মানুষ কেন এ প্রাণী দেখলেই ছুটে আসে হত্যা করার জন্য!
১.
তিন দশক আগের কথা। চরসিন্দুরের চরাঞ্চলে হঠাৎ করেই নেমে আসে বাঘের আতঙ্ক। স্থানীয় কয়েকজন কৃষক আঁখ ক্ষেতে কাজ করতে গেলে ডোরাকাটা শরীরের একটি প্রাণী তাদের নজরে আসে। এরপর চরের ফসলক্ষেতে কাজ করতে আসা অনেকের চোখেই পড়ে প্রাণীটা। একটি ছাগলও কোনো এক প্রাণীর আক্রমণে মারা যায়। কৃষকদের মনে তখন ভয় ঢুকে যায়। অনেকেই চরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। স্থানীয় কৃষকেরা তখন শরণাপন্ন হয় এক তরুণ শিকারির।
খবরটা জানার পর শিকারি বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। চরে বাঘ কিংবা চিতাবাঘ থাকার উপযোগী ঘাসবন এবং ঝোপঝাড় রয়েছে। কিন্তু বাঘ আসবে কোথা থেকে? তবে একসময় আসত নদীর ওপারের গজারি বন থেকে। কিন্তু সে তো বহুকাল আগের কথা। নির্মম হলেও সত্যি, বাঘ আর চিতাবাঘ চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে গজারি বন থেকে। নদীর ওপারের অরণ্যবেষ্টিত বরগাঁও গ্রামে সর্বশেষ চিতাবাঘটি নিহত হয় শিকারি আরমান মিয়ার গুলিতে ১৯৬৪ সালে। গজারি বনে এখন শুধু টিকে আছে কিছু মেছোবাঘ (Fishing Cat)।
মেছোবাঘ বা মেছো বিড়াল নদী পেরিয়ে চরে চলে আসতে পারে। কিন্তু কৃষকেরা চরাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যে প্রাণীটার বর্ণনা দিয়েছে, তার সঙ্গে মেছো বাঘের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, প্রাণীটার লেজ বেশ লম্বা আর সাদা-কালো ডোরাকাটা। শরীরজুড়ে কালো ফোটা ফাটা দাগ। কেউই বিস্তারিত বর্ণনা দিতে পারেনি। তবে তাদের বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছিল, এ যেন বাঘ আর চিতাবাঘের সংমিশ্রণে জন্ম নেওয়া কোনো অদ্ভুত প্রাণী। শিকারি খুব মন দিয়ে ভাবতে শুরু করলেন ঘটনাটা নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
সেই তরুণ শিকারি স্রেফ একজন সাধারণ শিকারি ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ ট্রেকারও। তাই সিঙ্গেল ব্যারেল স্টিভেন্স শটগান হাতে চরে নেমে প্রাণীটাকে খুঁজে বের করতে তার খুব বেশি সময় লাগল না। কৃষকদের আতঙ্কের কারণে প্রাণীটাকে সেদিন মরতে হয়েছিল শিকারির গুলিতে।
২.
কিছুকাল পরের কথা। আমার তখন মাছ ধরার ভীষণ বাতিক ছিল। এক দুপুরে হুইলের ছিপ নিয়ে নিজের গ্রাম পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম ব্রহ্মপুত্র নদের দিকে। গোকুলনগর গ্রামের কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল, একদল মানুষ একখণ্ড গ্রামীণ বনকে ঘিরে রেখেছে। প্রত্যেকের হাতে দেশীয় অস্ত্র। এরপর লোকগুলো হই-হট্টগোল করতে করতে জঙ্গলটার ভেতরে বৃত্তাকারে ঢুকে পড়ল। আস্তে আস্তে ওদের বৃত্ত ছোট হয়ে আসতে লাগল। আমি তখন কিছুটা কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, একটা প্রাণী ওদের ভয়ে বড় কড়ইগাছে উঠে পড়েছে।
লোকগুলোর থামার নাম নেই, ওটাকে যেন মেরেই ছাড়বে। সবাই একের পর এক ঢিল ছুড়তে লাগল কড়ইগাছের ওপরের দিকে। এরপর প্রাণীটার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হলো না, দুম করে পড়ে গেল নিচে। একের পর এক বল্লমের আঘাতে মৃত্যু হলো তার। এখানেও বিরাজ করছিল বাঘ-আতঙ্ক।
গ্রামের নাম সুলতানপুর, বিলের নাম বাঘবেড়। কথিত আছে, একসময় বাঘ এসে নিয়মিত এই বিল থেকে জল পান করত। তবে এখন আর সেই দিন নাই। বিলের দক্ষিণ দিক জুড়ে রয়েছে বড় একটা আনারসবাগান। ঘটনাটা ১৯৯৮ সালের। সকালবেলায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আনারসবাগানে প্রবেশ করেন আব্দুল হক নামের এক কৃষক। তিনি একটা কিছু দেখে, প্রচণ্ড ভয়ে বাঘ, বাঘ, চিৎকার করতে করতে বাগান থেকে বেরিয়ে আসেন। ছুটে আসে আশপাশের লোকজন। ঘিরে ফেলা হয় বাগানটাতে। এরপর ট্যাটার আঘাতে মৃত্যু হয় প্রাণীটার।
এই যে প্রাণীটাকে মানুষ যুগের পর যুগ হত্যা করে এসেছে, সে কি এমন ভয়ংকর? কী তার পরিচয়? মানুষ কেন এদের দেখলেই ছুটে আসে হত্যা করার জন্য? আসলে সে কোনো ভয়ংকর জন্তু নয়। তেড়ে এসে মানুষকে আক্রমণ করেছে, এমন ইতিহাসও জানা নেই।
সে খুব সাধারণ এক প্রাণী। আমাদের দেশে বসবাসকারী গন্ধগোকুলজাতীয় প্রাণীদের মধ্যে সেই হচ্ছে সবচেয়ে বড়। আকৃতিতে বাঁশভাল্লুকের চাইতে কিছুটা ছোট। ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয় Large Indian civet আর বৈজ্ঞানিক নাম Viverra zibetha। বাংলায় এরা বড় বাগডাশ নামে সর্বাধিক পরিচিত। তবে এর বহু ধরনের আঞ্চলিক নাম রয়েছে। যেমন নরসিংদী ও গাজীপুরের মানুষের কাছে এরা 'বাঘডাইয়া' নামে পরিচিত।
ওরা রেগে গেলে বা উত্তেজিত হলে শরীরের বিশেষ গ্রন্থি থেকে পোলাওর চালের মতো এক ধরনের গন্ধ বের হয়। এই গন্ধের কারণে অনেকে এদের খাট্টাস বলে ডাকে। এরা নিজেরা গর্ত করতে পারলেও অন্যের গর্তে থাকতে পছন্দ করে, বিশেষ করে সজারুর গর্তে। সজারু তার বহুমুখী গর্তের ভেতর দেয়াল তুলে এদের সীমানা আলাদা করে দেয়। মাংসাশী আর তৃণভোজীর সহ-অবস্থান আসলেই বিরল ঘটনা। খাদ্যাভাসের দিক দিয়ে বড় বাগডাশদের সর্বভুক বললে বাড়িয়ে বলা হবে না, তবে কাঁকড়া এদের বিশেষ প্রিয় খাদ্য। এরা ভূমিতে বিচরণকারী প্রাণী হলেও গাছে চড়ায় ভীষণ ওস্তাদ।
আসলে বড় বাগডাশ হচ্ছে অতি জমকালো দেহের এক সুন্দর স্তন্যপায়ী প্রাণী। নিজের দেহের ঝলমলে সৌন্দর্যই এর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবুজ ঝোপের পাশে অথবা নির্জন কোনো স্থানে হঠাৎ ওদের দেখলে মানুষের মনে বাঘের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। বাঘ আর বিড়ালের সম্মিলিত মুখশ্রী, সাদা-কালো ডোরাকাটা লেজ, গলায় মাফলারের মতো সাদা দাগ, নকশা-কাটা শরীর- এসব চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার ঘটে। লোকজন ওদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে অন্যদের বাঘ দেখতে পাওয়ার খবর জানায়। আর তখনই সম্পূর্ণ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মানুষ ছুটে আসে সাধারণ একটি প্রাণীকে হত্যা করার জন্য।
৩.
একসময় বাংলাদেশের পাহাড়ি জঙ্গল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি গ্রামে বড় বাগডাশ দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু ক্রমাগত হত্যার ফলে এদের আর এখন তেমন একটা দেখাই যায় না। সবচেয়ে দুঃখের কথা, এখনো মানুষ ওদের মেরেই চলেছে।
এখনো প্রকৃতিতে যে কয়টা বড় বাগডাশ টিকে আছে, ওদের বাঁচানোর উপায় কী? উপায় একটাই, বন্য প্রাণীদের সঠিক পরিচয় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভূমিকা সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলা। মানুষকে বোঝাতে হবে, আমরা যেমন প্রকৃতির সন্তান, ওরাও তা-ই। আমাদের যেমন বাঁচার অধিকার আছে, ওদেরও তা-ই। একটি সন্তানও যদি অনাদরে ঝরে যায়, প্রকৃতি আমাদের ক্ষমা করবে না।