নীড়হারা সেই ছোট্ট পাখি
শুনলাম পাখির ছবি তুলতে 'কুরমা' গিয়েছিলেন তরুণ দুই আলোকচিত্রী। কমলগঞ্জ উপজেলার প্রান্তিক এক চা-বাগানের নাম কুরমা; ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর সীমানা লাগোয়া বাগান। শুক্র-শনি এই দুটি ছুটির দিন পাখির ছবি তুলবেন বলে দুজনে ঢাকা থেকে এসেছিলেন। মূল আকর্ষণ ছিল চা-বাগানের কোণে ছোট এক ঘাসবন। আশা ছিল মুনিয়া, প্রিনা, ছোটন, এসব খুদে পাখির ছবি পাবেন।
কুরমা থেকে তাঁরা ফিরেছেন শূন্য হাতে; কোনো ছবি পাননি, পাননি ঘাসবনটিও। চা-বাগানের লোকেরা ঘাস কেটে ফেলেছেন। ওখানে চা-বাগান সম্প্রসারণ করা হবে। আশাহত এই আলোকচিত্রীদের সাথে শনিবার আমাদের সাক্ষাৎ হলো সাতছড়ি বনে। করুণ কণ্ঠে সে দুই তরুণ সদ্য বিলুপ্ত ঘাসবনের কথা বললেন। শুনে আমরাও হতাশ। কুরমার ঘাসবনে ছোট্ট একটি পাখি ছিল, যাকে বাংলাদেশে আর কোথাও দেখা যায়নি।
রোববার আমরাও গেলাম কুরমার বিলুপ্ত ঘাসবন দেখতে। দেশের যেখানে পাখি আছে, সেখানে আমরা যাই বারবার। পাখি নেই এমন স্থান দেখতে এলাম এই প্রথম। এ যেন নিউইয়র্কের ধংসপ্রাপ্ত টুইন টাওয়ারের মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে গিয়ে দাঁড়ানো। বাংলাদেশের অতিবিরল প্রজাতির একটি পাখি এখানে ছিল—সে কথা স্মরণ করে সেই কাটা ঘাস, কাশ, ভাঁট ও নামহীন লতাগুল্মের স্তুপের মাঝে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম।
নীড়হারা সেই পাখিটির নাম ধলামাথা ছোটন। ছোট্ট পাখি; লম্বা নাম। এর ইংরেজি নাম আরও দীর্ঘ: গোল্ডেন-হেডেড সিস্টিকোলা। এ পাখির দেখা সবচেয়ে বেশি মেলে অস্ট্রেলিয়ায়। তাসমানিয়া থেকে দক্ষিণ-পাশ্চিম দিকে বাংলাদেশ পর্যন্ত সব দেশেই পাখিটি আছে। তবে বাংলাদেশের পাশ্চিমে এর দেখা মেলে কমই। বাংলাদেশেও পাখিটি বিরল। তাই এর এত কদর। এই শতাব্দীতে আমরা একমাত্র এই ঘাসবনেই এর দেখা পেয়েছি।
ছয়-সাত বছর আগে এখানে পাখিটিকে কাছ থেকে দেখেছিলাম। তখন তার প্রজনন মৌসুম শুরু হয়েছে। দেহে তার সোনালি রংয়ের নতুন পালক; মাথায় সোনালি ঝুঁটি। শুকনো ঘাসের মাথায় বসে সোনালি ঝুঁটি উঁচিয়ে পুরুষ পাখিটি গান গাইল। তার সে গান যার উদ্দেশ্যে সেই স্ত্রী পাখিটির সাক্ষাৎ পেলাম না। তবে জানি, সে কাছেই কোথাও ঘাসের আড়ালে বসে আছে। সে দূরে সরে গেলেই পুরুষের গান থেমে যাবে।
ছোটন, ভরত আর তুলিকা পরিবারের পাখিরা আমাদের ঘাসবন আর খেতখামারেরই পাখি। সুরেলা গলার জন্য এরা বিখ্যাত। গান গেয়ে এরা নিজ নিজ এলাকা চিহ্নিত করে। গান গেয়েই এরা প্রেম নিবেদন করে। তবে ঘাসে বসে গাইলে সেটা হয় না; আকাশে উড়ে উড়ে গাইতে হয়।আকারে ক্ষুদ্র হলেও প্রতিটি পুরুষ আকাশে একটা ভুঁই দখল করে আর সেখানে উঠে চক্রাকারে উড়ে উড়ে গান গায় দীর্ঘক্ষণ ধরে।
এই পাখিদের গান নিয়েই শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন, 'শোন, শোন, স্বর্গের তোরণে গিয়ে গাইছে ভরত' (Hark, hark, the lark at heavenÕs gate sings)। বেশিক্ষণ থাকিনি বলে সেবার কুরমার ঘাসবনে দাঁড়িয়ে ধলামাথা ছোটনকে স্বর্গের তোরণে উঠে গাইতে দেখার ভাগ্য হয়নি আমাদের। ঘাসে আর ভাঁটফুলের চূড়ায় বসেই সে অনেক গান শুনিয়েছে। দেখেছি তার ক্ষুদ্র জিব দিয়ে সে কী করে গানের পরদা নিয়ন্ত্রণ করে।
শুধু স্ত্রী পাখিকে নয়, ঘাসবনের তাবৎ প্রাণীকূলকে যেন গান দিয়ে মোহিত করতে চায় পুরুষ পাখিটি। তিন ইঞ্চি লম্বা তার দেহ, গান গেয়ে সে দখল করেছে দুই একর জমি। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শক্তিশালী কিছু ভাঁটগাছ আর গবুরাগুল্মের ডগা। এখানেই সে ঘাস পাতা দিয়ে বুনিয়ে নেবে ছোট্ট গোল বলের মতো বাসা। ভাঁটপাতা, গবুরাকাঠি, শিমুলতুলা আর মাকড়সা জাল দিয়ে বোনা সে বাসায় তিন-চারটি ডিম দেবে তার স্ত্রী।
ডিম দেওয়া শেষ হলে ক্ষান্ত হবে গান। এখন পুরুষের কাজ গিরগিটি আর মেঠো ইঁদুর তাড়িয়ে দূরে রাখা। দশ দিন পর ডিম থেকে ছানা বেরোবে। তখন দুজনে ছানাদের আহার জোগাতে ব্যস্ত। ঘাসবনের ঝরাবীজ ও পোকামাকড় সবই ছোটন ছানার জন্য সুখাদ্য। তবে উন্মুক্ত এই ঘাসবনে আছে সাপখোপ, বেজি, কুকুর, বিড়াল এবং মানুষ। সর্বসাকুল্যে একটি ছানা বড় হয়ে উড়ে যেতে পারলেও ছোটন দম্পতি কৃতার্থ।
বছরে একটি ছানা বাঁচলেও বংশধারা রক্ষা হতে পারে ধলামাথা ছোটন পাখিদের। তাই হয়তো বাংলাদেশের এই অতিবিরল প্রজাতিটি এ ঘাসবনে এত দিন টিকে ছিল। কুরমাচাবাগানের অখ্যাত এই ঘাসবন হয়ে উঠেছিল পাখিপ্রেমী ও আলোকচিত্রীদের ছোট্ট একটি তীর্থক্ষেত্র। আজ সেসবই হয়ে গেল অতীত কাহিনি। ঘাসবন নিপাত করে বাগান কর্তৃপক্ষ এখানে রোপণ করতে যাচ্ছে ম্যাগ্নোলিয়া-চিনেন্সিস—অর্থাৎ চা-গাছ।
এখানে সমতল ভূমিতে আগে কোন চা-বাগান ছিল না। বিস্তীর্ণ এলাকাটি চা-শ্রমিকদের পশু-চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তারপর এই সমতলে চা-বাগান সম্প্রসারিত হলো। মাত্র দশ একর জমি অবশিষ্ট ছিল; যেখানে টিকে ছিল অবিস্মরণীয় একজোড়া ধলামাথা ছোটন। আমার মহাভাগ্য এই পাখিকে কাছ থেকে দেখেছিলাম, ছবি তুলেছিলাম। ধূলিমলিন সে সৌভাগ্য। আমার সেই দেখা আর ছবির কী মূল্য, যদি পাখিই না থাকে!
দশ একর সমতল জমি চা-বাগানের জন্য মহামূল্যবান কোনো সম্পদ নয়। ইচ্ছে করলে বাগান কর্তৃপক্ষ ঘাসবনটি সংরক্ষণ করতে পারত। কর্তৃপক্ষ সে প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিল; রক্ষা করেনি। ভুলক্রমেই নাকি প্রতিশ্রুতিটি রক্ষা হয়নি। দেশের তাবৎ চা-বাগানেই প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতিগুলো খুব একটা রক্ষা হচ্ছে না। এককালে চা-বাগানের ফাঁকে ফাঁকে অগণিত ঝোপঝাড় ছিল। এখন প্রায় কিছুই নেই।
যদি সত্যিই ভুল করে এই দশ একর জমির ঘাসকাটা হয়ে থাকে, তবে সে ভুল সংশোধন করা কঠিন কিছু নয়। এই জমিনে আপনাআপনি ঘাস, ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম গজিয়ে উঠবে সামনে বর্ষায়। শুধু চা না লাগালেই হল। ঘাস হলে একদিন ছোটন, ভরত, মুনিয়া আর তুলিকা পরিবারের অনেক পাখিই ফিরে আসবে। আমাদের সেই অতিবিরল ধলামাথা ছোটনও কি ফিরে আসবে? তা হলপ করে বলতে পারিনে। কিন্তু সে আশাটি লালন করতেই তো মন চায়।