রুমীর মদিরায় মত্ত এক চিকিৎসক
ডা নেভিট এরগিন ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভুত একজন নামকরা চিকিৎসক ও প্লাস্টিক সার্জন। চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করেছেন কানাডায়, তারপর কর্মজীবন মিশিগান ও দক্ষিণ ক্যালিফোনির্য়ায়। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ম্যাটেও শহরের বিখ্যাত চিকিৎসক তিনি, পাঁচ সন্তানের জনক এক সুখী পিতা। দিনমান রোগী দেখে, অস্ত্রোপচার করে আর অবসরে পরিবারের সাথে সময় কাটিয়ে দিব্যি তাঁর জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন এই মানুষটি, যদি না ২৭ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালে তাঁর দেখা হয়ে যেত বিখ্যাত সুফী সাধক হাসান লুতফি সুসুধ এর সাথে।
হাসান লুতফি সুসুধ পশ্চিমা বিশ্বের এই বরেণ্য চিকিৎসকটিকে পরিচয় করিয়ে দেন জালালউদ্দিন রুমীর কর্ম আর ইতলাক ইয়োলুর সাথে। ইতলাক হল এক ভিন্ন ধরণের সুফী ধারা, যা ইসলামি সুফিবাদ থেকে অনেকটাই দূরে, আর বৌদ্ধ মতবাদ আর মধ্য এশিয়ার শামান মতবাদের অনেকটাই কাছাকাছি। সুসুধের সাথে এই পরিচয় আমূল বদলে দিল এরগিনের জীবন। তাঁর নিজের জবানে-"এই দেখা হবার পর থেকে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি রুমী নামের মানুষটির দুর্ভেদ্য শিকারে আহত অস্থির ও দুর্ভাগাদের একজন!"
ডা নেভিট এরগিন একমাত্র ব্যক্তি যিনি জালালউদ্দিন রুমীর সম্পূর্ণ দিওয়ান ই কাবির এর ২২ টি খন্ড (৪৪ হাজার কবিতা) ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এই কাজে তিনি ব্যয় করেন তাঁর জীবনের শেষ ৬০টি বছরের প্রতিটি নির্ঘুম রাত, প্রতিটি অস্থির দিন। এছাড়াও তিনি রুমীর ২২১৭টি রুবাই অনুবাদ করেন ইংরেজিতে। এরগিনের অনুবাদ আক্ষরিক অনুবাদ নয়, বরং তিনি মনে প্রাণে রুমীকে ধারণ করতেন, গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ইতলাক এ-যার অনুসারী রুমী স্বয়ং, আর এরগিনের বন্ধু হাসান লুতফি সুসুধও।
এই বিশাল অনুবাদ কর্মের জন্য নেভিট এরগিন তুরস্কের সরকারের সহায়তা চাইলে সরকার সানন্দে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে সম্মত হয়। ফলে ১৫ বছরের মধ্যে ২৩ খন্ডের দিওয়ান ই কাবির এর মূল ইংরেজি অনুবাদের ২২ খন্ড প্রকাশিত হয়। তবে শেষ খন্ডটি প্রকাশিত হবার সময় তুর্কি সরকার রহস্যজনক ভাবে অস্বীকৃতি জানায় ও অসহযোগিতা করে। কারণ এই চুড়ান্ত খন্ডের কবিতাগুলো চিরকালই নানা বিতর্কের আর ধোঁয়াশার জন্ম দিয়েছে। এ বিষয়ে এরগিন বলেছেন-দিওয়ানের শেষ খন্ডের কবিতাগুলো পাঠ ছিল মাইন বিছানো মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা। কেউ জানে না কোন কবিতাটা হৃদয় ও মনের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটাবে!
ডা এরগিনের অন্যান্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে আছে- নিজের লেখা ছোট গল্পের সংকলন-টেইলস অফ আ মডার্ন সুফি, রুমী, হাসান সুসুধ ও ইতলাক বিষয়ক গ্রন্থ দ্য সুফি পাথ অফ এনিহিলেশন, ফরবিডেন রুমী বা নিষিদ্ধ রুমী, আননোন রুমী বা অজানা রুমী ইত্যাদি।
ফরবিডেন রুমীর ভূমিকায় ডা এরগিনের বক্তব্য হল-সত্যকে অন্বেষণের যাত্রায় আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হল আপন সত্তা বা অহং। এই সত্তা চোখে চুল পড়ার মত, আত্নার পদতলে বিদ্ধ কাঁটার মত। চোখ থেকে এই চুল বা পায়ের তলা থেকে এই কাঁটা অপসারণ না করা পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই না বা চলতে পারি না। আমরা যদি এই অহং এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করি তাহলে পৃথিবীতে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। যখন আমরা অহং এর শহিদে পরিণত হব তখনই কেবল আমাদের পক্ষে চিরন্তনকে জয় করা সম্ভব।
রুমীর মদিরায় মত্ত এই চিকিৎসক-অনুবাদক ২০১৫ সালে ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার আগে রুমীর সাথে নিজের যাপিত ৬০ বছর সম্পর্কে তিনি বলেন-এই সময়টা আমি কেবল এই দুনিয়া থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করেছি যতদিন না দুনিয়া আমাকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি দেয়!
২০০৮ সালে ভারতীয় পত্রিকা স্প্যান এর উর্দু সম্পাদক আনজুম নাইম ডা এরগিনের একটা সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। সেই সাক্ষাতকারের অনুবাদ করার প্রয়াস করছি এখানে।
প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে রুমী কতটা প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: রুমী চিরকালই সভ্যতা আর এর সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ যোগসাধনের প্রতীক। সভ্য মানুষের সদা উদ্বিগ্ন মস্তিষ্ক আর ভারাক্রান্ত হৃদয়কে সর্বদা প্রশান্তি দিয়ে এসেছেন রুমী। ভুলে যাবেন না, এই পৃথিবী যতই ভয়ংকর হয়ে উঠবে, পৃথিবীতে মানুষের জীবন ততই অপাংক্তেয় হয়ে উঠবে, রুমী ততই বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকবেন। আপনি কি টের পান না মানুষের আত্নকেন্দ্রিক আচরণ দিন দিন কেমন নেতিবাচকতায় বোঝাই হয়ে পড়ছে? নেতিবাচক দৃষ্টান্তে ভরপুর এক ধূসর মরুতে আধ্যাত্নবাদের মরুদ্যান ব্যাতীত আমরা এখানে কিভাবে টিকে থাকবো বলুন? জীবনের চাবিকাঠির নিছক অন্বেষণে, বিশ্বাসের বিকল্প সন্ধানে, যা মানুষকে নিজ সমাজ ও স্বজাতির কাছে এলিয়েন হয়ে উঠতে বাধা দেবে-রুমীকে আমাদের দরকার হবে। রুমী নিশ্চয় অন্য যে কারও চাইতে তাকে সবচেয়ে ভাল পথ প্রদর্শন করতে পারবেন। অবশ্যই তিনি জীবনের চাইতে বড় (লার্জার দ্যান লাইফ) ছিলেন। কিন্তু একই সাথে তিনি ছিলেন মানুষের আত্নার ভীষণ নিকটের, তার ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের বাইরে এক নৈকট্যের মানুষ। রুমী এক অসীম ছাতার মত, আমাদের যা কিছু আছে আর থাকবে-তার ওপর।
প্রশ্ন: পাশ্চাত্যে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন রুমী এত জনপ্রিয়?
উত্তর: কে যেন একবার বলেছিল-পশ্চিমে রুমীর বিপুল এই জনপ্রিয়তার পেছনে আছে তাদের আধ্যাত্ববাদিতার প্রতি বিপুল খিদে। এটা অবশ্যই মানতে হবে, পশ্চিমে মানুষ পড়ে অনেক বেশি। আর এখানে বই প্রকাশিত বা বিক্রয়ও হয় অনেক বেশি। যেসব দেশে জীবিকা নির্বাহ জটিলতায় ভরা, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাভাবিকতা বিনষ্ট, সেখানে সাধারণ মানুষ বইয়ের দুনিয়ায় ডুবে যেতে সহজেই পারে না। মার্কিনীরা সারাক্ষণই সমাধান খুঁজতে ব্যস্ত, আর এই অন্বেষণই তাদেরকে রুমীর প্রতি এত আকৃষ্ট করে তুলে।
তার চেয়ে বড় কথা, আমেরিকার মত এক বহুমাত্রিক সমাজে, যেখানে সারাক্ষনই বিশ্বাস আর যুক্তির মধ্যে এক টানাপোড়েন চলছে, রুমী পাঠ সেখানে এক নতুন দুয়ার খুলে দেয়। এখানে মানুষ বিলাসী ও ভোগবাদী জীবন যাপন করে, কিন্তু এও সত্য যে স্বচ্ছল আর সমৃদ্ধ হলেই সুখী হওয়া যায় না। এই আপাত সুখের পরবর্তী সুখ খুঁজে পেতে রুমী সাহায্য করেন-যে সুখ শরীর আর আত্নার, যে সুখ মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের খোরাক যোগায়। এইজন্যই তিনি এখানে এত জনপ্রিয়।
আমি বলব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রুমীর এই ব্যাপক জনপ্রিয়তার পেছনে অধ্যাপক কোলম্যান বার্কস এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তিনি যে কেবল আমেরিকার বোদ্ধা সাহিত্যিক মহলে রুমীকে পরিচিত করেছেন তা নয়, রুমীর নৃতাত্বিক পরিচয়কে দারুণ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এর আগের ইংরেজি অনুবাদগুলো ছিল পাখির ডানার নিচে লুকোনো কল্পনামাত্র, বার্ক এসে সেই পাখির খাঁচা খুলে দিলেন। আর সেই পাখি তখন গাইতে শুরু করল তার সমস্ত স্বত্তা আর সর্ম্পূর্ণতা নিয়ে।
প্রশ্ন: রুমীর অনুবাদ কতটা কঠিন ছিল আপনার কাছে?
উত্তর: অনুবাদ সব সময়ই জটিল আর চ্যালেন্জিং কাজ। আর রুমীর আধিবিদ্যক কাজের অনুবাদ তো আরও জটিল। রুমীর কবিতাগুলোর মধ্যে এক অর্ন্তনিহিত বিপদ বিদ্যমান। কেননা এরা তাদের কাব্যিক অভিনব সৌন্দর্যে আপনার চোখ এতটাই ধাঁধিয়ে দেবে যে তার ঐশ্বরিক অর্থ আপনার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। আপনি যতক্ষণ না তাঁর নিজস্ব গোপন জানালা দিয়ে উঁকি না দেন ততক্ষণ আপনি রুমীকে বুঝতে বা ধারণ করতে পারবেন না। আমি একজন চিকিৎসক, আর আপাদমস্তক বিজ্ঞানের জগতের মানুষ। কিন্তু আমি যখন রুমীকে পড়তে শুরু করলাম তারপর ১৫ বছর লেগেছে তার ভাবনা আর বিষয়বস্তুকে হৃদয়ঙ্গম করতে। রুমীর দাবি হল আপনি যদি তার ভাবনার জগতে ডুব দিতে চান তবে আপনার অতীত জীবনের সমস্ত আদর্শ আর ধারণাকে জলান্জলি দিয়ে আসতে হবে। তাঁর সঙ্গীতের মূর্ছনায় ভেসে যাবার পূর্বশর্ত হল এটি। আপনি যদি আপনার পূর্বধারণা বা বিশ্বাস নিয়ে রুমীকে বুঝতে চান তবে তা আপনার জন্য জটিল কাজ হয়ে উঠবে। এই বিষয়ে আমি সচেতন ছিলাম আগাগোড়া।
প্রশ্ন: পশ্চিমের বহুমাত্রিক সমাজে রুমীর আধ্যাত্নিক সুফিবাদ কি ধরণের ভূমিকা রাখে?
উত্তর: সুফিবাদ মানুষকে তার স্বঅলংকৃত বিশ্বাস বা ধারণা থেকে মুক্তি দেয়। এটি মানুষকে ঈশ্বরের সরাসরি সংস্পর্শে যেতে সাহায্য করে। একটি বহুমাত্রিক সমাজের নানামুখী নানাবিধ স্বআরোপিত বিশ্বাস মানুষকে ঈশ্বরের দিকে ফিরতে বাধা দেয়। সুফিবাদ তাকে এই হাঁসফাঁস শেকল পরা অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়। এই জন্য এ ধরণের সমাজে এর ভূমিকা এত গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে প্রাচ্যে মানুষ সর্বদা ঈশ্বরের অনুসন্ধানে নিজেদের ব্যাপৃত রাখে। সুফিবাদ এই সমাজের অতি গভীরে প্রোথিত। পূর্ব ও পশ্চিমের যোগসূত্র এখানেই স্থাপিত হতে পারে।
- (আধুনিক বিশ্বে রুমীর প্রাসঙ্গিকতা: আনজুম নাইম কতৃক ডা নেভিট এরগিনের সাক্ষাৎকার)