ভাষাশহীদ শফিউরের শেষ দিন
২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। পুরানো ঢাকার ৬ নম্বর রঘুনাথ দাস লেনের বাসিন্দা শফিউর রহমান অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। তিনি হাইকোর্টের হিসাবরক্ষণ শাখায় কাজ করেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র জনতার উপর গুলি চালানোর ঘটনাটা দৈনিক আজাদে বেরিয়েছে। তাঁর মনটা একদম ভেঙে পড়েছে। একটা সভ্যদেশে এভাবে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ছাত্র মেরে ফেলবে! এ কেমন বর্বরতা!
আজ অফিস আদালত সবই বন্ধ। তারপরও একটা জরুরী দরকারে যেতে হবে অফিসে। স্ত্রীকে কথা দিলেন কাজ সেরেই সাথে সাথে বাড়ি ফিরবেন। ফেরার সময়ে একমাত্র কন্যা শাহনাজের জন্য জামাও নিয়ে আসবেন। স্ত্রী আকিলা খাতুন তখন অন্তঃসত্ত্বা। আকিলা খাতুন স্বামীর জন্য খাবার ভরে দিলেন টিফিন বক্সে- ডিমভাজি আর পরোটা। শফিউর রহমান সেই খাবার চটের থলেতে ভরে সাইকেলে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অফিসের উদ্দেশ্যে। পরনে তাঁর পাজামা, শার্ট আর কোট।
সৌখিন মানুষ শফিউর। মাঝে মাঝে হ্যাটও পরেন। বাড়িতে ছোট ভাই তৈয়বুরের তোলা বেশ কিছু হ্যাট পরা ছবিও আছে। সেদিন অবশ্য হ্যাটটা নেন নি। ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে একসময় শফিউর রহমান এসে পৌঁছুলেন নবাবপুর সড়কে।
নবাবপুর সড়ক ততক্ষনে হয়ে উঠেছে জনসমুদ্র। হাজার হাজার মানুষের শোক মিছিল ছুটে চলেছে নবাবপুর সড়কের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত। ২১শে ফেব্রুয়ারির স্লোগান "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" এর সাথে যোগ হয়েছে নতুন স্লোগান- "শহীদ স্মৃতি অমর হোক", "খুনি নুরুল আমিনের বিচার চাই"। সড়কের দু'প্রান্তে আর রথখোলা মোড়ে জনতার মুখোমুখি অবস্থা্ন নিয়েছে পুলিশবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা।
ভাষাসৈনিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বেবী মওদুদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান সেদিনের কথা "১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা বিশাল গায়েবী জানাজা হলো। সেখানে শেরে বাংলা এসেছিলেন, আমার মনে আছে। ওখান থেকে আমরা যখন কার্জন হলের সামনে গেছি তখন আবার গুলি। …. তখন সবাই দু'ভাগ হয়ে গেল। আমরা কার্জন হলের দেয়াল টপকে ফজলুল হক হলের ভিতর দিয়ে চলে গেলাম। আমি, হাসান আজিজুর রহমান, গাফফার চৌধুরী, কয়েকজন আমার বাসায় চলে গেলাম। এই ২২ তারিখে আর একটা অংশ নওয়াবপুরের দিকে গিয়ে 'সংবাদ' পত্রিকা অফিসে আগুন দিল, 'মর্নিং নিউজ' অফিসে আগুন দিল।"
মিছিলের একপাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন শফিউর রহমান। তিনি মরণচাঁদের দোকানের সামনে আসতেই পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালাল। একটি গুলি এসে লাগল তাঁর পিঠে। তারপরও সাইকেল ছাড়লেন না, আরো কিছুদূর গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই এগিয়ে গেলেন। খোশমহল রেস্তোঁরার সামনে এসে পড়ে গেলেন তিনি।
লোকজন ধরাধরি করে তাঁকে রেস্তোঁরার ভেতর নিয়ে গেল। সেখান থেকেই অ্যাম্বুলেন্সে পাঠনো হল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শফিউর রহমানের বোনের দেবর কাজী এনামুল্লাহ ছিলেন ঢাকা মেডিকেলের স্টেরিলাইজ ডিপার্টমেন্টে। তিনি চিনতে পেরে খবর পাঠালেন মিটফোর্ড হাসপাতালে সে সময়ে ডাক্তারি অধ্যয়নরত শফিউরের ছোট ভাই আসজাদুর রহমানকে।
আসজাদুর ছুটে এসে নিজে রক্ত দিলেন, আরো দুই ব্যাগ জোগাড় করলেন। অপারেশনে নেয়ার আগে পর্যন্ত জ্ঞান ছিল শফিউরের। বার বার মনে করছিলেন নিজের তিন বছরের মেয়েরটার কথা। বাবার আহলাদি মেয়ে শাহনাজ, বাবার কোলে বসেই যার সব খাওয়াদাওয়া, আদর-আবদার! শফিউরের মুখ থেকেও শুধু তারই নাম- "আমার শাহনাজ! আমার শাহনাজ!!"
ভাই যখন অভয় দিয়ে বলছেন তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব তখন শফিউর বলেছিলেন "আমার বাসায় আর যাওয়া হবে না।"
শফিউরের আর বাসায় যাওয়া হয়নি। ডাক্তার এলিনসন দীর্ঘ অপারেশন করেন। কিন্তু বাঁচানো যায়নি তাঁকে। হৃদপিণ্ড ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সন্ধ্যা সাতটায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভাষাশহীদ শফিউর রহমান।
সান্ধ্য আইনের ভেতরে রেডক্রসের এক অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনবছরের কন্যা শাহনাজকে নিয়ে স্ত্রী আকিলা খাতুন যখন ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছেন তখন আর শফিউর রহমান এই পৃথিবীতে নেই। স্বামীর মরদেহ দেখে তাঁর মনে হয় "তিনি ঘুমুচ্ছেন। কপালে একটু রক্তের দাগ। বুকে ব্যান্ডেজ বাঁধা।"
২২শে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনা পরদিন 'আজাদ' পত্রিকা ছেপেছিল ঠিকই, তবে সেখানে শফিউর রহমান বা অন্য কোন শহীদের নামের উল্লেখ ছিল না।
"বৃহস্পতিবারের শোচনীয় ও ভয়াবহ ঘটনা বিস্মৃত হইতে না হইতে গতকাল (শুক্রবার) জুম্মার দিন আর একবার ঢাকার মাটি শিশু ও ছাত্রদের রক্তে লাল হয়ে ওঠে। সেদিনকার ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শান্তিপূর্ণ মিছিল বাহির করিয়া পুলিশ ও সৈন্যদের গুলির আঘাতে নাগরিকদের ৪ জনকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় এবং শতাধিক আহত ব্যক্তি হাসপাতালে নীত হয়। ইহাদের মধ্যে ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্ত্তি করা হয়। তাদের ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলিয়া জানা গিয়াছে।"
সেসময়ে পাকিস্তানী সরকার হাসপাতালে ঢুকে লাশ গুম করছে। শফিউর রহমানের মৃত্যুর সাথে সাথে তাই দাফন সম্ভব হয়নি। সরকারের সৈন্যদের কাছ থেকে লাশ লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল আরো দুইদিন। ঢাকা মেডিকেলের স্টেরিলাইজ ডিপার্টমেন্টের চকির নীচে লাশ লুকিয়ে রাখা হয়। গোপনে লাশ নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করবেন এরকম মুচলেকা দেয়ার পর কর্তৃপক্ষ লাশ হস্তান্তরে সম্মত হয়। স্ত্রীর শেষ সঞ্চয় ১০০ টাকায় কবরের জায়গা কেনা হয়। ২৫শে ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে শফিউর রহমানের দাফন সম্পন্ন হয়।
শফিউর রহমানের শাহাদতের তিন মাস পর পিতৃহীন এই পৃথিবীতে জন্ম নেয় তাঁর একমাত্র পুত্র।