রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
০১৬. সাতরঙা দিন
ভাত ও রুটির বাইরে এখনকার বাংলাদেশের মানুষ প্রধান খাবার হিসাবে সম্ভবত সবচে'বেশি খান নুডলস। চায়নিজ রেস্তোরাঁর বাইরে এদেশের ঘরে ঘরে নুডলস ঢোকে আশির দশকের গোড়ার দিকে সম্ভবত'ড্রাগন নুডলস' দিয়ে। কিন্তু অমন আকারের নুডলস বানানোর ক্ষেত্রে নানা হ্যাপা থাকায় সেটা খুব নিয়মিত খাওয়া হতো না। তাছাড়া নুডলস তখনও আমাদের অভ্যস্থতায় আসেনি। নুডলসের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যায় যখন ইরফান ফুডস হলুদরঙা মুরগীর ছানা আর ডিমের ছবিওয়ালা ছোট পলিপ্যাকে 'ফুজি ইনস্ট্যান্ট নুডলস' বাজারে নিয়ে আসল। ঝটপট নুডলস বানানোর সেই শুরু যা এক পর্যায়ে এদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে দেয়। কাছাকাছি সময়ে বম্বে সুইটস 'রিংচিপস্' নামের ময়দা ভিত্তিক আর 'পটেটোক্র্যাকার্স' নামের আলুভিত্তিক ক্রিস্প বাজারে নিয়ে আসে। এর আগে দেশী কোন ব্রান্ডের পটেটো চিপস পাওয়া যেত না। সিনেমা হলে স্বচ্ছ পলিপ্যাকে অনামা পটেটো চিপস বিক্রি হতো। সিনেমাতে যখন উত্তেজনা তুঙ্গে তখন হঠাৎ টুংটুং শব্দেগোটা হল মুখরিত হয়ে যেত। বোঝা যেত সিনেমাতে 'ইন্টারভ্যাল' আসন্ন। হকারেরা হাতে ঠাণ্ডা ফান্টার বোতল আর পটেটো চিপসের প্যাকেট নিয়ে হাজির হতেন। লোহার মোটা গজাল দিয়ে ফান্টার বোতলে ঠোকার ফলে অমন টুংটুং আওয়াজ হতো। গজালের ছুঁচালো প্রান্ত বোতলের টিনের ঢাকনাতে ঠেকিয়ে চ্যাপ্টা প্রান্তে হাতের পাতা দিয়ে জোরে আঘাত করলে যে ছিদ্র হতো তাতে স্ট্র লাগিয়ে ফান্টা খাওয়া হতো। ঐ চিপস আর ফান্টা না খেলে সিনেমা দেখার মজা অর্ধেক হয়ে যেত। রিং চিপস্ পাওয়া যেত আড়াই টাকায়, পটেটো ক্র্যাকার্স পাঁচ টাকা।
"যত খাও ততো মজা রিং চিপস্
দিনভর খাওয়া যায় রিং চিপস্
আহা কি তাজা
মচমচে ভাজা
খেতে ভারি মজা"
আমাদের বন্ধু রাহাত তখন সবকিছুর মূল্য রিং চিপস দিয়ে হিসাব করতো। যেমন, পাঁচ টাকা রিকশা ভাড়া মানে দুইটা রিং চিপস্, এক টাকা বাস ভাড়া মানে আধখানা রিং চিপস্। আজ কয়েক দশক পরে তিনটা মহাদেশের চারটা দেশে ছড়ানো রাহাতের কর্ম জগতে রিং চিপসের মতো 'কমন কারেন্সি' থাকলে তার খুব সুবিধা হতো।
আমাদের মেজো কাকার ঘরোয়া ভাবে আকদ্ হবে। হবু কাকীদের বাড়িতে যাবার পরে আমাদেরকে লেবু বা রুহ্ আফজার শরবতের বদলে ফান্টার মতো কী যেন একটা জিনিস খেতে দেয়া হলো। আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী? উত্তর পেলাম, অরেঞ্জ স্কোয়াশ।
রেডিওতে আহমেদ ফুড প্রডাক্টস আর এপি'র অরেঞ্জ স্কোয়াশের বিজ্ঞাপন আগেই শুনেছিলাম, কাইজার চৌধুরীর পল্টু মামা–বিল্টু মামাকে নিয়ে লেখা গল্পগুলোতে পড়েছি ভাগনে ছোটলুকে অরেঞ্জস্কোয়াশ খাওয়ানো হয়, এবার জিনিসটা নিজেই চেখে দেখতে পেলাম। সেই ফূর্তিতে আমি আর পিন্টু দাদা কয়েক গ্লাস স্কোয়াশ খেয়ে ফেললাম। আমাদের কাণ্ড দেখে আব্বু বিরক্ত হয়ে বললেন, বোকাগুলো পানি খেয়ে পেট ভরাচ্ছে! পরে খাবার দিলে খাবে কী করে? এর বহু পরে অরেঞ্জজ্যুস আর স্কোয়াশের পার্থক্য জেনেছিলাম। আজকাল কোম্পানিগুলো স্কোয়াশ নামে কিছু বেচে না। তবে জ্যুস, ফ্লেভারড ড্রিংক্স, ফ্রুট ড্রিংক্স ইত্যাদি নামে যাকিছু বিক্রি করে সেগুলো আদতে স্কোয়াশই বটে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আমরা নিজেরাই চিনি, ফুড কালার, এডিবলসাইট্রিক অ্যাসিড, পানি মিশিয়ে অরেঞ্জস্কোয়াশ বানিয়ে ফেললাম।
ঘরে পাওয়া যায় এমন এটা সেটা মিলিয়ে আমাদের নতুন কিছু বানানোর খেলা শুরু হয়েছিল আরেকটু আগে, এবং সেসব নিয়ে নানা কেলেঙ্কারিও ঘটেছে। কী করে যেন সেইসময় দেশে বিজ্ঞান ক্লাব করার হিড়িক পড়ে যায়। তাতে আমাদের মতো উদ্ভাবনে উৎসাহী বিভিন্ন বয়সীদের উৎসাহের আগুনে ঘি পড়লো। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা সেসব ক্লাবের নাম হতো অনুসন্ধানী, বিভাসা, রেডিয়েন্টের মতো জ্ঞানান্বেষী ভাবের; অথবা ইউরেনাস, নেপচুন, ভালকান, নেবুলা, সয়ুজের মতো মহাকাশ বিষয়ক। তখন আমাদের চেয়ে বয়সে কিঞ্চিৎ বড়রা অমন একটা বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে সেখানে আমাদেরকে জড়ো করে ফেললেন। ক্লাবের নাম 'দি সায়েন্টিফিক অবজারভেশন সোসাইটি'। এতবড় নাম বলা যেত না বলে সংক্ষেপে 'এসওএস' বলা হতো। এই সংক্ষিপ্ত নামটা বললে আবার অন্য ভেজাল হতো। তখন লোকে আমাদেরকে 'এসওএস' মানে যে 'সেভ আওয়ার সোলস্' এবং এটা বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার আবেদন সেই জ্ঞান দিতে লেগে যেতেন। আমাদের খুব বিরক্ত লাগত কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না। যেখানে অন্যরা নিজেদের ক্লাবের নাম নিয়ে
"ইয়াংসিকার্স, ইয়াংসিকার্স, অনুসন্ধানী
আমরা সবাই ক্ষুদে বিজ্ঞানী"
এমন সব গান গাইত তখনও আমাদের চুপ করে সেসব শুনতে হতো। জানুয়ারি মাস আসলে সারা দেশে স্কুল-কলেজে 'জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ' নামে বিজ্ঞান মেলা হতো, যেটা এখনো হয়। সেখানে স্কুল, কলেজ আর ক্লাবগুলো নানা রকমের প্রজেক্ট বানিয়ে নিয়ে আসত। লোকজন বিকালে দলবেঁধে সেসব প্রজেক্ট দেখতে যেতেন। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় হিল্লোল একটা পুরনো ছেঁড়া বই যোগাড় করলো যেখানে ফক্সহোল রেডিও কী, সেটা কী করে বানাতে হয়, এবং সেটা কীভাবে কাজ করে তা সংক্ষেপে বলা আছে। ব্যাস! আমি, হিল্লোল, রাহাত, সুমন, মুনির ভাই, ইব্রাহিম ভাই রেডিও বানাতে লেগে গেলাম। আমরা ফক্সহোল রেডিও বানাতে সফল হইনি। তবে ট্রানজিস্টর, ওয়্যার কয়েল, হেডফোন দিয়ে ঠিকই রেডিও বানিয়ে ফেলতে সমর্থ হলাম. যেটাতে মিডিয়ামওয়েভ ৪৭৬ দশমিক এক নয় মিটারে 'রেডিও বাংলাদেশ'-এর 'খ'কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ধরা যেত। ঐ বয়সে নিজেরা একটা কিছু বানিয়ে ফেলার যে কী বিপুল আনন্দ সেটা যাদের অভিজ্ঞতায় নেই তাদের বোঝানো যাবে না।
শীত থাকতে থাকতেই হাইকোর্টের পাশে শিশু একাডেমির মাঠে 'শিশু আনন্দমেলা' নামে সপ্তাহখানেকের একটা আয়োজন করা হতো। সেখানে মাঠে মেলা, বইমেলা, মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান, মিলনায়তনে ছোটদের নাটকের পাশাপাশি মিলনায়তনের বারান্দায় বিজ্ঞানমেলা হত। আমরা মিলনায়তনের দোতলার পশ্চিম দিকের বারান্দায় আমাদের বানানো বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে বসে থাকতাম। সেখানে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের মুখে রোদপড়ত, আমাদের তাকাতে কষ্ট হত কিন্তু আয়োজকদের এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। লোকে মাঠের মেলার মজা ছেড়ে বিজ্ঞানের প্রজেক্ট দেখতে আগ্রহী ছিল না। কেউ কেউ ওখানে কী হচ্ছে এমন আগ্রহ থেকে দেখতে আসতেন। ড্রাইসেল ব্যাটারির কার্বন রড দিয়ে বানানো ছোট হিটার নিয়ে হাসনাত, কুপির ভুষা থেকে বানানো জুতার কালি নিয়ে নূরনবী, চোর ধরার যন্ত্র নিয়ে তন্ময় এবং কাঁঠালের বিচি থেকে বানানো পুষ্টিকর ড্রিংক্স নিয়ে আমার সাথে কার্ডবোর্ডের বাক্স আর আয়না দিয়ে পেরিস্কোপ বানানো অনীতাও ছিল। এর ফলে আনন্দের মেলার ভেতরে নিরানন্দের বিজ্ঞানমেলা নেহাত খারাপ লাগত না।
মেলার মুক্তমঞ্চে একেক দিন একেক গ্রুপের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেখানে আমি সাধারণত একাঙ্কিকায় অভিনয় করতাম। গান-নাচ-আবৃত্তি-অভিনয় পারি না বলে একাঙ্কিকাগুলোতে মোটামুটি সংলাপবিহীন চরিত্র বা 'নেপথ্যে কোলাহল' জাতীয় অংশে আমাকে নেয়া হত যেন সুযোগ না পাওয়ার দরুন মন খারাপ না করি। ঐ মেলায় 'দুর্বার হালিম সুচয়নী' নামের একটা হালিমের দোকান আর একটা চটপটির দোকান ছাড়া অন্য কোন খাবারের দোকান ছিল না। তবু সেখান থেকে একবার মেলায় আগুন ধরে যায়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল মিডিয়া এন্ড টেকনোলজি (নাইমট) নামের একটা প্রতিষ্ঠান টেলিভিশন-ভিসিআরের সাহায্যে নানা প্রকারের শিক্ষামূলক ভিডিও দেখাতো। মিলনায়তনে একবার টিকিট কেটে 'সুমনের নাটাই' নামে ছোটদের একটা নাটক দেখেছিলাম। মেলার মাঠের বইমেলাতে শিশু একাডেমি, মুক্তধারা, হাক্কানী পাবলিশার্স, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স আর ঝিনুক পুস্তিকার স্টল থেকে আমরা বই কিনতাম। শিশু একাডেমি আর মুক্তধারাতে খুব কম দামে ছোটদের পছন্দের বই পাওয়া যেত। হাক্কানী আর স্ট্যান্ডার্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত আর ঝিনুক গণচীন থেকে প্রকাশিত মোটা কাগজে, ঝকঝকে রঙিন ছাপা বই বিক্রি করত।
শিশু একাডেমির মূল ভবনের সামনে তখন 'দুরন্ত' ভাস্কর্যটি বসানো হয়েছে যা পরবর্তিতে দফায় দফায় কিছু মানুষের আক্রমণের শিকার হয়। একাডেমির সামনে হাইকোর্টের দক্ষিণ গেট থেকে দোয়েল চত্ত্বর পর্যন্ত রাস্তাটির দুপাশে ছিল বিশাল বিশাল প্রাচীন বৃক্ষরাজী। রাস্তাটি ছিল ছয় লেনের–সবচে' নিচু দুটো লেন গাড়ি চলার জন্য, সবচে' উঁচু দুটো লেন পায়ে হাঁটার জন্য, আর মাঝারী উচ্চতার দুটো লেন সাইকেল আর রিকশার জন্য। গোটা ঢাকার আর কোথাও, কখনো সাইকেল আর রিকশার জন্য আলাদা লেন ছিল বলে আমার জানা নেই। আমরা প্রতিদিন দুপুরে গুলিস্তান পর্যন্ত বাসে করে এসে পায়ে হেঁটে বা রিকশায় একাডেমিতে আসতাম। পথে গোলাপ শাহ্ মাজারের কাছে দোচালা চালের আকৃতির ঘর আর চ্যাপ্টা মিনার নিয়ে গোলাপ শাহ্ মসজিদ, তার পাশে লাল সিরামিকের ইটের দোতলা ভবনে মহানগর পাঠাগার পড়ত। কলেজে ওঠার পর অনেক দিন মহানগর পাঠাগারে দীর্ঘসময় ধরে বই পড়েছি। পাঠাগারটি এখনো আছে কিনা জানি না তবে তার ভবনটি আর নেই। গোলাপ শাহ্ মসজিদের সেই দৃষ্টিনন্দন ভবনটিও অনেক দিন হয় ভেঙে ফেলা হয়েছে। পীর ইয়ামেনী মাজার আর তার কাছের পুরনো মসজিদটি হাতের বাঁয়ে ফেলে আবদুল গণি রোডে ঢোকার মুখের রাস্তার চকে, যেটি এখন জিরো পয়েন্ট বা নূর হোসেন চত্ত্বর নামে পরিচিত, ভাস্কর আনোয়ার জাহান বর্শা হাতে খেলোয়াড়ের এক বিশাল ভাস্কর্য বানিয়েছিলেন। ভাস্কর্যটি সেখানে থাকতে পারেনি। কারা যেন রাতের আঁধারে গোটা ভাস্কর্যটি তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কোথায়–তার হদিস আর পাওয়া যায়নি।
আবদুল গণি রোডে ঢুকলে হঠাৎ করেই যেন গুলিস্তান এলাকার হট্টগোলটা বন্ধ হয়ে যেত। আরেকটু এগোলে হাতের বাঁয়ে নতুন বানানো ওসমানী মেমোরিয়াল, যেখানে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে সাত রাত ধরে সার্কের তখনকার সাত সদস্য দেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। গণ্যমান্য মানুষের কাতারে পড়ি না বলে ঐ অনুষ্ঠানগুলো আমাদেরকে বাংলাদেশ টেলিভিশেনে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। ঐ সময় টেলিভিশনে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন একটা করে ভারতীয় বাংলা অথবা পাকিস্তানী উর্দু চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছিল। এর পাশাপাশি নেপালের দুটো চলচ্চিত্রও দেখিয়েছিল–'বাদালিনদো আকাশ' আর 'কুমারী'। বাদালিনদো আকাশে শিব শ্রেষ্ঠা আর সুষমা শাহী অভিনয় করেছিলেন যারা দুজনেই পরে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এই সময়ে প্রায় মাসাবধি ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জের সিনেমাহলগুলোতে ভারতীয় আর পাকিস্তানী চলচ্চিত্র চলেছে। দেশের অন্য শহরগুলোতেও এমনটি চলেছে কিনা জানি না।
সার্কের সুবাদে তখন ভারত আর পাকিস্তানের কিছু বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে এসে অনুষ্ঠান করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ভারতের গজল শিল্পী পঙ্কজউধাস, বেহালাশিল্পী অমর হালদিপুর, গিটারশিল্পী ক্ল্যারেন্স পিটারসন, আর তবলাশিল্পী রাশিদ মুস্তাফাকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে মাতিয়ে দিলেন। যদিও পরে জানা গেল গোটা অনুষ্ঠানে শিল্পীরা কেবল ঠোঁট মিলিয়েছেন, অভিনয় করেছেন, কোন গান গাননি বা বাজনা বাজাননি। তবুও ঐ অনুষ্ঠানের পরে বাসায় বাসায় ক্যাসেটপ্লেয়ারে বাজতে শুরু করলো–
"চান্দি য্যায়সা রাঙ হ্যায়তেরা
সোনে য্যায়সি বা'ল
এক তুহি ধনবান হ্যায়গোরি
বাকি সাব কাঙ্গাল"
পাকিস্তানের গজল শিল্পী মেহেদী হাসান এসে "মুঝে তুমনযর" বা "দুনিয়া কিসি কে প্যায়ার ম্যাঁয় জান্নাতসে কম নেহি"র মতো তাঁর জনপ্রিয় গজলের পাশাপাশি কষ্ট উচ্চারিত বাংলায় "তুমি যে আমার ভালোবাসা" গেয়েছিলেন। গোলাম ফরিদ সাবরি আর মকবুল আহমেদ সাবরি যাঁরা 'সাবরি ব্রাদার্স' নামে পরিচিত ছিলেন তাঁদের কাওয়ালী বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। কয়েকদিন পর্যন্ত মানুষ "বিতেযায়ে বিতেযায়ে সাওয়ান বিতেযায়ে" গুনগুনিয়ে গেয়েছেন।
সার্কের মূল অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ না পেলেও ওসমানী মেমোরিয়ালে আয়োজিত সার্ক নারীদের হস্তশিল্প মেলা দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেই মেলাতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম ভীড় কাকে বলে! সেখানে শ্রীলঙ্কার প্যাভিলিয়নে একজন নারী এমন বিস্ময়কর কায়দায় শাড়ি পরে এসেছিলেন যে বাংলাদেশী নারী দর্শকেরা মোটামুটি হাতে ছুঁয়ে দেখে বুঝতে চাইছিলেন কায়দাটা কী! তখন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস সবে বাংলাদেশে ফ্লাইট চালু করেছে। টেলিভিশনে তার বিজ্ঞাপনে এয়ার হোস্টেসদের পরনের 'সারং'দেখে আমাদের মেয়েরা কিঞ্চিত দ্বিধান্বিত এটা পরবে নাকি পরবে না। গণহারে মেয়েদের সেলাইকরা অথবা সেলাইবিহীন ধুতি পরতে তখনো বছরদুয়েক বাকি। মেয়েদের পোশাকের রঙে তখন ম্যাজেন্টা-শ্যাওলা বা ম্যাজেন্টা-নীল কম্বিনেশনের জয় জয়কার; হলুদ-কালো কম্বিনেশনের পোশাক আরও দেড়-দুই বছর পরে আসবে। আমাদের চোখে অত কিছু পড়ে না। আমরা কেবল মুগ্ধ বিস্ময়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের বিজ্ঞাপন দেখি আর তার জিঙ্গেলে ঠোঁট মেলাই—
"Your home is there across the world
As you smile, as you care"
সেবার মধুমিতা সিনেমা হলে চার্লটন হেস্টন, হায়া হারারি, স্টিফেন বয়েডের অভিনীত 'বেন-হার' সিনেমাটি এসেছিল। আমি, স্বপন, ইমরুল স্কুল ফাঁকি দিয়ে সকাল থেকে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আশি টাকা করে টিকিট কেটে বিকেলে সাড়ে তিন ঘন্টার সিনেমাটি দেখেছিলাম। আমাদের কাছে ফেরার বাস ভাড়ার চেয়ে খুব বেশি টাকাছিল না বলে সেদিন দুপুরে ভাত না খেয়ে রামকৃষ্ণ মিশন রোডের 'ক্যাফে ম্যাডোনা'তে চা-সিঙ্গারা খেয়েছিলাম। হেস্টন ১৯৮২ সালে একবার জনসেবামূলক কাজে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন ১১ই জুলাই রাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলার আগে হেস্টন বিটিভিতে গোলাম মোস্তফার কাছে এক দীর্ঘ সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। আমি ঐ প্রথম ইংলিশে দেয়া কোন সাক্ষাতকার পুরোটা ধৈর্য্য ধরে দেখি। বিটিভিতে একবার'মুভি অব দ্য উইক'-এ বয়েডের 'জাম্বো' সিনেমাটি দেখিয়েছিল। হারারি চিত্রপরিচালক জ্যাক ক্লেটনকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে থিতু হয়েছিলেন, এবং ২০২১-এর ফেব্রুয়ারির তিন তারিখে পৃথিবীকে বিদায় জানান। আমাদের তিনজনের মধ্যে স্বপন এখন হারারি'র শেষ ঠিকানাতে নিজের ঠিকানা গড়েছে, আর টেলিভিশনের সংবাদ প্রযোজক ইমরুল আরও কয়েক বছর আগে এমন এক দেশে স্থায়ী ঠিকানা গড়েছে যেখানে জীবিত কেউ যেতে পারে না।
হকি বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় খেলা নয়। এদেশে হকিস্টিক খেলার বদলে অন্য কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় যখন 'দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকি'র আসর বসে তখন গোটা দৃশ্যপট পালটে যায়। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চীন আর জাপানের সাথে ড্র করার পর তখনকার অন্যতম বিশ্বসেরা দল পাকিস্তানের কাছে মাত্র ১-০ গোলে হারে। পাকিস্তানে তখন হাসান সরদার, হানিফ খানের মতো কীংবদন্তী খেলোয়াড়রা খেলেন। বাংলাদেশ তার শেষ ম্যাচে ইরানকে ৩-১ গোলে হারায়, আবাহনীর জুম্মন লুসাই হ্যাটট্রিক করেন। জুম্মনের বড় ভাই মোহামেডানের ফুটবলার রামা লুসাইকে সবাই আগে থেকেই চিনতেন। এই টুর্নামেন্টের সুবাদে পাড়ায় পাড়ায় লাঠি গোছের কিছু একটা জোগাড় করে হকি খেলা শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে হকির প্রশিক্ষণ নেয়াও শুরু করেন। কিন্তুএ ই উৎসাহটা আর ধরে রাখা যায়নি। সেবার ঢাকায় মেয়েদের এশীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশীপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে ভারতের অনুপমা অভয়ঙ্কর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। চ্যাম্পিয়নের পদবী আগে কখনো শুনিনি বলে এখনো মনে আছে। তার কয়েক মাস পরে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে সুইজারল্যান্ডের ভেভে স্পোর্টস ক্লাব ফিনল্যান্ডের তুরুন পালুসেরাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এই প্রথমদেশের কোন প্রতিযোগিতায় ইউরোপের দুই দেশের ক্লাবের মধ্যে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। ফাইনালে আমরা ঐ দুই দেশের নিচু সারির অপরিচিত দুটো দলের মধ্যকার খেলায় কাকে সমর্থন করবো সেটা বুঝে উঠতে পারিনি।
বছরের ঠিক মাঝখানে অথবা শেষে যখন স্কুল বন্ধ থাকত তখন আমরা নাটক করার মানসে ছোট বড় একাঙ্কিকা অভিনয়ের আয়োজন করতাম। কারো বাসা থেকে একটা চৌকি আর কয়েকজনের বাসা থেকে তাদের মায়ের সুতী শাড়ি এনে স্টেজ বানানো হতো। তখন ঢাকেশ্বরী, লক্ষ্মী নারায়ণ বা চিত্তরঞ্জন কটন মিলে লাল পাড়ের নীল আর সবুজ রঙের জমিনের মোটা সুতী শাড়ি বানানো হতো। বাজারে সেগুলো 'মিলের শাড়ি' নামে পরিচিত ছিল। মিলের শাড়ি দিয়ে ব্যাকস্ক্রীন, উইংস বানালে একেবারে সত্যিকারের নাটকের মঞ্চ বলে মনে হতো। নাটকে আমাদের কারো চরিত্রের সাথে মিল রেখে উপযুক্ত পোশাক ছিল না, আমাদের কারো মুখে মেকআপ ছিল না–কেবল কেউ পাট বা কচুরিপানা দিয়ে দাড়ি-গোঁফ বানাতো আর কেউ ট্যালকম পাউডার মেখে চুল সাদা করতো, আমাদের নাটকে আলোক প্রক্ষেপনবা নেপথ্য সঙ্গীত বলে কিছু ছিল না। সেসব একাঙ্কিকার দর্শক কেবল আমাদের বয়সীরাই থাকত, তবু আমাদের উৎসাহের অভাব ছিল না। অবশ্য আমরাও চাইতাম বড়রা আমাদের বিষয়গুলোতে যেন নাক না গলান। কয়েক দিন ধরে রিহার্সাল দিয়ে আমরা নূরুল মোমেনের 'ভাই ভাই সবাই', আসকার ইবনে শাইখের 'সুখী রাজপুত্র' আর রাজিয়া মাহবুবের 'ভূত ভুতুম' মঞ্চস্থ করেছিলাম। বাজারে কিছু নাটকের বই পাওয়া যেত যেগুলো মূলত নারী চরিত্র বর্জিত এবং আদর্শের জয়, অনৈতিকতার পরাজয় ধরনের। কিন্তু সেই নাটকগুলো অনেক অঙ্কের হতো বলে আমরা করার সাহস করতাম না। আমাদের কারো নাটকের পার্ট মুখস্থ থাকতো না বলে শাড়ি দিয়ে বানানো উইংসের আড়াল থেকে একজন প্রম্পট করত। সেসব শুনে 'ভাই ভাই সবাই'-এর 'আপনভোলা'র সংলাপ বলতাম–
"–বাজনা বাজে আট প্রহর
বাজি পোড়ায় গেটের 'পর
সেই বাড়িতে হচ্ছে বিয়ে
এগিয়ে খোঁজ করি গিয়ে"
অথবা
"–অ্যাঁ! আবু সাঈদ আবদুন নূর
কিনতো বেচত পাটালি গুড়
ঊনিশশো সেই কত সালে
গণ্ডগোলের ফাঁকতালে
অন্যের জমি বিঘে আড়াই
সঙ্গে নিয়ে চাচাতো ভাই
অন্য লোকও সদলবল
করলো গিয়ে জোর দখল
তেজগাঁয়েরই কাছে অতি
নয় কি সে আপনার ভগ্নিপতি?
–ওরকম সব দুশমন বালাই
নেই কোন মোর বোনের জামাই"!
নাটক যে কেবল আমরা ছোটরাই করতাম তা নয়। অনেক পাড়াতে বড়রাও বছরে একটা নাটক মঞ্চস্থ করতেন। এর জন্য বাইরে থেকে গুণী পরিচালক-নির্দেশক নিয়ে আসা হতো। তাঁর তত্ত্বাবধানে কয়েক সপ্তাহজুড়ে রিহার্সাল চলত। একটা লম্বা, মোটা, রুলটানা বালাম খাতায় নাটকের স্ক্রীপ্ট হাতে লেখা থাকত। চরিত্ররা তাঁদের নিজ নিজ অংশের সংলাপ হাতে লিখে কপি করে নিতেন। মঞ্চায়নের দুদিন আগে থেকে ডেকোরেটর থেকে কাঠের পাটাতন, বাঁশ, কাপড়, চেয়ার, টেবিল, মাইক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এনে মঞ্চ, দর্শকদের আসন, গ্রিনরুম ইত্যাদি বানানো হতো। মঞ্চায়নের দিন আলোক প্রক্ষেপণ, নেপথ্য সঙ্গীত, রূপসজ্জার জন্য পেশাদারদেরকে আনা হতো। এই নাটক টিকিটছাড়া দেখানো হতো।
পাড়ার স্বল্প শিক্ষিত ও দিনমজুর শ্রেণীর বড়রা আরেক রকমের নাটক করতেন যেগুলোতে প্রচুর গান এবং তলোয়ার যুদ্ধ থাকতো। সেখানে যাত্রার কায়দায় শুরুতে সবাই মিলে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে নাটক শুরু করা হতো, অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীদেরকে দিয়ে নারী চরিত্রে অভিনয় করানো হতো এবং চরিত্রদের অনেকেই উচ্চস্বরে সংলাপ বলতেন। লোকে মহিলাসমিতি মঞ্চ, গাইড হাউজ মিলনায়তন, বা স্থানীয় মিলনায়তনে পেশাদার নাট্যগোষ্ঠীগুলোর মঞ্চনাটক যেমন দেখতে যেতেন তেমন নিজেদের পাড়ার বা পাশের পাড়ার নাটকগুলোও দেখতে যেতেন। বিটিভিতে নিয়মিত ভালো নাটক দেখানো, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে দূরদর্শনের শক্তিশালী রিলে সেন্টার বসানোর ফলে দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া, ফুনাই বা আকাই ব্রান্ডের ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ারের দাম কমে যাবার ফলে পাড়ায় পাড়ায় নিজেরা নাটক করার উদ্যোগ কমতে থাকে। আমাদের পাড়ায় শেষের কয়েক বার এর সাথে যুক্ত হয়েছিল মঞ্চের বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়া, ব্লেডটেনে পর্দা কেটে ফেলা, নাটক চলাকালে মঞ্চে আধলা ইট, ডাবের খোসা ছুঁড়ে মারার মতো ঘটনা। ফলে সৌখিন নাট্যকর্মীরা কিছুটা ভয়ে, কিছুটা উৎসাহ হারিয়ে আর কিছুটা পরিবারের চাপে পড়ে অমন নাটক মঞ্চায়ন থেকে সরে আসতে থাকেন, এবং এক সময় তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
সেবার দেশের ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসা সামরিক শাসক ৭ই চৈত্র বৃহস্পতিবার সারা দেশে গণভোট নামের এক নির্মম তামাশার আয়োজন করে নিজের ক্ষমতা দখলকে একপ্রকার বৈধতা দেয়। ২৪শে মে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে উড়িরচরসহ উপকূলীয় অঞ্চলে কমপক্ষে এগারো হাজার জন প্রাণ হারান। আর ১৫ই অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন ধারাবাহিক নাটক 'শুকতারা' দেখানো হচ্ছিল তখন ঐ নাটকে অভিনয়করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্র মনন অধিকারীর অভিনয় দেখার জন্য হলের টিভিরুম কানায় কানায় ভরে যায়। এমন সময় জরাজীর্ণ টিভি রুমের ছাদধ্বসে পড়লে শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও অতিথিসহ মোট ৩৯ জন নিহত আর তিনশতাধিক আহত হন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলে রোদের সুবাসের সাথে কখনো কখনো কিছু গ্লানির দুর্গন্ধও ভেসে আসে। কখনো কখনো বাতাসের রঙও বেদনায় ফিকে হয়ে যায়।