ভ্যাকসিন যুগে যুগে
পৃথিবীর শুরু থেকে ক্রমাগত হিংসা, সংঘাত ও যুদ্ধের কবলে পড়ে মানুষের হাতে মানুষ মরেছে অসংখ্য। মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার যত আয়োজন সে তুলনায় নিরাপদ পৃথিবী গড়ার চেষ্টা খুব অল্প। অন্যকে ঘায়েল, জবর-দখল ও সাম্রাজ্য বিস্তারের খায়েশে আধুনিক বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নানা রকম মারণাস্ত্র তৈরির চেষ্টার শেষ নেই। বলা যায় 'অস্ত্র শিল্প' বর্তমান বিশ্বের সবচে' প্রভাবশালী ও লাভজনক ব্যবসা। সে তুলনায় মানুষকে বাঁচানোর উদ্যোগ কই। আদিকাল থেকে মহামারি আর মড়কে যে কোটি কোটি মানুষ নির্মমভাবে মারা যাচ্ছে তা ঠেকাতে পারছে না বিজ্ঞান। এখন পর্যন্ত সাকুল্যে দুটি রোগকে নির্মূল করা গেছে পৃথিবী থেকে। টিকার ইতিহাস মাত্র আড়াইশ বছরের। সেই টিকা নিয়েও আছে নানা চাল নানা রাজনীতি।
দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ইমিউনিটি বা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে যে জৈব-রাসায়নিক মিশ্রণ তাকে ভ্যাকসিন বা টিকা বলে। এ প্রতিষেধক জৈব পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। কোনো সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু (ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) দেহে প্রবেশ করলে শরীরের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে অ্যান্টিজেন বা বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে। এই অ্যান্টিজেনকে ধ্বংস করার জন্য দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা 'ইমিউন সিস্টেম' অ্যান্টিবডি তৈরি করা শুরু করে। অ্যান্টিবডি জীবাণুকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
জীবাণু ধ্বংসের এই পদ্ধতি ধীর গতির হয় বলে আক্রান্ত দেহকে সাধারণ অবস্থায় জীবাণুর কাছে হার মানতে হয়। হার না মেনে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিপুল পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরির সুযোগ পেলে জীবাণুকে হারিয়ে দেহকে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম হয়। এমন কি দ্বিতীয়বার একই ধরনের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলেও ভয় থাকে না। অ্যান্টিজেনকে ধ্বংস করার পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুতই জীবাণুর হাত থেকে আক্রান্ত দেহকে রক্ষা করতে পারে। ফলে একবার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে উতরে যেতে পারলে আর ভয় নেই। কিন্তু সেই একবার উতরে যাওয়া সম্ভব হয় না বলেই মহামারির ছোবলে কোটি প্রাণ হারাতে হয়। এই ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত রক্ষাকবজ হয়ে মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখছে ভ্যাকসিন বা টিকা। টিকা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শিখিয়ে দেয় কিভাবে দ্রুত নির্দিষ্ট জীবাণুটিকে ধ্বংস করতে হয়। এতে অসুস্থ হতে হয় না। ফলে দেহে সংক্রামক রোগের জীবাণু ঢোকার আগে থেকেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রস্তুত হয়ে থাকে লড়াই করার জন্য। হারানোর পদ্ধতিটিও চেনা বলে সহজেই জিতে যায়।
পৃথিবীতে বর্তমানে দুই ডজনের বেশি রোগের টিকা চালু রয়েছে। নানা রোগের প্রতিরোধক হিসেবে এসব টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু টিকার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি রোগকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। গুটি বসন্ত ও গবাদিপশুর বিশেষ রোগ রাইন্ডারপেস্ট থেকে পৃথিবী মুক্ত বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, টিকা দানের মাধ্যমে প্রতি বছর অন্তত ২০ থেকে ৩০ লাখ শিশুর প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
মাত্র দুটি রোগকে নির্মূল করা গেলেও কয়েক ডজন রোগ দূরীকরণ ও নিয়ন্ত্রণে অসামান্য অবদান রাখছে টিকা। অন্তত দশ বছর বিশ্বের কোথাও একটি রোগের দেখা পাওয়া না গেলে সেটি 'নির্মূল' হয়েছে বলে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রোগটির জীবাণুর আধার (রিজার্ভার) একমাত্র গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকা ছাড়া এর অস্তিত্ব পৃথিবীর কোথাও থাকতে পারবে না।
আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি মহাদেশীয় অঞ্চলের চারটিতে ১০ বছর যাবত কোনো একটি রোগে কেউ আক্রান্ত না হলে রোগটি 'দূর হয়েছে' বলে ধরা হয়। বিশ্বের এক অঞ্চলে এ রোগের অস্তিত্ব না থাকলেও অন্য অঞ্চলে থাকতে পারে। অন্যদিকে টিকার মাধ্যমে একটি রোগকে কোনো অঞ্চল থেকে নির্মূল বা দূর করা সম্ভব না হলেও যদি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় তবে তাকে পরিভাষায় বলে 'নিয়ন্ত্রণ' করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ সংজ্ঞা ও তথ্যানুযায়ী টিকা প্রয়োগ করে প্রতি বছর ৬০ লাখ মৃত্যু ঠেকানো হচ্ছে।
টিকার আগের অধ্যায়: টিকা আবিষ্কারের আগের অধ্যায়টা ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। রোগের প্রতি অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা মানুষকে আরো অসহায় করে তুলেছিল। ঐতিহাসিক সূত্র বলে, মহামারি নিয়ে মানুষের মনে নানা কুসংস্কার আর বিশ্বাস কাজ করত। অনেক অঞ্চলে রোগের জন্য দায়ি করা হতো নারীদের। মনে করা হতো নারীরা অপয়া। খারাপাত্মা তাদের উপর ভর করে মড়ক ছড়িয়ে দেয়। এ বিশ্বাসের কারণে বহু নারীকে নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। কোথাও কোথাও বিশ্বাস করা হতো মহামারি দেব-দেবীদের অসন্তোষের ফল। তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য মড়ক চলাবস্থায়ও তাই দেব-দেবীদের পূজা-অর্চনা করত মানুষ।
ইতিহাস মারফতে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৯ অব্দে স্পার্টানদের সঙ্গে গ্রিকদের যুদ্ধের সময় এথেন্সে একটি মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের ধারণা এটি ছিল প্লেগ মহামারি। এ মহামারিতে বহু সৈন্য ও সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মারা যায়। ঐতিহাসিক থুসিডাস এ মহামারির চাক্ষুস সাক্ষী। তিনি একটি বিষয় লক্ষ করেন, একবার যে ব্যক্তি মারিতে আক্রান্ত হচ্ছে বেঁচে থাকলে দ্বিতীয়বার সে আর একই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না। তখন আবিষ্কার করা না গেলেও আধুনিক টিকা মূলত এ চিন্তা থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে।
আস্তে আস্তে চিকিৎসকরা ধারণা দিতে থাকেন মহামারি থেকে বাঁচতে হলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। আক্রান্তদের আলাদা করে রাখতে হবে। অবশ্য আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের ধারণা ১৪০০ সালের দিককার। এর আগে ১০০০ সালের দিকে চীনে ভাইরিওলেশনের ধারণা আবিষ্কৃত হয়। এটিকে অনেকটা টিকার আদিরূপ বলা যায়।
গুটি বসন্ত ও এডওয়ার্ড জেনারের প্রথম টিকা আবিষ্কার
বৃটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনারকে আধুনিক টিকার প্রথম আবিষ্কারক ধরা হয়। ১৭৯৬ সালে তিনিই প্রথম গুটি বসন্তের কার্যকর টিকা তৈরি করেন। এ জন্য তাকে 'ফাদার অব ইমিউনোলোজি' বলা হয়। তরুণ এই চিকিৎসক পড়াশোনা শেষ করে একনিষ্ঠ গবেষণা ও অবহেলিত জনপদের সেবা করার মনোবাসনা নিয়ে গ্রামে চলে যান। শুরু করেন খামারিদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া। থেমে থেমে বারবার গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে শত শত বছর ধরে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছিল। গুটি বসন্ত থেকে রেহাই পেতে ছোটবেলায় জেনারও ভাইরিওলেশন চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। চিকিৎসক হওয়ার পর তিনিও তার রোগীদের ভ্যারিওলেশ সম্পন্ন করছিলেন। গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসা দিতে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, খামারিরা গোবসন্তে আক্রান্ত হলে তাদের সামান্য ফুসকুড়ি দেখা দেয়। জেনার এ-ও লক্ষ করলেন, এতে করে খামারি ও গোয়ালিনীরা আর মারণব্যধি গুটিবসন্তে আক্রান্ত হচ্ছে না।
জেনার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ১৭৯৬ সালের মার্চে সারা নেলমস নামের এক তরুণ গোয়ালিনীর গায়ের গোবসন্তের তাজা ক্ষত থেকে জেনার টিকার উপাদান সংগ্রহ করেন। এ উপাদান ব্যবহার করে তৈরি টিকা সর্বপ্রথম জেমস ফিপস নামের আট (বা তেরো) বছর বয়সী এক শিশুর গায়ে পুশ করেন। ফলাফল ইতিবাচক আসে। জুলাই মাসে আবারো শিশুটিকে দ্বিতীয় ধাপে টিকা দেন জেনার। জেনার এ পরীক্ষা অব্যাহত রাখেন এবং আশানুযায়ী ফল পান। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধী টিকার বুনিয়াদ এভাবেই গড়ে দেন এই চিকিৎসা বিজ্ঞানী। এরপর যত রোগের টিকা তৈরি হয়েছে এটিকে অনুসরণ করেই হয়েছে।
১৭৯৮ সালে জেনারের গবেষণাপত্র প্রকাশ হওয়ার পর তা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। রাজপরিবার এই টিকা নিজেরা গ্রহণ করে এবং তার আজীবন পেনশনের ব্যবস্থা করে। রাজা তৃতীয় জর্জ তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। যে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে আঠার শতকে প্রতি বছর শুধু ইউরোপ জুড়েই চার লাখ লোক মারা যেত সেই ভয়ঙ্কর মহামারিটি নির্মূল হয়েছে বলে ১৯৮০ সালে ঘোষণা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৭০ অব্দ থেকে দুর্দান্ত প্রতাপে বহু রাজা-বাদশাহ ও শহর-নগর ধ্বংস করে দিয়ে ১৯৮০ সালে এসে পরাজিত হতে হয় প্রাণঘাতী গুটিবসন্তকে।
লুই পাস্তুরের জীবাণু রহস্য ও তার প্রতিষ্ঠান
ফ্রান্সের ডোলেতে ১৮২২ সালে লুই পাস্তুরের জন্ম। এই রসায়ন বিজ্ঞানী ১৮৮৫ সালে জলাতংকের টিকা আবিষ্কার করেন। কিন্তু এ ফরাসি বিজ্ঞানীকে স্মরণ করা হয় সম্ভবত তার জীবাণু নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও যুগান্তকারী ফলাফল সৃষ্টির জন্য। তার গবেষণার ফলে রেশম পোকার মড়ক দূরীকরণ আবিষ্কার হয়। লুই পাস্তুর মহামারি ও মড়কের মূল ঘটক জীবাণু নিয়ে গবেষণা করে এর চরিত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ফল ও দ্রব্যের পচনের পেছনে যে রয়েছে জীবাণু তা তিনি সামনে আনেন। খাদ্যকে জীবাণুমুক্ত রাখার যে পদ্ধতিকে আজ আমরা 'পাস্তুরিতকরণ' বলি সে পদ্ধতিটিরও ধারণা দিয়েছিলেন লুই পাস্তুর।
১৮৮৭ সালে লুই পাস্তুর প্রতিষ্ঠা করেন একটি বিশেষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। 'পাস্তুর ইনস্টিটিউট' বিশ্বের সমকালীন বিজ্ঞানীদের প্রধান আগ্রহ কেন্দ্র হয়ে উঠে। একটি সূত্র বলছে, এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের হাত ধরেই ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, যক্ষ্মা, পরিমাইলিটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পীতজ্বর এবং প্লেগের মতো ঘাতক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়েছে। অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১০ জন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন।
জীবাণু নিয়ে পাস্তুরের গবেষণার সূত্র ধরে পরবর্তীতে কলেরা ও প্লেগের মতো ভয়ঙ্কর দুটি সংক্রামক রোগের আবিষ্কার করেন ওয়াল্ডেমার হফকিন। কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ফেলা ঘাতক এই রোগ দুটির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়।
কলেরা ও প্লেগের টিকা আবিষ্কার
ইউক্রেনের ওদেসায় জন্ম ওয়াল্ডেমার হফকিনের (১৮৬০-১৯৩০)। অণুজীব বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের গবেষণাগারে কাজের আগ্রহ নিয়ে তরুণ বয়সে এই বিজ্ঞানী ফ্রান্সে পৌঁছেন। এক পর্যায়ে পাস্তুরের গবেষণাগারে কাজের সুযোগ পেলে কলেরার টিকা উদ্ভাবনের জন্য পূর্ণ মনোযোগ দেন। খরগোশের উপর কলেরার টিকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আগ্রহজাগানিয়া ফলাফল পেলেন। ১৮৯২ সালের ১৮ জুলাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথমবার নিজের উপর কলেরার টিকার পরীক্ষা চালালেন সাহস করে। ফলাফল ইতিবাচক। সামান্য পার্শ্বতিক্রিয়া ছাড়া বিস্ময়কর সাফল্যের দেখা পেলেন। এবার একদল স্বেচ্ছাসেবকের দেহে পরীক্ষা চালালেন। কিন্তু টিকার কার্যকারিতার উপর পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন আরো ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার। এ জন্য দরকার মানবদেহ।
ভারতবর্ষে ওয়াল্ডেমার হফকিনের আগমন
কলেরায় তখন এশিয়া ও ইউরোপের টালমাটাল দশা। ভারতে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে কলেরায়। হফকিন স্থির করলেন টিকার কার্যকারিতা আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য ভারতবর্ষে টিকার ব্যবহার করবেন। প্যারিসের বৃটিশ রাষ্ট্রদূতের সাহায্যে তার এ চিন্তা তিনি বাস্তবায়নের সুযোগ পেলেন। ১৮৯৩ সালে পা রাখলেন কলকাতায়। এখানকার দারিদ্র্য আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ কলেরার জন্য উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করছিল। অসচেতনতা তো ছিলই। হফকিন তার সহকর্মীদের নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। হফকিনের টিকা উতরে গেল। কলেরা নিয়ন্ত্রণে আনার দুঃসাধ্য কাজটি সাধন হলো অবশেষে।
১৮৯৬ সাল। কলেরার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই ভয়ঙ্কর বুবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে বোম্বে (মুম্বাই) শহরে। এই বুবোনিক প্লেগে মধ্যযুগে শুধু ইউরোপেই মারা গিয়েছিল দুই শ মিলিয়ন মানুষ। কলেরা নিয়ন্ত্রণে অসামান্য অবদান রাখায় বৃটিশ সরকার কর্তৃক এবার বোম্বেতে ডাক পড়ে হফকিনের। পুরো বোম্বে জুড়ে আতংক। মহামারির ভয়ে রাস্তাঘাটে পলায়মান মানুষের ছুটে চলা। ৭ অক্টোবর কলকাতা থেকে বোম্বেতে আসেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সের তরুণ বিজ্ঞানী ওয়াল্ডেমার হফকিন। গ্র্যান্ট মেডিকেল কলেজের করিডোরে একটি অস্থায়ী ল্যাব বা গবেষণাগারে টিকা উদ্ভাবনের কাজ শুরু করেন। কোনো বিরাম নেই। লাগাতার তিন মাস অবিচল পরিশ্রমের পর মানবদেহে পরীক্ষা করার মতো টিকা তৈরি করা সম্ভব হয়। সীমাহীন পরিশ্রমের কারণে তার তিন সহকর্মীর দুইজন ইতোমধ্যে টিকতে না পেরে মাঝপথে সটকে পড়েন। আরেকজনের শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। এবারও মানবদেহে টিকার উপযোগিতা পরীক্ষা করার জন্য নিজেকেই বেছে নিতে হয়। সবশেষে ১৮৯৭ সালের ১০ জানুয়ারি নিজের শরীরে টিকার পরীক্ষা চালান। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জ্বর ও ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়লেও ফলাফল আসে দুর্দান্ত। বোম্বের কয়েদিদের মাঝে এর প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়া যায়। খুব দ্রুত এ টিকা ব্যবহার করে পুনা, পালামপুর, সিন্ধু ও হায়দ্রারাবাদে অসামান্য সুফল আসে।
বিশ্বজুড়ে কলেরা ও প্লেগের টিকার আবিষ্কারক হিসেবে হফকিনের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। গ্র্যান্ট মেডিকেল কলেজের করিডোরে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত গবেষণাগারটিকে আরেকটি সরকারি দপ্তরে স্থানান্তর করে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপন করা হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি 'হফকিন ইনস্টিটিউট' নামে পরিচিত।
চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার
ডিপথেরিয়া চিকিৎসার প্রতিষেধক সিরাম থেরাপি উদ্ভাবন করে ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন জার্মান বিজ্ঞানী অ্যাডলফ এমিল ফন বেহরিং (১৮৫৪-১৯১৭)। ডিপথেরিয়া এন্টিটোক্সিন আবিষ্কার করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তার এ আবিষ্কারের জন্য ইতিহাসে তিনি Saviour of children হিসেবে পরিচিতি পান। তার পরে জাপানী চিকিৎসক শিবাসাবুরো কিতাসাতো ডিপথেরিয়া এবং ধনুষ্টংকারের টিকা আবিষ্কার করেন।
পোলিও ও ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা
আমাদের দেশে প্রায় সব শিশুকেই পোলিও টিকা দেওয়া হয়। ফলে এ নামটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। পোলিও মানুষকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ করে ফেলতে পারে। হতে পারে মৃত্যুও। সাধারণত এ রোগ হলে হাত-পা শুকিয়ে যায়। এই রোগের টিকা আবিষ্কার হওয়ার আগে অসংখ্য আক্রান্ত মানুষ মারা গেছে। ১৯৫৫ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী জোনাস এডোয়ার্ড সল্ক (১৯১৪-১৯৯৫) পোলিওর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার করেন। তার এ আবিষ্কার বহু প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। ইতিহাসে এটি স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত। ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে এশিয়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ঘটলে প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। এশিয়ান ফ্লু নামে এই মহামারি চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৯৪৫ সালে সামরিক ব্যক্তিদের মাঝে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা প্রয়োগের প্রথম অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। পরের বছর সর্বসাধারণের মাঝেও এ টিকা প্রয়োগ করা হয়। টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র, জোনাস এডোয়ার্ড সল্ক—যারা পোলিও টিকা আবিষ্কার করেছিলেন তারাই ছিলেন এ টিকা তৈরির গবেষকদলের মূল ব্যক্তি। স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রতি ৬৭জন মার্কিন সেনার একজনের মৃত্যু হলে সরকার এই মহামারির টিকা আবিষ্কারের জন্য মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালায়।
১৯৫৭ সালে হংকং থেকে ছড়িয়ে পড়া এশিয়ান ফ্লু মহামারি আকার ধারণ করার শুরুতেই মার্কিন বিজ্ঞানী মরিস হিলম্যান তার সহকর্মীদের নিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করে প্রস্তুত হয়ে থাকেন। এই মহামারিতে প্রায় ৭০ হাজার মার্কিন নাগরিক প্রাণ হারায়। গবেষকদের ধারণা, হিলম্যানের টিকা না থাকলে অন্তত ১ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক মারা যেত। স্বাস্থ্য গবেষকরা জীবন রক্ষার এ কৃতিত্ব হিলম্যানের টিকাকে দেন।
করোনার টিকা স্পুটনিক-৫:
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহান শহর থেকে 'কোভিড-১৯' বা 'করোনা' নামে যে মহামারিটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে তাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে দেশে দেশে। জীবাণুর কাছে মানুষের জীবন-জীবিকা যখন হেরে যাচ্ছে তখন চলতি মাসের এগারো তারিখ রুশ প্রেসিডেন্ট ব্লাদিমির পুতিন জানালেন রাশিয়া করোনার টিকা ইতোমধ্যে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় 'স্পুটনিক-৫' নামের এই টিকা উদ্ভাবন করেছে দেশটির 'গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট'। গণমাধ্যমকে পুতিন বলেছেন,'আমি জানি, এই টিকা পুরোটাই কার্যকর। এর প্রতিরোধ ক্ষমতা টেকসই।'পুতিন এ কথাও বলেছেন, এ টিকা তার মেয়েকে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, রাশিয়া যথাযথ নিয়ম না মেনে তাড়াহুড়ো করে এ টিকাটি ছেড়েছে। তাই এর কার্যকারিতা নিয়ে তারা গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন। সংক্রামক রোগ বিষয়ের মার্কিন বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি ফসি বলেছেন,'রাশিয়া বলছে এই টিকা নিরাপদ এবং এর কার্যকারিতা প্রমাণিত। তবে এ নিয়ে আমার প্রবল সন্দেহ রয়েছে। টিকা হাতে পাওয়া আর তা নিরাপদ ও কার্যকর বলে প্রমাণ করা দুটি ভিন্ন জিনিস।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রায় অভিন্ন কথা বলছে। পুতিন টিকাটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই এর কার্যকারিতা নিয়ে গণমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে বসেছেন। অথচ পশ্চিমা সূত্র জানাচ্ছে দুই হাজারের বেশি লোকের ওপর শেষ ধাপের পরীক্ষা এখনো বাকি।
আরো টিকা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ২৫টি রোগের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মাঝে কলেরা, প্লেগ, অ্যানথ্র্যাক্স, হাম, রুবেলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডিপথেরিয়া, মাম্পস, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস এ এবং বি, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, পোলিও, জলাতঙ্ক ইত্যাদি রোগ রয়েছে। প্রতিটি রোগের টিকা আবিষ্কারের ইতিহাস আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু মহামারি ও মড়কের হাত থেকে বাঁচার জন্য টিকার যে বিকল্প নেই এ কথা মানা ছাড়া উপায় নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর টিকার মাধ্যমে আড়াই মিলিয়ন মৃত্যু প্রতিরোধ হয়।
এখনো বহু রোগের টিকা আবিষ্কার করতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের তিয়াত্তর বছর হতে চলল এখনো এর টিকা উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। সার্স, মার্স বা এইডসের মতো ঘাতক ব্যধির টিকা এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: এ লেখায় যেসব তথ্য ব্যবহার করেছি তার বেশির ভাগই'দি কলেজ অব ফিজিশিয়ান অব ফিলাডালফিয়া' এর ওয়েবসাইট The History of Vaccines থেকে নেয়া। এ ছাড়া জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি, বিবিসি এবং immune.org, healthaffairs.org, sobbanglay.com, vikaspedia.in,roar.media, chop.edu, haffkineinstitute.org ওয়েবসাইটগুলো থেকে তথ্যসাহায্য নিয়েছি। এর বাইরেও কোনো বই বা ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে থাকতে পারি। সবার কাছে কৃতজ্ঞতা।