মৃত্যুর মিছিল
৩৭.
তুষার ঝরা একদিন আবার রনের অফিসে হাজির হলো তারিক। আবোলতাবোল না-না বিষয়ে কথোপকথন ঘুরপাক খেয়ে চলল। হঠাৎ কি হলো বলতে পারবে না, পুরোনো কারখানার জানালাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, 'আসলে লোকে কি চায়?'
'কি বলতে চাইছ?' জানতে চাইল সে।
'ওহিওর ছোট এক শহর থেকে কঠিন এক টিনএজারকে তুলে এনে ট্রেনিং দিয়ে দেশের সেবায় ভয়ঙ্কর এবং জঘন্য সব কাজ করতে বাধ্য করলে তোমরা। বছর ঘুরতে ঘুরতে এক সময় বুড়িয়ে গেল সে। আগের চেয়ে নিপুণ হয়ে উঠল। তাকে অত্যন্ত দক্ষ শিকারিতে পরিণত করলে তুমি। খুবই নিপুণ মানুষখেকো।'
বড় করে শ্বাস নিল ও। সব কথা অবিরল ধারায় বেরিয়ে আসতে চাইছে। 'তারপর তার সাথে বেঈমানি করা হলো। তখন একটা কঠিন কিন্তু কাজের রফা খাড়া করল সে। ক্ষমা এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হলো। তোমাকে ধন্যবাদ জানাল ওরা, তারপর নিরামিষীদের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিল। আশা করা হলো এখন থেকে সুবোধ শিশুর মতো বাঁধাকপি আর গাজর খেতে শুরু করবে সে। হর বছর আমার মতো কয়েক শো শিকারীকে রিলিজ করে বেসামরিক দুনিয়ায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে। একজন শিকারীকে কোনো সমস্যা ছাড়া ঘরে ফেরত পাঠানো যাবে চিন্তা করা, সে তার সব জিনিসপত্র আর দক্ষতা তুলে রাখবে বলে আশা করাই তো অস্বাভাবিক। বিশেষ করে...বিশেষ করে বেঈমানির পর।'
'হয়তো সেজন্যেই আমরা এখানে,' বলার চেষ্টা করল রন।
'আর বলো না,' বলল ও। 'তোমার তাতে কিছু এসে যায় বলে মনে হয়?'
'তোমার কিছু এসে যায়?'
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল ও। 'গত চারমাস একে অপরকে দেখছি আমরা। এখনও বলার সময় আসেনি বলেই মনে হয়। সবার হয়ে কথা বলতে পারব না। সত্যি কথা হলো, এটা কি কাজে লাগার জন্যে, নাকি কিছু কিছু মানুষের মনে অপরাধবোধ জাগিয়ে দেয়ার জন্যে। যারা লোক নিয়োগ করে ট্রেনিং দিয়ে তারপর বেঈমানি করেছে।'
'তোমার কি মনে হয়?'
ওর দিকে ফিরল ও। 'আমার মনে হয় আঙ্কল স্যামের কাছ থেকে তুমি যে পরিমাণ টাকা খসাচ্ছ, সে হিসাবে বড্ড বেশি প্রশ্ন করো।'
৩৮.
রাত ২:০০ টা। ফের মাথায় নাইট ভিশন লাগিয়ে বারান্দায় এসেছে ও। ফিরে এসেছে ওরাও। আর কিছু না হলেও এঞ্জিন আর গানের আওয়াজ এখন আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। স্নোমোবাইলগুলোর মাঝখানে বরফের উপর একটা আগুন জ্বালানো হয়েছে। নাচানাচি করছে ওরা, গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে। ওদের মাথার ভেতরের কোনো অংশ হাজার বছর আগের রেয়াজের কথা মনে করে বসেছে কিনা ভাবল ও। সেই আইস ফিল্ড বা সাভানার মতোই প্রাচীন কোনো রেয়াজ।
মদ খেতে খেতে নাচতে থাকা অবয়বগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকার সময় হতচ্ছাড়া ফিসফিস কণ্ঠস্বরটা আবার ফিরে এলো। সেলারে চলে যাও। সেলারের ওমাথায় লম্বা বাক্সটা আছে। সেই একইরকম নাইট ভিশন স্কোপসহ দুর্দান্ত রেমিংটন মডেল ৭০০ রাইফেল, তবে ওটার ক্রসহেয়ার আছে। কি এমন ক্ষতি হবে? বরং তোমার ভালোই লাগতে পারে। ওই চিড়িয়াগুলোকে স্ক্যান করে ট্র্যাক করো। ওদের প্রত্যেকের বুকে ক্রসহেয়ার তাক করো। ৭.৬২ এমএম ন্যাটো কার্তুজের ভার অনুভব করো তোমার হাতে। রাইফেলের মাথায় একটা সাউন্ড সাপ্রেসর থাকলে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই, কি হচ্ছে কেউ বুঝে ওঠার আগেই, শুইয়ে দিতে পারবে সবকটাকে।
প্র্যাক্টিস। সম্ভাবনার বলয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাও তোমার মনটাকে, কার্তুজ, উইন্ডোজ, গ্রেইন আর গতিবেগের কাছে। কি হতে পারে আঁচ করো। 'যাও' বলার পর 'মিশন সফল হয়েছে' বলার আগে কতটুকু সময় লাগতে পারে।'
তোমার ভালো লাগতেও পারে। ভালো লাগতেও পারে।
'না,' স্কোপ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল ও। 'পারব না। ফিরে যেতে পারব না।'
আরও একটা ঘণ্টা বারান্দায় বসে থাকল ও। চোখজোড়া সয়ে এলে আরো নড়াচড়া চোখে পড়ল। আবার স্কোপ তুলে নিল ও। দুটো স্নো মেশিন এগিয়ে এসেছে, ওগুলোর ড্রাইভারের পেছনের সিটে অবয়ব দেখা যাচ্ছে। তুষার ঢাকা তীরে উঠে এলো ওরা। ঝটপট কাজে নামল লোকজন। নিজেদের কাজের দিকে মনোযোগ। আনুমানিক আট বা নয়টা আবর্জনার বস্তা খালি করা হলো ওর জমিনে। মজা আরেক ডিগ্রি বাড়িয়ে তুলতে আগেই ছুরি দিয়ে ব্যাগগুলো কয়েক জায়গায় কেটে রাখা হয়েছে। ফলে বরফ স্পর্শ করতেই ফেটে যাচ্ছে, চতুর্দিকে ময়লা ছিটাচ্ছে। আরও কয়েক দফা চিৎকার চেঁচামেচি, তারপর পেছনে আবর্জনা আর মিটমিট করে জ্বলতে থাকা আগুন ফেলে সগর্জনে ছুটে চলে গেল স্নোমোবাইলগুলো। লেকের উপর দিয়ে মধ্যখানের সতর্কবাণী লেখা সাইনগুলেকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় স্নোমোবাইলগুলোর বাতির দিকে তাকিয়ে রইল ও। এক সময় উধাও হয়ে গেল ওগুলো।
নাইট ভিশন স্কোপটা এখন ওর কোলে রয়েছে। ফিসফিসানি ফিরে এলো: স্নোমোবাইলগুলোর এঞ্জিনে গোটা দুই বুলেট সেঁধিয়ে দিয়ে ওখানেই ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে পারতে। ভীষণ রকম বেআইনি, কিন্তু ওদের মনোযোগ পাওয়া যেত, ঠিক?'
ঠিক।
৩৯.
রনের সাথে ওর পরের সাক্ষাৎ। সোজাসুজি কাজের কথা পাড়ল ও। 'দক্ষিণে কি ধরনের রিপোর্ট পাঠাচ্ছ?'
লোকটাকে মনে হয় থতমত খাইয়ে দিয়েছে বলে মনে হলো। 'রিপোর্ট?'
'অবশ্যই। আমার অগ্রগতি সংক্রান্ত কথাবার্তা। কিভাবে মানিয়ে নিচ্ছি, এই জাতীয় জিনিস আরকি।'
এক মুহূর্ত চুপ থাকল সে। হাসি হাসি চোখজোড়ার আড়ালে এখন প্রচুর হিসাবনিকাশ চলছে, আঁচ করল তারিক। 'এই মামুলি কথাবার্তা, ব্যস। ভালোই দেখাচ্ছ তুমি।'
'তাই কি?'
'আমার তো তাই মনে হয়।'
'গুড।' এক মুহূর্ত চুপ থেকে মাথার ভেতরের ভাবনাগুলোকে উল্টেপাল্টে দেখল ও। 'তাহলে ওদের এই বার্তাটা পাঠাতে পার। তোমার সাথে আমার সাক্ষাৎগুলোর সময় আমি পুরোপুরি তোমার সাথে ছিলাম না, রন। মোটেও না। সম্ভবত মন খুলে কথা বলা আমার ধাতেই নেই। কিন্তু এর উপর নির্ভর করতে পার। আমি এটা খোয়াব না। বন্দুকের দোকানে ঢুকে তারপর বেরিয়ে এসে একদল বেসামরিক লোকজনকে শেষ করব না। ১৬০০ পেনসিলভিনিয়া অ্যাভিনিউর ওদিকে ঘুরঘুর করতেও যাচ্ছি না। আমি ঠিক হয়ে যাবো।'
হাসল সে। 'আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।'
'অবশ্যই সন্দেহ ছিল,' বলল ও। উত্তরে হাসল। 'কিন্তু কথাটা তুমি বেশ ভদ্রভাবে বলেছ এই আরকি।'
৪০.
শনিবার। ঝলমলে রোদ উঠেছে। নানসেন শহরের দুটো সার্ভিস স্টেশনের একটা গ্লেন'স গ্যাস অ্যান্ড রিপেয়ারে পুলিসের কর্তার সাথে দেখা করল তারিক। তার গাঢ় নীল রংয়ের ক্রুজারটা পাম্পের কছে পার্ক করা ছিল। পথঘাট তুষারের হামলা থেকে বাঁচাতে রোড-সল্ট ছিটিয়ে দেয়ায় এক ধরনের ভৌতিক আভা লেগেছে ওটার গায়ে। গ্যারাজের একধারে নিজের গাড়ি পার্ক করে সার্ভিস-বে ধরে আগে বাড়ার সময় ওর উপর লক্ষ রাখা হচ্ছে, এমন একটা অনুভূতি হলো।
ভেতরে উঁকি দিয়ে কয়েকজন লোককে তিনটা গাড়ি মেরামতের কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখল ও। গাড়িগুলোর হুড তুলে দেয়া হয়েছে। পরিচিত একটা ইউনিফর্মও চোখে পড়ল। কালো স্নোমোবাইল জাম্পস্যুট। কফি খাচ্ছিল পুলিসের কর্তা, ওর সাথে কথা বলতে এগিয়ে এলো বিশালবপু লোকটা। ভারী নীল রংয়ের ইউনিফর্ম জ্যাকেটের সাথে কালো নেভি ওয়াচ ক্যাপ পরেছে সে। কিন্তু মুখটা উন্মুক্ত, সেখানে বন্ধুসুলভ অভিব্যক্তি। সবকিছু খুলে বলার সময় জুৎসই জায়গাগুলোয় যাথারীতি মাথা দোলাল সে।
'মনে হয় না খুব বেশি কিছু করতে পারব,' ক্রুজারের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল সে। শহরে গোটাকতক ক্রুজারের একটা তার। 'তোমার ওখানে ঝামেলার সময় হাতেনাতে ধরতে হবে ওদের। তার মানে নজরদারির ব্যাপার। সেটা করতে গেলে ওভারটাইমের প্রশ্ন এসে যাবে। আমার সে উপায় নেই।'
'সোজা কথায় এসো, চিফ,' বলল ও। 'নজরদারী মানে স্রেফ সময় নষ্ট। এই লোকগুলো গুণ্ডাবদমাশ নয়, ঠিক আছে? এখানকার আদিবাসিন্দা ওরা, নানসেনে কোথায় কি হচ্ছে সব ওদের নখদর্পণে। আমরা নজর রাখার ব্যবস্থা করলে ওরা জেনে যাবে। তখন আর আমার ওখানে চেহারা দেখাতে যাবে না।'
'তুমি আমাকে অপমান করছ ভাবতে পারো, কিন্তু আসলে তা নয়,' আস্তে করে বলল সে। 'এখানে কাজকর্ম ঠিক এভাবেই হয়। এটা একটা ভালো শহর। বেশিরভাগই চালিয়ে নেয়। আসলে আমি তেমন ব্যস্ত নই, মোটেও না।'
'তা বুঝতে পারছি। কিন্তুআমার সমস্যাটাও তো তোমাকে বুঝতে হবে,' বলল ও। 'আমি এখানে থাকছি, প্রপার্টি ট্যাক্স মেটাচ্ছি। অথচ একদল লোক আমাকে অযথা হয়রানি করে চলেছে। আমি স্রেফ একটু সাহায্য চাইছি, আর আমার কি করার আছে সে ব্যাপারে একটু পরামর্শ।'
'এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে পারো,' কফি কাপ উঁচু করে ধরে বলল সে।
'ভালো পরামর্শই বলতে হবে।'
'এরচেয়ে ভালো কিছু এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না। দেখ, বন্ধু, এখানে নতুন তুমি, তোমার কোনো পরিবারপরিজন নেই। কোনো বন্ধন নেই। স্রেফ তোমার সাথে বনিবনা হচ্ছে না বলেই এখানকার নামকরা কয়েককটা পরিবারের বিরুদ্ধে নামতে বলছ। তারচেয়ে তুমিই বিদায় হয়ে যাও না কেন? আরো ছোট কোনো জায়গা খুঁজে নাও। এমনকি আরো বড় কোনো জায়াগাও পেতে পারো। যেখানে তোমাকে কারো নজরেই পড়বে না। কথাটা মেনে নাও, নানসেনে তোমাকে মানায় না। অবস্থা এরচেয়ে সুবিধার হবে না।'
'সত্যিই ভদ্রলোক ওরা,' কণ্ঠে তিক্ততার ছাপ ফুটিয়ে বলল ও।
কিন্তু তাতে চিফের ভাবান্তর হয়েছে বলে মনে হলো না। 'হ্যাঁ, ওরা ভদ্রলোক। অনেক পরিশ্রম করে ওরা, প্রচুর খেলাধুলো করে, কর দেয়। সবাই সবার দিকে খেয়াল রাখে। জানি, স্নোমোবাইলগুলোকে তোমার কাছে মহাঝামেলা মনে হচ্ছে, আসলে ওরা তারচেয়ে বেশি কিছু। ওরা সমাজেরই অংশ। আরে, আগামী সপ্তাহেই ওদের একটা দল মাজলাতে লেকে স্নো-রানে যাবে। লেকের উপর দিয়ে পাহাড়ের দিকে যাবে ওরা। লেক মন্কামে পঙ্গু শিশুদের ক্যাম্পের জন্যে টাকা তুলবে। অন্যের জন্যে যারা ভাবে না, তারা কখনোই এমন কিছু করতে যাবে না।'
'তবে আমাকে নিয়ে না ভাবলেই খুশি হতাম।'
কাঁধ ঝাঁকাল সে, বলল, 'দেখ, আমি যতদূর করতে পারি করব...' কিন্তু তার কণ্ঠের সুর এবং জবাবে ওর মৃদু মাথা ঝাঁকানি পরস্পরকে জুৎসই সঙ্কেত যোগাল। কুটোটিও ভাঙবে না এ ব্যাটা, স্পষ্ট বুঝতে পারল ও।
ক্রুজারে উঠে বসল চিফ। বিদায় হয়ে গেল। সার্ভিস স্টেশনের খোলা দরজার সামনে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় পরিহাস মেশানো চিৎকার কানে এলো ওর। পিকআপের দিকে এগিয়ে গেল ও, ফুর্তির কারণটা চোখে পড়ল তখন।
থ্যাবড়ানো চারটে টায়ারের উপর বসে আছে ওর ট্রাকটা।
৪১.
রাতে ফের দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠল ও। পড়ে রইল বিছানায়। চমৎকার কিছু কল্পনায় মনটাকে ভেসে যেতে দিল। এখন ওদের সবার নামধাম জানা হয়ে গেছে; ওরা কে, কোথায় থাকে। ইচ্ছা করলেই সোজা ওদের বাড়ি হাজির হয়ে সবকটাকে বের করে এনে ওর বাড়ির বেসমেন্টের বেঁধে ডলে দিতে পারে।
নিজের পরিচয় দিয়ে এখন পর্যন্ত কি করেছে ও, কি করতে পারে তার ফিরিস্তিসহ স্রেফ ওর একা থাকতে চাওয়ার কথা জানিয়ে দিতে পারে। ব্যস। স্রেফ ওকে ওরা শান্তিতে থাকতে দিক, তাহলে কোনো ঝামেলা থাকবে না। সার্বিয়ায় আলীয়াকে একথাই বলেছিল ও। নিরিবিলি, শান্তি। এরচেয়ে বেশি কিছু চায় না ও।
চমৎকার ভাবনা। ওর কথা মনে দিয়ে শুনবে ওরা, মাথা ঝাঁকাবে, কিন্তু ভালো করেই জানে তারিক, ওদের বিশ্বাস করাতে আরো বেশি কিছুর দরকার পড়বে। তো গুঁফো জেরি টম্পকিন্সের কাছে যাবে ও, লোকটা নিজের চৌহদ্দী চিহ্নিত করতে পছন্দ করে। কথার গুরুত্ব বাড়াতে লোকটার গোটা দুই আঙুল মুচড়ে দেবে। অন্ধকার ছোট বেসমেন্টে প্রতিধ্বনি তুলবে কটকট হাড় ভাঙার আওয়াজ।
এটাও চমৎকার ভাবনা।
কিন্তু এমন কিছু কখনোই ঘটবে না। নিজের কাছে ওয়াদা করেছে ও।
পাশ ফিরে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করল ও। এঞ্জিনের শব্দ ফিরে আসার জন্যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করল।
দুর্দান্ত কাটছে ওর অবসর।
রনের ওখানে টুকটাক নানা প্রসঙ্গে ঘুরপাক খেতে লাগল ওদের আলাপ। এক সময় রনের দিকে তাকিয়ে ও বলল, 'কি লাভ?'
ছোটখাটো ভুড়ির উপর হাত বেঁধে চেয়ারে আয়েস করে বসেছিল সে। 'সরি?'
'আমাদের এই সাক্ষাৎগুলোয় কি লাভ?'
চশমার আড়াল থেকে অপলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল সে। 'তোমাকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করছে।'
'কিসের সাথে মানিয়ে নিতে?'
'বেসামরিক জীবনের সাথে।'
কাউচে খানিক নড়েচড়ে বসল ও। 'কথাটা সোজাসুজি বলতে দাও। সারা জীবন এই দেশের জন্যে কাজ করেছি আমি, এ দেশের মানুষের জন্যে খেটেছি। দায়িত্ব আর আনুগত্যে ঘেরা একটা পরিবেশে কাজ করেছি আমি, যেখানে স্পষ্ট লক্ষ্য আর নেতা ছিল, সবকিছুর মূল্য ছিল। বহু জায়গায় গেছি, প্রত্যেক সপ্তাহয় মৃত্যু আর চোট পাওয়ার ঝুঁকি নিয়েছি। প্রাইভেট সেক্টরে সারা বছরে এর তিনভাগের এক ভাগ হতো সেটা। কিন্তু শেষমুহূর্তে আমার সাথে বেঈমানি করা হয়েছে। আরো চারজন.. মারা গেছে ওরা। কাজ শেষ হওয়ার পর আমাকে বলা হলো মানিয়ে নিতে, বেসামরিক লোকদের জন্যে ছাড় দিতে হবে। কিন্তু সিভিলিয়ান, ওদের কিছুই করতে হবে না। তাই তো?'
'মনে হয়।'
'চমৎকার রফা!'
অবিচল চোখে চেয়ে রইল সে। 'এটাই জুটেছে তোমার ভাগ্যে।'
৪২.
লেকের ধারের বাড়ির সিঁড়িতে পা রেখেই দরজাটা খোলা দেখতে পেল ও। নিমেষে কোমরের কাল্পনিক অস্ত্রের দিকে এগিয়ে গেল ওর হাত। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল ও। ওর এককালের বাড়ি, অচেনা জায়গায় ঢোকার মুহূর্তে সবকিছু কেমন যেন ঠেকছে, শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। ছোট রান্নাঘরে পা রাখল ও, ওর বুটের নিচে পড়ে চুরমার হচ্ছে মেঝেয় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কাঁচের ভাঙা থালাবাসনের টুকরো। লিভিং রুমের ভেতরটা লন্ডভন্ড করে ফেলা হয়েছে, ফার্নিচারগুলো উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। যেন ভূমিকম্পে আঘাত হেনেছে আচমকা।
এক পলকের জন্যে লিভিং রুমে থামল ও। বিরাট জানালা দিয়ে ঘেরাও করা বারান্দা পেরিয়ে লেক মেরির জমাট বাঁধা পানির দিকে তাকাল। অনেক দূরে হোয়াইট মাউন্টেনের সফেদ চূড়া দেখা যায়। অপেক্ষা করতে লাগল ও, কাঁপছে থরথর করে, এখনও অদৃশ্য অস্ত্রের খোঁজে নিশপিশ করছে ওর হাত। ওরা চলে গেছে। শূন্য পড়ে আছে ওর বাড়িটা।
কিন্তু ওদের হাতের ছোঁয়া রয়ে গেছে। ফার্নিচার, ছেঁড়া বইপত্র আর ম্যাগাজিন, ছিন্নভিন্ন ছবি আর ফ্রেমের একটা ঢিবিতে পরিণত হয়েছে লিভিং রুমটা। ফায়ার প্লেসের পাশে পরিষ্কার শাদা প্লাস্টার দেয়ালে সম্ভবত কেচাপ দিয়ে স্রেফ দুটো শব্দ লেখা:
চলে যাও।
এটা ওর বাড়ি। একটা চেয়ার উল্টে নিয়ে টেনে জানালার কাছে নিয়ে এলো ও। পাজোড়া সামনে মেলে বসে পড়ল, কড়কড়ে শীতের পরিবেশের দিকে তাকাল। দুই হাত নিথর পড়ে আছে কোলের উপর। সাফল্যই বলতে হবে একে।
এই মুহূর্তে কারো গলা টিপে ধরতে আকুলিবিকুলি করছে ওর হাতজোড়া।
পুরোনো অনুভূতি আর আবেগ প্রবল স্রোতের মতো বয়ে চলেছে ওর মনে, নিয়ন্ত্রণ তুলে নিচ্ছে ওর। গভীর করে কয়েকটা শ্বাস নিল ও। অচিরেই সেলারে এসে একটা ক্ষয়ে যাওয়া তারে টান মেরে ছাদ থেকে ঝুলন্ত একমাত্র বাল্বটা জ্বালল। বিভিন্ন প্যাকিং কেস হাতড়ে কম্বিনেশন লক খুলতে গেলে বাল্বের সাথে কাঁধের ছোঁয়া লাগায় এপাশ-ওপাশ দোল খেতে লাগল ওটা, পাথরের দেয়ালে বিচিত্র ছায়া ফুটে উঠল।
রাতের হাওয়া শীতল, কড়কড়ে। বাড়ির চারপাশে জমা বরফের উপর দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে পিকআপ ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল ও। সবমিলিয়ে তিনবার চক্কর দিল। গতিসীমার আওতায় থেকে শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার পথে সবগুলো স্টপ সাইন নষ্ট করার পেছনে প্রচুর সময় খরচ করল। রেডিওতে কান পেতে থাকল পুরো সময়। নানসেন যথেষ্ট উত্তরে হওয়ায় ওর ধরা অনেকগুলো স্টেশনই কুইবেকের। ফ্রেঞ্চকানাডিয়ান সঙ্গীতে এক ধরনের ফুর্তির ভাব আছে, ওর ভেতরটা কেমন যেন আকাক্সক্ষার যন্ত্রণায় ভরিয়ে তুলছে।
প্রায় দিনের আলো ফুটে উঠেছে যখন, মাস্ট রোডে উঠে এলো ও। এদিকের বেশিরভাগ শহরেই একটা করে মাস্ট রোড আছে, যেখানে উপনিবেশিক সার্ভেয়ররা শেষপর্যন্ত রয়্যাল নেভির মাস্তুলে পরিণত হওয়ার উপযুক্ত সমস্ত লম্বা পাইন গাছ চিহ্নিত করে রাখে। আজ রাতে কোনো সার্ভেয়র নেই, স্রেফ রাতের হাওয়া আর অন্ধকার, আর খানাখন্দে ভরা অ্যাসফল্টের উপর দিয়ে ছোটাছুটি করছে শীর্ণ খরগোশের দল।
লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি এসে বাতি আর এঞ্জিন বন্ধ করে দিল ও। শেষ শখানেক ফুট দূরত্ব আপনাআপনি এগিয়ে যেতে দিল গাড়িটাকে। অন্ধকারে ঢাকা বাড়ির সামনেই থামল ও। একটা পিকআপ ট্রাক আর একটা সুবারু স্টেশন ওয়্যাগন রয়েছে ড্রাইভওয়েতে। চিমনি দিয়ে ধূসর ধোঁয়া কু-লী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে।
জানালার কাঁচ নামাল ও। ঠান্ডা হাওয়া ধেয়ে এলো ওর দিকে। প্রায় জলের ঢেউয়ের মতো। একটু থেমে গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলী ভাবল ও, তারপর কাজে নামল।
৪৩.
নাইট ভিশন গ্লাস উঁচু হয়ে ক্লিক শব্দে কাজ শুরু করল। জোরালো সবুজ আলোয় মেইলবক্সে হার্ডঅয়্যার স্টোর থেকে কেনা রূপালি-কালো হরফে লেখা নামটা পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে। টম্পকিন্স। দোতলা বাড়ি এবং ওটার আশপাশে নজর চালাল ও। ডানদিকে একটা লাগোয়া গ্যারাজ, বামদিকে সানরুম দেখা যাচ্ছে। সামনে সদর দরজা। আরেকটা দরজা গ্যারাজ হয়ে মুল বাড়িতে যাওয়ার ব্রিজওয়ের মুখে। পেছনে কোনো দরজা নেই।
নাইট স্কোপটা কোলে রেখে পাশে অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াল ও। প্রথমটা পুরোনো আমলের একটা এম৭৯ গ্রেনেড লঞ্চার, ওটার পাশে সিটের উপর পড়ে আছে একগুচ্ছ ৪০এমএম হোয়াইট ফসফরাস রাউন্ড, দেখতে ধাতব ডিমের মতো। গ্রেনেড লঞ্চারের পাশে ওর অতীত জীবনের স্মারক, একটা হেকলার অ্যান্ড কচ এইচকে৪১৬। রাইফেলের সাথে জুড়ে দেয়া ক্রসহেয়ারঅলা আরেকটা নাইটভিশন।
বেশ কয়েকবার লম্বা দম নিল ও। পরিকল্পনাটা নেহাতই সাধারণ। সদর দরজা এবং ব্রিজওয়ের দরজায় একটা করে ফসফরাস বিস্ফোরণ ঘটাও। আরেকটা সানরুমে। দুই-এক মিনিটের মধ্যেই বাড়িটার দুপ্রান্তই জ্বলে উঠবে। স্নোমোবাইলার বন্ধু এবং তার পরিবার ঘুম থেকে জেগে উঠবে। ঘুমের ঘোরে আগুন আর শোরগোলে ভয় পেয়ে সদর দরজা দিয়ে তুষার ঢাকা উঠোনে বেরিয়ে আসবে ওরা।
তখন ওর হাতে তৈরি থাকবে এইচকে৪১৬। একটা নির্দিষ্ট চেহারার উপর স্থির ক্রসহেয়ার। গোঁফঅলা একটা চেহারা। নিজের কাজ সেরে পরের বাড়িটার পথ ধরবে ও। তারপর আরেকটা।
নিশ্চিত।
গ্রেনেড লঞ্চার তুলে নিয়ে গাড়ির জানালার উপর স্থির করে বসাল ওটার ব্যারেল। ঠান্ডা পড়েছে। দুপা ডলল ও। বাইরে আকাশের তারার দিকে চোখ ফেরাল। বাতাস বইতে শুরু করেছে। খানিকটা তুষার ধেয়ে গেল রাস্তার উপর দিয়ে। একটা প্যাঁচার গুমগুম ডাক কানে এলো।
গ্রেনেড লঞ্চার উঁচু করল ও, গালের সাথে লেপ্টে আছে ওটার বাট। নিশানা স্থির। এখন কেবল অপেক্ষা।
ভীষণ ঠান্ডা।
কাঁপছে ও, অস্ত্রটা সামনের সিটে নামিয়ে রাখল। 'হাদা,' আপনমনে বিড়বিড় করে বলল। 'হতচ্ছাড়া আনাড়ি।'
দুই হাত নিতম্বের নিচে চাপা দিয়ে উষ্ণ করার প্রয়াস পেল ও। বাতাস অব্যাহত বয়ে চলেছে। হাদা। কাজটা করার পর কতদিন জেলে থাকতে হবে। বিচারের পরেই বা কতদিন জেলে পচতে হবে, যেখানে আজরাতে যাদের গুলি করে মারতে যাচ্ছ তাদেরই বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গঠিত জুরির সামনে বিচার হবে যখন?
একে পরিকল্পনা বলো? একে আগেভাগে চিন্তাভাবনা করা বলে?
ট্রাক চালু করল ও, আপনাআপনি চলতে শুরু করল হিটারটা। জানালার কাচ তুলে ধীর গতিতে বাতি বন্ধ রেখেই সরে আসতে শুরু করল।
হতচ্ছাড়া আনাড়ী। ঠিকভাবে কাজ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছ, নিজের পটভূমি, ট্রেনিং এবং অভিজ্ঞতার কথা উপেক্ষা করার জোর চেষ্টা চালাচ্ছ। তোমার পুরোনো কমরেডরা এইমাত্র আনাড়ীর মতো একটা ঘণ্টা বরবাদ করায় মুখ টিপে হাসবে।
বিশেষ করে আলীয়া।
আলীয়া।
'বোকা,' আবার আপনমনে বলল ও। ট্রাকের বাতি জ্বালিয়ে বাড়ির পথে এগোতে শুরু করল।
৪৪.
রনের সাথে আরেক দফা সাক্ষাৎ। বলার মতো একমাত্র বিষয়টা মাত্র কয়েক মিনিট সময় নিল।
'আরেকবার চেষ্টা করে দেখার কথা ভেবেছি আমি,' বলল ও।
'সেটা কেমন?'
'শহরের কিছু লোককে আর আমাকে বিরক্ত করার সুযোগ দেব না,' বলল ও। 'যাই ঘটুক না কেন, মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করব। নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করব। অনেক খাটুনি গেছে, অনেক ঝামেলা পুইয়ে টিকে আছি, এখন আবার নতুন করে শুরু করতে গিয়ে সেসব ছুড়ে ফেলে দিতে পারব না।। আমি নানসেনেই থাকতে চাই। আমার নতুন জীবন নিয়ে আগে বাড়তে চাই।'
ক্ষীণ মাথা দোলানো। হয়তো এক ধরনের বিজয়ীর ছাপ ছিল সেখানে। 'শুনে খুশি হলাম।'
'আমি জানি।'
৪৫.
বেশ কয়েক দিন পরের কথা। নিজের বাড়িতেই আছে ও। বাতাসে তরতাজা একটা ভাব। প্রচুর সাফসুতরো আর রংয়ের কাজ করেছে ও, সবকিছু ঠিক যেভাবে ছিল আবার সেভাবে সাজানোর চেষ্টা করেনি, বরং আরো নিখুঁত করে তোলার চেষ্টা করেছে। মেইন রুমেই আসল সমস্যা ছিল, ওখানে চলে যাও কথাটা ঢাকতে তিন দফা রং লাগাতে হয়েছে। শেষমেশ গোটা কামরাতেই রঙ করতে পেরেছে ও। বাড়ির মালিকানার জন্যে চড়া মাশুলই বলতে হবে।
অন্ধকারে ডুবে আছে গোটা বাড়ি। অপেক্ষা করছে ও। হাতে পানীয় ভর্তি একটা গ্লাস। ঘেরাও করা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। লেক মেরির জমাট বাঁধা জলের দিকে নজর। হালকা তুষারপাত দেখছে। বাড়ির প্রতিটি বাতি নিভিয়ে ধেয়া হয়েছে। কেবল ফায়ার প্লেস থেকে একমাত্র আলোর আভাস আসছে। ক্রমে নিভতে বসেছে ওটাও, আরো লাকড়ি দেয়া দরকার।
কিন্তু সন্তোষের সাথে অপেক্ষা করছে ও। নানসেনে এতগুলো সপ্তাহ আর মাস কাটানোর পর অবশেষে মনের ভেতর শান্তি অনুভব করছে। অবশেষে যেন নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। নিজের আসল পরিচয় মনে পড়ছে।
গ্লাস চুমুক দিল ও। অপেক্ষা। একসময় স্নোমোবাইলের আওয়াজ শোনা গেল। ওগুলোর ক্ষুদে আলোর বিন্দুগুলো দেখতে পাচ্ছে। লেকের উপর দিয়ে সবেগে ধেয়ে আসছে, চাঁদার তোলার দায়িত্ব সারছে। কি চমৎকার! স্যালুটের ঢঙে গ্লাসটা উঁচু করে ধরল ও। লেকের উপর দিয়ে একটা সরল রেখায় এগিয়ে আসতে শুরু করায় স্নোমোবাইলের আওয়াজ আরো জোরালো হয়ে উঠল।
গ্লাসটা নামিয়ে রেখে লিভিং রুমে এসে নিভন্ত আগুনে শেষ কয়েক টুকরো লাকড়ি ঠেসে দিল ও। চকিত উত্তাপ এক ধরনের প্রীতিকর আভায় উষ্ণ করে তুলল ওর চেহারাটা। আগুনে ঠেসে দেয়া লাকড়িগুলো গাছের ডালপালা নয় অবশ্য। মানুষই ওগুলোকে আকার দিয়ে রঙ করেছে, অগ্নিশিখা লাফিয়ে উঠে ওগুলোকে গিলে নেয়ার ফাঁকে হরফগুলো মিলিয়ে যেতে দেখল ও: বিপজ্জনক! পাতলা বরফ!
হাঁটতে হাঁটতে আবার বারান্দায় এলো ও। গ্লাসটা তুলে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আলীয়া এবং টাস্ক ফোর্স ওয়ালেবির বাকিরা যেখানেই থাকুক, ওর পক্ষে থাকবে বলেই ভাবল ও।
ওর নিচে লেক মেরির শান্তিপূর্ণ, নিরিবিলি তীরে নতুন বাড়ির পাশ ঘেঁষে একে একে ছুটে যাচ্ছে বাতিগুলো। তারপর হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার গহ্বরে। চারদিক সুনসান।
এই নীরবতা সত্যি ভীষণ ভালো লাগছে ওর।
- [প্রথম পর্ব সমাপ্ত]