বাবল চুপসে যাবে
জীবনে চুইংগাম চিবোয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। বিভিন্ন ফ্লেভার আর রং-বেরঙের চুইংগাম কেবল ক্যান্ডিজাতীয় খাবার হিসেবে নয়, বরং কয়েক দশক ধরে পপ কালচারের জনপ্রিয় অনুষঙ্গ হিসেবে রাজত্ব করেছে। তারুণ্যের উদ্দামতা, বিদ্রোহ আর যৌন আবেদনের প্রতীক এই চুইংগাম। বিশ্বখ্যাত সংগীত তারকা থেকে শুরু করে সিনেমা বা ড্রামায় এককালে তরুণদের মুখে মুখে বাবল বেলুনের দেখা মিলত।
কিন্তু চুইংগামের সেই বাবল হঠাৎ করেই ফেটে দুম-পটাস! বাবল আর কোথায়, মুখে এখন সবার মাস্ক আঁটা। বন্ধুদের আড্ডা কিংবা অভিসার, লকডাউনে সবই বাতিল করতে হয়েছে। শুধু ২০২০ সালেই বিশ্বে চুইংগামের বেচাবিক্রি ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। তবে মহামারির আগে থেকেই কমতে শুরু করে চুইংগামের জনপ্রিয়তা। কিন্তু কেন?
প্লাস্টিক চিবোনোর ইতিহাস!
এত প্রশ্নের আগে চুইংগামের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ইতিহাসটাও জানা দরকার। প্রাচীন গ্রিক জাতির মধ্যে বিশেষ ধরনের গাছের ছাল চিবোনোর প্রমাণ মেলে। এমনকি কয়েক শতাব্দী ধরে মায়ান ও অ্যাজটেক সভ্যতাতেও মেক্সিকান সাপোডিলাগাছ উদ্ভূত আঠালো গাম চিবোনোর প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে চুইংগামের বাণিজ্যিকীকরণের কৃতিত্ব পুরোটাই আমেরিকানদের। গাছের আঠালো গামের সঙ্গে বিভিন্ন সুগন্ধি ও রস যুক্ত করে তৈরি হয় আধুনিক চুইংগাম। ১৯৫০ সালে কারখানাগুলো খরচ কমাতে প্রাকৃতিক আঠার পরিবর্তে গাম হিসেবে সিনথেটিক রাবার ও প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরু করে। একই সঙ্গে আসে সম্পূর্ণ চিনিমুক্ত গাম।
কিন্তু টাকা খরচ করে কেউ কেন প্লাস্টিক চিবিয়ে রস খেতে যাবে? চুইংগামের জনপ্রিয়তার বড় একটি কারণ এর বিপণন কৌশল। মার্কিন শিল্পপতি ও চুইংগাম সম্রাট উইলিয়াম রিংলে জুনিয়রের মতে, 'চুইংগাম যে কেউ বানাতে পারে। এটি বিক্রি করাই মূল সমস্যা।'
তবে চটকদার বিজ্ঞাপনের সামনে এই সমস্যা আর টিকেনি। ১৯ শতকের শেষ দিকে আমেরিকার 'কিস-মি' গাম জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিস-মির বিজ্ঞাপনে ট্যাগলাইন ছিল, 'চুমুর চেয়ে বহু গুণে ভালো'।
রিগল জুনিয়রের 'ভ্যাসার' চুইংগাম ব্র্যান্ডের নাম ছিল অভিজাত মেয়েদের কলেজের নামে। শুরুতে তিনি নারীদের বাজারটাই ধরতে চেয়েছিলেন। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেশনের প্যাকেটের সঙ্গে চুইংগাম বিতরণ শুরু হয়। আবেদন সৃষ্টির পাশাপাশি চুইংগাম এবার দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রিটনি স্পিয়ার্সের এঁটো চুইংগামের দাম ১৪ হাজার ডলার!
প্রথা ভাঙার চেষ্টা আর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়াই তারুণ্য। তরুণদের প্রিয় এই চুইংগাম একসময় হয়ে ওঠে বিদ্রোহ ও বেপরোয়া আচরণের প্রতীক। বড়দের সামনে চুইংগাম চিবানো হয়ে যায় অভব্যতার শামিল। বাবল ফুলানো পরিণত হয় রীতিমতো ঔদ্ধত্য আচরণে। কিন্তু অভিভাবক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চুইংগামকে যত অপছন্দ করতে শুরু করে, তরুণদের মাঝেও ততই এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
৪০-এর দশকের শেষে হলিউড তারকাদের অনুকরণে চুইংগাম প্রসার লাভ করে। যুদ্ধের সময় আমেরিকানদের দেখাদেখি বৃটিশ তরুণেরাও পরোয়াহীন ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে চুইংগামের দিকে ঝুঁকে। এরপর ৭০, ৮০ কিংবা ৯০-এর দশকেও চুইংগামের জনপ্রিয়তা কমেনি। ২০০৪ সালে ই-বের এক নিলামে ব্রিটনি স্পিয়ার্সের এক টুকরো এঁটো চুইংগামের দাম ১৪ হাজার মার্কিন ডলারে ওঠে।
জেনারেশন 'জেড'-এর কাছে প্লাস্টিক গামের আকর্ষণ নেই
নতুন শতকের শুরু থেকেই চুইংগামের আবেদন কমতে শুরু করে। রাস্তাঘাটে কিংবা বাসের সিটে এখনো এঁটো চুইংগামের দেখা মিললেও (সিঙ্গাপুর ছাড়া! ১৯৯২ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে চুইংগাম বিক্রি নিষিদ্ধ) প্রায় এক দশক আগে থেকেই কমছে চুইংগামের বিক্রি।
অনেকে চুইংগামের জনপ্রিয়তা কমার পেছনে স্মার্টফোনকে দায়ী করেন। স্মার্টফোন আমাদের সকল মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। আর তাই অন্য কারও নজর কাড়তে চুইংগাম চিবোনোর প্রয়োজনও কমে গেছে!
অনলাইন কেনাকাটা বেড়ে যাওয়াকেও দুষছেন অনেকে। অনলাইনে এত ছোটখাটো জিনিস কেউ কেনে না বললেই চলে। সতেজ নিশ্বাসের জন্যও চুইংগামের পরিবর্তে বেড়েছে মিন্টের ব্যবহার।
তবে সব থেকে পরিবর্তন সম্ভবত নতুন প্রজন্মের ধ্যান-ধারণায় এসেছে। ১৯৯৬ সালের পর জন্ম নেওয়া জেনারেশন 'জেড' এখন বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তাশ্রেণি হয়ে উঠছে। ৯০-এর দশকের মতো গাম চিবিয়ে তা ফেলে দেওয়া এখনকার তরুণদের পছন্দ নয়। চিটচিটে এই জিনিস যেকোনো জায়গায় আটকে নোংরা সৃষ্টি করতে পারে।
তা ছাড়া বাড়ছে স্বাস্থ্যকর, প্রাকৃতিক ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত খাবারের চাহিদা। কার্বন নিঃসরণ কমাতে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে নিরামিষের দিকে ঝুঁকছে তরুণেরা। কেনাকাটার আগে মানুষ এখন পণ্যের গায়ে পরিবেশবান্ধব ছাড়পত্রের চিহ্ন খোঁজে। টেকসই উন্নয়নের এই যুগে তাই প্লাস্টিকের চুইংগাম ফুলিয়ে চোখেমুখে তা পটাস করে ফাটানো তরুণদের মাঝে কোনো আবেদন তৈরি করতে পারে না।
একসময় কোনো কিছু পরোয়া না করাই ছিল আকর্ষণীয় আচরণ। কিন্তু এখনকার তরুণদের বড় অংশের কাছে উল্টোটাই সত্য।
তবে সচেতন ক্রেতাদের জন্য চুইংগামও তার রূপ বদলাতে সচেষ্ট। বর্তমানে একাধিক নতুন ব্র্যান্ড প্লাস্টিকমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব চুইংগাম বাজারজাত শুরু করেছে। চুইংগামের সেই আদি উৎসতেই ফিরে গেছে তারা। ফের সেই সাপোডিলাগাছের আঠা থেকেই তৈরি হচ্ছে চুইংগাম। এখন পর্যন্ত উদ্ভিজ্জ এই গামগুলো সফলতার সঙ্গেই ব্যবসা ধরে রেখেছ।