রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
পাতায় পাতায় ভরা রঙিন স্বপন
যে আমলে মোবাইল ফোন নামক বস্তুটি সায়েন্স ফিকশন লেখকদের চিন্তায়ও বিশেষ আসতো না, টেলিভিশনের একটিমাত্র চ্যানেলে দিনে ছয় ঘন্টার চেয়ে কম সময় ধরে সাদা-কালো অনুষ্ঠান চলত, একটি ভিএইচএস ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডারের যা মূল্য ছিল তা দিয়ে কয়েক ডেসিমেল জমি কেনা যেত — তখন লোকে বিনোদনের জন্য ঘরে-বাইরে আড্ডা দিতেন, আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বাসায় বেড়াতে যেতেন, গল্পের বই পড়তেন এবং অতি অবশ্য প্রতিদিন খবরের কাগজ ও নিয়মিত ম্যাগাজিন পড়তেন। তখন ব্রডশিটে ছাপা দৈনিক পত্রিকাগুলো হতো আট পৃষ্ঠার, বিশেষ দিনে বারো বড়জোর ষোল পৃষ্ঠার। পত্রিকাগুলোতে তখনও রঙ লাগেনি, তখনো আলাদা সাপ্লিমেন্ট বের হওয়া শুরু হয়নি। আট পৃষ্ঠার পত্রিকাতে সপ্তাহে একদিন সাহিত্য নিয়ে, একদিন নারীদের জন্য, একদিন ছোটদের জন্য, একদিন সিনেমা আর একদিন খেলার জন্য একটি করে পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকত। শুরুর দিকে আমাদের পাড়ায় গ্রাহক কম ছিল বলে পত্রিকার হকার আসতে চাইতেন না। ফলে অন্য সব পাড়ায় বিলি করা শেষে আমাদের পাড়ায় পত্রিকা আসত দুপুরের পরে। পাড়ার লোকসংখ্যা বাড়ার পরে অবস্থার উন্নতি হয়, তখন হকার বজলু ভাই আর তাঁর শ্যালক সালাহউদ্দিন মিলে দৈনিক পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের গাঁঠরি নিয়ে সকাল আটটার আগেই হাজির হয়ে যেতেন। ছুটির দিনে আক্ষরিক অর্থে খবরের কাগজের সাথে আমাদের ঘুম ভাঙতো।
তখন আমাদের বাসায় 'ইত্তেফাক' রাখা হতো। সেখানে রবিবাসরীয় ইত্তেফাকে বড়দের সাহিত্য ছাপা হতো, শুক্রবারে সিনেমা নিয়ে ছাপা হতো 'রূপবাণী', মফস্বল সংবাদের পাতার নাম ছিল 'শহর-বন্দর-গ্রাম', নারীদের সাপ্তাহিক পাতার নাম ছিল 'মহিলা অঙ্গন', ছোটদের পাতার নাম 'কচিকাঁচার আসর'। আমরা সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম কচিকাঁচার আসরের জন্য। আমাদের অপেক্ষা অসহনীয় হয়ে যেত যখন সেখানে কোন গল্প কয়েক সপ্তাহ ধরে কয়েক পর্বে প্রকাশিত হতো। নিয়ামত হোসেনের ফেলু মামা সিরিজের গল্প 'গরু নিয়ে গড়াগড়ি', 'ছদকার ছাগল' বা 'জন্মদিনের ছবি' অথবা নাম ভুলে গেছি এমন কারো লেখা 'মেহেদি গাছের ভূত' এভাবে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। কচি কাঁচার আসরে প্রকাশিত 'কাটা হাত', 'সংকলন সম্পাদক নাড়ুদা', 'ডিসেম্বরের বৈমানিক', 'তালটিয়ার সুতপাদি'র মতো অগণিত গল্প আজো নিউরণের আনাচে কানাচে পড়ে আছে যেগুলোর বেশির ভাগ বাস্তবের দুনিয়া থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। এক বাসায় যেহেতু একটির বেশি দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো না, তাই একরামদের বাসায় রাখা 'দৈনিক বাংলা'র 'সাত ভাই চম্পা' অথবা শাকিলদের বাসায় রাখা 'সংবাদ'-এর 'খেলাঘর'-এর পাতা কখনো বদলা-বদলি করে পড়া হতো।
সম্ভবত ১৯৭৭ সালের একদিন আব্বু যখন প্রথম মাসিক 'শিশু' পত্রিকা বাসায় নিয়ে আসলেন সেদিন থেকে আমার জগতে নতুন রঙ লাগলো। এরপর থেকে 'শিশু' নিয়মিত পড়ে গেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠা পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছোট বোনকে 'শিশু'র গ্রাহক বানিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে বাসায় 'শিশু' চলে আসত বটে কিন্তু মানের অধোগতির কারণে আর পড়া হতো না। আশির দশকে 'শিশু'র বিশেষ সংখ্যাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে যেমন, হাসান আজিজুল হকের 'লাল ঘোড়া আমি', মাহমুদুল হকের 'কুশল ও চিক্কোর মারণ কাবুক', আল কামাল আবদুল ওহাবের 'গহন বনের পথে', সৈয়দ ইকবালের 'কুশল আর মৃত্যুবুড়ো', আলাউদ্দিন আল আজাদের 'জলহস্তি', সরদার জয়েন উদ্দিনের 'আমরা তোমাদের ভুলবো না', নাজমুল আলমের 'রক্তমণি', মাহমুদ আল-জামানের 'সমুদ্র ও টুকুর গল্প', আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের 'কড়ে আঙুলের ছাপ', নির্মলেন্দু গুণের 'কালো মেঘের ভেলা', হালিমা খাতুনের 'বাচ্চা হাতির কাণ্ড', বুলবন ওসমানের 'অমিতের কথা', রাবেয়া খাতুনের 'সুমন ও মিঠুর গল্প'র মতো উপন্যাসগুলো বাংলাদেশের শিশু সাহিত্যের আকারটি তৈরি করে দিয়েছে। 'শিশু'র এক একটি সংখ্যা এতবার করে পড়তাম যে অনেক গল্প-কবিতা মুখস্থ হয়ে যেত। 'শিশু' প্রথমে বের হতো নিউজপ্রিন্টে, পরে সাদা অফসেট কাগজে। সেখানে গাজী শামসুর রহমান লিখতেন 'আইনের কথা', যতীন সরকার 'ব্যাকরণের ভয় অকারণ', আলী ইমাম পিকু-নীলডুংরি নিয়ে যত রহস্যময় গল্প, কাইজার চৌধুরী ছোটলু-বিল্টু মামা-পল্টু মামাকে নিয়ে টান টান উত্তেজনার সব গল্প, আবদার রশীদ মজার সব কবিতা, একেবারে ছোটরা 'কচি হাতের কলম থেকে' কলামে নিজেদের ইচ্ছেমতো লেখা লিখত। গল্প বা কবিতার সাথে হাশেম খান, রফিকুন নবীদের মতো বড় শিল্পীদের আঁকা মানানসই অলঙ্করণ ছিল 'শিশু'র অন্যতম আকর্ষণ।
'শিশু'র সাথে আব্বু একদিন চলচিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত পত্রিকা 'নবারুণ'ও নিয়ে আসলেন। 'নবারুণ' সাদা কাগজে ঝকঝকে ছাপানো পত্রিকা, কিন্তু তাতে 'শিশু'র মতো প্রাণের ছোঁয়া নেই, অলঙ্করণ প্রায় নেই। আমাদের কাছে বিশেষ ভালো লাগেনি। এজন্য খুব বেশি পড়াও হয়নি। আমাদের প্রতিবেশি তানিমদের বাসায় বই আর পত্রিকার বিশাল সংগ্রহ ছিল। একদিন সেখানে কয়েক খণ্ডে বাঁধানো অনেকগুলো 'টাপুর টুপুর' পেয়ে গেলাম। ষাটের দশকে প্রকাশিত 'টাপুর টুপুর' দেখে, পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি কাগজের মান, কি ছাপা-বাঁধাই, কি ছবি! আর তার ভেতরে যে লেখা – একেবারে অকল্পনীয়! চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ছোটদের একটা পত্রিকা সেখানে দেশের প্রথম সারির হেন কবি-সাহিত্যিক নেই লেখেননি। অলঙ্করণ করতেন প্রখ্যাত শিল্পীরা। সেখানে প্রকাশিত অনেক গল্প, কবিতা পরে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে, বিশেষত বাংলা দ্রুত পঠন 'চয়নিকা'তে ঠাঁই পেয়েছিল। 'টাপুর টুপুরের' একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এর সুস্পষ্ট প্রগতিশীল অবস্থান। এর ফর্ম বা কনটেন্টে যে আধুনিকতা ছিল সেটাও উল্লেখ করার মতো। সেখানে প্রকাশিত 'সুশোভন পদ্মলোচন মধুরবচন সিংহ' নামের রগচটা প্যাঁচা আর 'খাস্তগীর বরকতুল্লাহ্ বিন ওবায়দুল্লাহ্ হক্কে' নামের হোঁৎকা খরগোশের গল্প হোক অথবা দক্ষিণ রোডেশিয়ার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামের ছবিতে দেখে প্রথম 'Zimbabwe' শব্দটা শেখা হোক অমন মানের ছোটদের বাংলা পত্রিকা আর দেখিনি।
খবরের কাগজের মধ্যে 'ইত্তেফাকের' ছাপা সবচে' পরিষ্কার লাগতো, 'সংবাদের' ছাপা তার তুলনায় একটু ঝাপসা লাগতো। সরকারি পত্রিকা 'দৈনিক বাংলার' ছাপা তিনটার মধ্যে সবচে' খারাপ লাগতো, কারণ এর ফন্টগুলো ছিল ভাঙা ভাঙা। 'দৈনিক বাংলা' থেকে প্রকাশিত রফিকুল হক দাদুভাই সম্পাদিত 'কিশোর বাংলা'র ছাপার অবস্থা 'দৈনিক বাংলার' মতো ছিল। তারওপর এটা বের হতো ট্যাবলয়েড সাইজে, নিউজপ্রিন্টে, ফরম্যাট আর রঙের অবস্থা করুণ। তবে 'কিশোর বাংলা'য় প্রকাশিত বেশিরভাগ লেখার মান ছিল অতি উচ্চ। ওখানে যারা নিয়মিত লিখতেন অচিরেই তাঁরা বড় লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। এই কারণে আমাদের বাসার উলটো দিকের শাহ্আলম ভাইকে তোয়াজ করে তাদের বাসায় নেয়া 'কিশোর বাংলা'য় ভাগ বসাতাম।
ইসলামী ফাউণ্ডেশন তাদের চার বিভাগীয় কার্যালয় থেকে চারটি ছোটদের পত্রিকা বের করতো — ঢাকা থেকে 'নতুন চাঁদ', চট্টগ্রাম থেকে 'সাম্পান', খুলনা থেকে 'সপ্তডিঙ্গা' আর রাজশাহী থেকে 'ময়ুরপঙ্খী'। এই পত্রিকাগুলো হকারদের কাছে বা সংবাদপত্র বিক্রয়কেন্দ্রে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ফাউন্ডেশনের আয়োজিত কোন অনুষ্ঠান বা প্রতিযোগিতায় গেলে এসব পত্রিকা উপহার হিসাবে পাওয়া যেত। এদের মধ্যে ময়ুরপঙ্খীর'র একটা বিশেষ সংখ্যা ছিল 'আমার চোখে আব্বা আম্মা'। বড় আকারে বাঁধাইকরা বইয়ের মতো করে বের করা হয়েছিল। পেপারব্যাক বইয়ের আকারে 'কিশোর জগত' বের হতো যেটা আরও পরে বের হওয়া 'কিশোর পত্রিকা' ও 'কিশোর তারকালোক'-এর সাথে তুলনীয় ছিল। দামের জন্য এই পত্রিকাটা কম পড়তে পেয়েছি। তাছাড়া এর কনটেন্ট কোন কারণে আমাকে আকর্ষণ করেনি। আমাদের ক্লাসের মিনারা একদিন বড় আকারের মোটাসোটা বইয়ের মতো দেখতে 'ধান শালিকের দেশ' নিয়ে স্কুলে আসল। সেখানে 'রবিনসন ক্রুশো'র 'ঈষৎ সংক্ষেপিত' অনুবাদ ছিল। এর পর থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম বাংলা একাডেমি থেকে কবে 'ধান শালিকের দেশ' বের হবে। সেবা প্রকাশনীর আগে বাংলা অনুবাদে ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিকগুলো 'ধান শালিকের দেশে' পড়তে পেয়েছি। ফলে বাংলা অনুবাদে জুল ভার্ন, ড্যানিয়েল ডিফো, এডওয়ার্ড ল্যুদভিগ, রবার্ট লুই স্টিভেনশন, আলেকজান্ডার দ্যুমা এমনসব দুনিয়া সেরা লেখকদের লেখা প্রথম পড়ার সুযোগ হয়। এর বাইরে সেখানে মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার কবিরের মতো বাংলাদেশী লেখকদের লেখা উপন্যাস প্রকশিত হতো। ফলে একটা 'ধান শালিকের দেশ' কিনলে অনেকগুলো বইয়ের সমান কনটেন্ট পাওয়া যেত।
ভারতীয় পত্রিকা 'আনন্দমেলা' আর 'শুকতারা'র কোন কোন সংখ্যা কালেভদ্রে স্কুলের কারো কাছ থেকে পড়তে পেতাম। উচ্চ মূল্য আর দুষ্প্রাপ্যতার জন্য এই পত্রিকাগুলো মানে ভালো হলেও আমরা কিনতে পারতাম না। বাংলাদেশী পত্রিকাগুলোর চেয়ে এই পত্রিকাগুলোর খুব স্পষ্ট পার্থক্যটা ছিল 'কমিক'-এ। বস্তুত দেশী-বিদেশী সব কমিকের জন্য এই পত্রিকাগুলো আমাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল।
ছোটদের পত্রিকা হোক আর দৈনিকের ছোটদের পাতা হোক একসময় সেগুলোতে প্রতিষ্ঠিত লেখকরা নির্দ্বিধায় তরুণ লেখক বা জীবনে প্রথমবার লিখছে এমন সব শিশুদের সাথে সমান তালে লিখে গেছেন। পুরোনো 'টাপুর-টুপুর', 'কিশোর বাংলা' বা 'শিশু' হাতে নিলে একথার সত্যতা বোঝা যায়। এরপর একটা সময়ে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বড় অংশ ছোটদের জন্য লেখা কমাতে কমাতে প্রায় নাই করে দিলেন। তখন থেকে ছোটদের পত্রিকাগুলো বা দৈনিক পত্রিকায় ছোটদের পাতাগুলো কনটেন্টের ক্ষেত্রে মরতে শুরু করল। ছোটদের পত্রিকার ফর্ম ও কনটেন্টের ক্ষেত্রে জরুরী বিষয় হচ্ছে প্রতি বৎসর যোগ হওয়া নতুন প্রজন্মের চাহিদাকে মাথায় রেখে সে অনুযায়ী নিয়মিত পরিবর্তন করা। প্রতি বৎসর বিয়োগ হওয়া প্রজন্মের চাহিদা ধরে রেখে পত্রিকা বের করলে এক প্রজন্ম তার ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করবে আর পরবর্তী প্রজন্ম তার ব্যাপারে অজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
বড়দের পত্রিকার মধ্যে বেশিরভাগ বাসায় 'বিচিত্রা', 'সচিত্র সন্ধানী' বা 'রোববার'-এর সাথে অতি অবশ্য নারীদের পত্রিকা 'বেগম' রাখা হতো। নূরজাহান বেগমের সম্পাদনায় লয়াল স্ট্রীটের সওগাত প্রেস থেকে বের হওয়া 'বেগম' ছাপা হতো অন্য ম্যাগাজিনগুলোর তুলনায় আকারে বড় কাগজে নিউজপ্রিন্টের প্রচ্ছদে। 'বেগমে'র কোন কোন লেখা আমরা পড়তে পারবো আম্মু সেটা কলম দিয়ে দাগিয়ে দিতেন। আমরা সুবোধ বালক-বালিকার মতো সেই লক্ষণরেখা পার হতাম না। আপা অবশ্য নিজেকে সবসময় প্রাপ্তবয়স্ক বলে দাবি করতেন বলে 'বেগমে'র সব লেখাই পড়তেন। 'বেগম' হাতে পেলে আমরা প্রথমেই পড়তাম কৌতুক আর ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন। রফিকুল্লাহ্ এমরান এমু আর মোহাম্মদ নজরুল ঝিনুক নামে দুজন ব্যক্তি প্রতি সংখ্যায় একাধিক ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিতেন। তাঁদের সেই বিজ্ঞাপন এখনকার সময়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সাথে তুলনীয়। 'বেগমে' বেগম সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, মকবুলা মনজুর, জুবাইদা গুলশান আরা, ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ, রিজিয়া রহমানদের মতো সাহিত্যিকদের লেখা ছাপা হতো। মকবুলা মনজুরের উপন্যাস 'কানা গলির বস্তি', বেগম জাহান আরার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের গল্প নিয়ে লেখা 'অয়নাংশ', মীনা আজিজের হজ্জ্বের সময়কার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা 'সউদি আরবকে যেমন দেখেছি' বা রওশন আরা হাফিজ কাক্কুর উগান্ডার প্রবাস জীবন নিয়ে লেখা 'স্মৃতির সোনালী পৃষ্ঠায়' ধারাবাহিকভাবে বের হতো। এইসব ধারাবাহিক নিয়ে আম্মুর সাথে খালা-মামাদের আলোচনা হতো – কী হতে যাচ্ছে, কী হতে পারে! অনেকটা এখনকার সময়ের টেলিভিশনের সিরিয়ালগুলোর মতো ব্যাপার। ঈদসংখ্যা 'বেগমে' যেসব লেখিকাদের লেখা ছাপা হতো তাদের সবার পাসপোর্ট সাইজের ছবি শুরুতে কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপানো হতো। আমি আর কোন পত্রিকায় এভাবে 'কৃতি ছাত্র' স্টাইলে লেখক/লেখিকাদের ছবি ছাপা হতে দেখিনি। 'বেগমে'র শেষ প্রচ্ছদে অবধারিতভাবে 'রিগার্ডে'র ত্রিফলা তেল, গোলাপ জল বা কেওড়া জলের বিজ্ঞাপন থাকতো। 'বেগমে' পড়ে রাদেন আদজেং কার্তিনী, হালিদা এদিব হানুম, গারট্রুড এডারলে বা রোবেন আর্চারদের মতো কৃতি নারীদের জীবন ও কর্ম বিষয়ে প্রথম জানতে পেরেছি। নারীদের পত্রিকা মানেই যে পোশাক, সাজগোজ আর রূপচর্চ্চা নিয়ে কথন নয় 'বেগম' বহু যুগ আগে সেটা করে দেখিয়েছিল।
ঠিক মনে নেই, সম্ভবত বুধবার দিন আমরা 'বিচিত্রা' হাতে পেতাম। সম্পাদকীয়র পরে চিঠিপত্র কলাম, ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে শেষের চিত্র সমালোচনা বা হৃদয়ঘটিত জটিলতা নিয়ে কলাম 'কুরুক্ষেত্র' পর্যন্ত সব কিছু পড়তাম। 'বিচিত্রা'র মূল আকর্ষণ ছিল এর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। বিষয়ের বৈচিত্র্যে, রিপোর্টিং-এর সাহসিকতায়, লেখার মানে 'বিচিত্রা' বাংলাদেশে প্রকাশিত নিয়মিত সাপ্তাহিকদের মধ্যে অনন্য — পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে অসংখ্য বিষয়ের ট্রেন্ডসেটার। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মাহমুদুল হক, শওকত আলী, রাহাত খান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, দিলারা হাশেম, রিজিয়া রহমান, মঈনুল আহসান সাবেরদের মতো সাহিত্যিকদের লেখা নিয়ে 'বিচিত্রা'র ঈদসংখ্যাগুলো ছিল সাহিত্যের ভাণ্ডার। সেখানে কয়েক পাতাজুড়ে রনবীর বিশেষ কার্টুন ছাপা হতো, কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে কবিতা, একদম শেষে দেশের একজন বরণ্যে ক্রীড়াবিদ আর একজন জনপ্রিয় চিত্রতারকাকে নিয়ে আত্মজীবনীমূলক সচিত্র বিশাল ফিচার। 'বিচিত্রা'র বাইরে 'রোববার' বা 'নিপুণে'র ঈদসংখ্যা বেশ সমৃদ্ধ ছিল। কোন কোন বাসায় নিউজপ্রিন্টের ব্রডশীটে ছাপা সিনে ম্যাগাজিন 'চিত্রালী' বা 'পূর্বাণী' রাখা হতো। 'পূর্বাণী'র ঈদসংখ্যাও বেশ সমৃদ্ধ ছিল। মাঝে মাঝে বড় মামা 'চিত্রালী'র কোন সংখ্যা নিয়ে আসলে আমরা সেখানে দেখতাম আগামী কয়েক মাসে কোন কোন চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে যাচ্ছে। আর পড়তাম গসিপ কলাম 'হাওয়া থেকে পাওয়া'। তখন দেশে চলমান সামরিক শাসন বিরোধী প্রকাশনা হিসাবে 'যায় যায় দিন' তার সাহসিকতার জন্য জনপ্রিয় ছিল। আমাদের বাসায় নিয়মিত রাখা হতো না বলে গাজী ভাইয়ের বাসায় গিয়ে 'যায় যায় দিন' পড়তাম। গাজী ভাই যখন এক মনে তাঁর কোচিং-এর ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে যেতেন আমি তখন তাঁর সংগ্রহের 'যায় যায় দিন' থেকে নিষিদ্ধ উত্তেজনা নিয়ে 'খ্যাতির শিখরে প্রেমের গভীরে' বা 'দিনের পর দিন' পড়তাম। কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত একই ঘরাণার 'বিচিন্তা' ও আরও কিছু সাপ্তাহিক, সিনে সাপ্তাহিক 'চিত্রবাংলা', খেলার সাপ্তাহিক 'ক্রীড়াজগত'ও পড়া হয়েছে, তবে অনিয়মিতভাবে।
ভারতীয় পত্রিকার মধ্যে কোন কোন বাসায় 'দেশ' রাখা হতো। দাম বেশি বলে সেটা খুব বেশি বাসায় রাখা হতো না। কালেভদ্রে কেউ 'আনন্দমেলা' বা 'আনন্দলোক' কিনতেন। 'সানন্দা' এসেছে আরও অনেক পরে। অবশ্য শারদীয়া সংখ্যা 'দেশ', 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'আনন্দমেলা' বা 'আনন্দলোক' অনেক বাসাতেই রাখা হতো উপন্যাসের লোভে। ইংলিশ পত্রিকার মধ্যে কোন কোন বাসায় দৈনিক 'Times' অথবা 'Bangladesh Observer' রাখা হতো। তবে ইংলিশ পত্রিকা পড়ার লোক কম ছিল। অনেক বাসায় মাঝে মাঝে 'Redear's Digest', 'Time', 'Newsweek' বা 'The Economist' কিনে আনা হতো। আমরা রিডার্স ডাইজেস্টের 'Laughter the best medicine', 'All at day's work', বা 'Drama in real life'-এর মতো অল্প কিছু লেখা ছাড়া বাকি কিছু পড়তাম না।
একটি বিষয় এখনকার শিশুকিশোররা হয়তো ভাবতেও পারবে না সেটি হচ্ছে আমাদের ছোটবেলায় আমাদের নিজেদের পত্রিকা ছিল। তখন প্রায় সব পাড়াতে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, পয়লা বৈশাখ আর ষোলই ডিসেম্বরে হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের হতো। উদ্যোক্তা-প্রকাশকদের দল নিজেরাই ছোট গল্প, কবিতা, ছড়া, কৌতুক লিখত, ছবি আর কার্টুন আঁকত। যাদের হাতের লেখা সুন্দর ছিল তাদের দিয়ে পত্রিকা লেখানো হতো, যারা ভালো ছবি আঁকতে পারত তারা সেখানে অলঙ্করণ করতো। নির্দিষ্ট দিনে পাড়ার মোড়ের এমন দেয়ালে পত্রিকাটি সাঁটিয়ে দেয়া হতো যেন পথচলতি সবার চোখে পড়ে। পত্রিকাটি বৃষ্টি-শিশির-ধুলায় নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকতো – দেশে তখনো ল্যামিনেশন প্রযুক্তি আসেনি। তবে মাঝমধ্যে 'শত্রুপক্ষ' এসে পত্রিকা ছিঁড়ে বা কালি লেপ্টে দিয়ে যেত। দেয়াল পত্রিকার বাইরে স্টেনসিল পেপারে হাতে লিখে বা টাইপ করে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে কপি করে পত্রিকা বের করা হতো। স্টেনসিল পেপার কী জিনিস আর সাইক্লোস্টাইল মেশিনই বা কী জিনিস সেটা এখনকার মানুষকে বোঝাতে গেলে উইকিপিডিয়াতে নিবন্ধ লিখতে হবে। ছোট পোস্টকার্ডের একপাশে আটটা বা বারোটা ছড়া ছাপিয়ে ছড়াকার্ড বের করা হতো। আমাদের নিজেদের দেয়াল পত্রিকার নাম ছিল 'দুর্বার', সাইক্লোস্টাইল পত্রিকার নাম 'শিশির' আর ছড়াকার্ডের নাম 'ফুলকি'।
পাড়ায় আমাদের চেয়ে বড়রা 'শিশির' বের করেছিলেন যার প্রথম সংখ্যাটা ছিল ঈদসংখ্যা। মিল্টন মামা স্টেনসিল কেটে লিখতেন, অলঙ্করণ করতেন, কার্টুন আঁকতেন। সেখানে বড়দের কবিতার সাথে আমাদের মতো গুঁড়াগাড়াদের ছড়া ছাপা হতো। 'শিশির' অনিয়মিতভাবে কয়েক বছরে বেশ কয়েক সংখ্যা বের হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। শাহআলম ভাই মোটামুটি একক প্রচেষ্টায় ছড়াকার্ড 'ফুলকি' বের করতেন। আমরা সেখানে ছড়া ছাপানোর জন্য ধরণা দিতাম অথবা লোকজনের কাছে জোরজার করে বেচার চেষ্টা করতাম। আমরা নিজেরাই যখন দেয়ালিকা 'দুর্বার' প্রকাশ করি দেশ তখন আবারও সামরিক শাসনের কবলে পড়েছে। আমরা কিন্তু সেখানে সাহসভরে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী ছড়া-কবিতা প্রকাশ করেছি। অন্য পাড়ার দেয়ালিকা বা সাইক্লোস্টাইল পত্রিকাতেও তখন এমন নিখাঁদ বিদ্রোহের সাহসী উচ্চারণ দেখেছি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বোধহয় কেবল আমাদের মেরুদণ্ড নরম হয়ে যায়নি পরের প্রজন্মগুলোর মেরুদণ্ডও নরম হয়ে গেছে।
দেয়াল পত্রিকা বের করে যখন আর আমাদের মন ভরছিল না তখন একদিন আমার ছোট ভাই, আমাদের প্রতিবেশী তানিম আর আমার মনে হলো আমরা নিজেরাই ছাপানো পত্রিকা বের করতে পারি। 'বিচিত্রা প্রিন্টার্স' আর 'বসুন্ধরা প্রিন্টার্সে' খোঁজখবর নিয়ে আমরা ব্যয়ের হিসাব করে ফেললাম। টাকাপয়সা যে কী করে জোগাড় করেছিলাম সেই মহাভারত আর বর্ণনা করলাম না। পত্রিকা বের হবে শুনে দেখা গেল আশেপাশের সবাই লেখক, কিন্তু কেউ ছাপানোর খরচে ভাগীদার হতে রাজী না। প্রাপ্ত লেখা বাছাই করতে গিয়ে আমাদের গলদঘর্ম হতে হলো। এরপর এক শুভ দিনে সীসার টাইপ বসানো ট্রেডল মেশিনে ছাপিয়ে আমাদের নিজেদের পত্রিকা 'পিলসুজ' প্রকাশিত হয়ে গেল। নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে বের করা সেই পত্রিকায় কোন বিজ্ঞাপন ছিল না। সেই পত্রিকা আগ্রহ নিয়ে কেউ পয়সা দিয়ে কেনেওনি। আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পত্রিকা বিলি করেছিলাম। অল্প কয়েকজন দুই টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা করে দিয়েছিলেন — তাতে আমাদের খরচের এক-আধলাও ওঠেনি। আমরা তখনও 'লিটিল ম্যাগ' শব্দটা জানতাম না। সেটা না জেনেই আমরা লিটিল ম্যাগ বের করে ফেলেছিলাম। খুব স্বাভাবিকভাবে অচিরেই অর্থ আর উদ্যোগের অভাবে 'পিলসুজ' প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
এখন লোকে পত্রিকা পড়েন মোবাইলে, ট্যাবলেটে, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটারে। সরাসরি পত্রিকার সাইটে ঢুকে যত জন খবর পড়েন তারচেয়ে ঢেড় বেশি জন সামাজিক মাধ্যমে অন্যের দেয়া লিঙ্ক ধরে খবর পড়তে আসেন। এখন প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার বাইরে কোটি কোটি অনলাইন খবরের সাইট, ব্লগ, ম্যাগাজিন। এত কিছুর ভীড়ে পাঠক তাঁর প্রয়োজনের জিনিসটি খুঁজে পেতে হিমশিম খেয়ে যান। এখন একদল কিশোর বা তরুণ আগের চেয়ে অনেক কম আয়াসে 'দুর্বার', 'শিশির', 'ফুলকি' বা 'পিলসুজে'র মতো পত্রিকা বা ই-জাইন বের করে ফেলতে পারে। কিন্তু তারা কি অমনটা করছে? না। নতুন পত্রিকার কাগজের ঘ্রাণ যার নাকে লাগেনি, পত্রিকা প্রকাশ করার আনন্দের রঙ যে দেখেনি সে কী করে অমন উদ্যোগ নেবার কথা ভাবতে পারবে!
- ১১ ডিসেম্বর ২০২০