মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর ভয়ংকরতম পাখির ১৮,০০০ বছরের বন্ধুত্ব
'পৃথিবীর ভয়ংকরতম পাখি'র তকমাটা অনেক সময়ই জুটে থাকে সাউদার্ন ক্যাসোয়ারির কপালে।
নিজের চিরাচরিত বাসস্থান নিউগিনি ও নর্দার্ন অস্ট্রেলিয়ায় বেশ লাজুক ও গোপনীয়তাপ্রিয় হয়ে থাকলেও বন্দিদশায় বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে এই পাখি। যেমন ২০১৯ সালে একবার ক্যাসোয়ারির আক্রমণে মরতে বসেছিল ফ্লোরিডার এক ব্যক্তি।
কেউ যদি তাদের ধরতে উদ্যত হয় আর তারা সেটি টের পেয়ে যায়, তাহলেও ব্যাপারটিকে ভালোভাবে নেয় না এই ক্যাসোয়ারি। ১৯২৬ সালে এক অস্ট্রেলিয়ান কিশোর যখন একটি ক্যাসোয়ারিকে ধরতে গিয়েছিল, ফলাফল : ক্যাসোয়ারিটির আক্রমণে সেই কিশোরের গলা কাটা পড়েছিল চার ইঞ্চি লম্বা নখরে।
যদিও কোনো পাখির সঙ্গেই খুব বেশি সখ্য গড়ে তোলা পরামর্শযোগ্য নয়, তারপরও অন্তত ১৮,০০০ বছর আগে থেকেই নিউগিনির অধিবাসীরা ক্যাসোয়ারি প্রতিপালন করতে শুরু করে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে ক্যাসোয়ারিরা বেশ মানতও তাদের মানব-মনিবদের। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় শকুন ঘরানার পাখি প্রতিপালনের প্রাথমিক নিদর্শন।
শুনতে হয়তো অবাক লাগবে, কিন্তু মানুষ ক্যাসোয়ারির মতো নির্দয়-নিষ্ঠুর পাখিকেও পালন করা শুরু করেছে মুরগি পালনের অনেক আগে থেকে!
বস্তুত, নিউগিনিতে প্রথম মানুষের আবির্ভাব ঘটে নিদেনপক্ষে ৪২,০০০ বছর আগে। সেই প্রাচীন বসতি স্থাপনকারীরা দেখতে পায়, রেইন ফরেস্টের ভেতর নিজস্ব জগৎ গড়ে তুলেছে বিশালাকার, ভয়ংকরদর্শন, তীক্ষ্ণ পা-বিশিষ্ট ক্যাসোয়ারিরা। প্রথম প্রথম একটু ঘাবড়ে গেলেও অচিরেই তারা বুঝে যায়, কীভাবে এই পাখিদের কাজে লাগাতে হবে।
নিউগিনির পূর্বাঞ্চলীয় উচ্চভূমিতে রক শেল্টার সাইটের জন্য খননকার্য চালাতে গিয়ে সুসান বালমার নামের নিউজিল্যান্ডের এক প্রত্নতত্ত্ববিদ হদিস পান বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও পাখির দেহাবশেষের। সেসব দেহাবশেষের মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্যাসোয়ারির ডিমের খোসা। ধারণা করা যায়, সেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল বুনো ক্যাসোয়ারির বাসা থেকে।
রক শেল্টারের মানুষেরা কী করত ওই ডিমগুলো দিয়ে? সেটিই জানার উদ্দেশ্যে থ্রি-ডাইমেনশনাল লেজার মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ডিমের খোসাগুলো স্ক্যান করে দেখেন পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্রিস্টিনা ডগলাস ও তাঁর সহকর্মীরা।
পরিসংখ্যানগত মডেলিং, আধুনিক উটপাখির সঙ্গে তুলনা এবং খোসাগুলোর আনুবীক্ষণিক গঠনের ব্যাপারগুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয় এবং জানার চেষ্টা করা হয় যে খোসার ভেতরের ডিমগুলোর অবস্থা কেমন ছিল।
দেখা যায়, কিছু সদ্য পাড়া ডিমের গায়ে পোড়া দাগ রয়েছে, অর্থাৎ সম্ভবত ডিমগুলোকে রান্না করে খাওয়া হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ ডিমই বিশেষত ১১,০০০ থেকে ৯,০০০ বছর আগের, যা ছিল প্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপে। এ থেকে ধারণা করা যেতেই পারে, সম্ভবত তখনকার মানুষেরা ডিম না খেয়ে বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করত এবং সেসব বাচ্চাকে পালন করত।
এই অনুমানের আরও কিছু ভিত্তি রয়েছে। এককালে এই দ্বীপের কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ছিল ক্যাসোয়ারির মাংস ও পালক পুরস্কার হিসেবে প্রদান কিংবা বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিক্রির রীতি। এখনো তাদের অনেকেই বুনো পাখির বাসা থেকে ক্যাসোয়ারির ডিম সংগ্রহ করে এবং ক্যাসোয়ারির বাচ্চা পালন করে।
ডিম সংগ্রহ করা এবং বাচ্চা পালন করা পশুপাখি পোষার প্রাথমিক ধাপ হতে পারে, কিন্তু তারপরও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে ক্যাসোয়ারিকে পুরোদস্তুর পালনের ব্যাপারে, ঠিক যেভাবে ৮,০০০ বছর পূর্বে শুরু হয়েছিল মুরগি পালন। অথচ যদি এ দাবি সত্য হয় যে নিউগিনির প্রাচীন অধিবাসীরা আসলেই ক্যাসোয়ারি পালন করত, তাহলে নিঃসন্দেহে তারাই একদম গোড়ার দিককার মানবসমাজ, যারা পদ্ধতিগতভাবে পাখিদের পোষ মানাতে শুরু করেছিল।
আর এভাবেই, নতুন লব্ধ তথ্যগুলো বদলে দিচ্ছে পশুপাখি পোষার ব্যাপারে আমাদের এত দিনকার জানা সকল ভৌগোলিক জ্ঞান। কুকুর ও ছাগলের মতো স্তন্যপায়ীদেরই এত দিন সামগ্রিকভাবে পোষ্য জন্তুর তালিকায় সবার ওপরে রাখা হলেও এখন হয়তো সময় এসেছে মানুষের সঙ্গে অন্যান্য শকুন ঘরানার পাখির সম্পর্কের ব্যাপারটি খতিয়ে দেখার।
ক্যাসোয়ারির ডিমের খোসা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আরেকটি চমকপ্রদ সম্ভাবনাও উঁকি মারতে শুরু করে। সম্ভবত মানুষেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই ইনকিউবেশন পিরিয়ডের (তা দেওয়ার সময়) শেষ দিকে খুব অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ডিমগুলো সংগ্রহ করত।
এই কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। ক্যাসোয়ারির বাসা খুঁজে বের করা খুবই দুরূহ ব্যাপার এবং সেগুলো পাহারার দায়িত্বে থাকত পুরুষ ক্যাসোয়ারিরা। এদিকে ডিমগুলোর ইনকিউবেশন পিরিয়ডও স্থায়ী হয় ৫০ দিনের মতো।
একটি পরিণত অবস্থায় ক্যাসোয়ারির ডিম সংগ্রহের জন্য নিউগিনির অধিবাসীদের সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হতো কখন ও কোথায় ক্যাসোয়ারিরা বাসা তৈরি করছে। এই জানার জন্য ক্যাসোয়ারিদের গতিবিধির দিকেও রাখতে হতো সার্বক্ষণিক নজর।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, প্রাচীন আমলের মানুষদের পরিবেশের ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান ছিল এবং তা এতই বেশি যে আজকের দিনে কল্পনাও করাও কঠিন।
ভাসর কলেজের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ার এপ্রিল এম বেইস বলেন, এ ধরনের নতুন জ্ঞান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কত ছোট ও ভঙ্গুর সব দেহাবশেষও আমাদের দিতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক চর্চার সন্ধান।
নিউগিনির ক্যাসোয়ারিদের নিয়ে কাজে যেসব কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, সেগুলো অন্যান্য জায়গায় প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভবত আরও ভালোভাবে জানা সম্ভব যে মুরগি পালনেরও কত আগে থেকেই মানুষের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে পক্ষীকুল।
পরিশেষে এটাই বলব, ক্যাসোয়ারির ব্যাপারে দারুণ সব তথ্য জানলেন ভালো কথা, কিন্তু ভুলেও যেন নিজেদের বাড়িতে বসে ক্যাসোয়ারির ডিমে জন্ম দিতে যাবেন না!