‘হ্যামলেট, আ ভিলেইন অফ জিনিয়াস’
রাজা তৃতীয় রিচার্ড, ইয়াগো, ম্যাকবেথ শেক্সপিয়ারের তৈরি খল চরিত্রগুলোর মধ্যে আলোচিত চরিত্র হলেও তাঁর শ্রেষ্ঠ খল চরিত্র নিঃসন্দেহে হ্যামলেট।
নাম ভূমিকায় হ্যামলেট পুরো নাটকে এমন একটা চরিত্র উপস্থাপন করে তাঁর দর্শক, পাঠককে ঘোরের মধ্যে রাখে যেনো সেই নাটকের মূল চরিত্র বা নায়ক। এই চরিত্রটি বহু বছর ধরে তার দর্শক, পাঠক, সমালোচকের চোখে ঠুলি পরিয়ে নায়কের আড়ালে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করে গেছে আর এখানেই হ্যামলেট ছক কেটে বেরিয়ে নতুন মাত্রার ভিলেন হিসেবে সার্থক।
হ্যামলেটের অপরাধের অংশ গুলো বিবেচনা করলে এর অনেকটাই পরিস্কার হয়।
প্রথমেই আসে রাজার প্রধান উপদেষ্টা এবং লাইয়ারটাস, অফেলিয়ার বাবা পলিনিয়াসকে হত্যা। মায়ের সাথে কথোপকথনের সময় পর্দার আড়ালে ক্লডিয়াস ভেবে ছুরি চালিয়ে পলনিয়াসকে হত্যা করে হ্যামলেট। অনিচ্ছাকৃত হলেও এই হত্যার জন্য হ্যামলেটকে মনে হয়নি অনুশোচনায় ভুগছে কোনো। পর্দার আড়াল থেকে শব্দ শুনেই পলনিয়াসকে গোপন অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে হ্যামলেট। পলনিয়াস অপরাধী হতেই পারে কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয়নি তাকে, অথচ পূর্ববর্তী দৃশ্যে ক্লডিয়ার ব্যক্তিগত কক্ষে ধ্যানরত অবস্থায় হ্যামলেটকে দেখতে পাওয়া যায় একজন গোপন অনুপ্রবেশকারি হিসেবে। যে অন্যায় সে নিজে করেছে সে অন্যায়ে আরেকজনকে শাস্তি দিয়ে তার দ্বৈত চরিত্রকে স্পষ্ট করেছে হ্যামলেট। দ্বৈত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন হ্যামলেট নাটকের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং এই দোষেই খুব সূক্ষ্মভাবে খল চরিত্রে পরিণত করেছে মূল চরিত্র হ্যামলেটকে। মৃত্যুদণ্ড দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি হ্যামলেট, কোন রকম শেষকৃত্য না করে প্রিয়জনদের কাছ থেকে আড়াল করে পলনিয়াসের মৃতদেহকে টেনে নিয়ে খোলা জায়গায় ফেলে রেখে বন্য পশুদের খাদ্যে পরিণত করে। নিষ্ঠুরতার মাত্রায় হ্যামলেট পরিণত হয় খল চরিত্রে।
পলনিয়াসের প্রতি হ্যামলেটের বিদ্বেষ বরাবরই লক্ষ্য করা যায়। জীবদ্দশায়ও পলনিয়াস শিকার হয় হ্যামলেটের নিষ্ঠুরতার। তাঁকে নাম ধরে ডাকা, তার বয়স নিয়ে তির্যক মন্তব্য করা, বিভিন্ন সময়ে তার সাথে সরাসরি কথা বলতে অস্বীকার করা, সবার সামনে হেয় করাসহ সব ধরনের অপমান করে হ্যামলেট। প্রতি উত্তর করার অবস্থানে পলনিয়াস ছিল না, সেই সুযোগের সদব্যবহার করে সে যা তার খল চরিত্রের আরেক নমুনা। 'পাঞ্চিং ডাউন' হ্যামলেট চরিত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, সামাজিক অবস্থানকে ব্যবহার করে অন্যদের হেয় করাই তার লক্ষ্য এবং এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় রোজেনক্রাঞ্চ, গিল্ডেন্সটার্ন এবং অসরিকও।
হ্যামলেটের খল চরিত্রকে ভালো ভাবে ব্যাখ্যা করে অফেলিয়ার মৃত্যু। মানসিক পীড়ন সৃষ্টি করে সে ক্রমাগত শুদ্ধ অশুদ্ধের এক দহন তৈরি করে অফেলিয়ার মনে। প্রচণ্ড রকম নারী বিদ্বেষের কারণে অফেলিয়ার নারী জন্মকে দোষারোপ করে হ্যামলেটের তির্যক মন্তব্য বিপর্যস্ত করে অফেলিয়াকে। সবার সামনে হ্যামলেটের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় অফেলিয়া। অশ্লীল শ্লেষ বাক্যে পর্যদুস্ত অফেলিয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। আবশ্যিক ভাবে অফেলিয়ার মৃত্যুর দায় পড়ে খল চরিত্রের হ্যামলেটের উপর।
রোজেনক্রাঞ্চ এবং গিল্ডেনস্টার্নের হত্যা আরেকটি দিক উম্মোচন করে যেখানে হ্যামলেট চরিত্রের নেতিবাচক দিক উন্মোচিত হয়। রাজার আদেশ পালন করাই ছিল রোজেনক্রাঞ্চ এবং গিল্ডেনস্টার্নের অপরাধ। তাঁদের বন্ধু কি সমস্যায় আছে তা খুঁজে বের করা এবং তাকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া ছিল রাজার আদেশ। কিন্তু যে চিঠি তারা বহন করছিল তা যে হ্যামলেটকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল সে সম্পর্কে অবগত ছিল না রোজেনক্রাঞ্চ এবং গিল্ডেনস্টার্ন। তাদের কোন রকম দোষ স্বীকারের সুযোগ না দিয়ে তাদের হত্যার নির্দেশ দেয় হ্যামলেট। কোন রকম দ্বিতীয় চিন্তার সুযোগ না দিয়ে তার নিজস্ব মতকে বরাবর প্রাধান্য দেয়ার মধ্য দিয়ে খল চরিত্রের চেহারাটা বারবার প্রকাশিত হয় হ্যামলেটের।
লাইয়ারতিস হ্যামলেটের মত তাঁর পিতাকে হারিয়েছে, হারিয়েছে বোনকে। বোনের সমাধিস্থলে কয়েক ছত্র পড়াকে উদ্দেশ্য করে হ্যামলেটের কটাক্ষ তার আত্মপ্রেমের স্পষ্ট উদাহরণ। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সলোলকি বা স্বগতোক্তি জুড়ে কেবল মাত্র নিজের সম্পর্কে বলা, হ্যামলেট মাত্র আট লাইনের স্তবকে বোনের প্রতি নিবেদন নিতান্তই অবহেলা মনে করে। অফেলিয়ার প্রতি ভাইয়ের চেয়ে চল্লিশ হাজার গুণ বেশি তার ভালোবাসা বলে দাবি করে হ্যামলেট, যদিও এর প্রমাণ পুরো নাটকে খুব কম বিদ্যমান। অতিরঞ্জিত এই প্রতিবাদ ছাড়া এরপর সে আর কখনই সরাসরি বা ইঙ্গিতে অফেলিয়ার নাম উচ্চারণ করেনি। অফেলিয়ার মৃত্যু শোকে অনুশোচনা করেছে একাকী।
অস্থির মানসিক অবস্থায় বেশির ভাগ অন্যায় করেছে বলে হ্যামলেটের সমর্থনে উপস্থাপন করা হয়েছে যুক্তি। পলনিয়াসের মৃত্যুও একই মানসিক বৈকল্যে সংঘটিত বলে লাইয়ারতিসকে ব্যাখ্যা করে হ্যামলেট নিজেও। তাঁর এই যুক্তিকে সমর্থন করা যেতো যদি না সে তার মাকে এই হত্যার ব্যাপারে ঠিক উল্টোটা বোঝাতেন।
নাটকের পরিসমাপ্তিতে দেখা যায় শুধু নিজের না পরিবার, বন্ধুসহ সবার জীবন ধ্বংস করে হ্যামলেট। একের পর হত্যার মাধ্যমে রক্তাক্ত করে নিজের হাত। প্রতিশোধের আগুনে ধ্বংস করে সবার জীবন। যে দেশ রক্ষায় তার বাবা জীবন পণ চেষ্টা করেছে সেই দেশকে সে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছে বিনা যুদ্ধে। হ্যামলেট একটি আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, নির্বোধ, অত্যাচারী, নিজের ইচ্ছের অধীনে সবকিছু পরিচালনাকারী চরিত্রের নাম। তার ক্যারিশম্যাটিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে সে যুগের পর যুগ বিশ্বের কোটি কোটি পাঠককে চুম্বকের মত আটকে রেখেছে তাকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপে।
এখানেই খল চরিত্রে হ্যামলেটের স্বার্থকতা, 'হ্যামলেট, আ ভিলেইন অফ জিনিয়াস'।