মৃত্যুর মিছিল
দ্বিতীয় পর্ব
১.
নিউ হ্যাম্পশায়ার। লেক মেরির জমাট বাঁধা তীরে মোহনীয় একটা দিন। ঘেরাও করা উষ্ণ বারান্দায় বসে কফির কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে দূরের বরফের টুপি পরা হোয়াইট মাউন্টেনের পাহাড়সারি, গ্রামীণ হ্রদের কিনারে দাঁড়ানো নিবিড় বনভূমি এবং পাবলিক সেফটি অফিসিয়ালদের ক্ষুদে জটলা দেখছিল তারিক আহসান। সফেদ বরফের নির্মল বিস্তারে একটা ছোট গর্ত ঘিরে শশব্যস্ত হয়ে কাজ করছে ওরা। গত রাতে ওরই জনাছয় পড়শী ফোকর গলে চারটে স্নোমোবাইলসহ অন্ধকার বরফ শীতল পানিতে ডুবে দুনিয়া ছেড়ে গেছে।
ভালোই লাগছে।
বেশ সন্তোষ বোধ করছে ও।
কফিটুকুও ওর পছন্দমতো বানানো হয়েছে। তারিয়ে তারিয়ে স্বাদটা উপভোগ করছে।
মোদ্দা কথা, দিনের শুরু হিসাবে দুর্দান্ত বলতে হবে। দৌড়ানোর জন্যে বেরুনোর কথা ভাবছিল ও, কিন্তু এখন এভাবে বসে সামনের কাজকারবার দেখেই শান্তি লাগছে।
ফের কফিতে চুমুক দিলো ও। লক্ষ করল, দ্বিতীয় একটা টো-ট্রাক পিছু হটে উন্মুক্ত গর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্যাড লাগানো জাম্পস্যুট পরা এক লোক ফাটলটাটল আছে কিনা সেদিকে খেয়াল রেখে পথ বাতলে দিচ্ছে। একটু বাদেই ঘোলা জল থেকে স্টেট পুলিসের এক ডুবুরি মাথা জাগালো।
কাছেই বরফের উপর ধূসর উলের কম্বল তিনটা অবয়ব ঢেকে রাখা হয়েছে। ওই কম্বলের উমে শীত কাবু হচ্ছে, এমনটা মনে হচ্ছে না। প্রায় বারো ঘণ্টা আগে পানিতে পড়েছে স্নোমেশিন এবং ওগুলোর চালকরা উৎসুক গণমাধ্যম বা শোকার্ত পরিবারকে যাই বোঝাক না কেন, এখন একে উদ্ধার তৎপরতা বলা যাবে না। স্রেফ লাশ উদ্ধারের কাজে পরিণত হয়েছে। সেটাও খুব একটা সুবিধার নয়।
কফিতে আরেক দফা চুমুক দিয়ে স্যালুটের ঢঙে কাপটা উঁচু করে ধরল ও। 'তোমাদের কাছে শান্তির প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম,' নিঃশব্দ তীরের উদ্দেশে বলল। 'গ্রহণ করা উচিত ছিল হে!'
হঠাৎ দরজায় জোরালো টোকার শব্দ হলো ।
বেশ।
কফির কাপ হাতেই প্রশস্ত লিভিং রুম ধরে আগে বাড়লো ও। টাটকা রংয়ের সুবাসে এখনও মম করছে। কাছের জ্বলন্ত ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও। একটা পোকার নিয়ে জ্বলন্ত কয়লা নেড়েচেড়ে গোটা দুই শুকনো ওক কাঠের টুকরো ঠেসে দিলো ওগুলোর ভেতর। লকলকিয়ে উঠল আগুনের শিখা। ওর হাত আর মুখে উষ্ণ আঁচ লাগল।
কয়লা এবং ছাইয়ের বেশ ভেতর দিকে চারটে রঙ করা সাইনবোর্ড আর কিছু পরিমাণ কমলা রংয়ের দড়ি দেখা যাচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা আগেও 'বিপজ্জনক! পাতলা বরফ!' সতর্ক বাণী প্রচার করছিল ওই সাইনবোর্ডগুলো। কিন্তু এখন আলামত গায়েব হয়ে গেছে। ওটার অনুপরমাণু সবই ধোঁয়া এবং ছাই হয়ে গেছে।
ফের আগুন উস্কে দিলো ও।
সত্যিকারের দক্ষ ফরেনসিক এজেন্সি - এফবিআই হতে পারে, কিংবা হোমল্যান্ড সিকিউরিটির কোনও অফিস - এখন এসে হাজির হয়ে ফায়ারপ্লেসসহ জব্দ করতে পারে ওকে। তারপর ব্যাপক এবং জটিল পরক্ষিায় লাকড়ির ছাই আসলে এককালে রঙিন সাইনবোর্ড থাকার গুমোর জেনে যাবে।
হয়তো আরও বহু তদন্তের পরইÑসম্ভবত বেশ দীর্ঘই হবে সেটা - এই ছাইগুলো খোয়া যাওয়া সাইনবোর্ডের অংশ থাকার কথাটা ধরতে পারবে ওরা। তারপর ওগুলোর ধ্বংস এবং গতরাতের মারাত্মক বরফ দূর্ঘটনার সঙ্গে ওকে জড়াতে পারবে।
ফের টোকা পড়ল দরজায়।
সর্তকতার সঙ্গে পোকারটা নামিয়ে রেখে ম্যান্টলপিসের উপর থেকে আলগোছে সিগ সওয়ার পি২২৬ পিস্তলটা নিয়ে শার্টের নিচে পেছনে বেল্টে গুঁজল ও।
এক বছরেরও কম সময়ের জন্যে ওর বেছে নেওয়া আস্তানা, এই ক্ষুদে রাজ্যে এই ধরনের ফরেনসিক সরঞ্জাম থাকতেও পারে।
সদর দরজার দিকে পা বাড়াল ও।
মনে সন্দেহ থাকলেও সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখাই শ্রেয়। দরজা থেকে এখন আনুমানিক ফুট বিশেক দূরে রয়েছে ও। সব সময়ই সম্ভাবনা এবং শঙ্কার মুহূর্ত থাকে। ঠিক এখনকার মতো।
দরজার ওপাশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ থাকলে সহযোগিতার সবরকম চেষ্টা করবে ও, তবে তাতে যেন ওদের কোনও ফায়দা না হয় সেটাও দেখবে।
এই বাড়িটা ওর পছন্দ হয়ে গেছে। এটার সঙ্গে কংক্রীট আর গরাদের খুপরি অদলবদলের ইেচ্ছা নেই।
দরজার ওধারে মৃতদের কোনও বন্ধু বা পড়শি থাকলে- অবশ্য আজকের উপভোগ্য সকালটা ওর কাছে আরেক ডিগ্রি উপভোগ্য হয়ে উঠবে । বিনা দ্বিধায় কবাট খুলল ও। একটা লহমার জন্যে শীতের জোরালো রোদ ধন্ধ লাগিয়ে দিলো ওর চোখে। চোখ পিটপিট করল ও। একটা মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ভূতে বিশ্বাস ফিরে এসেছে ওর। ওর বাড়ির গ্রানিট সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে অল্পবয়সী একটা মেয়ে।
প্রায় ওর সমানই হবে লম্বায়, মাথায় ঘন কালো চুল, গায়ের রঙ আখরোটের মতো। তীক্ষè, উজ্জ্বল বাদামী একজোড়া চোখ। কাঁধ পর্যন্ত খাটো করে কাটা চুল। গায়ে হাঁটু অবধি ঝুলের কালো উলের কোট আর কালো স্ল্যাক্স। বছরের এই সময়ের বিচারে জুৎসই জুতো ওর পায়ে।
আনিকা বারী। ওর পুরোনো সহকর্মী। ওর মা মার্কীনি, বাবা বাংলাদেশী। ডিভি ভিসার অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন ওর বাবা-মা। এখানে জন্ম হয়েছে ওর। সেই সুবাদে জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক সে। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তারিকের মতোই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, পরে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থায় ডেপুটেশনে পাঠানো হয় ওকে। সংস্থার হয়ে দেশে বিদেশে বিভিন্ন গোপন মিশনে দুর্দান্ত সাফল্য দেখিয়েছে। এখনো সক্রিয় এজেন্ট সে।
অনেক কটি অ্যাসাইনমেন্টে তারিকের সহচর ছিল। পৃথিবীর উভয় গোলার্ধ, অফিসের পার্ক এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক লম্বা পথ একসঙ্গে কাজ করেছে ওরা। ৭.৬২ এমএম ন্যাটো রাউন্ড ছুড়েছে। কাজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই ওদের ভেতর এক ধরনের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। একে অন্যের প্রয়োজনে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ঝাপিয়ে পড়তে একবিন্দু দ্বিধা করবে না। মাঝখানে অনেক দিন ওদের তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। হয়তো কোনো অ্যাসাইনমেন্টে দেশের বাইরে ছিল। তাই ওকে এখানে দেখে বেশ বিস্মিত হয়েছে তারিক।
মাথা দোলালো ও। 'তারিক।'
'অবাক কাণ্ড,' বলল ও, 'তুমি কোত্থেকে?'
'ভালোই চমকে দিয়েছি, কি বলো।'
'তা দিয়েছ। এখানে আমার হদিস পেলে কিভাবে?'
ঝকঝকে শাদা দাঁতে হাসির একটা ঝলক দেখাল ও। ওর চমৎকার কালো উলের কোটের বোতাম একপাশে, খেয়াল করল তরিক। কিন্তু চট করে খোলার সুবিধার জন্যে কাপড়ের বেল্ট ফসকা গোরো দিয়ে বেঁধে রেখেছে।
'এ আর কঠিন কি,' বলল আনিকা। 'যাকগে, কফির গন্ধ পাচ্ছি মনে হয়? এক কাপ হলে মন্দ হয় না।'
দ্রুত একবার ওর পেছনে নজর চালাল তারিক। ওর লবনের দাগপড়া পিকআপ ট্রাকের কাছে একটা গাঢ় নীল শেভি মার্কিস দাঁড়িয়ে আছে।
একাই এসেছে ও।
অন্তত তাই মনে হলো ওর।
মার্কিসের আশপাশে ছাড়িয়ে আছে তুষারের মিহিদানা। শুধু ওর পায়ের ছাপই চোখে পড়ছে।
লক্ষণ ভালো।
'এই যে?' বলল ও। 'কফির কি হলো?'
সংবিৎ ফিরে পেয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল ও। 'এসো, ভেতরে এসো,' বলল। 'মাত্র কফি বানিয়েছি।' ক্ষনিক বিরতির পরই আবার যোগ করল, 'তুমি আগে, আনিকা।'
ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল আনিকার ঠোঁটে। 'ধন্যবাদ, তারিক। তুমি বরাবরই ভদ্রলোক।'
'বেশিরভাগ সময়।'
ওকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেল আনিকা। লাইলাকের সৌরভঅলা সুগন্ধির আভাস পেল ও। ওর দিকে পেছন ফিরে আনিকার নিশ্চিত ভঙ্গিতে এগিয়ে যাওয়ার তারিফ না করে পারল না।
হতে পারে ও ভদ্রলোক, তবে এখনও টিকে আছে।
আনিকাকে পছন্দ করে ও। আনিকার সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু খুব ভালো করেই জানা আছে, হুকুম দেওয়া হলে ঠিকই ওকে অনুসরণ করে বাড়িতে পর্যন্ত হাজির হবে, নিমেষে কোটের বাঁধন আলগা করে সাপ্রেসর লাগানো পিস্তল বের করে ওর মাথার পেছনে দুটো গুলি ঠেসে দেবে। সাবেক মনিবদের বিব্রত করার কারণে পরিস্থিতি ঠিক ওর অনুকূলে নেই।
২.
কিচেনে এসে নীরবে আনিকার জন্যে এক কাপ উত্তপ্ত কড়া কফি ঢালল ও। আগে একসঙ্গে কাজ করার সময় দুইবার বাজে ঠাট্টা করে আনিকা পুরুষদের ঢঙে কফি খাওয়ার কথা বলেছিলো ও। তৃতীয় দফা একই রসিকতা করতে গেলে স্রেফ ওর ক্ষিপ্রতার কল্যাণেই একটা উড়ন্ত সিরামিকের কাপে কপাল দু ফাঁক হওয়া থেকৈ রক্ষা পেয়েছে।
আনিকার দিকে কফির কাপটা বাড়িয়ে দিল ও। ওটা নিয়ে ধীরে সুস্থে চুমুক দিল আনিকা, বারান্দার দিকে পা বাড়াল সে। 'চমৎকার দৃশ্য।'
'আমার বেশ পছন্দ।'
'পেশাদারী ছাপ আছে,' বলল ও। 'মনে হচ্ছে যেন নিজের দিকে নজর কাড়ার মতো আলামত না রেখে বারবার দেখা দেওয়া ঝামেলা চুকাতে চেয়েছে কেউ।' বলে অপেক্ষা করল ও।
'প্রশংসার জন্যে শুকরিয়া।'
'এটা পর্যবেক্ষণ হতে পারে, প্রশংসা নয়।'
'যাই হোক, আমার ভালো লেগেছে।'
ওর দিকে ফিরল আনিকা। 'অবসর...অবসর নেয়ার পরেও বেশ তৎপর বলেই মনে হচ্ছে।'
'বিশাল নর্থ উডে জীবন এমনই।'
'তোমার জন্যে একটা কাজ নিয়ে এসেছি।'
'আমি অবসরে আছি।'
'আগে বলতে তো দাও।'
'তা বটে।'
দুই হাতে কাপটা ধরে লম্বা চুমুক দিল ও। 'রবিন রায়হানের কথা মনে আছে - বছর দুই আগে স্যান্ডবক্সে তোমার সঙ্গে কাজ করেছিল?'
চৌকষ, দশাশই শরীরের বাংলাদেশি আমেরিকান। এখন জর্জিয়ার বাসিন্দা। দরাজ প্রাণখোলা হাসি ছিল সবসময় তার মুখে। অনেক বছর আর্মিতে ছিল। লেখাপড়ায়ও চৌকষ, মধ্যএশিয় রাজনীতির উপর মেজর করেছে, পেশাদারী খুনখারাবি ছিল ওর দ্বিতীয় যোগ্যতা।
'আলবৎ মনে আছে।'
'আহত হয়েছে ও। তোমার কথাই সবার আগে মাথায় এসেছে। সাহায্য দরকার ওর।'
'কি ধরনের সাহায্য?'
'গেলেই বুঝতে পারবে।'
রবিন রায়হান। সেই জমিন কাঁপানো হাসি। পুরু, শক্তিশালী হাতে অনায়াসে রাস্তার ধারের যেকোনও আইইডিকে নিরস্ত্র করতে বা স্থানীয় ডিম থেকে ওমলেট বানাতে পারে।
'আমি অবসরে আছি।'
'তোমার সাহায্য ওর ভীষণ দরকার।'
'জানি...কিন্তু...'
আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ও, তবু আনিকার কাছ থেকে আরো বিশদ শুনতে চায়। কফিতে আবার চুমুক দিল সে। এখন বরফের গর্ত ঘিরে দাঁড়ানো মানুষের জটলার দিকে তাকিয়ে আছে।
'শেষতক ঠিক তোমার দরজায় এসে কড়া নাড়বে ওরা,' বলল ও। 'হাজারো প্রশ্ন, অভিযোগ মোকাবিলার চেয়ে বরং আমার সঙ্গে খেলায় নামলেই কি ভালো হতো না? দরজায় ক্ষিপ্ত টোকা, তদন্ত, আদালতের সমন?'
'ভালো যুক্তি,' বলল তারিক। 'কিন্তু এ জায়গাটা যে আমার পছন্দ...যদিও তোমার সঙ্গে খেলতে আমার ভালোই লাগবে।'
'তোমাকে পষ্ট বলে দিচ্ছি, খেলা বলতে আমি কিন্তু পেশাদারী ব্যাপার বুঝিয়েছি,' ভুরু কুঁচকে বলল আনিকা। 'তাছাড়া, কোনো বাড়ি তোমার কখন্ই মনে ধরেনি, জানি।'
'এটা অন্যরকম। এটাই স্থায়ী হবে বলে আশা করছি।'
একটা টো-ট্রাকের কপিকল কাজ শুরু করল, জলের গভীর থেকে উঠে আসছে শক্তিশালী কেবল।
'ব্যবস্থা করা সম্ভব,' অবশেষে বলল ও। 'কেউ একজন এখানে থেকে কোনো ঝামেলা না হওয়ার ব্যাপারটা দেখবে।'
পানিতে বুদ্বুদ দেখা দিল, ঢেউ উঠল। লাল রংয়ের একটা ইয়ামাহা স্নোমোবাইল জলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। টো-ট্রাক টেনে তুলছে ওটাকে, কেবলের সঙ্গে ধীরে গতিতে দোল খাচ্ছে ওটা। কালো স্নোস্যুট আর হেলমেট পরা স্থূল একটা অবয়ব ঝুলছে স্নোমেশিন থেকে, একটা পা সামনে আটকে গেছে।
'আরেকটা প্রশ্ন করি?' জানতে চাইল ও।
'নিশ্চয়ই।'
'কার গাড়িতে যাবো আমরা?'
একটা ছোট ব্যাগে জিনিসপত্র ভরে কিচেনে ওর সঙ্গে যোগ দিল তারিক। ওদের দুজনের কফি কাপ ধুচ্ছিল আনিকা।
'দেশের ভেতরে প্লেনে অস্ত্রসহ উঠতে হলে এক ধরনের কাভার লাগবে।'
'এয়ার মার্শাল হবে?' জানতে চাইল আনিকা।
'সবসময় কাউবয় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি, যাকগে মনে হয় কাজ হবে।'
তোয়ালেটা সযত্নে ভাঁজ করে আভেনের দীর্ঘ হাতলের উপর মেলে দিলে সে।
'তোমার আগের মিশনের কথা আমি জানি।'
চুপ রইল তারিক।
'সার্বিয়ায়,' আবার বলল সে।
সহসা চারদিক নীরব ঠেকল। জমাট বাঁধা লেকের ওদিক থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর কানে আসছে।
'আমাকে বলবে - '
'না।'
'মানে -'
'না,' বলল তারিক। 'নিয়মকানুন তোমার জানা আছে।'
ওর কোটটা এখনও কাপড়ের বেল্টে বাঁধা। কেন যেন ওর মনে হলো কোটের বাঁধন শিথিল করে একটা কিছু বের করে আনবে সে, মুখ খুলতে বাধ্য করবে ওকে। কিন্তু সেই মুহূর্তটা কেটে গেল।
'হ্যাঁ,' হাল ছেড়ে দিয়ে বলল আনিকা। 'নিয়ম জানা আছে আমার।'
৩.
বাইরে শীতল কড়কড়ে হাওয়া। তরতাজা। একটা মরা বার্চ গাছের কাছে একটা ফীডার বসিয়েছিল ও। ওটা ঘিরে এক জোড়া চিকাডী পাখি চক্কর মেরে বেড়াচ্ছে। ভবিষ্যৎ হাউস কিপার যাতে ফীডারগুলো সবসময় ভরে রাখে সেটা নিশ্চিত করবে বলে মনে মনে ঠিক করে রাখল ও।
মার্কিসের দিকে পা বাড়িয়েছে অনিকা। নিজের ফোর্ড ট্রাকের দিকে হাঁটা ধরল তারিক। 'চলে এসো,' বলল আনিকা। 'আমার সঙ্গেই তো যেতে পারো।'
'উঁহু, আমি পেছন পেছন আসছি।'
'একসঙ্গে গেলে সহজ হতো না?'
'তোমার জন্যে সহজ,' বলল তারিক। 'কিন্তু মাঝপথে সিদ্ধান্ত পাল্টালে অনায়াসে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যেতে পারব, লাফ দিতে হবে না।'
তোমার যা মর্জি,' বলে মার্কিসের দরজা খুলে ভেতরে উঠে বসল আনিকা। ও ভেতরে ঢোকার আগে প্রশংসার দৃষ্টিতে দরজার কিনারে চেপে বসা পাজোড়া জরিপ করল তারিক। ব্যাপারটা খেয়াল করে মৃদু হেসে দরজা আটকে দিল সে।
নিজের ট্রাকে উঠে ইগনিশনে তিন দফা চেষ্টার পর এঞ্জিন সাড়া দিল। সুইচ টিপে হিটার অন করল ও। ব্যাক গিয়ার দিয়ে বেরিয়ে গেল আনিকা। ড্রাইভ ওয়ে বরাবর ওকে অনুসরণ করল তারিক। ওটার দুপাশেই গাছপালা আর বুনো ঝোপের সারি।
আনিকার সঙ্গে অনেকদিনের সম্পর্ককে অপমানিত করতে চায়নি ও, কিন্তু ওর সঙ্গে একই গাড়িতে থাকলে পুরোনো কোনো শত্রু ওর পিছু নিয়ে এপর্যন্ত এসে হাজির হতে পারে, সেক্ষেত্রে ইসরায়েলে তৈরি স্পাইক অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইলে মার্কিসের ছাদ উড়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
নিজের গাড়ির কৃত্রিম স্বস্তি থেকে তারিকের উদ্দেশে হাত নাড়ল আনিকা।
পাল্টা হাত নাড়ল ও।
সংকীর্ণ স্টেট রোড অবধি কোনো ঝামেলা না হলেও এখানে হঠাৎ গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা হ্যাম্পশায়ার স্টেট পুলিস ক্রুজার অড়াআড়িভাবে থেমে পথ আটকাল।
গতি কমিয়ে ট্রাক দাঁড় করাল তারিক। এটা ওর ঝামেলা নয় বলে কোনো মাথাব্যথাও নেই। এক মুহূর্তে অপেক্ষ করে গাড়ির দরজা খুলে নেমে এলো আনিকা।
দুজন মোটাসোটা স্টেট পুলিস ট্রুপার ক্রুজারের সামনের আসন থেকে নেমে এগিয়ে গেল আনিকার দিকে। একজন নারী, অন্যজন পুরুষ। পরনের উর্দি, স্যাম ব্রাউনি বেল্ট, হোলস্টার, বন্দুক এবং গোল কিনারার টুপিতে ওদের ভাইবোনের মতো লাগছে।
পিস্তল হাতে শক্তিশালী, বেপরোয়া ভাই-বোন।
ওদের নিজের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ দিল আনিকা। কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল। প্রতিটি সেকেন্ডে দুই পুলিসের চেহারা ক্রমেই লাল হয়ে উঠছে। পরস্পর চোখাচোখি করল ওরা। তারপর আবার আলাপ।
কোটের পকেটে হাত ঢোকাল আনিকা। দেখে রীতিমতো জমাট বেধে গেল তারিক - খারাপ কিছু করতে যাচ্ছে নাকি মেয়েটা? - কিন্তু না, পকেট থেকে একটা সেল ফোন বের করল সে। বোঝা যাচ্ছে কাউকে ফোন করছে। বার দুই মাথা দোলাল আনিকা।
তারপর ওদের দিকে বাড়িয়ে ধরল ফোনটা।
অনীহার ছাপ পড়ল স্টেট পুলিসের চেহারায়। ওপাশের কথা কে শুনবে?
মহিলা পুলিস হাত বাড়াল শেষে।
ফোনটা নিল সে।
ওপাশের কথা শুনতে শুনতে বার কয়েক মাথা দোলাল।
ওর পার্টনার মাথা নেড়ে এক কদম পিছিয়ে গেল, যাই ঘটুক, এসবে থাকতে চায় না যেন।
আবারও মাথা দোলাল মহিলা পুলিস। ফোনটা আনিকাকে ফিরিয়ে দিল। কথা বলার ধারেকাছেও গেল না ও।
ফোনের সুইচ অফ করে কোটের পকেটে রেখে দিল। ঘুরে এগিয়ে গেল মার্কিসের দিকে। তারিকের দিকে তাকিয়ে কিশোরীর ঢঙে হাসল, যেন শিশু শিস্য প্রিয় শিক্ষকের মনোযোগ আদায় করে নিয়েছে।
সত্যিই সুন্দরী শিস্যই বলতে হবে। খোদাই জানে, কতগুলো অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে মেয়েটা, ভাবল ও।
পুলিস দুজন ওদের ক্রুজারের দিকে ফিরে যাওয়ার পর মার্কিসে উঠে বসল আনিকা। ক্রুজারটা পিছিয়ে গেল। সামনে বাড়ল মার্কিস। সৌজন্যের সঙ্গে বাম দিকের ব্লিঙ্কারের সুইচ অন করে থেমে থাকা ক্রুজার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল।
ওকে অনুসরণ করল তারিক। দুই পুলিসের দিকে এক নজর তাকাল ও।
গাড়ির ক্ষুদে মিছিল অগ্রাহ্য করে সামনে চোখ মেলে রেখেছে ওরা।
কেন যেন আপনমনে হাসল তারিক। আবার কাজে নামতে পেরে ভালোই লাগছে।
অনেক দিন পর আনিকার সঙ্গও ভালো লাগছে।
৪.
চিরকালের জন্যে ঋণী দেশের কাজ করতে গিয়ে একটা ব্যাপারে অভ্যস্ত না হয়ে পারা যায় না - ঘটনা এবং পরিবেশ পাল্টে যাওয়ার নাটকীয়তা। সকালে হয়তো পেন্টাগনের বন্ধ্যা অফিসে ছিলো কেউ, কিন্তু বিকেলে দেখা যাবে নিকারাগুয়ার কোনো জলাভূমিতে গিয়ে হাজির হতে হয়েছে। গলা অবধি পানিতে দাঁড়িয়ে আছে সে।
যেমন আজকের দিনটাই বরফ আর তুষারের ভেতর শুরু হয়ে জর্জিয়ার ছোট শহর বার্নসে এসে শেষ হয়েছে। জায়গাটা আটলান্টা থেকে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা।
শাদা ক্ল্যাপবোর্ডের ঘরবাড়ি আর তিনতলা ইটের দালানকোঠা নিয়ে মূল-শহর, কেন্দ্রে যথারীতি সিএসএ বীর কোনো যোদ্ধার ভাস্কর্যসহ একটা ঘেসো চত্ত্বর। ওকে একটা নিরিবিলি চওড়ায় রাস্তায় নিয়ে এলো আনিকা। কাছেই ক্ষুদে ক্ষুদে ঘরবাড়ি দেখা যায়। ওগুলোকে ঘিরে শাদা কাঠের বেড়া আর বিশাল গাছপালার সারি। শাদা আর কালো ছেলেমেয়েরা মসৃণ রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছে। একটা গ্যারাজে অল্প কয়েকজন বাস্কেট বল খেলছে, ওটার ছাদে বোল্ট দিয়ে একটা হুপ আটকে নিয়েছে ওরা। তেমন একটা চাঞ্চল্য নেই।
হালকা নীল রংয়ের একটা দোতলা বাড়ির সামনে থামল আনিকা। ওটার সামনে বারান্দায় একটা গ্লাইডার আর দুটো বেতের চেয়ার রাখা। জানালাগুলো বিরাট। বাইরের শাদা ডাকবাক্সে কালো হরফে সযতেœ রবিন রায়হান নামটা লেখা রয়েছে।
বারান্দায় একটা খাম্বা থেকে বেরিয়ে থাকা একটা ছোট খুঁটিতে শিথিল হয়ে ঝুলছে আমেরিকার পতাকা।
গাড়ির সুইচ অফ করল আনিকা। আটলান্টা-হার্টসফিল্ড থেকে মোটামুটি চুপচাপ এপর্যন্ত এসেছে ওরা। অভিজ্ঞতা থেকে তারিকের জানা আছে কি হচ্ছে বা ও কি পরিকল্পনা করেছে সেটা নিয়ে ওকে চাপ দিয়ে কোনো ফায়দা হওয়ার নয়। তাই মুখে কুলুপ এঁটে ছিল ও। আনিকাও কথাবার্তা বলেনি।
'পৌঁছে গেছি,' বলল আনিকা।
'ভালো।'
গাড়ি থেকে নামল ওরা। জর্জিয়ার বাতাস বুকে টেনে নিয়ে গাঢ় নীল আকাশের দিকে তাকাল তারিক। কোথাও মেঘের নাম নিশানা নেই। গাড়ির ওপাশ থেকে এগিয়ে এলো আনিকা। ভারী শীতের কোটের বদলে হালকা নীল ব্লেযার পরেছে ও, বেশ মানিয়ে গেছে ওকে। আবার অস্ত্রশস্ত্র আড়াল করারও কাজে এসেছে।
'কি দেখছ?' জানতে চাইল সে।
'আকাশ।'
'ওখানে আছেটা কি?'
'ফার্স্টক্লাসে বসে থাকা নারী-পুরুষে ভর্তি বিমানের একটা বিন্দু, গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে ওরা, কাগজ বা ল্যাপটপে কাজ করছে, যাকে বলে 'ফ্লাইওভার কান্ট্রি', সেদিকে নজর নেই। ওরা কোনোদিন ফ্লাইওভার কান্ট্রিই যে বেশিরভাগ লড়াকু নারীপুরুষের জন্ম দেয় তার পরোয়া করে না বা বোঝেও না, অথচ ওরাই ওদের জন্যে যুদ্ধে গিয়ে জীবন দেয়।'
স্রেফ আকাশের দিকে তাকিয়েই এতকিছু বুঝে গেলে?'
ওর দিকে তাকিয়ে হাসল তারিক। 'প্র্যাকটিস করি তো।'
এগিয়ে গিয়ে কাঠের বেড়ার গেট খুলল আনিকা। তারিককে আগে ঢোকার সুযোগ দিল। ভেতর থেকে কেউ নজর রাখছে, ধারণা করল তারিক। 'রবিন রায়হান সম্পর্কে কতদূর কি জানো?' জানতে চাইল আনিকা।
'রবিন? পূর্ব জার্মানির গাড়ির মতো বিশাল, কঠিন, দ্রুত, নিঃশব্দে চলাফেরা করে। খালি হাতে পাহারাদারের ঘাড় মটকাতে কিংবা দরজা ভেঙে যেকোনো জায়গায় ঢুকতে পারে, স্রেফ গলার হাঁকেই তালিবান বাহিনীকে চমকে দিতে পারে।'
একটু থামল ও। ওর মনের ভেতরের খুপরিগুলো থেকে অসংখ্য স্মৃতি বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, ওর মনোযোগ দাবি করছে। কিন্তু পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করল ও।
'বলে যাও,' বলল আনিকা।
'বেশ স্মার্টও,' বলল ও। 'আমরা ইরাকে থাকতে মজা করে বাবিলন আর উরের গল্প করত। আফগানিস্তানের বেলায়ও তাই। আলেক্সান্দার দ্য গ্রেটের গল্প করতে পছন্দ করে। ও বলত, "ভাবতে পারো, আলেক্সান্দার কেন সেই কোন দূর থেকে এপর্যন্ত এসে হাজির হয়েছিলো?"'
'শুনে মনে হচ্ছে অমন একজনই আছে।'
'ওর মতো শক্তিশালী, সাহসী আর বুদ্ধিমান কারও সঙ্গে খুব কমই কাজ করেছি।'
তারিকের সামনে থেকে এগিয়ে গেল আনিকা। ওর সঙ্গে পোর্চে যোগ দিল ও। দরজা খোলার ঠিক আগমুহূর্তে কিঞ্চিৎ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, 'কথাটা মাথায় রেখ, কেমন?'
কি বলতে বুঝতে পারল না ও।
দরজা খুলল আনিকা। ভেতরে পা রাখল ওরা। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র কটু একটা গন্ধ নাকে এসে আঘাত হানল ওর।
মৃত্যুপথযাত্রী কারো গন্ধ।
৫.
সামনের দিকে একটা ছোট প্রবেশপথ, ডানের ঘরটা ডাইনিং রুম বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু নিপুণ ভঙ্গিতে ওকে বামে নিয়ে গেল আনিকা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সবকিছু খোলাসা হয়ে গেল ওর কাছে। এই কামরাটা এককালে লিভিং রুম বা পার্লার বা এমন কিছু ছিল, কিন্তু দুটো কাউচ এবং তিনটা চেয়ার সরিয়ে মাঝখানে একটা হসপিটালের খাট পাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভেন্টিলেটরের মৃদু খরখর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ধীর পায়ে সামনে এগোল ও। চাদরের নিচে লুটিয়ে পড়ে আছে দোমড়ানো একটা কাঠামো। জোর করে নিজেকে সামনে বাড়াল ও। যুদ্ধক্ষেত্র, মেডিক টেন্ট বা ইভ্যাক হেলিকপ্টার ওর কাছে নতুন কিছু নয়। তবু যুদ্ধ শেষে যা কিছু অবশিষ্ট থাকে সেটা প্রত্যক্ষ করায় পিলে কাঁপিয়ে দেয়ার মতো একটা কিছু থাকে।
বিছানায় শুয়ে আছে বাংলাদেশী-আমেরিকান মানুষটা। মুখটা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। ওর গলা থেকে বেরিয়ে এসে একটা মেশিনে ঢুকেছে ভেন্টিলেটরের টিউব। জোড়া মাথার একটা অক্সিজেন টিউব সেঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর নাকে। ওর বাম চোখের কোটরটা ফাঁকা, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে যেন। হালকা নীল সুতি চাদরের উপর লুটিয়ে আছে ওর ডান হাত। আঙুলের ডগায় বিভিন্ন ধরনের মনিটর ডিভাইস জুড়ে দেওয়া।
বাম হাত বলে কিছু নেই।
কম্বলের নিচের অবয়ব দেখে বোঝা যায়, একটা পা নেই।
খাটের নিচে পেশাব ভর্তি একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলছে।
দেয়ালে ওই মানুষটারই ছোটবেলা আর কিশোর বয়সের অসংখ্য ছবি সাঁটানো। সেগুলোর দুটো ফুটবলের ইউনিফর্ম পরা, একটা হাইস্কুলের এবং আরেকটা কলেজের।
উর্দি পরা আরো একটা ছবি রয়েছে ওর, এটা আর্মিতে থাকার সময়ের। সুদর্শনা এক আমেরিকান-বাংলাদেশী নারী ওর বাহুতে রেঞ্জারের ট্যাব সেঁটে দিচ্ছে। দুজনই হাসছে। ওকে দেখে দারুণ আত্মবিশ্বাসী ঠেকছে, যেন সকালে দুনিয়ার মোকাবিলা করে বিকেলে খাসা একটা সিগার আর এক গ্লাস রেমি মার্টিন উপভোগ করতে পারে।
ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল তারিক। এক কোণে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল আনিকা।
অনেক কথাই ভাবছে তারিক, কিন্তু এক ধরনের ক্ষোভও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে ওর ভেতর। ইচ্ছা করছে আনিকাকে ওকে আবার এয়ারপোর্টে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলে, যেন পরদিনই আফগানিস্তানে ফিরে গিয়ে যারা ওই মানুষটার এই দশা করেছে তাদের সবকটাকে খুঁজে বের করে খুন করতে পারে। তারপর ওদের বাড়িঘর ধুলোয় মিশিয়ে দেবে।
ঠিক আলেক্সান্দার দ্য গ্রেটের মতো।
একমাত্র চোখের পাতা কাঁপতে কাঁপতে খুলল, চোখটা এদিক-ওদিক নড়ছে। ঝট করে ওর উপর স্থির হলো ওটা।
হাসল মানুষটা।
'আররে, দোস্ত, তোমাকে দেখে কি যে ভালো লাগছে,' বলল সে, এত ক্ষীণ কণ্ঠ, শুনতে কষ্ট হয়।
ওর কপালে হাত রাখল তারিক, চোখ পিটপিট করছে ওর। 'তোমাকে দেখে আমারও ভালো লাগছে, রবিন।'
'মিথ্যুক,' ফিসফিস করে বলল সে।
'সে তো তোমার কাছেই শেখা,' বলল তারিক। 'বানোয়াট গল্প বলায় তোমার জুড়ি ছিল কবে। তোমার কি এখনো ধারণা স্রেফ বীজ ছড়াতে ক্ষেপে থাকায় আফগানিস্তানে হামলা করেছিল আলেক্সান্ডার?'
আরো চওড়া হলো রবিনের হাসিটা। স্রেফ এমন দৃশ্য দেখার জন্যে যে কাউকেই নির্দ্বিধায় ওর হিসাবের সমস্ত টাকাকড়ি বিলিয়ে দিতে পারে তারিক।
'তোমার ধারণা কেবল নাম স্রেফ কিনতে সেই গ্রিস থেকে সুন্দরী নারী আর মদ নিয়ে আফগানিস্তানে এসেছিল সে? মোটেই তা মনে হয় না...'
চোখের পাতা পিটপিট করে মুদে গেল। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। 'মনে হয় না...'
তারিকের হাতের মুঠি শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। আবার ঘুমে ঢলে পড়ল রবিন।
ছবির সেই নারী হাজির হলো কামরায়। রেবেকা, রবিনের কাছে ওর কথা বহুবার শুনেছে ও। কালো হাই হীল জুতো ওর পায়ে, পায়ের আঙুল দেখা যায়; টাইট জিন্স এবং হাতা গোটানো শাদা পুলওভার পরেছে, বুকের খাঁজের আভাস দেখা যায়। হাত পায়ের নখে লাল পলিশ লাগানো। আঙুল এবং কব্জিতে সোনার অলঙ্কার।
মেহগনি কাঠের মতো মসৃণ ত্বক, শাদাসিধে পনিটেইল কায়দায় বেঁধেছে ঘন কালো চুল। ওই সুন্দর চেহারা আর স্টাইলের সুবাদে অনায়াসে মডেলিং জগতে নাম লেখাতে পারতো। তবে দুটো সমস্যা আছে: মেয়েটা বেশ খাটো, আর তারিকের দিকে চেয়ে থাকা চোখজোড়ায় যুগপৎ ভীষণ ক্রোধ এবং হতাশা খেলা করছে।
আনিকাকে উদ্দেশ করে রেবেকা বলল, 'ওর কথাই বলেছিলে?'
'হ্যাঁ, ওই।'
'দেখে তো তেমন কঠিন মনে হচ্ছে না।'
স্বামীর কাছে গিয়ে ওর কপালে হাত রাখল রেবেকা। ভেন্টিলেটরের রিডিং দেখল। তারপর নাইটস্ট্যান্ডে রাখা ওষুধপত্র দেখল একনজর।
আস্তে গলা খাকারি দিল তারিক। 'দেখে আমাকে যেমনই মনে হোক, যেকোনো কাজ করার ক্ষমতা আছে, বুঝলে।'
কথাগুলো যেন আপনা আপনি বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে।
'সেটা দেখা যাবে।'
ওর কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল আনিকা। যেন রেবেকার ক্রোধের কিঞ্চিৎ আঁচ অনুভব করতে চায়। 'আজ কেমন আছে ও?' জানতে চাইল।
'তেমন পরিবর্তন নেই,' নাইটস্ট্যান্ডে ব্যস্তসমস্তভাবে কিছু খুঁজছে রেবেকা। 'বড্ড বেশি ঘোরের ভেতর চলে যাচ্ছে...বেশি বেশি ঘুমাচ্ছে...ঘুমালেই রাজ্যে স্বপ্ন দেখছে...'
'ওর কোনো ভিএ হাসপাতাল বা ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে থাকা উচিত ছিল না?' জিজ্ঞেস করল তারিক।
অয়েনমেন্টের একটা টিউব রেখে তীক্ষন কণ্ঠে রেবেকা বলল, 'আমার স্বামীর সেবা কিভাবে করতে হবে তোমার কাছে তার সবক নিতে বলছ?'
'না, মানে, বুঝতে পারছি ব্যাপারটা ঝামেলাময় হতে পারে, তাছাড়া -'
আপাদমস্ত তারিককে জরিপ করল রেবেকা। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তরিকের মনে হলো প্রথম ড্রিল সার্জেন্টের মুখোমুখি হওয়ার সেদিনের মতো কেঁচোয় পরিণত হয়েছে ও। 'তুমি এখানে এসেছ ঠিক দেড় মিনিট হয়েছে, কিছুই জানা নেই তোমার, ঘোড়ার ডিম কিচ্ছু জানো না।'
মাথা দোলাল তারিক। 'ঠিকই বলেছ, ম্যা'ম। ক্ষমা করবে। আসলে আমি কিন্তু খারাপ কিছু বোঝাতে চাইনি।'
একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে রইল রেবেকা। তারপর হাত থেকে পড়ে যাওয়া টিউবটা তুলে নিল। 'আমাকে ম্যা'ম ম্যা'ম করবে না। মনে হচ্ছে কোনো মিটিংয়ে আছি।'
দুই আঙুলের মাথায় খানিকটা অয়েনমেন্ট নিয়ে রবিনের ঠোঁটে লাগাল রেবেকা। 'আসলে হাসাপাতালের ওরা সাধ্যমতোই করেছে। কিন্তু ওদের সাধ্যমতো করায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আরো ভালো কিছু চেয়েছি আমি। তাই ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। বাড়িতে আমার সঙ্গে থাকলে আর কিছু ওষুধপথ্য পেলেই হয়তো দ্রুত সেরে উঠবে বলে মনে হয়েছে। এখনো তেমন কিছু হয়নি অবশ্য, তবে কাজ হবে। আমি জানি।'
'ম্যা'ম' বলে মনে মনে জিভ কাটল তারিক, চট করে শুধরে নিয়ে বলল, 'রেবেকা, রবিনের সঙ্গে দুই বার সফরে গেছি আমি। যেভাবে সম্ভব সাহায্য করব বলেই এসেছি এখানে। কি চাইছ তুমি?'
'ওকে কিছু বলোনি, আনিকা?' আনিকাকে জিজ্ঞেস করল সে।
'না,' বলল আনিকা। 'তোমার মুখে শুনলেই ভালো হবে ভেবেছি।'
'বেশ তবে,' বলল রেবেকা। এবার তারিকের উপর স্থির হলো বাদামী চোখজোড়া। জ্বলজ্বল করছে। 'আমার রবিনের যে এই অবস্থা করেছে, ওকে এভাবে আহত করেছে, তাকে খুঁজে বের করতে চাই। বদলা নিতে চাই।'
ঘুমন্ত মানুষটার দিকে তাকাল তারিক। এই রবিনকে ওর চেনা রবিনের সঙ্গে মেলানো কঠিন। ওর ইউনিটের সেরাদের সেরা ছিল সে। 'সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় আনিকাই সবচেয়ে যোগ্য হবে,' বলল ও। 'রবিনের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি। আফগানিস্তানে ঠিক কবে, কোথায় ঘটনাটা ঘটেছে জানতে পারলে কাজে নামা যাবে। আনিকা আসল দলটাকে শনাক্ত করবে, তারপর চেইন অভ কমান্ডের সুতো ধরে দায়ী অফিসারদের নিশানা করা...'
হেসে উঠল রেবেকা। বাদ সাধল ওর কথায়। 'বোকা মেয়ে, তুমি মনে হয় ওকে কিছ্ ুবলোনি, তাই না?'
আনিকা যেন সহসা বাইরের দৃশ্যের ব্যাপারে উৎসুক হয়ে উঠেছে।
রবিনের স্ত্রী বলল, 'তালিবান কিংবা আলকায়েদা ওই কাজ করেনি। কিংবা আইএসআইএস।'
বিভ্রান্ত দেখাল তারিককে। অন্য কামরার দিকে ইশারা করল রেবেকা। 'আরো কিছু জানতে হলে আমার সঙ্গে এসো। তোমরা দুজনই।'
কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল রেবেকা। দ্বিধা না করে ওকে অনুসরণ করল তারিক।
- [চলবে]