রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
আমাদের এখনকার জীবনে খুব বড় একটা উৎসব হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। এই উৎসবটা এখনকার চেহারা পেয়েছে গত ত্রিশ বছরে। বৈশ্যকূল যখন এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসায় দেখতে পেল তখন থেকে একটু একটু করে এর জৌলুস বাড়তে থাকল। এতে নতুন নতুন জিনিস যোগ হতে থাকল, এর ব্যপ্তি বাড়তে থাকল। বিষয়টা অন্য গুরুত্ব পেতে থাকল যখন কয়েকটা দল এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। হয়তো এখানেও কিছু বৈশ্যবুদ্ধি কাজ করেছে। একসময় বিষয়টা যখন জঘন্য নৃশংসতায় পরিণত হল তখন ব্যক্তি পর্যায়ে একটা জেদ চেপে গেল, কিন্তু তাতেও বিরুদ্ধতা থেমে থাকেনি। তবে বিরোধীরাও এখন এর গুরুত্ব আর গভীরতা অস্বীকার করতে পারে না। যেমন এই করোনাক্রান্তিকালে মানুষ যখন গৃহবন্দী তখন বিরোধীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উৎসবের বিরুদ্ধে সারা দিন বিষ উগড়ে দিন শেষে রঙিনশাড়ি/পাঞ্জাবী পরে বাসার অন্য সবার সাথে মিলে হাস্যোজ্জ্বল ছবি পোস্ট করে শুভ নববর্ষ বলেছে। এদের পরাজয়টা এখানেই।
এমন জৌলুসপূর্ণ নববর্ষের রেওয়াজ চালু হবার আগে এই উৎসবের চেহারা আমাদের কাছে অন্য রকমের ছিল। উৎসবের শুরুটা হতো আগের দিন নিরামিষ রান্না থেকে। সকালে সবজি বিক্রেতা নরেশ কাকা নিরামিষ রান্নার জন্য হরেক রকমের বিচিত্র সব সবজি নিয়ে আসতেন, সেকথা আগে একদিন বলেছি। আম্মু সাত রকমের তেতো বা ২১/২৩/২৭ রকমের সবজি মিলিয়ে নিরামিষ রান্না করতেন। কত রকমের পদ জোগাড় হলো সেটা আমাদের জন্য একটা আগ্রহের বিষয় ছিল। আপা আবার সেটার তালিকা করে রাখতেন, যদি পরের বছর রেকর্ড ভাঙা যায়। চৈত্র সংক্রান্তির কয়েক দিন আগে থেকে দোকানদারেরা বাকি আদায়ের জন্য নামতেন। কেউ কেউ ফজরের পর পর দেনাদারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন। সবার এক কথা, হালখাতার আগে আগের সব পাওনা চুকিয়ে দিতে হবে, নয়তো অমঙ্গল হবে। সংক্রান্তির দিন শেষ রাউন্ডের তাগাদা চলতো। এই দিন দুপুরের পর বেচাকেনা বন্ধ করে দিয়ে দোকানগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হতো।
সংক্রান্তির বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো হতো। অবশ্য ঘুড়ি ওড়ানোর মৌসুম শুরু হয়ে যেতো ফাল্গুনের বাতাস শুরু হবার সাথে সাথে। চাপলাশ, লিপ্পু, বগ্গা, পেটকাটা …. নানা নামের নানা রকমের ঘুড়ি। কান্নি, কামানি, উপর গিট্টু, নিচ গিট্টু …. তার বিভিন্ন অংশের নানা নাম। ভোকাট্টা, গেন্না দেয়া, ঢিল দেয়া, ডিপ্পো দেয়া, ঝান্টা, গুরগুরুপ্পা, সূতা নেয়ন্তি ঘুড্ডি দেয়ন্তি…. খেলা সংক্রান্ত নানা টার্ম। বাসার কাছে কুমিল্লা টেক্সটাইলের প্রবাসী শ্রমিকরা সিমেন্টের কাগজের ব্যাগের মোটা খাকি কাগজ দিয়ে বিশাল আকৃতির ঘুড়ি বানাতেন। সেই ঘুড়ি এতো বিশাল যে আমার তখনকার সাইজের দুটো বাচ্চাকে নিয়ে উড়ে যেতে পারবে। সেই ঘুড়িতে কায়দা করে দুটো চওড়া রাবার ব্যান্ড বাঁধা হতো, তাতে ভোঁ ভোঁ শব্দ হতো বলে আমরা এটাকে বলতাম ভোঁ ঘুড়ি। সূতো নয়, পাটের মোটা সূতলী দিয়ে ভোঁ ঘুড়ি উড়িয়ে বাঁশের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হতো। রাতে ঘুড়িতে ছোট 'বায়েজিদ' হ্যারিকেন বেঁধেও ভোঁ ঘুড়ি ওড়ানো হতো।
আমাদের বয়সীদের কাছে ঘুড়ি ওড়ানোর একটা থ্রিলিং অংশ ছিল সূতা মাঞ্জা দেয়া। শিল পাটায় কাচ গুঁড়ো করে পিষে, সাগু-বার্লি-শিমুলের ছাল-কাফিলার কষ সাথে রঙ মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে মাঞ্জা বানানো হতো। মাঞ্জা দিতে কম পক্ষে চারজন লাগতো। প্রথম জন নাটাই থেকে সূতা ছাড়তো, দ্বিতীয়জন এক হাতে সূতা মাঞ্জার হাড়িতে চেপে ধরে রেখে আরেক হাতে একটা কিছু দিয়ে 'চিপ্পি' ধরে সূতা থেকে বাড়তি মাঞ্জা ঝরিয়ে ফেলতো, তৃতীয় জন মাঞ্জা দেয়া সূতাতে কাচের গুঁড়োর চিপ্পি ধরতো, চতুর্থ জন আরেকটা নাটাইয়ে কাচ-মাঞ্জা দেয়া সূতা প্যাঁচিয়ে রাখতো। মাঞ্জা দেয়া শেষ হলে কোন বারান্দার বা নির্মিয়মান বাসার দুটো কলামে অথবা দুটো গাছে সূতা প্যাঁচিয়ে শুকানো হতো। ঠিকঠাক মাঞ্জা দেয়া সূতা বিপদজনক রকমের ধারালো জিনিস — আঙুল, হাত কাটা কোন ব্যাপার না।
ঘুড়ি ওড়ানো হতো ছাদে, খালি প্লটে। তখনো পাড়াটা রেল লাইনের কাছে পর্যন্ত পৌঁছে যায়নি বলে পেছন দিকে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা ছিল। একবার পাশের পাড়ার সাথে সেখানে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হয়েছিল। উভয় পক্ষ 'বাংলাদেশ ব্যান্ড পার্টি' থেকে সাদা ইউনিফর্মপরা বাদক দল নিয়ে এসেছিল যারা ট্রাম্পেট, ক্ল্যারিনেট, ব্যাগপাইপ, সিম্বাল, রেটেল, সাইড ড্রাম আর বিগ ড্রামে ক্রমাগত জনপ্রিয় সব গান বাজিয়েছিল। আমরা খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম কোন মারামারি যেন না লাগে। উভয় পক্ষের মুরুব্বীরা সচেতন থাকায় সেবার মারামারি বাঁধতে পারেনি। তারা ফলাফল 'ড্র' ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য মারামারি লাগলে আমাদের পাড়া মার খেত। একে তো আমাদের পাড়ার লোকসংখ্যা কম, কোন কালে কোন নির্বাচনে আমাদের পাড়ার কেউ জেতেননি, তাছাড়া কতিপয় কুখ্যাত গুণ্ডার বাস ছিল ঐ পাড়ায়। এমন অবস্থা আরেকবার হয়েছিল ঐ পাড়ার সাথে সংক্রান্তির দিনে কাবাডি খেলায়। সেবার অবশ্য ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় মেটেনি। মারামারিতে আমাদের পাড়ার কয়েকজনের মাথা ফেটেছে, হাত ভেঙেছে।
পয়লা বৈশাখের দিন মালিকের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী দোকানগুলোতে মিলাদ পড়ানো হতো বা পূজা করা হতো। এক মামার সূতার ব্যবসা ছিল, তিনি বাসার সব পিচ্চিপাচ্চাদেরকে গাড়িভর্তি করে নিজের সেলস সেন্টারে নিয়ে যেতেন। সেখানে শত শত দোকানে মিলাদ পড়া হতো। এক দোকান থেকে আরেক দোকানে মিলাদের মিষ্টি বিলানো হতো। ছোটরা পেটভরে মিষ্টি খেয়ে আর মিষ্টির পোঁটলা হাতে করে বাড়ি ফিরতো। আগের দিন নিরামিষ খাওয়া হতো বলে এই দিন বাসায় মাছের ঝোল করা হতো — তবে ইলিশ মাছ নয়। তখনো বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়নি। কাঁচা আম আর সজনে ডাঁটা দিয়ে ডাল রান্না হতো। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম কবে আমাদেরকে লক্ষ্মীনারায়ণের আখড়ার বৈশাখী মেলায় নিয়ে যাওয়া হবে। এদিকে নানা রকম বাঁশি, ঢোল আর গাড়ির শব্দে প্রদর্শনে আমাদের কেবলই মনে হতো এই বুঝি মেলার সব জিনিস বিক্রি শেষ হয়ে গেল! বড়রা আশ্বাস দিতেন, আরে মেলা এক মাস ধরে চলবে! এখনই এত উতলা হচ্ছিস কেন?\
আখড়ার মেলাটা আহা মরি কিছু ছিল না, তবে সেখানে যা কিছু বেচা হতো সেগুলোর প্রায় সবই কিনতে ইচ্ছে করতো। দুই রকমের বাঁশের বাঁশি ছিল – একটার প্রান্তে কাঠের নজেল মতো বানানো ছিল সেটা বাজানো সহজ তাই সেটা ছোটদের, আরেকটা আড়বাঁশি সেটা বাজানো কঠিন তাই সেটা বড়দের। ঢোলও দুই রকমের – একটা কাঠি দিয়ে বাজাতে হয়, আরেকটা ডুগডুগি– সূতোর মাথায় পুঁতি আটকানো। গাড়ি ছিল অনেক রকমের – একটা টেনে চালাতে হয় তাতে দুটো কাঠি ঢোলের ওপর পড়ে বাজায়। আরেকটা কাঠের, সেটা চালালে উপরে হেলিকপ্টারের রোটরের মতো একটা চরকি ঘোরে। একটা টিনের প্রজাপতি, ঠেলে চালালে পাখা দুটো ওঠে-নামে। একটা প্লাস্টিকের গাড়ি তার উপরে একটা মেমের মাথা বসানো। নানা রঙের টিনের ছোট গাড়ি – আমরা বলতাম ট্যাক্সি। একটা লঞ্চ ছিল – স্টিম এঞ্জিনের। সেটার পানির ট্যাঙ্কে পানি আর তেলের ট্যাঙ্কে তেল ভরে আগুন জ্বালালে ফট্ফট্ শব্দ করে গামলা বা পুকুরের পানিতে চলত। পুতুল ছিল মাটির, কাঠের, প্লাস্টিকের। মুখোমুখি দুটো হাঁস মাঝখানে রাখা একটা মাছকে ঠোকরাতো। মুখোমুখি দুটো বক্সার ঘুষোঘুষি করতো। কাঠির সাথে সূতো দিয়ে লাগানো একটা মাটির সিলিন্ডারে ঘোরালে বোঁ বোঁ আওয়াজ করতো। একটা টিনের মাছের সাথে হাতল লাগানো, ঘোরালে ব্যাঙের মতো কট্কট করতো। মাটির, প্লাস্টিকের, এলুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিল ছিল। কাঠের হাতল লাগানো ছোট ছোট কাটারি-দা ছিল। খুব ছোট বাঁশের ঝুড়ি ছিল। ছোট থেকে বড় আকারের তিনটা কাঠের বলাকা ছিল যেগুলো দেয়ালে লাগানো হতো। বাঁশের পাতলা লেয়ার দিয়ে বানানো বাংলো বাড়ি ছিল যেটাকে কী কারণে যেন 'সিলেট হাউজ' বলা হতো। ব্লো-পাইপ দিয়ে গরম কাচে ফুঁ দিয়ে বানানো কাচের পাখিদের সেট ছিল। একটা বড় কাচের টিউবের ভেতরে রঙিন পানিতে জরি আর একটা ছোট টিউব দিয়ে বানানো রকেট ছিল। একটা প্লাস্টিকের ইঁদুরের ভেতরে ইলাস্টিকে সূতো প্যাঁচানো থাকতো, সূতো টানলে ইঁদুর চলতো। কাঠেরবন্দুক ছিল যাতে লম্বা পাইপের নল, কর্ক ছুঁড়ে মারা যেত। কাস্ট স্টিলের ধুসর রঙের ভারি পিস্তল ছিল যেটা বার বার ফায়ার করা যেত। কালো রঙের টিনের বানানো ছোট হালকা পিস্তল ছিল যেটার আবার বারুদ আলাদা করে কিনতে হতো। দুই রকমের সাপ ছিল – কাগজের, চক্রাবক্রা, কুঁচকানো যেতো; আরেকটা রাবারের সবুজ রঙের, একেবারে সবুজ বোড়া সাপের মতো দেখতে। কাগজের চরকি ছিল হরেক রকমের, হরেক রঙের। বড় বেলুন ছিল যার সাথে সরু লম্বা আরেকটা বেলুন লেজের মতো থাকতো; পানিভর্তি বেলুনের বলের সাথে রাবারের দড়ি লাগানো থাকতো – এর নাম হচ্ছে 'লারেলাপ্পা'। একটা প্লাস্টিকের কুকুর ছিল যেটার ভেতরে প্লাস্টিকের বেলো ছিল, বেলোর সাথে লাগানো পাইপে ফুঁ দিলে কুকুরের সামনের অংশ আর পেছনের অংশ আলাদা হয়ে হাঁটতো–একেবারে সুকুমারের ভজুর কুকুর আর রামার কুকুর কাণ্ড! স্বচ্ছ প্লাস্টিকের একটা ছোট ডুম ছিল যার ভেতরে ছিল একটা মেরি-গো-রাউন্ড; উপরে অক্ষটা ঘোরালে ভেতরের ঘোড়াগুলো ঘুরতো। কাঠের আর প্লাস্টিকের পশুপাখির সেট ছিল যার আরেক নাম 'টারজান সেট'–সময়টা রবিবার সন্ধ্যায় রন এলির টারজান দেখার। প্লাস্টিকের ঘড়ি, আংটি আর রঙিন চশমা ছিল – যেগুলো না পরতে পারলে বন্ধুমহলে বা প্রতিবেশিমহলে সম্মান থাকতো না, যদিও সেই চশমা পড়লে চারপাশের কিছু স্পষ্ট দেখা যেত না। স্কাইল্যাব নামের একটা বস্তু ছিল যেটাতে সূতো পেঁচিয়ে হঠাৎ টান দিলে একটা রোটর শূন্যে উড়ে যেত। ১৯৭৯'র ১১ই জুলাই আমেরিকার একটা স্পেস স্টেশন পৃথিবীতে ধ্বসে পড়েছিল। সেটা নিয়ে কয়েকদিন সারা দুনিয়ায় ব্যাপক উত্তেজনা ছিল। খেলনাটার নাম সেই স্পেস স্টেশনের নামে রাখা হয়েছিল। এমন আরও অসংখ্য খেলনা ছিল যেগুলো স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে।
মেলায় চিনি আর গুড়ের বাতাসা, মুড়ি, খই, মুড়কি, লাল আর সাদা মুরুলি, চিনির সিরায় ডোবানো নারকেলের ফালি, দশ রকমের কটকটি – যেটাকে আমরা বলতাম গাট্টা-মিঠাই, চিনির প্রলেপ দেয়া ছানার ছোট বালুসাই, হাওয়াই মিঠাই, চিনির হাতি-ঘোড়া, সত্যিকারের আমের ডালে ঝোলানো চিনির রঙিন আম, ঝালমুড়ি, ঘটিগরম চানাচুর, ডালের কচুরি, মুড়ি-চিড়া-চালভাজার মোয়া, তিলের নাড়ু, ছোট-বড় কদমা, তক্তা বিস্কুট, তেলে ভাজা, ঘুঘনি, ছোলাভুনা, চটপটি, ফুচকা, কমদামি রসগোল্লা, সেদ্ধ ডিম, কয়েক ডজন রকমের আচার, হজমি, আমসত্ত্ব, আইসক্রীম, ললিপপ– যাকে টেলি স্যাভালাসের টিভি সিরিজের সাথে মিলিয়ে 'কোজাক' বলা হতো, টিকটিকির ডিম আর বল গাম পাওয়া যেত। সেসবের খুব কমই আমাদের কিনে দেয়া হতো 'অস্বাস্থ্যকর' বলে। আরও বহু মজার খাবারকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে যাদের নাম আজ আর স্মরণে নেই। মেলার খেলনা বা খাবারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল মেলায় কে কী দেখেছে আর কে কী করেছে সেসব গল্প করা। মেলায় চার খোপের কাঠের নাগরদোলা, কাঠের ঘোড়ার মেরি-গো-রাউন্ড যেটাকে 'ছুটির ঘন্টা' সিনেমার গান থেকে দেখে 'আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী' বলতাম সেটা, পুতুল নাচ আর বায়োস্কোপ আসতো। পুতুল নাচে যারা গান গাইতেন তারা কেমন যেন গলা সরু করে গাইতেন –
বাঘ আইলো রে মনা, বাঘ আইলো রে
যাইস না রে মনা, যাইস না রে
তখন অনেক বাসাতে টেলিভিশন, বাজারে ভিসিআর চলে আসলেও বায়োস্কোপ দেখাতে আমাদের ব্যাপক উৎসাহ ছিল। বায়োস্কোপ হচ্ছে একটা বড় বাক্সে পাঁচ ছয়টা ঢাকা দেয়া দেখার ফুটো যাতে পুরু আতস কাচ লাগানো। একজন মানুষ সেই বাক্সের হাতল ঘোরালে ভেতরে ছবি পালটে যেত। লোকটা কী করে যেন উঁকি দিয়ে না দেখেই ভেতরে কী দেখাচ্ছে সেটা বলে দিতে পারতেন। তিনি গানের সুরে সুরে সেগুলো বলে যেতেন। একদম শেষে দেশের রাষ্ট্রপতির ছবি (গেঞ্জি গায়ে, কালো চশমাপরা বিখ্যাত ছবি) আর একটা ঝলমলে ফুলের ছবি দেখাতো। বায়োস্কোপওয়ালা বলতেন –
এই দেখো জিয়া মিঞা বইসা আছে, বইসা আছে
মৈরম ফুল সোনার মতন জ্বলতে আছে, জ্বলতে আছে
বাস্তবে মৈরম ফুল বা মরিয়ম ফুল মোটেও সোনার মতো জ্বলজ্বলে জিনিস নয়। কেমন পাটের সূতলীর মতো জড়ানো-পাকানো জিনিস। হাজী সাহেবেরা হজ্ব থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসতেন। এই ফুলের ভেজানো পানি আসন্নপ্রসবাদের খাওয়ানো হতো। এখন বায়োস্কোপ আর নেই, মরিয়ম ফুলের কথাও আর শুনতে পাই না।
এখন নববর্ষের যে নাগরিক রূপ, পয়সা খরচের যে জৌলুস, রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতি্র তোড়জোর তাতে আগের হালখাতা আর বৈশাখী মেলার সরল আনন্দের খুব কম কিছুই অবশিষ্ট আছে। তবু সবাই যে যথাসাধ্য আনন্দ করার চেষ্টা করেন, উৎসবে মাতেন সেটা দেখতেও ভালো লাগে। এবছরে লকডাউনে গৃহবন্দী সব মানুষ যখন সামাজিক মাধ্যমে রঙিন জামাপরা হাস্যোজ্জ্বল ছবি, নিজেদের হাতে হাত লাগিয়ে বানানো স্বল্প আয়োজনের ছবি, পরিবার পরিজন আর বন্ধুবান্ধবদের সাথে ভিডিও চ্যাটের ছবি দিল তখন এসব দেখে মনে হলো যারা এবার বৈশাখের উৎসব পণ্ড হয়ে গেছে ভেবে উল্লাস করেছিল তারা এই উৎসবের স্পিরিটটাই বুঝতে পারেনি। প্রাণের উৎসবকে কোন কিছু দিয়ে চেপে রাখা যায় না। শুভর বিজয় হবেই।