সব্যসাচী হাজরার বই ও আর্ট শো
বিরাল-কে বিড়াল করে দিলে হয় না।
জীবনানন্দ দাশ বিরাল লিখে গেছেন, বানানরীতির দোহাই দিয়ে সেই বিরালকে বিড়াল করে দিলে হবে কেন?
বিরাল আর বিড়াল কি এক?
মাত্র এক হরফের হেরফের, বিস্তর ফারাক দুই ছবিতে, হরফ যে ছবি তৈরি করে। কিংবা যে ছবি হয়ে থাকে হরফে।
সব হরফই ছবি, টানটোন গড়ন পরিপ্রেক্ষিত সমেত। পুরোনো কথা, বরাবর চর্চিত। তবে আমরা কি চর্চা করি? ছবি দেখার মন নিয়ে হরফ দেখার মতো অবসর আমাদের হয় না। আমরা হরফ দেখি পড়ার জন্য। মুখস্থ করি বা করি না, ছবিটা বেমালুম ভুল মেরে থাকি। না হলে 'ক'-তেই কাক দেখা যায়, 'ঞ'-তে মিঞা। মিঞাত্ব প্রকাশক মিঞা বানান অবশ্য বহুদিন ধরে লেখা হয় মিয়া। চিত্ররূপ ভাবনার যে কোনো সুযোগ বেনোজলে ভাসিয়ে দিতে আমরা বিরাট ওস্তাদ। সংকোচন সহজীকরণে বদ্ধপরিকর। সহজ এত সহজ আর কী! কোন সহজ রূপ আমরা ধরছি?
বাংলা হরফের রূপশৈলী কি আমাদের দেখানোর চেষ্টা করা হয় নাই বারবার? বইয়ের মলাটের মানুষ হিসেবে বইয়ের মলাটের কথাই বলি। বাংলা বইয়ের অগুনতি মলাট আছে, মনে থেকে যাবে কেবল হরফ বিন্যাসের অসামান্যতার জন্য। রায়-পত্রী-চৌধুরীর পরম্পরা এ। লাস্ট র্যাট স্ট্যান্ডিং সব্যসাচী হাজরা। লাস্ট র্যাট অবশ্যই লাস্ট না, কিছুর শেষ বলে কিছু নাই, সব্যর পরে যদি কেউ এ নিয়ে কাজ করে করবে। আশা রাখি করবে। যখন করবে তখন কথা হবে।
এখন এই ক্ষেত্রে সব্য একা, দুই বাংলার বইয়ের মলাটে একা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে বইয়ের মলাটে হরফের বিন্যাস, ব্যবহার নিয়ে। আরও বিস্তৃতভাবে হরফের রূপকল্প নিয়ে। এতদসংক্রান্ত তার বোঝাপড়ার একটা চমৎকার নজির সম্প্রতি উপস্থাপন করল সে, একটা বই প্রকাশ করে এবং আর্ট শো করে।
বইয়ের নাম 'অ: ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি'। দুই'শ পৃষ্ঠার ইংরেজি বই। সুমুদ্রিত। এই বইয়ের প্রকাশনা সম্পৃক্ত আর্ট শো আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে হয়েছে, ১৪ জুন থেকে ২৫ জুন ২০২২ ব্যাপী। স্বল্প পরিসরে সতর্ক বড় আয়োজন। বাংলা হরফের বিবর্তন নির্দেশক সেই আর্ট শো-এর শিরোনাম ছিল 'ব্রাহ্মী টু বাংলা'। চিন্তাশীল সহজ বিনীত উপস্থাপন। মনোযোগ দিয়ে যারা দেখেছেন বাংলা হরফের বিবর্তন তাদের মাথায় গেঁথে থেকে যাওয়ার কথা।
ক-অক্ষর গো-মাংস আমার বিবেচনা, এই প্রথম ঠিক এ রকম একটা আর্ট শো আমরা দেখলাম আমাদের এখানে। এই আর্ট শো-তে শিল্পী লেখক সব্যসাচী হাজরা নির্মিত 'সব্যসাচী টাইপ' উন্মুক্ত হয়েছে। আসকি, ইউনিকোড দুই ভার্সনেই যে কেউ ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে পারবেন। আমি করেছি।
এর মধ্যেই কিছু প্রচ্ছদে সব্যসাচী টাইপ ব্যবহার করেছি। কম্পিউটারে যদি টাইপ করতে পারতাম তবে এই লেখাটা নিশ্চয় সব্যসাচী টাইপ-এ টাইপ করতাম। আমাদের লেখক-প্রকাশকেরা এই টাইপে তাদের বই কম্পোজ করে দেখতে পারেন। ব্যবহার দরকার যথাযথ হরফের।
বইটার কথা বলি এখন। ইংরেজি বই, নাম 'অ' কেন? আর বিকল্প নাই বলে। বইয়ের অলংকরণ ও হরফ চিন্তা নিয়ে এর আগে আরও দুটা বই প্রকাশ করেছে সব্য 'চিত্রলিপি' ও 'রংতুলিতে ছোপছাপ'। দরকারি বই। 'অ' বইটা আরও দরকারি। বাংলা হরফের বিবর্তন শুধু, হরফের অস্থি-মজ্জায় ঢুকে দেখেছে সব্য। কেটে চিরে জুড়ে দেখেছে। বিস্তর গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে গেছে। ব্যবহারিক কাজ, গ্রিড অনুসারে হরফ নির্মাণের কলাকৌশল নিজে আয়ত্ত করে শেয়ার দিয়েছে। আরও সম্ভাবনা শনাক্ত করেছে বাংলা হরফের নান্দনিক নকশার যে এ রকম হতে পারে বা ও রকম হতে পারে। কেন?
দায়বোধ থেকে। দেশের দশের প্রতি দায়বোধ। সব শিল্পীর এই দায়বোধ থাকে কি না, আমার দেখাশোনা থেকে আমি নিঃসন্দেহ হতে পারি নাই এখনো। দেশের কতিপয় মহাকীর্তিমান যেটাকে বলছেন দায়বোধ আমাদের মনে হচ্ছে সেটা 'হায় বোধ'। আত্মপর পাইলাম না হায় হায়ের বোধ। এখানে সব্যর দায়বোধ খাঁটি। শিল্প ও ভাষা, শিল্পভাষার প্রতি দায়বোধ। অন্তর্গত হয়ে থাকে এটা। সয়ম্ভু বোধ, সব্য-স্বাভাবিক। ভূর্জপত্রে খাগের কলম দিয়ে হরফ রপ্ত করেছে এই ছেলে। দাদামশাইয়ের তত্ত্বাবধানে কয়লা গুলিয়ে হরফ লিখেছে শৈশবে। করণ-কৌশল সেই থেকেই আয়ত্ত।
লিখিত ভূর্জপত্র পাক্কা দশ দিন ভিজিয়ে রাখতে হতো নিমপাতার জলে, ঘুণে যাতে না ধরে যায়। সেই প্রোথিত এক লাল বটফল। পত্রপুষ্প ঝুরিতে শোভিত মহীরুহ এখন 'অ: ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি' বইয়ে।
আমার গণ্ডি বইয়ের মলাট, বইয়ের মলাট নিয়েই থাকি। বাংলা ভাষায় বইয়ের মলাট যারা বানান তারা মোটামুটি অবহিত আমাদের হরফের গলতি-ঘাটতি নিয়ে। বিচ্ছিন্নভাবে টাইপোগ্রাফি হয়েছে অগুনতি, কিন্তু সম্পূর্ণ বাংলা হরফ সংস্কার বা পরিশীলনের চিন্তা কেউই তেমন একটা করেন নাই ইদানিং। বহুদিন ধরেই কিছু দেখছি না। অনীহার নানা কারণের একটা শুনেছি কপিরাইট আইন। জটিলতা প্রচুর। মেধাস্বত্ব কী সেটাই আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারি নাই।
আজম খানের গান নির্বিঘ্নে ঘাটের এর-তার গান হয়ে যাচ্ছে। স্রষ্টার প্রাপ্য মর্যাদা নাই, কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের লেখক হয়ে যাচ্ছেন সিরিজের গ্রুপ অব গোস্ট রাইটার্সের একজন। পরিস্থিতি যখন এ রকম হরফ নকশার মতো ঝুঁকির কাজ করতে কেন কেউ আগ্রহী হবেন? প্ল্যাঙ্ক টাইমে (সময় মাপার সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক) চুরি-ছিনতাই হয়ে যাবে তার সৃজনশীলতা। হায়রে সৃজনশীলতা রে! অস্বীকার করি এই চর্চা। কপিরাইট ব্যাপার? যে কাজ করার সে করবেই। দায়বোধজাত নিজের তাগিদ থেকে করবে।
সব্য না হলে কেন করল? নিজের খেয়ে বনের মোষ গন্ডার তাড়াল? তাড়াল। কপিরাইট না অংশত বাইট এটা সৃষ্টিশীলতার, এই যে নিজের খেয়ে বনের মোষ গন্ডার তাড়ানো। সব্য তাড়িয়ে ছেড়েছে। পারবে বলে, পেরেছে বলে।
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর, বিদ্যাসাগরের জন্ম-দ্বিশতবার্ষিকীর এই বর্ষে প্রকাশিত বইটা সব্য উৎসর্গ করেছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে।
আর্ট শো-তে ফিরি আর একবার। শো-তে হরফ চর্চায় ব্যবহৃত নিজের বানানো কিছু কলম রেখেছে সব্য। পূর্বসূরিদের কাজের প্রচুর নমুনা রেখেছে, প্রামাণ্য ভিডিওসহ। এই আরেক ব্যাপার।
অকৃতজ্ঞতা আমাদের আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে, পূর্বসূরিদের আমরা ভুলে যাই। তাতে কী সুবিধা কে জানে? সব্য সেই সুবিধা নিতে যায় নাই। প্রাণ থেকে কাজটা করেছে। বাংলা হরফ সে যতটা নির্ভুল এবং নান্দনিক হতে পারে মনে করে তার একটা রূপ দাঁড় করিয়েছে বেজান খেটেখুটে। আমার সেই রূপ দেখে ভালো লেগেছে। প্রচলিত ফন্টের থেকে উন্নত লেগেছে। যাত্রা কি শেষ এখানেই? না এটা শুরু মাত্র। 'অ' বইটা অনুপ্রেরণামূলক এবং সদর্থে উসকানিমূলকও। একটা রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, আরও অনেক রাস্তা পড়ে আছে। চরৈবেতি। চরৈবেতি হে।
বই : 'অ : ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি'।
প্রকাশক : কথাপ্রকাশ এবং নোকতা।
লেখক শিল্পী সব্যসাচী হাজরা।
আমাদের সব্য। তার বই 'অ'-এর কথা এই ক্ষণে হরফ 'অ'-এর কথা দিয়ে শেষ করি। অ-এ অজগর আসছে তেড়ে। কথাটা না-পসন্দ অনেকের। অজগর আসছে তেড়ে বলে কিনা ভয় পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে শিশুদের, শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সেই ভয়ে। আচ্ছা, পরের হরফে গেলে হয় না? আ-তে কী? আমটি আমি খাব পেড়ে। এখন এই দ্বিতীয় পঙ্ক্তি অজগরকে অপাংক্তেয় করে দিল কি না। আরে অজগর তেড়ে আসছে তো কী, আমটি আমি পেড়ে খাবই। আমটি পেড়ে খাওয়ার আনন্দের কাছে অজগরের তেড়ে আসার ভয় কিছু থাকছে? কোনো ভয় নাই।
হরফ নিয়ে যারা কাজ করেন, ভাবেন, তাদের নিত্যসঙ্গী হোক, হবে, 'অ: ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি'। ভুলত্রুটি কী আছে বইতে, টুকটাক মুদ্রণ প্রমাদের কথা শুনছি, ইংরেজি-অজ্ঞ আমার চোখে অত ধরা পড়ে নাই, মুদ্রণ প্রমাদ থাকলে ঠিক করা যাবে, সেই সুযোগ আছে। আমি ভালোবাসা জানাই সব্যকে। অ থেকে ঁ, সমস্ত বাংলা হরফের মঙ্গল হোক। হরফের মঙ্গল শোভাযাত্রা হোক। চরৈবেতি। চরৈবেতি হে।
+ (যোগ) :
রাত ১২টা ৪৩ বাজে।
ব্লুপ পণ্ডিত দেখছে সব্যর বইটা।
আমাদের ব্লুপ একটা বিরাল।
বিড়াল না বিরাল।
রাত : ০৪.০৭.২০২২