক্ষ' কেমন রূপ লাভ করে? 'কায়া তরু নানা ভাবে মুকুলিল/ডাল গগনের কোণে/একেলা শবরী এ বন বিহারে/কুন্ডলাদি ধরি কাণে।'
আবার এই ত' ১৮৯৯ সালে জন্ম নেয়া কবি নজরুলের গানে 'যার শিখী পাখা গোপণে মোরে কবিতা লেখায়/ সে রহে কোথায় হায়?' বলা হচ্ছে। ময়ূর-ময়ূরী বাংলা গান ও কবিতায় সদা উজ্জ্বল ও উপস্থিত। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও 'হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে' বা 'ময়ূরের মত কলাপ মেলিয়া/তার আনন্দ বেড়ায় খেলিয়া' থেকে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া আধুনিক বাংলা গানে 'হতাম যদি তোতা পাখি তোমায় গান শোনাতাম/হতাম যদি বন ময়ূরী, তোমায় নাচ দেখাতাম' বলে নায়িকার উচ্ছাস ব্যক্ত করা হয়।
মধ্য যুগের বাংলা কবিতায় শুক-সারির বাদানুবাদে শুক কানু ও সারি রাধিকার পক্ষে ওকালতি করে। শুক বলে 'কানু'ই উত্তম আর সারি বলে 'রাধিকা।' এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে 'পরমাত্মা' ও 'জীবাত্মা' বিষয়ক আলাপ। আমাদের বাংলা গানে 'বউ কথা কও পাখি'র কথা আসে অহরহ। আসে 'ঘুঘু ডাকা' দুপুরের কথা। এক শালিক হলে বিষাদ আর দুই শালিকে আনন্দ ত' সারা পৃথিবীতেই ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় পরিব্যপ্ত। স্কটিশ কবির লিরিকসে 'ইলকা পাখি' তরুণ বাঙ্গালী কবি রবির অনুবাদে হয়ে যায় 'পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায়।'
আবার বাংলা ব্যকরণে কে আমরা সমাস মুখস্থ করতে গিয়ে 'পুরুষ সিংহের ন্যায়' যিনি তিনিই 'পুরুষ সিংহ' পড়িনি? একইভাবে 'শশকের মত ব্যস্ত' যে সে হয় 'শশকব্যস্ত।' নদীবেষ্টিত ও মাছভোজী বাঙালী 'মাছের মায়ের পুত্রশোক' বলে টিপ্পনী কাটতে ছাড়ে না। 'কুম্ভীরাশ্রু' বা 'কুমীরের কান্না' বলতে কপট শোককে বোঝায়।
একদিকে বাংলার গৃহী মানুষ আজীবন যেমন সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির-বাউলকে সম্মান করেছে, আবার 'ভন্ড' সাধুকে ঠাট্টা করে 'বিড়াল তপস্বী' ডাকতেও সে কখনো কুণ্ঠা বোধ করেনি। রবীন্দ্রনাথের 'গল্পগুচ্ছে'র একটি গল্পে এমনি এক সাধুর ভেক নেয়া কপট ব্যক্তিকে ঠাট্টা করে পড়শিরা বলে, 'উনি ত' পরম হংস নন- উনি পরম বক।' নদীতে মাছের শিকারে মুখিয়ে থাকা ও এক ঠ্যাংয়ে খাড়া বক পাখিকে সঙ্গত কারণেই শুভ্র ডানা থেকে কাদা ঝেড়ে ফেলা 'পরম হংসে'র সম্মান দিতে বাঙ্গালী রাজি হয়নি।
শামসুর রাহমানের নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা কবিতায় 'বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মত কেঁদে ওঠে' আর আল মাহমুদ নারীর হৃদয় সন্ধানী পুরুষকে বোঝাতে বলেন 'নিষাদ কি কখনো পক্ষিনীর গোত্র ভুল করে?' সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর এক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে কিভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় প্রাচীন কাব্যগুলোর ধারাবাহিকতায় সংস্কৃত কাব্যেও নারী বা অভিশপ্ত রাজকুমারী প্রায়শ:ই 'হংসী'র রূপ বা ছদ্মবেশ নিত। আজো বলশয় ব্যালের নানা নাটিকায় নায়িকাকে যেমন প্রায়ই 'হংসী' রূপকল্পে দেখা যায়। ইউরোপে ছিপছিপে শ্বেতকায়া নারীকে যেমন 'হংসী' হিসেবে প্রায়ই ভাবা হয়েছে সেখানকার লোককাব্যে বা নানা ব্যালাডে, ভারতে স্তেপ থেকে হাজার হাজার বছর আগে শ্বেতকায়রা এসে থাকলেও কালপ্রবাহে দ্রাবিড় সহ ভেড্ডিড বা আদি-অস্ট্রোলয়েড নানা জনগোষ্ঠির সাথে ক্রমাগত মিশ্রণে দক্ষিণ এশিয়ার নারী যখন এক গড় তামাটে রং ও ছিপছিপে দেহের বদলে খানিকটা গুরু দেহের অধিকারী হয়ে উঠেছে, তখন 'পদ্মিনী', 'চিত্রিনী' বা 'শঙ্খিনী'র পাশাপাশি নারী হয়ে উঠেছে 'হস্তিনী'ও। খোদ মকবুল ফিদা হুসেন যখন সেলুলয়েডে রং-তুলি বোলান, তখন মাধুরী দীক্ষিতকে তিনি 'গজগামিনী' হিসেবেই দেখতে চান।
কালিদাসের 'মেঘদূত'-এ সুন্দরী যক্ষপ্রিয়া দেহভারে খানিকটা মন্থরগামিনী। সে ঠিক ইউরোপীয় ব্যালাডের বা 'সোয়ান লেকে'র হংসীরূপা নারী নয়। নয় শৈশবে পড়া মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে রুশ রূপকথা 'মহান সম্রাট জার সালতানের কাহিনী' যেখানে জারপুত্র রাজকুমার গভিদনের প্রেমিকা হংসীর রূপে বৈকাল হ্রদের পাশে পায়চারিরত রাজকুমারকে দেখে কুশল জিজ্ঞাসা করে। মঙ্গলাচরণের অবিশ্বাস্য সুন্দর অনুবাদ এখনো মুখস্থ আওড়াতে পারি, 'মরালী কয়, 'হে অপরূপ রাজা! নমস্কার!/নীরব কেন? মনে কেন বাদল অন্ধকার?' পরে অবশ্য বুদ্ধিদীপ্ত মরালীর বুদ্ধিতেই খল কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রে স্ত্রী-পুত্র থেকে ছিন্ন রাজা সালতান তার পুত্র গভিদনকে ফিরে পান। সালতানের স্ত্রী মানবশিশু গভিদনকে প্রসব করলেও স্ত্রীর আপন দুই বোন যারা রাজার প্রাসাদে রাঁধুনী ও তাঁত বোনার কাজ করতো, তারা গভিদনকে ভাসিয়ে দিয়েছিল সমুদ্রে একটি পেঁটরায় পুরে ও গভিদন সমুদ্রের অপর তীরে এক নতুন ভূখন্ডে পেঁটরা সহ আছড়ে পড়ে। পেঁটরার ভেতরেই দ্রুত বড় হয়ে যাওয়া গভিদন পরে পেঁটরা থেকে বের হয়ে শিকার করার সময় এক বাজপাখির হাত থেকে বিপন্ন একটি মরালীকে উদ্ধার করে। এই মরালীই পিতা-পুত্রের মিলন ঘটায়, গভিদনের মায়ের কুচক্রী দুই বোনের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে এবং নিজেও মরালী রূপ ঝেড়ে অনিন্দ্য রূপসী এক মানবীর রূপ নিলে, আনন্দে আত্মহারা জার সালতান গভিদনকে পুত্রবধূসহ বরণ করে নেন।
এই গল্পটি একদম হুবহু দক্ষিণারঞ্জনের 'ঠাকুর মা'র ঝুলি'র 'অরুন-বরুন-কিরণমালা' গল্পটির মত লাগছে না? ছদ্মবেশী রাজা প্রজাদের দু:খ-কষ্ট শুনতে বের হয়ে এক সাধারণ গৃহস্থবাড়ির তিন বোনের অভিলাষ শুনতে পান। বড় দুই বোন রাজবাড়ির সাধারণ ভৃত্যস্থানীয়দের সাথে বিয়ের আকাঙ্খা ব্যক্ত করলেও ছোট বোন খোদ রাজাকেই বিয়ে করতে চায়। বড় দুই বোন হাসিতে ভেঙ্গে পড়লেও পরদিনই অকৃতদার রাজা তিন বোনেরই ইচ্ছা পূরণ করেন। হিংসুটে দুই বড় বোন পরপর তিন বারই আঁতুড়ঘরে ছোট বোনের বড় ছেলে প্রসবের পর 'কুকুর ছানা', মেজ ছেলে প্রসবের পর 'বিড়াল ছানা' ও মেয়েটি প্রসবের পর 'কাঠের পুতুল' হয়েছে বলে রাজাকে সংবাদ দিলে 'ডাইনী' সন্দেহে রাণীকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। তিন ভাই-বোনকেই অবশ্য এক সাধারণ গৃহস্থ দম্পতি পর পর তিন বছর ধরে নদীতীরে তিনটি পেঁটরা থেকে উদ্ধার করে। তারপর সেই অরুন-বরুন-কিরণমালার রুদ্ধশ্বাস মায়াপাহাড় যাত্রা, মায়াপাহাড় থেকে একটি টিয়া পাখিকে বাসায় নিয়ে আসা, রাজাকে খেতে নিমন্ত্রণ করার পর 'মোতির লাড্ডু' কি হীরের পায়েস খেতে না পারা রাজা যখন বলেন যে 'মানুষ কি এসব খেতে পারে?', তখন টিয়া পাখি বলে যে 'মানুষের পেটে কি কুকুর ছানা, বিড়াল ছানা বা কাঠের পুতুল হয়?' নদীর তীরে তিন ভাই-বোনের মা এক কুঁড়ে ঘরে বড় দু:খে মরমর হয়ে আছে বলেও জানায় এই টিয়া পাখি। অনুতপ্ত রাজা ফিরিয়ে আনেন তাঁর স্ত্রীকে।
শুধু কি টিয়াপাখি? বাংলার রূপকথায় কখনো ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী আর কখনো শুক-সারি হয়ে উঠছে রাজকুমার বা রাজকুমারীদের বিপদে বুদ্ধি ও মন্ত্রণাদাতা। 'শুক বসন্ত' গল্পে রাজকুমার বসন্ত দুই শুক-সারিকে বলছে, 'শুক-সারি মেসো-মাসী! কি বল্বি বল? আমি আনিব গজমোতি- সোনার কমল!' 'শুক বসন্ত' গল্পের সেই অলৌকিক সব সুন্দর ও ভয়ঙ্কর দৃশ্যাবলীর কথাই ভাবা যাক! এক রাজার এক সুয়োরানী সতীনের দুই ছেলে শুক ও বসন্তের রক্তে অবগাহন করবেন বলে জল্লাদের হাতে দুই সতীনপুত্রকে দিয়ে বনে পাঠালো। বেচারা জল্লাদ দু'টো শেয়াল-কুকুর হত্যা করে সেই রক্ত এনে দিল নৃশংস রানীকে। শীত ও বসন্ত পথে পথে ঘুরতে থাকে। তবে সুয়োরানীর পাপ তার নিজ পুত্রদের অক্ষত রাখে না। এক দেশের এক রূপবতী রাজকন্যা স্বয়ংবরে 'গজমোতি' আর 'সোনার কমল' না পেলে স্বয়ংবর করবে না। এই অভিলাষ তার মনে রোপন করে এক টিয়াপাখি। এই টিয়াপাখি আসলে রাজকুমারীর হবু শাশুড়ি বা শুক-বসন্তের মা দুয়োরানী নিজেই। রাজকুমার বসন্ত 'মুনীর কোঙর' হিসেবে বনে বনে ছেঁড়া চীবর পরিধানে আর ত্রিশুল হাতে ঘুরতে থাকলেও 'ক্ষীর সাগরে' ঝাঁপ দিয়ে গজমোতি আর সোনার কমল পায়। শুধু কি তাই? বালু হয়ে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষীর সাগরে তিনটি সোনার মাছও পাওয়া যায় যারা আসলে শীত-বসন্তের তিন বৈমাত্রেয় ভাই। রাজকুমার বসন্ত রাজা শীতের হেঁসেলে মাছ তিনটি দিলে, মাছ কূটতে গিয়ে চমকে ওঠে দাসী। মাছেরা দিব্যি মানুষের ভাষায় বলে, 'কেটো না, কেটো না মাসী- রাজা শীত আমাদের ভাই! গজমোতি যিনি আনিয়াছেন সেই রাজকুমার বসন্ত আমাদের ভাই!' তারা মানুষের রূপ ফিরে পায়। আর টিয়া পাখিকে স্নান করাতে গেলে রূপবতী রাজকুমারী ভুলে টিয়া পাখির মাথায় গুঁজে দেয়া কোন কালো যাদুর বড়ি ঘসে ফেললে পাখিটি আবার দুয়োরানীর রূপ ফিরে পায়। জানা গেল সে রাজকুমার বসন্তের মা বা রূপবতী রাজকুমারীর হবু শাশুড়ি। উদাহরণ দিতে গেলে ফুরোবে না।
শুধু কি প্রাণী বা পশু-পাখি? 'সাত ভাই চম্পা ও এক বোন পারুল' গল্পে হেঁসেলের ছাই-পাঁশে পুঁতে ফেলা সাত রাজপুত্র এক চম্পা ও এক রাজকুমারী পারুলের রূপে ফুটে ওঠে। 'বুদ্ধু ভুতুম' গল্পে যে দুই রানীকে বঞ্চিত করে অন্য পাঁচ রানী সন্তান সম্ভাবনার উদ্দেশ্যে এক সন্ন্যাসীর দেয়া গাছের শেকড় বাটা প্রায় সবটা খেয়ে ফ্যালে, তাদের কোলে পাঁচ মানব সন্তান জন্ম নিলেও শেকড় বাটা বঞ্চিত দুই রানীর কোলে জন্ম নেয় এক বানর আর এক পেঁচা। তবে কালক্রমে এই দুই ভাইই অন্য 'মানব রাজকুমার'দের হারিয়ে দিয়ে অধিকতর কৃতিত্ব ও সুনাম লাভ করে। জানা যায় তারা আসলে ছদ্মবেশী 'মানবপুত্র।' পরিবারে বা সমাজে অনেক সময় 'সুযোগ বঞ্চিত' ও আপাত:দৃষ্টে 'কুরূপ' হিসেবে বেড়ে ওঠা কেউ কেউ কখনো যে চারিত্রিক সততা ও বুদ্ধিমত্তা, সাহস সহ নানা গুণে একসময় যোগ্যতায় ছাড়িয়ে যায় 'সুবিধা প্রাপ্ত' বা 'রূপবান-রূপবতী'দের, এই রূপকথা তারও একটি প্রতিফলন হতে পারে।
আজ থেকে প্রায় চার দশক আগেই ক্রাড্ডিক ও মিলার (১৯৭০) পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার রূপকথায় প্রাণী বা পশু-পাখির রূপক ব্যবহারের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। এর কয়েক বছর পরই ফ্রেসার (১৯৭৯) মানবজাতির নানা ভাষায় পশু-পাখির প্রতীক ব্যবহারের বিষয়টি ব্যখ্যা করার চেষ্টা করেন। হোয়েলি এবং আন্তোনেল্লি (১৯৮৩) সালে দেখিয়েছেন যে কিভাবে ইতালীয় ভাষায় নারীকে প্রায়ই বিভিন্ন 'পাখি' বা 'পশু' হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়- উপস্থাপিত করা হয় সেই ভাষার নানা লোকগল্প, প্রবাদ বাক্য বা ধাঁধাঁয়। একইভাবে নেসির (১৯৯৫) গবেষণায় মধ্যযুগের ইংরেজি নানা সাহিত্যিক ও অসাহিত্যিক লেখা-পত্রেও প্রাণীভুবনের বিষয়টি কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা' দেখিয়েছেন। হসেইহে এবং লিয়েন (২০০৪) তাঁদের এক গবেষণায় ম্যান্ডারিন চৈনিক ও জার্মান ভাষায় দুই ভাষিক জনগোষ্ঠির ভাষাগত ভিন্নতার কারণেই এই দুই ভাষার লোকগল্পে পশু-পাখির কথা বা মানুষের সাথে সম্বন্ধ ভিন্ন ভিন্ন আলোকে ধরা পড়ার বিষয়টি ব্যখ্যা করেছেন। ব্যখ্যা করেছেন কিভাবে তৃণ-লতা বা গাছপালার পৃথিবীটি দুই ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন চেহারা পায়।
আবার সাম্প্রতিক আর এক গবেষণায় হালুপকা-রেসেটার ও রাদিক (২০০৩) দেখিয়েছেন যে কিভাবে সার্বিয়ার ভাষায় বিভিন্ন প্রাণির নামে মানুষকে ডাকা হয়। পৃথিবীর নানা দেশেই বিশেষত: পাখির নামে মেয়েদের নাম ত' হরদমই হয়ে থাকে। সে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হোক আর বাংলার কোন মেয়ের নাম 'তোতা' বা 'টিয়া' কি 'কোয়েল' বা 'দোয়েল' কি 'ময়ূরী', 'মুনিয়া' বা 'পাপিয়া', 'কেকা' বা 'কুহু' (কুহু অবশ্য কোন পাখি নয়- কেকার ডাক) যাই হোক। বাচ্চাদের আদর করে 'খরগোশ,' অলস ব্যক্তিকে রেগে গিয়ে 'কচ্ছপ' ডাকা রোজকার ঘটনা।
আবার ফার্নান্দেজ এবং ক্যাটালান (২০০৩) ইংরেজি ও স্প্যানীশ ভাষায় বিভিন্ন পশু-পাখির নামের প্রতীকী ভাবের কেমন অবমূল্যায়ণ ঘটে সেটা দেখিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে তারা গ্রেট বৃটেন, আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা ও কানাডা থেকে পঁয়তাল্লিশজন ইংরেজি মাতৃভাষা এমন ব্যক্তির সাথে কথা বলেছেন।
নীলাদ্রি এবং অর্পিতা তাঁদের গবেষণায় আরো জানান যে বাংলা ভাষার হাজার হাজার বাক্যে বিভিন্ন পশু-পাখির নাম নানা সময়ে নানা কৌতুক, ক্রোধ, অপছন্দ, প্রশংসা, অপমান, তোষণ এবং শ্রদ্ধা বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, নিচের বহুল প্রচলিত বাক্য বা প্রবাদগুলো লক্ষ্য করুন:
১) হাতি-ঘোড়া গেল তল, ভেড়া বলে কত জল!
২) শকুনের অভিশাপে গরু মরে না,
৩) সেই রাজার আমলে বাঘে-গরুতে তাঁর নামে এক ঘাটে জল খেত।
বাংলা প্রবাদ-প্রবচন-লোক কথা-রূপকথা থেকে নীলাদ্রি ও অর্পিতা পশু-পাখিদের মোট পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন:
ক) ভূমিতে ঘুরে বেড়ানো পশু (গরু, ছাগল, কুকুর, ঘোড়া, বলদ, গাধা, বেড়াল, হনুমান, বানর, শুকর, খাসি, ভেড়া, জিরাফ, খচ্চর, ইঁদুর, মহিষ, ভালুক, হাতি, বাঘ, চিতা বাঘ, হায়েনা, খেঁকশিয়াল, উট, সিংহ, ক্যাঙারু, হরিণ ইত্যাদি),
খ) জলজ প্রাণী (বোয়াল মাছ, পুঁটি মাছ, ভেটকি মাছ, কই মাছ ইত্যাদি),
গ) উভচর (ব্যাঙ, গোখরো, অজগর, কুমীর, কচ্ছাপ, সাপ ইত্যাদি),
ঘ) খেচর (বিভিন্ন ধরনের পাখি যেমন শকুন, সারস, কোকিল, হাঁস, কবুতর, রাজহাঁস, চিল, তোতা, টিয়া, বাজ পাখি, মোরগ, বুলবুল, মুরগী, শুক-সারি, ব্যঙ্গমা-বেঙ্গমি, পেঁচা ইত্যাদি) ও
ঙ) পোকা-মাকড় ও কীট-পতঙ্গ (জোনাকি পোকা, গুবরে পোকা, উই পোকা, প্রজাপতি, শামুক, মশা, মাছি, আরশোলা, ঝিনুক, গুগলি প্রভৃতি)।
খানিকটা কৌতূহলোদ্দীপক ভাবেই এই দুই গবেষক দেখিয়েছেন যে 'গাধা' শব্দটি বাংলা ভাষায় অহরহ ব্যবহৃত যদিও বাঙ্গালীর রোজকার জীবনে এই 'প্রাণিটি' খুব বেশি দেখা যায় না। কারণ কি? হিন্দু বিশ্বাসে মা ষষ্ঠীর বাহন আবার এই গাধা। বাংলা রূপকথায় অপরাধীর কঠিন শাস্তি হিসেবে তাকে 'মাথা মুড়িয়ে গাধার পিঠে উল্টো চাপিয়ে" ঘোরানো হতো। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শিশু-কিশোরদের জন্য অমূল্য কৌতুক চরিত্র টেনিদা'র একটি গল্পে দারুণ হাস্যরসসমৃদ্ধ একটি কবিতা মনে পড়ছে: 'রামধনের ঐ বৃদ্ধ গাধা/মনটি তাহার বড়ই সাদা/সে বেচারা তার পিঠেতে চাপায়ে/কত শাড়ি-ধূতি-প্যান্ট লইয়া যায়/মনোদুখে খালি বোঝা টেনে ফেরে গাধা/তবু একখানা ধূতি-প্যান্ট পরিতে না পায়।' বাস্তবে ছাপোষা বাঙ্গালীর হাজার বছরের শ্রম ও দারিদ্র্যের জীবনকে বোঝাতেই কি এত গাধার কথা আসে আমাদের প্রতিদিনের বাক-বিতন্ডায়?
আবার বাংলাভাষায় রয়েছে অনেক কাল্পনিক পশু-পাখিও। সুকুমার রায় একাই সৃষ্টি করেছেন এমন বিচিত্র নানা পশু-পাখির নাম। 'রামগরুড়ের ছানা/হাসতে তাদের মানা/হাসির কথা শুনলে বলে/ হাসবো? না-না-না-না!' অথবা 'হাঁস' আর 'সজারু' মিলে 'হাঁসজারু' বা 'বক' আর 'কচ্ছপ' মিলে 'বকচ্ছপ' তৈরি করেন যে সুকুমার রায়, তার ভেতর শুধুই ঠাট্টা পান না আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকে কবীর সুমন। উপনিবেশের বিরুদ্ধে একটা দ্রোহ খুঁজে পান ইলিয়াস সুকুমারের আপাত: অসংলগ্ন যত প্রহসনে আর কবীর সুমন ত' বলেই দিয়েছেন যে 'আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়।' এই সুকুমার সৃষ্ট 'কুমড়ো পটাশ'দের বহু আগেই অবশ্য আমাদের রূপকথা 'পঙ্খীরাজ' ঘোড়ার মত আকাশযান আর 'ময়ূরপঙ্খী' বা 'শুকপঙখী' নায়ের মত অলৌকিক যত জলযানের কল্পনায় ভরা। 'শামুকের গতি' বা 'শম্বুকগতি'তে কাজ করা মানুষকে 'শামুকগতি' বলে ঠাট্টা করা হলেও জীবনের নানা ঘাতে-প্রতিঘাতে একটু গুটিয়ে থাকা মানুষকেই আবার প্রশংসা করে আমরা বলি 'শেষের দিকে নিজেকে কেমন শামুকের খোলে' গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আমাদের লোক গল্পে কোন কমলা রানীর দীঘিতে বা কোন সন্ত কি দরবেশের মাজারে তিনশো বছরের কচ্ছপ বেঁচে থাকে অবলীলায়। যে বৃদ্ধ সহজে মরেন না, তাঁকে আমরা বলি 'কচ্ছপের প্রাণ।' শৈশব থেকেই শত গুণ বিরূপতায় বেঁচেও প্রকৃতিগত ভাবেই বেশি দিন আয়ু পাওয়া বাংলার নারীর যেন 'কই মাছের প্রাণ,' যে মাছকে কিনা ছাই দিয়ে কেটে, আঁশ ছাড়িয়ে, গনগনে চুলোয় তেলে ভাজতে থাকার সময়ও সে ছটফট করে লাফিয়ে নিজের প্রতিরোধ ঘোষণা করতে থাকে। 'কলুর বলদে'র জীবন বা 'ঘানির বলদে'র জীবন বাংলার অসংখ্য নর-নারীর। এরই ভেতর 'শৃগালের মত চতুর' মহাজন-জোতদাররা থাকে। বোকাসোকা কুমীরের সাত বাচ্চার ছয় বাচ্চাকেই খেয়ে ফেলা শেয়াল-শেয়ালনী একটি মাত্র বাচ্চাকেই সাত বার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখায় সন্তানের খবর জানতে আসা কুমীর বাবাকে। এ যেন দুই বাংলার যেখানে যে শাসক দলই আসুক বা যাক, নানা উন্নয়ন প্রকল্পের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে পুনরায় প্রতারিত হতে থাকা জনতাকে শাসকের একই বাঁধা বুলি বারবার শোনানোর মত কোন বিষয়।
শুধু বাংলায় নয়, সারা পৃথিবীতেই প্রাণী ভুবনের একাধিক চরিত্রের মাধ্যমে বলা নীতিগল্পগুলোয় আসলে মানব চরিত্রের নানা দিকই যেন শিশু-কিশোরদের শেখানো হয়। বককে ঘরে আপ্যায়ন করে শেয়াল যখন পায়েস চেটে খায় আর বক একটি কি দু'টো দানা ঠোকরাতে পারে বা পারে না, পরে ক্ষুব্ধ বক নিজেও শেয়ালকে আপ্যায়ন করে এক কলস মধু বাড়িয়ে দিয়ে নিজে দিব্যি তার লম্বা চঞ্চুতে মধু পান করে আর শেয়াল তার প্রাপ্য পায়। তবু কিছু চতুরের সাথে কিছু সরল মানুষ জীবনেও পেরে ওঠে না। বোকা ভালুককে আখের ভাগ নেবার সময় শেয়াল উপরের অংশ নিয়ে জিতে যাওয়ায় বোকাটি পরের বার আলুর ভাগের সময় উপরের অংশ নিতে চায় ও চতুর শেয়াল আবার আলুর নিচের অংশটি পেয়ে যায়। 'বাঙ্গালার রূপকথা'য় এক দেড় আঙ্গুলে মানবও জিতে যায় জীবনের নানা লড়াইয়ে। রূপকথার বিশালত্ব এখানেই। আশপাশের প্রতিটি সংগ্রামী প্রাণের প্রতি দরদ। বামনও না হারুক। এই দক্ষিণ এশিয়াতেই কিনা আদি বিশ্বাসে ঈশ্বর বামনাবতার হিসাবে এসেছিলেন, এসেছিলেন নৃসিংহ অবতার হিসেবেও। 'বালক বীরের বেশে' কেউ 'বিশ্ব জয়' করে। তাই আমাদের ভাষায় 'পুরুষ সিংহের ন্যয়' হয়। 'ব্যঘ্রপুরুষ' শুধু নয়, 'বাঘিনী'র মত নারীও হয়। হয় 'কাজল নয়না হরিনী।" আবার নজরুলের 'মৃত্যুক্ষুধায়' দরিদ্র ক্রিশ্চিয়ান ও মুসলিম নারীরা কলতলায় কলসের জলের কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে এ ওকে 'ভাগলপুরী গাই' বলে অশ্লীল ডাকও ডাকে। পুনরায় কোন ক্রিশ্চিয়ান ধাত্রী যখন এক স্বামী পরিত্যক্তা মুসলিম তরুনীর সন্তান প্রসবে সাহায্য করে, মুসলিম পাড়ার শিশুরা আনন্দে 'আমরা যিশুর গান গাই' গাইতে থাকে।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত লেখক কৃষণ চন্দর 'আমি গাধা বলছি' নামে স্যাটায়ার লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। 'রামায়ণ' ও 'মহাভারত'-এ 'অশ্বমেধ যজ্ঞে'র বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় এবং প্রয়াত মল্লিকা সেনগুপ্তের 'সীতায়ণ' থেকে জানা যায় একদম শুরুতে 'অশ্বমেধ যজ্ঞে'র রাতে বলবান রাজপুত্রের আশায় রানীদের অশ্বের সাথে রাত্রি যাপন করতে হলেও কালক্রমে এই ভয়ানক প্রথা রদ করে, বলী হওয়া মৃত অশ্বের সাথে রাজ্ঞীদের এক চাদরের নিচে থাকতে হতো। সীতাকে পরিত্যাগ করার পর, দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ না করা রাম সোনার সীতাকেই বলী হওয়া অশ্বের সাথে এক চাদরের নিচে থাকতে দিয়েছেন বলে এক বিমূঢ় করে দেওয়া কল্পদৃশ্য আছে 'সীতায়ণ'-এ। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী মল্লিকা খুব পড়ে-শুনেই এই বইটি লিখেছেন।
'রাঘব বোয়াল' বা 'রুই-কাতলা'র সাথে 'চুনো-পুঁটির দ্বন্দে রত' বাঙ্গালী, সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের লোভে মত্ত কৃষক থেকে ক্রুদ্ধ প্রেমিকাকে 'রেগে গেলে তুমি মা মনসা' বলা বাঙ্গালী প্রেমিক...পৃথিবীর অন্য সব দেশের ভাষা ও সাহিত্যের মতই আমাদের ভাষাতেও তাই রয়েছে সব ধরণের প্রাণের উপস্থিতি। বাংলার আকাশে তাই সোনালী ডানার চিল ঘুরে বেড়ায়, কোজাগরী রাতে লক্ষী পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে, গভীর সুখে জোনাকী ডানা মেলে, নিভৃত নীল পদ্মের জন্য ভ্রমর বিবাগী হয়। বাংলার ভাঁট ফুল, ধুন্দুল, আস-শ্যাওড়া, বেত ফল, বাসমতী চাল আর চালতার কষ...এই সব নিয়েই ত' আমাদের রূপসী বাংলা। আজ তার নীলিমা যতই বিধ্বস্ত হোক!
টিকা:
-
Based on the same logic, many other fictitious as well as mythological animal names (e.g., rākkṣas "monster", khokṣas "monster", petni "witch", bhut "ghost", pari "fairy", daitya "giant", jalakanyā "mermaid", matsyakanyā "mermaid", etc.) are kept outside the list of animal names consider for our presentinvestigation.
-
Most of the scientific studies on behavioural patterns of most of the animals mentioned above (e.g., donkey, mule, bullock, etc.) have reported that these animals are quite intelligent in their normal behaviour. However, in some language communities, due to some unknown reasons, these are treated as animals with very low level of intelligence. In the present study also, this aspect of the animals has been referred to with reference to some example sentences obtained from the Bengali textdatabase.
-
In most cases the stupidity, diligence, arrogance and strength of the animal is mostly under reference in regular speech and verbal communication. The term garu is mostly used in the sense of a 'bullock', and not in the sense of a 'cow' or an'ox'.
-
Incaseofa?ā˜ṛ"ox"thefeatureswhicharemostoftenreferredtoareaggressiveness, strength, stubbornness, short temper, impatience, arrogance, etc. However, additional features may added based on the analysis of new set of data, which is, however, beyond the scope of the presentstudy.
REFERENCES
Bang, J.C. and J. Door. 2007. Language, ecology, and society: a dialectical approach. In, Steffensen, S.V. and J. Nash (Eds.) Language, Ecology, and Society: An Introduction to Dialectical Linguistics, London: Continuum, pp., 77-88.
Craddick, R. and J. Miller. 1970. Investigation of the symbolic self-using of the concentric circles method and animal metaphor, Journal of Perceptual and Motor Skills, 31(1): 147-160.
Dash, N.S. 2007. Indian scenario in language corpus generation. In, Dash, N.S., P. Dasgupta, and P. Sarkar (Eds.) Rainbow of Linguistics: Vol-I. Kolkata: T. Media Publication. Pp. 129-162.
Dash, N.S. and B. Topdar. 2011. Animal Names Used in Addressing People in Bengali: A Sociolinguistic Exploration. Presented in 33rd All India Conference of Linguists (33rd AICL), Dept. of English and Culture Studies, Punjab University, Chandigarh, India, October 1-3, 2011.
Davies, E.E. and A. Bentahila. 1989. Familiar and less familiar metaphors, Language and Communication, 9(1): 49-68.
Fernandez, F.A. and R.M.J. Catalan. 2003. "Semantic derogation in animal metaphor: a contrastive-cognitive analysis of two male/female examples in English and Spanish", Journal of Pragmatics, 35(5): 771-797.
Fraser, B. 1979. The interpretation of novel metaphors. In, Ortony, A. (Ed.) Metaphor and Thought, pp. 45-56, Cambridge: Cambridge University Press.
Gibbs, R. 1985. On the process of understanding idioms. Journal of Psycholinguistic Research, 14(3): 465-472.
Halliday, M.A.K. 1990. New ways of meaning: the challenge to applied linguistics, Journal of Applied Linguistics, 6(1): 7-36.
Halupka-Resetar, S. and B. Radic. 2003. Animal names used in addressing people in Serbian,
Journal of Pragmatics, 35(12): 1891-1902.
Hsieh, S. C-Y and C. Lien. 2004. The compositionality of botanical concepts in languages: a study of Mandarin Chinese and German plant fixed expressions. Presented at
Compositionality, Concepts, and Cognition: An Interdisciplinary Conference on Cognitive Science (CoCoCo 2004), Heinrich Heine University, Düsseldorf, Germany, February 28 -March 3, 2004.
Hsieh, S.C-Y. 2002. Cat expressions in Mandarin Chinese and German: animal expressions and cultural perspectives. Presented at the 10th International Conference on Cognitive Processing of Chinese and Other Related Asian Languages. National Taiwan University, Taipei, December 2002.
Makkai, A. 1993. Ecolinguistics: Towards a New Paradigm for the Science of Language.
London: Printer publishers.
Nesi, H. 1995. A modern bestiary: a contrastive study of the figurative meanings of animal terms, English Language Teaching Journal, 49(2): 272-278.
Norrick, N.R. 1986. Stock similes, Journal of Literary Semantics, 15(1): 39-52.
Pettit, P. 1982. The demarcation of metaphors, Language and Communication, 2(1): 1-21. Pinker, S. 1995. The Language Instinct: The New Science of Language and Mind. Middlesex,
England: Penguin Books Ltd.
Pulman, S.G. 1982. Are metaphors 'creative'?, Journal of Literary Semantics, 11(1): 23-38. Schulz, M. 1975. The semantic derogation of women. In, Thorne, B. and N. Henley (Eds.)
Language and Sex: Difference and Dominance, pp. 64-75, Massachusetts: Newbury House.
Stibbe, A. 2005. Counter discourses and harmonious relationships between human and other animals, Anthrozoos, 18(1): 3-17.
Sutton, L.A. 1995. Bitches and skankly hoobags: the place of women in contemporary slang. In, Hall, K. and M. Burholtz (Eds.) Gender Articulated, pp. 75-87, London: Routledge.
Whaley, C.R., and G. Antonelli. 1983. The birds and the beasts – woman as animals,
Maledicta, 7(2): 219-229.