রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
১৫. হারানো হরিৎ
এই মহানগরের ফুটপাতের কিছু অস্থায়ী রেস্তোরাঁর জনপ্রিয় নাম হচ্ছে 'ইটালিয়ান হোটেল'। বাস্তবে ইতালি দেশটি বা সেখানকার খাবারের সাথে এই রেস্তোরাঁগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। চেয়ার, টুল বা বেঞ্চির বদলে এখানে ফুটপাতে ইট পেতে বসে খাবার খেতে হয় বলে এর নাম 'ইটা'লিয়ান হোটেল! এখানে অস্থায়ী কাঠের চুলা বা কেরোসিন স্টোভে রান্না করা হয়। কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপর হাড়ি-গামলা-প্লেট-গ্লাস রেখে ভাত, ডাল, আলুভর্তা, ডিমের ঝোল, ছোট-মাঝারি মাছের ঝোল আর ফার্মের মুরগীর মাংসের তরকারী বিক্রি করা হয়। এগুলোর কোন কোনটাতে রুটি বা পরোটা, তার সাথে সবজি ভাজি, বুটের ডাল, হালুয়া আর ডিমভাজা পাওয়া যায়। নব্বইয়ের দশকে রাজারবাগ–মতিঝিল এলাকার ডিআইটিএভিনিউ বা আউটার সার্কুলার রোড অথবা গুলিস্তানের কাপ্তানবাজারের উত্তর দিকের রাস্তার ইটালিয়ান হোটেলগুলোতে আটার বড় বড় গোল রুটির সাথে আখের গুড় সাজানো থাকতো। নিম্ন আয়ের লোকজন ডাল, ভাজি বা হালুয়ার পরিবর্তে তখন গুড়ের টুকরো দিয়ে রুটি খেতেন। ঐ রাস্তাগুলোর কোনটা দিয়ে যখন রিকশা করে যেতাম তখন আমার খুব ইচ্ছে করতো নেমে গুড় দিয়ে রুটি খাই, কিন্তু 'সঙ্কোচের বিহ্বলতায়' কোনদিন সেটা করা হয়ে ওঠেনি।
ইটালিয়ান হোটেলের রুটি-গুড়ের কথায় মনে পড়ে সত্তর-আশির দশকে আগে আমরা বাড়িতে প্রায়ই সকালের বা সন্ধ্যার নাস্তায় গুড় দিয়ে রুটি খেতাম। শীতকালে ফেরিওয়ালারা যখন মাথায় বাঁশের টুকরিতে চার-পাঁচটা অদ্ভুত আকৃতির মাটির কলসে করে খেজুরের রস থেকে বানানো ঝোলা গুড় বা 'মরিচা মিঠাই', কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে অর্ধগোলকাকৃতির মুচি গুড় আর শিল পাটার মতো পাটালি গুড়ের বার নিয়ে নিয়ে হাজির হতেন, তখন আমরা খুব চাইতাম গুড়ওয়ালাকে ডেকে আস্ত কলসভর্তি গুড় আর তার সাথে যথেষ্ট পরিমাণে মুচি গুড় কেনা হোক। কলসভর্তি গুড় কেনার ঘটনা সচরাচর না ঘটলেও পিঠেপুলি বানানোর উদ্দেশ্যে কয়েক 'সের' ঝোলা গুড় আর মুচি গুড় ঠিকই কেনা হতো। আমাদের বাড়িতে একটা অদ্ভুত আকৃতির অ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনাওয়ালা বয়ামে সারা বছর শুকনো গুড় রাখা হতো। আমরা মহানন্দে পিঠে বানাবার গুড় দিয়ে রুটি খেতাম, তারচেয়ে বেশি এমনি এমনি খেতাম–কিছুটা প্রকাশ্যে, বেশির ভাগ সময়ে চুরি করে। গুড় যে কোন ইঁদুরে খেয়ে যাচ্ছে আম্মু সেটা বিলক্ষণ জানতেন, কিন্তু এমন ভাব করতেন যেন কিছুই ধরতে পারেননি। সম্ভবত চুরির পরিমাণ হিসেবে রেখেই গুড় কেনা হতো। এই চিত্র যে কেবল আমাদের বাড়ির ছিল তা নয়, এটা তখনকার অনেক বাড়ির সাধারণ চিত্র ছিল। গুড় ছাড়া চিনি দিয়েও রুটি খাওয়া হতো। রুটিটার একপাশে অল্প পানি লেপে ভিজিয়েতাতে চিনি ছিটিয়ে রোল বানিয়ে খাওয়া হতো। বাড়িতে পরোটা ভাজা হলে তো মোটামুটি অবধারিতভাবে তার একটা চিনি দিয়ে খাওয়া হতো। তখন পাড়ার সব দোকানে সামনের দিকে অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় গুড়ের স্তুপ রাখা থাকত–পাটালি গুড়, মুচি গুড়, আখের গুড়। দোকানে গুড়ের সাথে মুড়ির বিশালবস্তা থাকতো, কারণ লোকে গুড় দিয়ে মুড়ি খেতে পছন্দ করতেন। গুড় দিয়ে চা, শরবত বানানো হতো। সাধারণ সব পরিবারের মাসের বাজারের তালিকায় অবধারিতভাবে গুড় থাকত। অথচ এখন শীতকাল এলে এবং পিঠে বানানোর পরিকল্পনা থাকলে কেবল গুড় কেনা হয়। খুব অল্প কিছু পরিবার ছাড়া বাকি সব পরিবারে গুড় অত্যাবশকীয় পণ্য থেকে শৌখিন জিনিসে পরিণত হয়েছে। কেন এমনটা হল? সেটা কি চিনি উৎপাদনের মৌসুমে গুড় বানানো নিষিদ্ধ হওয়ায়, নাকি দেশে আখ আর খেজুরের রসের উৎপাদন কমে যাওয়ায়, নাকি গুড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেটা জানি না!
আটার সাথে গুড় গুলিয়ে একটা বলের আকৃতির জিনিস বানিয়ে ডুবো তেলে ভাজা হতো–এর নাম গুলগুল্লা। এটা যতটা না বাসায় বানানো হতো তারচেয়ে ঢেড় বেশি পাড়ার চায়ের দোকান যেখানে ডালপুরি, সিঙ্গারা ভাজা হয় সেখানে বানানো হতো। গুলগুল্লার দাম একটাকা থেকে বাড়তে বাড়তে পাঁচ টাকা পর্যন্ত উঠতে দেখেছিলাম। আমাদের পাড়ার সুবলের চায়ের দোকানে সকাল নয়টার দিক থেকে গুলগুল্লা ভাজা শুরু হতো আর বারোটা বাজার আগেই সব গুলগুল্লা বিক্রি শেষ হয়ে যেত। এখনো হয়তো কোথাও কোথাও গুলগুল্লা ভাজা হয় তবে আগের মতো অমন ব্যাপক হারে চোখে পড়ে না। পাড়ার কোন কোন দোকানে অতি পাতলা করে আয়তাকারে কয়েক স্তরে ময়দা বেলে, ডুবো তেলে ভেজে চিনির সিরায় ডুবিয়ে ঝরিয়ে গজা বানানো হতো–খেতে মিষ্টি আর মুচমুচে। জিলিপি রাখার মতো একটা কাঠের গোল খাঞ্চায় গজা সাজিয়ে রাখা হতো তাতে উপরের স্তরের গজার বাড়তি সিরা ঝরে পরার সময় ঠাণ্ডা হয়ে স্ট্যালাকটাইটের মতো নিচের স্তরের গজার গায়ে আটকে যেত। লোকে গজা এমনিতেই অথবা চা সহযোগে খেতেন। অমন দোকানের কোন কোনটাতে জিলিপিও বানানো হতো–হলুদ রঙের, খুব বড় না আবার খুব ছোটও না, খুব মোটা না আবার খুব সরুও না। বাইরেটা শুকনো অথচ ভেতরটা রসে টইটুম্বুর সেই জিলিপি দোকানে পড়তে না পড়তে বিক্রি হয়ে যেত। কেউ এক 'পোয়া' জিলিপি কিনে কাগজের ঠোঙায় নিয়ে এমনিতেই খেয়ে ফেলতেন, আবার কেউ এক গ্লাস গরম দুধ সহযোগে মুচমুচে জিলিপি খেতেন। একমাত্র গুলিস্তানের 'পূর্ণিমা'তেই বুঝি লোকে বনরুটি সহযোগে মোটা জিলিপি খেতেন–এখনো খান। শুক্রবারে মসজিদে বা কোন কোন বাসায় মিলাদ দেয়া হতো বলে সেদিন নেওয়াজ বা তবরুকের জন্য সকাল থেকে বিপুল পরিমাণে জিলিপি ভাজা হতো। আমাদের 'আদি গন্ধেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' বা 'রীপা সুইটস'থেকে লোকে খাকি রঙের কাগজের ঠোঙা ভরে মিলাদের জন্য পাঁচ 'সের' থেকে দশ 'সের' জিলিপি কিনে নিয়ে যেতেন। এখন জিলিপির রঙ, আকার, প্যাঁচ, পুরুত্ব, সুবাস সবই পালটে গেছে, মিলাদেও বোধকরি আগের মতো জিলিপির তবরুক খুব একটা দেয়া হয় না।
আমরা ভাইবোনেরা নাস্তাতে রুটি-গুড় খেতে যতটা পছন্দ করতাম তারচেয়ে ঢেড় বেশি অপছন্দ করতাম ছাতু খেতে। গম, যব বা ভুট্টার ছাতু অল্প পানি দিয়ে ভিজিয়ে গুড় মাখিয়ে ঢেলা বানানো হতো। সেই ঢেলা খেতে গেলে অবধারিতভাবে গলায় আটকাতো। কেউ কেউ কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ কুঁচি সহযোগেও ছাতুর ঢেলা বানাতেন। নানীকে দেখতাম গম বা যব শুকনো খোলায় ভেজে ছাতু বানাতেন–পরিমাণে বেশি হলে কাঠের কাহাইল-ছিয়া দিয়ে কুটে, আর অল্প পরিমাণে হলে লোহার হামানদিস্তা দিয়ে কুটে। কাচের বয়ামে এয়ারটাইট করে ছাতু রাখা হতো যেন তাজা থাকে। খুব ছোটবেলায় যবের ছাতু খেতে পেলেও পরে কেবল গমের ছাতু খেতে পেতাম। বোধকরি দেশে যবের চাষ কমে যাওয়ায় আর যবের ছাতু মিলতো না। ভুট্টা মূলত শীতকালে পুড়িয়ে খাওয়া হতো। কালেভদ্রে কেউ কেউ ভুট্টার আটা অথবা ছাতু বানাতেন। সেসময়ে ভুট্টার খই বা পপকর্ন বানাতে দেখিনি। ধবধবে সাদা ধানের খই আর গুড় দুধে ভিজিয়ে তা দিয়ে, গরম গলানো গুড়ে পাক দেয়া খই দিয়ে বানানো মুড়কি বা 'উকরা' দিয়ে অথবা স্রেফ মুড়ি আর গুড় দিয়েও লোকে নাস্তা করতেন। বিন্নিধানের লাল-সাদা, গোল গোল খই পেলে গুড় ছাড়াই খাওয়া যেত। কারো পেটে গোলযোগ দেখা দিলে পানিতে ভেজানো চিঁড়ে আখের গুড় দিয়ে মেখে খেতেন। এর সাথে কেউ কেউ পাকা কলা আর দুধও মেশাতেন। অবশ্য পেটের রোগীরা বিচি কলা বা 'আইট্যা কলা' নামের খাটো, মোটা এক রকমের কলা খেতেন যেটা খেতে বেশ সুস্বাদু হলেও তাতে কোটি কোটি বীজ থাকত। এই কলার আরেকটা ভ্যারাইটি ছিল 'তুলা আইট্যা' যাতে বীজের পরিমাণ কম থাকত। এই দুটো কলার কোনটাই এখন আর সুলভ নয়। নিতান্ত বিপদেনা পড়লে এখন কেউ মুড়ি, চিঁড়ে, খই, মুড়কি বা ছাতু দিয়ে নাস্তা করার কথা ভাবেন না; পেটের গোলমালে কেউ বিচি কলার খোঁজও করেন না।
লাল আর সাদা রঙের মিষ্টি আলু এখনো পাওয়া যায় বটে, তবে খুব কম বাসাতে সেটা খাওয়া হয়। অথচ এক সময়ে প্রায় সব বাসায় মৌসুমে মিষ্টি আলু কেনা হতো। সেই আলু সেদ্ধ করে, পুড়িয়ে অথবা চাক চাক করে কেটে শুকনো খোলায় টেলে খাওয়া হতো। কাঁচা আম সহযোগে মিষ্টি আলুর চচ্চড়ি রান্না করা হতো। কেউ কেউ ভর্তা বানিয়েও খেতেন। কী কারণে মিষ্টি আলু তার বাজার হারিয়েছে জানি না। আমি গণচীনের এক অভিজাত হোটেলের সকালের নাস্তায় সেদ্ধ মিষ্টি আলু দিতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। মিষ্টি আলু তাও এক আধটু বাজারে মেলে কিন্তু মোটামুটি একেবারে হারিয়ে গেছে একই গাছের লতায় ধরা পেস্তা আলু আর তার শেকড়ে ধরা মেটে আলু। আমাদের বাসায় একটা কদম গাছ ছিল যার গা বেয়ে একটা পেস্তা আলুর লতা বেয়ে উঠেছিল। সেই লতা ঠিক গোল নয়, ষড়ভুজ না যেন অষ্টভুজাকৃতি। সবচে' সুন্দর ছিল এর পাতা–একেবারে হৃদয়াকৃতির। উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্রী বড় আপার কাছে শিখেছিলাম লতার পেস্তা আলু হচ্ছে 'বুলবিল' আর শেকড়ের মেটে আলু হচ্ছে 'টিউবার'। পেস্তা আলুর ভেতরটা সবুজ, খেতে কচুর মুখীরমতো একটু পিচ্ছিল। মেটে আলুর ভেতরটা সাদা, এর একটা বিশেষ তীক্ষ্ম স্বাদ আছে। গ্রীষ্মকালে ফুটপাতে কখনো কখনো শাকালু নিয়ে বসতে দেখা গেলেও এর জনপ্রিয়তা আগের পর্যায়ে নেই।
'তরুকলা' বা 'তুরিকলা' নামের একটা ফল আছে যেটা দেখতে অনেকটা তেঁতুলের মতো। গায়ের রঙও তেঁতুলের খোলসের মতো কিন্তু গায়ে রোম আছে। ভেতরটা অন্যান্য শিমের মতো ফাঁপা নয়, সলিড। তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়া হতো। লতানো গাছ অন্য বড় গাছ বেয়ে বেড়ে ওঠে। এক-দেড় ফুট লম্বা, চ্যাপ্টা, পুরু মৌ শিম বা মুকুল শিম এখনো হঠাৎ হঠাৎ বাজারে মেলে। আমরা কেবল এর ভেতরের অদ্ভুত গোলাপী-লালরঙা বড় বড় বীজ খুলে দেখতে চাইতাম। মান কচু, দুধ কচু, ওল কচু, জংলা কচু, কালী কচু, দস্তর কচু, নারকেলী কচু, ঘেঁটু কচু বা খারকোন ছাড়াও আরও অন্তত সাত-আট রকমের কচু ছিল। কোন কোন বাসার মানকচু গাছের উচ্চতা একতলার ছাদ ছাড়িয়ে যেতে চাইত। তার বিশাল বড় পাতার নিচে অনায়াসে একজন মানুষ বৃষ্টিতে মাথা বাঁচাতে পারতেন। এসব কচুর কিছু কিছু এখনো চাষ হয়, বাকিরা হারিয়ে গেছে। পথের ধারে যখন জংলা কচু গাছে ফুল ফুটতো তখন এর সৌন্দর্যে মোহিত হতে হতো। বকফুলও (Sesbania grandiflora) দেখতে অসাধারণ–যেন শিমফুলটাকে কেউ টেনেটুনে বড় করে দিয়েছে। আর কি তার রঙের বাহার! বেসনের গোলায় ডুবিয়ে তেলে কড়কড়ে ভাজা বকফুলের স্বাদ যিনি খাননি তাকে বোঝানো যাবে না। গন্ধভাদালী (Paederiafoetida) পাতার গন্ধটা কাঁচা অবস্থায় অরুচিকর হলেও এর বড়া বেশ মজার ছিল।
জলাভূমিগুলো ভরাট হয়ে হারিয়ে যাওয়ায় ঢ্যাঁপ আর শালুকও হারিয়ে গেছে। অথচ লোকে শখ করে ঢ্যাঁপের খই বানিয়ে খেতেন আর ভাতের বিকল্প হিসাবে শালুক সেদ্ধ করে খেতেন। ঢ্যাঁপের দানার মতো দানাদার ও মিউকাসে ভর্তি, আকারে ছোট সাইজের পটলের মতো তবে একটু সরু আর ঝিঙের মতো গায়ে দাঁড়ওয়ালা রামকলা'র (Alismataceae) নাম বোধকরি এখন খুব কম জনে জানেন। এটা এক প্রকারের সমূল ভাসমান জলজ উদ্ভিদের ফল। সিলেট অঞ্চলের হাওড়ে জন্মানো মাখনা (Euryale ferox) মূলত পুরনো ঢাকায় বিক্রি হতো। কী করে এই ফল সিলেটে জনপ্রিয় না হয়ে পুরনো ঢাকায় জনপ্রিয় হয়েছিল সেটা এক বিস্ময়! বড় আপার কাছ থেকে এটাও শিখেছিলাম মাখনার পাতা বাংলাদেশে প্রাপ্ত উদ্ভিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাতা।
আমাদের ছেলেবেলায় কারো জ্বর হলে ভাত-রুটিখাওয়া বন্ধ করে দেয়া হতো। ধারণা করা হতো এতে জ্বর আরও বেড়ে যাবে। তখন যব বা বার্লির পাউডার পানির সাথে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে রোগীকে খাওয়ানো হতো। জ্বরমুখে লেবু লবণ সহযোগে অথবা চিনি মিশিয়ে গরম বার্লি খাবার কথা মনে হলে আজো নাড়িভুঁড়ি উলটে অন্নপ্রাশনের ভাত বের হয়ে আসতে চায়। বাজারে, পাড়ার মুদি দোকানে লাল রঙের টিনের কৌটায় 'রবিনসন বার্লি' পাওয়া যেত। এই কৌটার বিশেষত্ব হচ্ছে এর মুখের ঢাকনাটা ছিল স্লিভযুক্ত। আমাদের বাসায় অমন একটা কৌটায় ভাঙতি পয়সা, খুচরো টাকা রাখা হতো। ঝাল মুড়িওয়ালারা ঐ কৌটায় মুড়ি আর মশলা রেখে ঝাঁকিয়ে ঝালমুড়ি বানাতেন। বার্লি কেন হারিয়ে গেল কে জানে! একইভাবে হারিয়ে গেছে কাউনের চাল। আজকাল খুব খোঁজাখুজি করলে পায়েস রান্না করার জন্য কাউনের চাল পাওয়া যাবে, অথচ একসময় এটা ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের খাবার–জাউ রেঁধে খাবার জন্য। বার্লির মতো করে সাগুদানা পানিতে অথবা দুধে জ্বাল দিয়েও রোগীদের খাওয়ানো হতো। এটা স্বাদও বার্লির মতো বীভৎস লাগতো। এটা এখন কালেভদ্রে কেউ হয়তো সাগু-বার্লি খান, তবে আগের মতো বহুল ব্যবহার আর নেই।
আমাদের জ্বর হলে নিমপাতার রস গরম করে খাওয়ানো হতো। আমাশয় হলে আশ শেওড়া বা মটকিলা পাতা (Glycosmis pentaphylla) আর আদা থেঁতলে রস বানিয়ে খাওয়ানো হতো। কৃমি হলে খালি পেটে চিরতা (Swertia bimaculata) বা কালোমেঘ (Andrographis paniculata) ভেজানো জল খাওয়ানো হতো। কাশি হলে বাসক পাতার (Justicia adhatoda) রস, আদার রস মধুর সাথে মিলিয়ে খাওয়ানো হতো। কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা বড়রা আগের রাতে ইসবগুল, ইসবগুলের ভুষি অথবা তোকমা (Hyptissuaveolens) ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে আখের গুড়ের শরবতে দিয়ে খেতেন। কালো রঙের তোকমার দানা জলে ভেজালে যে তারচেয়ে বড় আকারের সাদা দানা হয়ে যায় এটা আমাদের কাছে আশ্চর্যের বিষয় ছিল। কেউ কেউ ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার শাঁসও খেতেন তবে সেটা খুব সহজলভ্য ছিল না। খোসপাঁচড়া হলে নিমপাতা বেটে গায়ে লাগানো হতো অথবা নিমপাতা সেদ্ধ জলে গোসল করানো হতো। একবার 'ঝিনঝিনা' নামের একটা রোগের কথা শোনা গেল যেটাতে নাকি পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে ঝিঁঝিঁ ধরে আস্তে আস্তে পুরো শরীর অবশ হয়ে লোকে মারা যায়। সেটা কেবল শোনাই গেল, কেউ কখনো স্বচক্ষে কাউকে ঝিনঝিনা রোগে আক্রান্ত হতে দেখল না। অবশ্য এর নানা রকমের টোটকা চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়ে গেল, যেমন ২০২০ সালে সারা দুনিয়া কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে প্রতিদিন এর নতুন নতুন টোটকা চিকিৎসার কথা শোনা যেত। ঝিনঝিনার জন্য সবচে জনপ্রিয় টোটকা ছিল কপালে চুণ দিয়ে আড়াআড়ি তিলক কাটা আর পায়ের বুড়ো আঙুলে গোড়া চক্কর গাছের (Dracaena trifasciata) আঁশ দিয়ে আঙটির মতো করে পরা। আরেকটা চিকিৎসা ছিল মাথায় পানি ঢালা। এটা নিয়ে রেডিওতে নাটক প্রচার করা হয়েছিল যেখানে গম্ভীরা গানের সুরে বলা হয়েছিল
"ঝিনঝিনা রোগে ধরলে মাথায় পানি ঢালা চাই
হোমিওপ্যাথি ঔষধ নিয়মিত খাওয়া চাই
ঝিনঝিনা, ঝিনঝিনা, ঝিনিঝিনা"।।
এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে তখন আমরা কেবল ভেষজচিকিৎসা নিতাম। বরং সবার ঘরে ঘরে কিছু জনপ্রিয় ঔষধ সবসময় থাকতো যেমন, 'সিবাজল' ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেটটি বুঝে অথবা না বুঝে দৈনন্দিন সকল প্রকার শারিরীক সমস্যায় ব্যবহার করা হতো। আমি এই ট্যাবলেট গুঁড়ো করে ঘায়ে লাগাতে দেখেছি, এমনকি অসুস্থ মুরগীকে পর্যন্ত খাওয়াতে দেখেছি। 'প্যারাপাইরিন' এসে না হঠানো পর্যন্ত সিবাজল দোর্দণ্ডপ্রতাপে এদেশে ঘরে ঘরতে রাজত্ব করে গেছে। এর বাইরে পরিপাকের সাথে সম্পর্কিত 'ডিজিপ্লেক্স' আর 'লিভাপ্লেক্স', শিশুদের পুষ্টির সাথে সম্পর্কিত 'মিনোলাড', অ্যাসিডিটির সাথে সম্পর্কিত 'অ্যালকালি', সর্দি-কাশির সাথে সম্পর্কিত 'ফেনারগ্যান', সর্বব্যথাহর–কাটাছেঁড়া নিরাময়ক 'জামবাক', ঘা-চর্ম রোগ সম্পর্কিত 'ঢোল মলম', 'সালফা নিলামাইডপাউডার', 'জেনশিয়ান ভায়োলেট', 'পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট' ঘরে ঘরে থাকতো। রেডিওতে বিজ্ঞাপন দিত–
"কেটে গেলে, ছড়ে গেলে জামবাক
মচকালে, ব্যথা পেলে জামবাক
এক নিমিষেই সারিয়ে দেয় জামবাক, জামবাক"।।
অথবা
"মাথাব্যথাতো রবে না
সর্দি ও জ্বর হবে না
জিনেস্প্রিনের দুটো বড়ি
খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি"।।
লোকে পায়ে আলতা দেবার মতো করে জেনশিয়ানভায়োলেট লাগাতেন। বাচ্চাদেরকে 'গ্রাইপ ওয়াটার' খাওয়াতেন। পত্রিকাতে হাস্যোজ্জ্বল মায়ের সাথে মোটাসোটা বাচ্চার ছবি সহ গ্রাইপ ওয়াটারের বিজ্ঞাপন দেয়া হতো– "হাসিখুশি শিশু, ফুলফোর্ডের শিশু"। রেডিওর বিজ্ঞাপনে বলত–
"শিশুর হাসি, মায়ের খুশি দেখতে যদি চান
সীমার তৈরি গ্রাইপ ওয়াটার শিশুকে খাওয়ান"।।
পত্রিকাজুড়ে নানা রকমের টনিকের বিজ্ঞাপন দেয়া হতো। ধারণা করা হতো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য টনিকের বিকল্প নেই। সবচেয়ে জনপ্রিয় টনিক ছিল প্রসূতিদের জন্য 'ভাইব্রোনা' আর শিক্ষার্থীদের জন্য 'ব্রেইন টনিক'। এখনকার বিবেচনায় একটা আশ্চর্যকর বিষয় হচ্ছে ভেষজ ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গণমাধ্যমে 'সুরা'র বিজ্ঞাপন দিত। তারা নীরোগ আর সতেজ থাকার জন্য প্রতিদিন সুরাপানের পরামর্শ দিত। সেগুলোর নামও ছিল আকর্ষণীয়–যেমন, প্রাপ্তবয়ষ্ক পুরুষদের জন্য নির্মল, নারীদের জন্য লাবণী, শিশুদের জন্য 'উদ্যম', বৃদ্ধদের জন্য 'উপশম'। এর বাইরে 'মৃতসঞ্জীবনী সুরা', 'সারিবাদী সালসা', 'দ্রাক্ষারিষ্ট', 'দশমূলারিষ্ট', 'চ্যবনপ্রাশ'-এর মতো ভেষজ পণ্যগুলোর নিয়মিত বিজ্ঞাপন থাকত। আয়ুর্বেদের ভাষায় বলা 'আসব', 'অরিষ্ট' অথবা 'সালসা'কে সোজা বাংলায় 'মদ' অথবা নেশাকারক বলা যায় কিনা সেটা নিয়ে তর্ক করাই যায়, কিন্তু ১৯৮২ সালে 'জাতীয় ঔষধ নীতি' চালু হলে কেবল গণমাধ্যমে ঔষধের বিজ্ঞাপন দেয়াই বন্ধ হয় না সেইসাথে সুরাসহ এতক্ষণ বলা ঔষধগুলোর বেশিরভাগ ক্ষতিকর বিবেচনায় বন্ধ করে দেয়া হয়।
ঝিনঝিনা রোগের গুজব শুনে এর থেকে বাঁচার জন্য যারা কখনো নামও শোনেননি তারাও গোড়াচক্কর গাছ খুঁজে এনে বাড়িতে লাগাতেন। কিন্তু আশির দশকে আরেক গুজবের তোড়ে একটা গাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ঐ সময়ে বাড়ির আশেপাশে ঢোল কলমী (Ipomoea carnea) গাছ লাগানো হতো। গবাদিপশু এই গাছ খায় না বলে এই গাছ প্রাকৃতিক বেড়া হিসাবে এবং ভূমি ক্ষয়রোধক হিসাবে কাজ করে। এই গাছ সারা বছর ধরে বেগুনী রঙের ফুলে ভরে থাকে। ১৯৮৭ সালে এক গুজব ছড়ায় যে ঢোল কলমী গাছে বাসকারী এক পোকা মারাত্মক বিষাক্ত, যার স্পর্শমাত্র মানুষ মারা যায়। কোন প্রকার সত্যাসত্য যাচাই না করে লোকে নির্বিচারে ঢোল কলমী গাছ কেটে নিঃশেষ করে দিতে থাকে। এই সময়ে সরকারের তরফে গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। একজন বিজ্ঞানী ঢোল কলমী গাছের পোকা নিজের শরীরে ঘষে দেখান যে সেখানে ক্ষতিকর কিছু নেই। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। অন্তত ঢাকা মহানগরী ও তার আশপাশ এলাকা থেকে ঢোল কলমী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
বাড়ির সীমানার চারপাশে লাগানো বেড়া-লতার পাতার মধ্যশিরার মাঝ বরাবর আড়াআড়ি চাপ দিলে পুট্ করে ভেঙে গিয়ে সাদা কষবের হয়ে একটা অর্ধ-গোলক তৈরি হতো। আমরা একে বলতাম 'গরুর চোখ'। শুকনো ঘাসের লতা দিয়ে ছোট লুপ্ বানিয়ে তাতে মরিচা গাছের পাতার কষ লাগিয়ে ফুঁ দিলে ছোট ছোটবাবল্ তৈরি হয়ে উড়তো। হিজল ফলের কাঁচা বীজ গুড়িয়ে, পানিতে ভিজিয়ে সেই পানিতে পেঁপের ডগা বা পাটখড়ি দিয়ে ফুঁ দিলে প্রচুর ফেনায় বাটি উপচে পড়তো। মেন্ডা বা পিটকিলার ফল চাকা হিসাবে ব্যবহার করে কাদা দিয়ে গাড়ি বানানো হতো। পানি বল্লাশের অতি হালকা লম্বারোমশ বীজ ফুঁ দিয়ে বাতাসে ওড়ানো হতো। এসবের কিছুই আর আবশিষ্ট নেই। বাগান বা ঘরের চারপাশে রাংচিতা, জহরবাজ বা মধুজবা'র বেড়া এখন আর কেউ দেন না। মাঠের পাশে মান্দার, কাঁটাবাবলা বা ময়নাকাঁটা'র প্রাচীরও আর কেউ তোলেন না। একটা দেশে মাত্র দুই প্রজন্মের ভেতরে এমন ডজন ডজন প্রকারের গাছ 'নাই' করে দেবার ঘটনা ঘটতে পারে সেটা ভাবতেও কষ্ট হয়। এ এক নিরব গণহত্যা!
২৮ জানুয়ারি ২০২১