মানচিত্রকরের বন্ধু রাজা দ্বিতীয় রজার ও আল-ইদ্রিসি
সাল ১১৪৫। সিসিলির রাজপ্রাসাদ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে লেবু ও কমলা বনের উষ্ণ সুবাস। আঁকার টেবিলের দুই প্রান্তে বসে পরস্পরের দিকে শ্যেনদৃষ্টি হানছেন দুই ভদ্রলোক। তাদের দুজনের মধ্যকার তফাতগুলো বেশ প্রকট। একজন দীর্ঘকায়, কর্কশ কণ্ঠস্বরের অধিকারী, এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। তিনি সিসিলির রাজা। অন্য মানুষটি কথাবার্তায় কুশলী ও সংযত, স্বভাবতই বিদ্বান। ধর্মমতে তিনি মুসলিম, এসেছেন উত্তর আফ্রিকা থেকে।
তখন চলছে প্রথম ধর্মযুদ্ধ। খ্রিস্টান ও মুসলিম যোদ্ধারা পবিত্র ভূমিতে একে অপরের উপর হামলে পড়ছে, রক্তগঙ্গা বইছে যুদ্ধে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, রাজা ও বিদ্বান মানুষটির মধ্যে রয়েছে গভীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের অভিপ্রায়ে পৃথক ভূমিকা পালন করে চলেছেন তারা। রাজা অর্থ ও সহায়তাদাতা। বিনিময়ে তিনি পর্যটক, বণিক ও তীর্থযাত্রীদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন। অপরদিকে, মুসলিম ব্যক্তিটি এসব তথ্যকে একীভূত করে চালাচ্ছেন তার গবেষণাকর্ম। তৈরি করছেন দ্বাদশ শতকের শ্রেষ্ঠতম মানচিত্র।
রাজা রজার দি হটভিলের জন্ম ১০৯৫ সালে। তিনি ছিলেন যুদ্ধবাজ নরমানদের পৌত্র। তিনি সেই নর্সদের উত্তরসূরী, যারা সম্পদ লুণ্ঠন ও নরহত্যার উদ্দেশ্যে ইতালিতে অনুপ্রবেশ করেছিল। তবে ১০৬৬ সালে ইংল্যান্ড দখল করেছিল যে নরমানরা, তাদের তুলনায় এই দক্ষিণী নরমানরা ছিল অনেকটাই আলাদা। একটি কথা তারা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে ক্ষমতাকে নিজেদের দখলে আনার ক্ষেত্রে পরাজিত জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল আরো সহজতর ও নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে উঠতে পারে, যদি তারা বিজিতদের সঙ্গে নিয়ে একত্রে পথ চলে, তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে, তাদের জ্ঞানের আলোয় নিজেরাও আলোকিত হয়। সিসিলিতে দি হটভিলরা খ্রিস্টান ও মুসলিমদের নিয়ে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলেন, যেটি মুষ্টিমেয় কয়েক বছরের জন্য হলেও, বহন করেছিল ইউরোপের সবচেয়ে বহুসংস্কৃতিবাদী, শিক্ষিত ও সহনশীল সমাজের খেতাব।
দ্বিতীয় রজারের বয়স তখন প্রায় পাঁচ। পালের্মোর রাজপ্রাসাদে বসে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করছেন গ্রীক ও মুসলিম শিক্ষাগুরুদের কাছে। ঠিক এমন সময়ই, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্তে, মুসলিম অধ্যুষিত সিউটা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন সেই বালকটি, যিনি পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন দ্বিতীয় রজারের প্রিয়তম বন্ধু। বালকের নাম (আগে একটু লম্বা শ্বাস নিয়ে নিন) আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে-মুহাম্মদ ইবনে-আব্দুল্লাহ ইবনে-ইদ্রিস আল-শরিফ আল-ইদ্রিসি (সাধারণভাবে 'ইদ্রিসি' বা 'ইদ্রিস')। 'আল-শরিফ' অর্থ হলো অভিজাত। আল-ইদ্রিসির পূর্বপুরুষরা ছিলেন আদতেই সত্যিকারের অভিজাতবংশীয় (রজারের পরিবারের একদম বিপরীত)। তারা ছিলেন সেই খলিফাদের বংশধর, যারা শাসন করতেন স্পেনের মালাগা অঞ্চল।
গুণে-মানে আল-ইদ্রিসির শিক্ষাজীবন ছিল এমনকী রজার অপেক্ষাও শ্রেয়তর। তিনি পড়াশোনা করেন স্পেনের কর্ডোবার বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর, ১৯৬০-র দশকের কিছু হিপ্পির মতোই, কবিতা লিখতে লিখতে পাড়ি জমান ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায়। সম্ভবত, আল-ইদ্রিসি পালানোর পথ খুঁজছিলেন নিজ জন্মভূমির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকেও। তবে অন্তরালের কারণ যা-ই হোক, ১১৩৮ সালে তিনি পেয়ে যান সিসিলির সদ্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজা দ্বিতীয় রজারের অদ্ভুত আমন্ত্রন। সেই ডাকে তিনি সাড়াও দেন। হয়তো এ কারণে যে, তিনি শুনেছিলেন এই রজার অন্যান্য খ্রিস্টানদের মতো নন। এই রজার নাকি কেবল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে আগ্রহী নন, বরং তিনি চান নিজের মনের পরিধিকেও বিস্তৃত করতে। ইতোমধ্যেই রজারের রাজসভা লাভ করেছিল দারুণ খ্যাতি, কেননা সেখানে শোভাবর্ধন করছিলেন নামকরা সব চিকিৎসক, গণিতবিদ, জ্যোতিষী ও কবি। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার ছিলেন মুসলিম। প্রমোদ উদ্যানে বসে বিতর্কে মেতে উঠতেন তারা। রজারের প্রস্তর প্রাঙ্গনে বসে লিপিবদ্ধ করতেন নিজেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বয়ান।
মনে প্রশ্ন জাগে, রজার কি মুসলিমদের ভূমিতে নিজের ক্ষমতাকে বিস্তৃত করার জন্য আল-ইদ্রিসির পরামর্শ চেয়েছিলেন? সবচেয়ে নিকটবর্তী সীমানায়, সিসিলি থেকে উত্তর আফ্রিকার দূরত্ব ছিল মাত্র ১৫০ কিলোমিটার (৯০ মাইল)। রজার খুব ভালো করেই জানতেন, কেউ যদি কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর এবং সেখানকার বাণিজ্যের উপর নিজের ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে চায়, সেক্ষেত্রে তাকে সর্বাগ্রে দক্ষিণী উপকূল ও মুসলিম যুবরাজদের উপর নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে হবে। বিশেষত শেষোক্তদের নিয়ন্ত্রণ লাভ খুবই জরুরি, কেননা তারা সর্বদাই ষড়যন্ত্র আঁটছেন সম্প্রতি নরমানদের কাছে খোয়ানো সিসিলির কমলা ও লেবু কাননের দখলদারিত্ব ফিরে পেতে।
আল-ইদ্রিসির সিসিলিতে পদার্পণের মাত্র বছর তিনেক পূর্বেই, পবিত্র রোমান সম্রাটের কাছে রজারের নামে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন বাইজেন্টিয়াম ও ভেনিসের দূতরা। বাইজেন্টাইন ও ভেনিশিয়ানরা চাইতেন রজার যেন আফ্রিকার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন এ অঞ্চলের 'প্রকৃত হকদার শাসক', অর্থাৎ অন্য খ্রিস্টানদের নিকট। তারা সিসিলিয়ান রাজাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এ কারণে যে, তিনি ছিলেন আরবিভাষী, এবং তিনি মুসলিম নগরীগুলো দখলের পর সাধারণত আইন পরিচালনার জন্য আদালতের দায়ভার এবং নিজেদের ধর্ম পালনের অধিকার মুসলিম প্রজাদের উপরই ছেড়ে দিতেন। অর্থাৎ, রজারের আচরণ আর যা-ই হোক, একজন ভালো খ্রিস্টানের ন্যায় ছিল না।
বিশ্বাস না হলে স্মরণ করা যায় তার ন্যাক্কারজনক একটি আচরণের কথা, যখন জেরুজালেমের নরমান রাজা বল্ডউইন সিসিলিতে দূত পাঠিয়ে রজারকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন উত্তর আফ্রিকান একটি রাজ্য জয় করে সেখানকার সকল অধিবাসীকে খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরিত করেন। রজারের খ্রিস্টান যোদ্ধারাও কায়মনোবাক্যে সায় জানিয়েছিল এই অসাধারণ প্রস্তাবে। কিন্তু রজারের রাজসভার ইতিহাস রচনা করেছেন ইবনে আল-আথির নামের যে আরব ইতিহাসবিদ, তিনি বরাতে জানা যায় এক বিচিত্র ঘটনার আখ্যান। রাজা বল্ডউইনের দূতের কাছে সব শোনার পর রজার তার পা উঁচিয়ে বায়ুত্যাগের ভঙ্গি করলেন, এবং তার নাইটদের বলেন, "আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা যে পরামর্শ দেন তার চেয়ে বায়ুত্যাগ ঢের ভালো।"
অন্যান্য খ্রিস্টান শাসকরাও মনে করতেন, রজার যেন মুসলিমদের একটু বেশিই সম্মান করেন। যখন আল-ইদ্রিসি সিসিলিয়ান রাজ দরবারে এসে হাজির হন, তখনো অতিরিক্ত খাতির ও সৌজন্যপ্রকাশস্বরূপ তাকে রাজার উপস্থিতিতেই খচ্চরে চড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। আল-ইদ্রিসিকে দেখে, বাইজেন্টাইন শৈলীর মুকুটশোভিত, কাঁধস্পর্শী মুক্তোর দুল ঝুলতে থাকা রাজাও, নিজের সিংহাসন ছেড়ে উঠে আসেন, স্বাগত জানান তার অতিথিকে। মুসলিম ইতিহাসবিদরা আমাদের জানান, অচিরেই আল-ইদ্রিসির বসার জায়গা হয় রাজার ঠিক পাশেই, যেন যখন-খুশি রজারের কানে মন্ত্রণা দিতে পারেন তিনি।
তবে আল-ইদ্রিসি রাজাকে সব কথা যে কেবল গোপনে, ফিসফিস করেই বলতেন, তা কিন্তু নয়। রাজার সাথে আল-ইদ্রিসির অনেক কথোপকথন প্রকাশ্যে, সর্বসম্মুখেই হতো। ইবনে আল-আথিরের লেখা থেকে জানা যায় আরেক কাহিনী। খবর আসে, রজারের যোদ্ধারা নাকি ত্রিপলি নগরী আক্রমণ করে প্রচুর মুসলিমকে হত্যা করেছে। এ খবরে খ্রিস্টান নাইটরা উল্লাস প্রকাশ করেন, কিন্তু রাজার ঠিক পাশেই অধিষ্ঠিত আল-ইদ্রিসি কোনো অভিব্যক্তিই প্রকাশ করেন না। রজার তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "কোথায় তোমাদের আল্লাহ? তিনি কি তার বান্দাদের কথা ভুলে গেছেন?" রাজার এ কথায় আল-ইদ্রিসির সাহসী প্রত্যুত্তর ছিল, "যদি আমার আল্লাহ অনেক দূরে থাকেন, তবে তিনি অংশ নিচ্ছিলেন এডেসা অধিগ্রহণে। মুসলিমরা খানিক আগেই খ্রিস্টানদের থেকে সেটি কেড়ে নিয়েছে।" এ কথা শুনে উপস্থিত খ্রিস্টানরা সশব্দে ব্যাঙ্গ করতে থাকেন আল-ইদ্রিসিকে। কিন্তু তাদের রাজা বলেন, "ঈশ্বরের দোহাই, তোমরা তার কথায় হেসো না! এই মানুষটি সবসময় সত্যি কথা বলে।"
বস্তুতই, এই গল্পের খ্রিস্টান রাজা এবং তার মুসলিম বিদ্বান বন্ধুটির সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ট ছিল যে, সিসিলিয়ানদের মাঝে গুজব রটে গিয়েছিল, রজার নাকি গোপনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তবে তাদের বন্ধুত্বের আসল ভিত্তি ছিল অন্য কিছু। সেটি হলো, তারা দুজন মিলে কাজ করছিলেন রজারের মস্তিষ্কপ্রসূত এক মহাপ্রকল্পে: বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও নিখুঁত মানচিত্র নির্মাণ। মানচিত্রটি তৈরি হবে রূপা দিয়ে, যেখানে খোদাই করা থাকবে পৃথিবীর সকল দ্বীপ ও উপকূলের প্রান্তরেখা।
মধ্যযুগীয় অধিকাংশ মানচিত্র নির্মাতার মতোই, তারাও শুরু করেছিলেন প্রাচীন গ্রীক-মিশরীয় ক্লডিয়াস টলেমির লেখনীর মাধ্যমে। তবে তারা চাননি ক্লডিয়াসের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভুল-ত্রুটির পুনরুৎপাদনে সন্তুষ্ট থাকতে। আল-ইদ্রিসির নিজের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি ও রজার বিভিন্ন মুসলিম ভূগোলবিদের বুদ্ধি নেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ইবনে-হাওকাল, যিনি ৮৭২ সালের দিকে পালের্মো ভ্রমণ করেছিলেন। ভূগোলের ধ্রুপদী রচনাকর্মের 'বিশদ ও ক্লান্তিকর বিশ্লেষণ' শেষে দুই মানচিত্র নির্মাতা সিদ্ধান্ত নেন তাদের নিজস্ব ও স্বাধীন অনুসন্ধান শুরু করার।
রাজা নির্দেশ দেন সকল 'অভিজ্ঞ অভিযাত্রী', যেমন নাবিক, বণিক, তীর্থযাত্রীদের তার সাম্রাজ্যের সকল প্রান্ত থেকে পালের্মোয় এসে জড়ো হতে, যেন তাদেরকে জেরা করা সম্ভব হয়। তারপর তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত নতুন তথ্যগুলোর সাথে বিদ্যমান মানচিত্রসমূহের তুলনা করতে আরম্ভ করেন দুই মানচিত্র নির্মাতা। বিশালাকার এক আঁকার বোর্ডের উপর লোহার কম্পাস ব্যবহারের মাধ্যমে কাজটি করেন তারা।
বহু বছরের ঘামঝরানো সাধনা শেষে, দুজন প্রস্তুত হয়ে ওঠেন চূড়ান্ত মানচিত্র নির্মাণের জন্য। আল-সাফাদি নামের আরেক মুসলিম ইতিহাসবিদ লিখেছেন, রাজা নাকি আল-ইদ্রিসিকে এনে দেন ৪ লক্ষ ড্রাম রূপা। স্যাকরাদের বলে রূপাগুলো দিয়ে এমন এক রৌপ্যক্ষেত্র তৈরি করানো হয়, যেমনটি 'স্বর্গে দেখা যায়'। রজার এতটাই খুশি হন যে, তার বন্ধু মোট রূপার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ খরচ করলেও, বাকিটা তাকে রেখে দিতে বলেন।
সুদীর্ঘ, সমতল মানচিত্রটির পরিমাপ ছিল প্রায় ৩.৫ × ১.৫ মিটার (১১ × ৫ ফুট) এবং ওজন ছিল প্রায় ১৮০ কিলোগ্রাম (৪০০ পাউন্ড)। তবে এই চমকদার বস্তুটি যত মূল্যবানই হোক না কেন, তার চেয়েও ঢের বেশি মূল্যবান ছিল যা এর পৃষ্ঠতলে খোদাই করা হয়েছিল – চেনা পৃথিবীর যাবতীয় সীমারেখা।
আল-ইদ্রিসি যেভাবে পৃথিবীকে কল্পনা করেছিলেন, তাতে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। ইংল্যান্ড সেখানে নিছকই ক্ষুদ্র এক বিন্দু, যা ইউরোপ উপকূলের কাছে স্ফীত হয়েছে। এবং আফ্রিকা গিয়ে পৌঁছেছে অ্যান্টার্কটিকায় – আপনি এখান থেকে জলপথে ঘুরে ভারত যেতে পারবেন না। তবে নীল নদটা এখানে ঠিকভাবেই এসেছে। এ মানচিত্রে দেখা যায় কীভাবে নীলাভ নীল নদ শুরু হয় ইথিওপিয়া থেকে, আর শ্বেত নীল নদের উৎস কেন্দ্রীয় আফ্রিকার চাঁদের পাহাড় (যেটি উনবিংশ শতকের মধ্যভাগের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ ভূগোলবিদরা নিশ্চিত করতে পারেননি)। মানচিত্রটিতে এমনকী স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও জাপানকেও দেখানো হয়েছে। প্রাচীন গ্রীক ভূগোলবিদদের মতো, আল-ইদ্রিসিও বিশ্বাস করতেন পৃথিবী গোলাকার, এবং হিসেব করে বের করেছিলেন এর পরিধি প্রায় ৩৭,০০০ কিলোমিটার (২৩,০০০ মাইল)। অবশ্য, প্রকৃতপক্ষে এটি ৪০,০০০ কিলোমিটারের আশেপাশে (২৫,০০০ মাইল)।
মানচিত্রটি তৎকালীন চীনা মানচিত্রসমূহের মতো অতটা বাস্তবসম্মত ছিল না বটে, কিন্তু আল-ইদ্রিসি যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন উত্তর ইউরোপের ওই সময়কার মানচিত্র নির্মাতাদের চেয়ে, যারা পৃথিবীর প্রান্তরেখার বদলে স্বর্গের রাস্তা প্রদর্শনেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
আল-ইদ্রিসি তার মানচিত্রটির যোগ্য সঙ্গী হিসেবে একটি বই রচনা করেন – 'নুজহাত আল-মুশতাক ফি'খিতিরাক আল-আফার' (দ্য বুক অভ প্লেজেন্ট জার্নিস ইনটু ফারঅ্যাওয়ে ল্যান্ডস)। বইটি অবশ্য 'দ্য বুক অভ রজার' নামেই বেশি পরিচিত। এটিকে বলা যায় এমন এক জ্ঞানকোষ, যেখানে বর্ণিত হয়েছে চেনা পৃথিবীর মানুষজন ... তাদের সমুদ্র, পাহাড় ও পরিমাপ ... ফসল, খাজনা ও সব ধরনের দালানকোঠা... এবং পরস্পরসম্বন্ধীয় চমকপ্রদ সব বিষয়ের ইতিবৃত্ত।
তারপরও, এত পরিশ্রম ও নিষ্ঠা সত্ত্বেও, দুই মানচিত্র নির্মাতা কিছু বিষয় আশ্চর্যজনকভাবে ভুল করেছিলেন। তারা লিখেছিলেন ওয়াক ওয়াক দ্বীপের গাছে নাকি নারীদের মাথাসদৃশ, কথা বলতে সক্ষম ফল জন্মায়; সারাদিন এই ফলেরা ডাকতে থাকে 'ওয়াক ওয়াক!' তাদের বইটি আরো জানায়, নরওয়ের অধিবাসীরা নাকি ঘাড় ছাড়াই জন্মায়, এবং ইংল্যান্ড নাকি অবস্থিত তিমিরাচ্ছন্ন মহাসাগরে, যেখানে বিরাজ করে চিরস্থায়ী শীত ঋতু।
পনের বছরের খাটুনি শেষে, ১১৫৪ সালের জানুয়ারিতে, আল-ইদ্রিসি ঘোষণা দেন তার রূপার মানচিত্র ও বইটির কাজ অবশেষে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ততদিনে রজার বুড়িয়ে গেছেন। তিনি মারাও যান ওই বছরই।
আর ছয় বছরের মধ্যেই, তার রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটতে শুরু করে। রজারের উত্তরাধিকারী, রাজা উইলিয়াম দ্য ব্যাড মোটেই রজারের মতো ছিলেন না। বাবার মৃত্যুর পর বেশিদিন তিনি রজারের অধিকৃত আফ্রিকান অঞ্চলগুলোকে ধরে রাখতে পারেননি। ফলে ত্রিপলি চলে যায় মুসলিমদের হাতে। হাজারো খ্রিস্টান পালিয়ে আসে সিসিলিতে, যেখানে উইলিয়াম শাসনের ব্যাপারে থোড়াই কেয়ার করতেন।
১১৬১ সালের ৯ মার্চ সকালে বিদ্রোহীরা ঢুকে পড়ে রাজপ্রাসাদে। তারা খুলে দেয় ভূগর্ভস্থ কারাকক্ষের দরজা, এবং অস্ত্র সরবরাহ করে কারাবন্দিদের। উইলিয়াম ও তার পরিবারকেও নজরবন্দি করা হয়। পালের্মোর রাস্তা থেকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসে, ঘুরে বেড়াতে থাকে প্রাসাদময়। মুসলিম বিদ্বানদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়। বিক্ষোভকারীরা আগুন জ্বালিয়ে তাতে ছুড়ে ফেলতে থাকে বিভিন্ন বই, দলিল, করের নথি। মূল্যবান যা কিছু পাওয়া যায়, সবই আত্মসাৎ করা হয়। রূপার তৈরি পৃথিবীর মহামূল্যবান মানচিত্রটি সেদিন উধাও হয়ে যায়। আর কখনো দেখা মেলেনি সেটির।
সিসিলিতে সেদিন অপমৃত্যু ঘটে এমন এক সাম্রাজ্যের ধারণার, যেখানে ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষেরাও সুখে-শান্তিতে বাঁচতে পারে, বিতর্ক করতে পারে, জ্ঞানচর্চা চালাতে পারে। রজারের পুত্র ও তার পরিবার শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যায়, পুনরায় নিতে সক্ষম হয় সিসিলির নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু এরপর তাদের মনোযোগ সীমিত হয়ে পড়ে কেবলই চার দেয়ালের ভিতর নিজেদের সুরক্ষায়। গোটা ইউরোপজুড়েই দেখা যায় একই চিত্র। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের সাথে বিচ্ছেদ ঘটে বাইরের পৃথিবীর। নিজেদের দিগন্তের ওপাশে কী আছে, এ নিয়ে ভাবাটাও হয়ে পড়ে বিষম ঝুঁকির ব্যাপার। কেননা তাতে ভয় রয়েছে ধর্মবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে শাস্তি পাবার। মানচিত্র নির্মাণও হারিয়ে ফেলে তার মৌলিক উদ্দেশ্য। সেটি তখন খুঁজতে থাকে এসব প্রশ্নের উত্তর: কীভাবে পৃথিবীকে চিত্রায়িত করলে খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হবে? এবং কতগুলো দৈত্যের ছবি এঁকে মানচিত্রের শূন্যস্থানগুলো ভরিয়ে তোলা সম্ভব হবে?
সৌভাগ্যের বিষয় এটিই যে, বিক্ষোভকারীরা আল-ইদ্রিসির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ ধ্বংস করেনি। বেঁচে গিয়েছে 'দ্য বুক অভ রজার', এবং সেটির খসড়া মানচিত্রগুলো। তাছাড়া রাজা উইলিয়াম তার বাবার বৃদ্ধ সুহৃদকে দিয়ে আরেকটি বইও লেখান – 'গার্ডেনস অভ প্লেজার অ্যান্ড রিক্রিয়েশন অভ দ্য সোলস'। সেই বইটি রচনার পর আল-ইদ্রিসি সিউটায় নিজের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানে বসে তিনি শোক করতে থাকেন রজারের, তার সেই খ্রিস্টান বন্ধুর, যিনিও এককালে তার মতোই বুকে লালন করতেন পৃথিবীকে চেনার ও বোঝার তীব্র বাসনা।
"তার (রজারের) জ্ঞানান্বেষণের পরিধিকে বিবৃত করা অসম্ভব," লেখেন আল-ইদ্রিসি। "এতটাই গভীরভাবে, বিচক্ষণতার সাথে তিনি পড়াশোনা করতেন। তার স্বপ্নগুলোও অধিকাংশ মানুষের জাগ্রত চিন্তার চেয়ে অধিক মূল্যবান।"
আল-ইদ্রিসি জানতেন, একজন মানচিত্র নির্মাতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু হলেন এমন কেউ, যিনি আগ্রহী সেইসব গল্প জানতে, যেগুলো বলতে পারে তার মানচিত্র।
-
সূত্র: দি রোড টু দিয়ার গ্রন্থ অবলম্বনে