রবীন্দ্রনাথ হো হো হেসে বললেন, ‘অবন চিরকালের পাগলা’
ফ্রান্সের ল্যুভ জাদুঘর কোনো শিল্পীর ছবি কিনতে চাইলে তিনি হয়তো হাতে স্বর্গ পাবেন। সেখানে অর্থের অঙ্ক বড় হয়ে দেখা দেবে না। কিন্তু না এ শিল্পী রাজি হলেন না। তার ধারণা জন্মাল, সংগত কারণেই, নেটিভ ভারতীয় হিসেবে ছবির মূল্য কম ধরা হয়েছে। ল্যুভকে সাফ জানিয়ে দিলেন—না, বিক্রি করব না ছবি। ছবিটার নাম 'শেষ বোঝা' আর শিল্পীর নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
স্বমত যদি সঠিক হয় তাতে অটল থাকবেন। এ গুণের প্রকাশ ঘটেছিল শৈশবে, কঠিন এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। শিক্ষাজীবনের শুরু হয়েছিল নর্মাল স্কুলে। সেখানে লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত নামের এক শিক্ষক ক্লাসে একবার ভিনদেশি এক খাবারের নাম বলেন, 'পাডিং'। শিশু অবন ঝট করে বলে উঠে, 'না, না, পাডিং নয় ওটা পুডিং।' দুধ ও ডিমের তৈরি এ খাবার রোজ রোজই বাড়িতে খায়। তাই নাম ভুল হওয়ার কোনো কারণ নেই। 'মা দুর্গার অসুর'-এর মতো চেহারার বদরাগী শিক্ষক লক্ষ্মীনাথ তা মানলেন না। বরং শাস্তি হলো অবনের। ছুটির পরে এক ঘণ্টা 'কনফাইনমেন্ট'। আর বেতের বাড়ি। তারপরও 'পুডিং' বলা বন্ধ হলো না। 'পাডিং' কবুল করলই না এই শিশু শিক্ষার্থী। এরপর স্কুলের পড়াশোনার যবনিকা পতন। বাড়িতেই যদু ঘোষালের কাছে লেখাপড়া সূচনা। শিখতে হলো ফার্সিও। একগুঁয়ে এ শিশুই পরিণত বয়সে শিষ্যের ছবিতে রঙের অভাব অনুভব করেন। তাকে রং দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিদ্রাহীন রাত কাটান; কারণ, তার মনে হতে থাকে শিষ্য হয়তো ও ভাবেই দেখেছে। সেখানে কেন রং দিতে হবে। ভোর হতেই মোটর নিয়ে ছুটলেন শিষ্যের বাড়ি। তাকে রং দিতে মানা করলেন তিনি। তার এ শিষ্য হলেন নন্দলাল বসু।
ঔপনিবেশিক ভারতে ছবি আঁকার নিজস্ব ধারা তৈরি করেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার এই নিজস্ব ধারা তৈরি নিয়ে নন্দলাল বসু বলেন, 'আমি আরম্ভ করলুম, আমাদের পৌরাণিক ধারায় ছবি আঁকতে। অবনীবাবু করতেন নানা পুরাণ সংস্কৃতকাব্য আর ইসলামি কাহিনি কেচ্ছা থেকে রাজ-বাদশাদের ছবি। এসব উনি করতেন অতি অদ্ভুতভাবে। সেটা আমরা পারিনি।
অবনীবাবু বলতেন, 'তোমরা পারবে না এসব ছবি করতে। এই রকম মোগলাই কায়দায় ছবি তোমাদের হবে না। আমাদের বংশের মধ্যে পিরালিধারায় আছে এই কায়দা। তোমরা করো স্রেফ দেশি ছবি।'
'পিরালি ধারা' নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এটা নয়। তবে জোঁড়াসাকোর পরিবারের সাথে মুসলমানদের যোগসাজশের কারণে সে সময় তাদের পিরালি ব্রাক্ষ্মণ বলা হতো। ফলে অত বড় জমিদারি থাকা সত্ত্বেও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মতো একজন মানুষের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও বিয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথের কোনো পাত্রী জুটছিল না। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে তাঁদের জোড়াসাঁকো কাছারিরই এক কর্মচারী, যশোরের ফুলতলা গ্রামের বাসিন্দা, বেণীমাধব রায়চৌধুরীর শরণাপন্ন হন ঠাকুর পরিবারের লোকেরা। তাঁর দশ বছরেরও কমবয়সি মেয়ে, প্রায় অশিক্ষিত ভবতারিণী ওরফে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তড়িঘড়ি করে ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর, রোববার দিন বিয়ে দিয়ে তবে তাঁরা নিশ্চিন্ত হন। কারণ ওই একই—পিরালি কলঙ্ক। এমনকি রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখনো কেউ কেউ নাক সিঁটকে বলেছিলেন, নোবেল পুরস্কার পেয়েছে তো কী হয়েছে? ওরা তো পিরালি ব্রাহ্মণ। লোকের মুখে মুখে অপভ্রংশ হয়ে 'পিরালি' হয়ে গেলেও আসলে 'পিরালি' নয়, কথাটা হল 'পির আলি'। এই 'পির আলি' অপবাদের জন্যই নাকি তখনকার দিনের লোকেরা ওই পরিবারে কোনো ছেলেমেয়ের বিয়েও দিতে চাইতেন না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেও পিরালিত্বের কলঙ্ক কিন্তু তাঁদের পিছু ছাড়েনি।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে রবীন্দ্রনাথের ভাইপো, সে কথা নতুন করে জানানোর প্রয়োজন নেই। এখানে দেখার বিষয় হলো নিজ সাংস্কৃতিক চেতনা সৃষ্টিতে 'পিরালি ধারা'র প্রভাবের দাপট অকপটে স্বীকার করছেন তিনি। কথিত কলঙ্ককে তিনি অহংকার হিসেবে প্রকাশ করলেন। অবনীন্দ্রনাথ স্মৃতি বইতে ভারতশিল্পে নবযুগের ভূমিকায় অবনীন্দ্রনাথ রচনায় সে কথার সাক্ষ্য হয়ে আছেন ভারতের চিত্রজগতের আরেক দিকপাল নন্দলাল বসু। পাশাপাশি বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দেন, অবনীন্দ্রনাথের ছবির সবচেয়ে 'বড় সম্পদ, তাঁর স্টাইল...।' তবে এ বিষয়টি খানিক যেন উপেক্ষিত। কারণ, 'ভারতমাতা', 'ওমর খৈয়াম', 'শাজাহানের মৃত্যু-প্রতীক্ষা', 'আলমগীর', 'শেষ বোঝা' প্রভৃতি ছবিগুলোতে যে 'ভাব' রয়েছে, তার আবেশেই যে ডুব দেন সকলে। তাঁর প্রতিটি ছবিতেই যে লাগে অনুভূতির স্পর্শ। প্লেগে অবনীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে শোভার মৃত্যু হয়েছে। 'শাজাহানের মৃত্যু-প্রতীক্ষা'য় তাঁর 'বুকের ব্যথা সব উজাড় করে ঢেলে' দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ। রাজশেখর বসুবলেন, অবনীন্দ্রনাথ প্রধানত নূতন চিত্রকলা আর নূতন সাহিত্যের স্রষ্টা। তিনি এ দেশের কলাশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন, ভারত-পারস্য-চীন-জাপান প্রভৃতি চিরাগত পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলেন এবং নিজের উদ্ভাবিত নূতন পদ্ধতিতে আঁকতে লাগলেন।
এমনটি করতে গিয়ে রাতারাতি স্বীকৃতির পুরস্কার বা খোশ আমদেদের হাততালি মেলেনি। বরং উল্টাটাই হয়েছে। তারও বিবরণ দেওয়া হয়েছে, 'অসাধারণ কিছু করতে গেলেই গঞ্জনা সইতে হয়। অবনীন্দ্রনাথও নিন্দিত হলেন।' এদিকে নন্দলাল বলেন, 'বিলিতি-চীন-জাপানি-মোগল—এসব পদ্ধতি নিয়ে হলো ভারতশিল্পের রেনেসাঁর চেহারা।' এদিকে রসুল আলী যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম, সে কথাও গোপন থাকেনি।
বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় মনে করেন, দেশে ও বিদেশে অবনীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় চিত্রের পুনরুদ্ধার করেছেন বলে। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ কোনো দিন কোনো কিছু চেষ্টা করে পুনরুদ্ধার করতে চাননি। অলংকারশাস্ত্র তিনি পড়েছিলেন। 'ষড়ঙ্গ' লিখেছিলেন এবং 'ভারতশিল্প' গ্রন্থে ভারতীয় আদর্শ সম্পর্কে ওকালতি করেছিলেন, কিন্তু ছবি রচনার কালে সে মত অনুসরণ করেননি। সংক্ষেপে ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ এবং যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকলেও ভারতীয় চিত্র বা ভাস্কর্যের ভঙ্গিকে তিনি অনুসরণ করেননি। বস্তুরূপটা কিছুই নয়, ভাবপ্রকাশের জন্য অনুকরণের প্রয়োজন নেই—এই মতকে চরম নন্দনাদর্শ (aesthetic ideal) বলা যেতে পারে। এই মত ব্যক্তিগত; জাতিগত আদর্শ একে বলা চলে না। কাজেই নিঃসন্দেহে বলা চলে, অবনীন্দ্রনাথ কোনো দেশ বা কালের আদর্শ অনুসরণ করেননি, নিজের রুচির দ্বারা চালিত হয়েছেন। প্রাচীন ভারতীয় আদর্শ সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান ছিল, বুদ্ধি দ্বারা সে আদর্শকে তিনি জেনেছিলেন, কিন্তু অন্তরের সঙ্গে তিনি সে আদর্শ গ্রহণ করেননি বলেই মনে হয়। দেশি বা বিদেশি ছবির করণকৌশল এতদিন অচল অবস্থায় ছিল, অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে দুই কৌশল একত্র হয়ে সক্রিয় হয়ে উঠল।
অবনীন্দনাথের প্রতিভার সর্বপ্রধান দান এই। আধুনিক যুগের উপযোগী রূপকালের ভাষা আমাদের দিলেন; সে ভাষা যতই অর্বাচীন হোক, তবু সেই ভাষার দ্বারাই নিজেকে ব্যক্ত করবার সুযোগ পেলাম আমরা।
ঠাকুর পরিবারের পরিবেশ ভরপুর ছিল নানা বৈচিত্র্যে। ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত এবং বাংলা ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি চিত্রশিল্পের প্রতি গড়ে ওঠে তার এক সহজাত আকর্ষণ।
কলকাতার বিখ্যাত স্কুল অব আর্টে ভর্তি হন ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে। তার শিক্ষকদের তালিকায় ছিলেন ইতালির শিল্পী ওলিন্টো গিলার্ডি এবং ইংরেজ শিল্পী চার্লস পামার। প্রথমজন তাকে পেস্টেল ব্যবহারে দক্ষ করে তোলেন। আর দ্বিতীয়জন লাইফ স্টাডি, তৈলচিত্র সম্পর্কে তাকে গভীর জ্ঞান দেন। এ ছাড়া তৎকালীন সরকারি স্কুল অব আর্টের উপাধ্যক্ষ তাকে ইউরোপীয় চিত্রকলার ব্যবহৃত নানা কৌশল শেখান। এ ছাড়া শেখেন আরও বিভিন্ন চিত্র-কৌশল। এ সময়ই জলরঙের প্রতি প্রীতি তার মনে গেঁথে গেল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা ছিলেন গুনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা সৌদামিনী ঠাকুর। জোড়াসাঁকোতে তার জন্ম ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট। তার দাদা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন 'প্রিন্স' দ্বারকানাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র। এ সূত্রে রবীন্দ্রনাথ হলেন অবনীন্দ্রনাথের চাচা। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেন সুহাসিনী দেবীকে। তাদের এক ছেলে আলোকেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দুই কন্যা সরূপা ও উমা। সাধারণভাবে অবনীন্দ্রনাথ অবন ঠাকুর হিসেবেই পরিচিত।
সংস্কৃত কলেজে লেখাপড়া করেন ১৯৮১ থেকে ৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খামখেয়ালী সভার সদস্য ছিলেন। এটি ১৮৯০-এর কথা। সেখানে তিনি কবিতা পড়েছেন। নাটক করেছেন। ১৮৯৬-এ কলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করার সুযোগ পান। রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি ভারত সফরে আসেন ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে। আর্ট গ্যলারি পরিদর্শনের সময় ব্রিটিশ রাজ-দম্পতিকে ওরিয়েন্টাল আর্ট সম্পর্কে বোঝাবার দায়িত্বও বর্তায় তারই ওপর। ইংরেজে সরকার অবন ঠাকুরকে সিআইই উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তার ছবির মেলা বসেছিল লন্ডনে। সেটি ১৯১৩-এর কথা।
এ তো গেল চিত্রের কথা। কিন্তু সাহিত্যেও কম নন তিনি। অবনীন্দ্রনাথের জীবনে সবচেয়ে বড় এবং স্থায়ী প্রভাব ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাকে তিনি 'রবিকা' বলে ডাকতেন। অবন ঠাকুরের মধ্যে বহমান সাহিত্য ও চিত্রকলার ধারার মধ্যে কোনটা বলবান বলা কঠিন। গল্প শোনানোর জন্য যে ভাষা ব্যবহার করেন, তাকে অনুকরণীয় বলা ছাড়া উপায় নেই। ভাষার দমক এবং উপমার ঝংকার মিলেমিশে পাঠকের মনে শব্দগুলো ছবি হয়ে দেখা দেয়। 'রাজকাহিনী, ভূতপৎরীর দেশ, বুড়ো আংলা'য় পাঠক ছবির প্রবাহই দেখতে পায়।
তিনি রচনা করেছেন ছবি এবং সাহিত্য আর এই দুই ক্ষেত্রেই প্রধান হয়ে উঠেছে ভঙ্গিমা। অবনীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়, 'শব্দের সঙ্গে রূপকে জড়িয়ে নিয়ে বাক্য যদি হোলো উচ্চারিত ছবি, তার ছবি হোলো রূপের রেখায় রঙের সঙ্গে কথাকে জড়িয়ে নিয়ে রূপকথা।' অন্যদিকে যোগীও শিল্পীর তফাৎ বোঝাতে গিয়ে নন্দলাল বসুকে চোখ বন্ধ করে নয় বরং চোখ খুলে ধ্যান করার উপদেশ দিয়েছিলেন তিনি।
অবনীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রমথনাথ বিশী চিরকালীন এক সমস্যাকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির দুর্ভাগ্য এই যে অনেক সময়েই এক দিকের খ্যাতির তলে তাঁহার অন্যদিকের কৃতিত্ব চাপা পড়িয়া যায়; সব দিকে কৃতিত্ব কদাচিৎ সমানভাবে স্বীকৃত হয়। তার কারণ, প্রতিভার বহুমুখিতার প্রতি সাধারণ মানুষের কেমন যেন একটা অবিশ্বাসের ভাব আছে। তাই সে একটা মাত্র কৃতিত্বকে আদরে বাছিয়া লইয়া অন্যগুলোকে অবহেলা করে। পাঠকের রাসাস্বাদে বহুমুখিতার অভাব প্রতিভার বহুমুখিতার অস্বীকৃতির অন্যতম কারণ। অবনীন্দ্রনাথের প্রধান কৃতিত্ব তাঁহার চিত্রশিল্প, ইহাই তার প্রথম কৃতিত্ব। আর এই কৃতিত্বের আড়ালে তাঁহার সাহিত্যিক পরিচয় কেবল গৌণভাবেই প্রকাশিত।'
শিল্পীর বহুমুখিতা নিয়ে অবন ঠাকুরের কথাই হয়তো এ প্রসঙ্গে শেষ কথা হতে পারে। রানী চন্দের সুবাদে জানি, অবন ঠাকুর বলেন, 'শিল্পী যে, সে শুধু ছবিই আঁকবে কেন? তার সৃষ্টি যে রূপে ফুটে উঠবে, সেইদিকেই সে যাবে। সৃষ্টিকে ফুটিয়ে তুলবে। এক দিকে সার্থকতা না আসুক, অন্য দিকে আসবে।'
কালের সাক্ষী থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সৃষ্টিকে ফুটিয়ে তোলার কাজে অবনীন্দ্রনাথের স্বার্থকতা সব দিক থেকেই এসেছে। এ এক বিস্ময়।
নিজ জীবন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অবন ঠাকুর বলেন, নিজ জীবন নিয়ে বই লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বটতলার ছাপা 'হাজার জিনিসি' বইখানার চেয়েও মজার একখানা বই—তারই পাণ্ডুলিপি মাল-মসলা সংগ্রহ করে চলেছে আমার বয়সটা তখন। বড় হয়ে ছাপাবার মতলবে কিংবা শর্ট-হ্যান্ড রিপোর্টের মতো ছাঁটঅক্ষরে টুকে নিচ্ছে সব কথা—এ মনেই হয় না।
আজও যেমন বোধ করি—যা কিছু সবই—এর আমাকে আপনা হতে এসে দেখা দিচ্ছে—ধরা দিচ্ছে এসে এরা। খেলতে আসার মতো এসেছে, নিজে থেকে তাদের খুঁজতে যাচ্ছি না—নিজের ইচ্ছেমতো তারাই এসে চোখে পড়ছে আমার, যথাভিরুচি রূপ দেখিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে খেলুড়ির মতো খেলা শেষে।
পাশাপাশি ফলের বিচি খাওয়া নিয়ে ছোটকালের বিশ্বাসকে তুলে ধরেন এভাবে, 'কালো জামের বিচি পেটে গেলেই সর্বনাশ, মাথা ফুঁড়ে মস্ত জামগাছ বেরিয়ে পড়ে। আর কাগ এসে চোখ দুটোকে কালোজাম ভেবে ঠুকরে খায়।'
আমাদের ছোটকালেও ধারণা দেওয়া হয়েছিল, বিচি খেলে মাথা দিয়ে গাছ গজাবে। তবে 'কাগ'-এ চোখ ঠুকরে খাবে, সে কথা শুনিনি কখনো!
লেখা বা ছবি আঁকা কিংবা কুটুম-কাটামের কারিগর—যার কথাই ধরা হোক, সবখানেই অনায়াসেই মন পবনের নাওয়ে চড়ে অবাধে যাতায়াতে পটু ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শিল্পী মনে করেন, তার সৃষ্টির প্রাণ আছে। অবনীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন এক কাহিনি মুন্সিয়ানার সাথে তুলে ধরেন রানী চন্দ। তিনি লেখেন, 'এই কুটুম-কাটাম ছিল তাঁর অতি অন্তরঙ্গ জন। সেবারে "ঘরোয়া"র জন্য গল্প নিতে জোড়াসাঁকোর ছয় নম্বর বাড়িতে আছি, অবনীন্দ্রনাথ রোজ দু বেলা এসে গল্প বলে যান। একদিন আসতে দেরি দেখে ভাবলাম বুঝি বা শরীর খারাপ হয়েছে তাঁর। খবর নিতে ও-বাড়িতে গিয়ে দেখি তিনি বাগানের এক কোণে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, না, ও আর পাওয়া যাবে না, একেবারে গর্তে পালিয়েছে।'
আমার একটু অবাক লাগল। বললাম, কী খুঁজছেন আপনি?
বললেন, 'একটা ইঁদুর জ্যান্ত হয়ে আমার হাত থেকে লাফিয়ে কোথায় যে পালাল! ও ঠিক গর্তে ঢুকে বসে আছে।' ঘটনাটা হলো, 'এই এতটুকু' একটা ইঁদুর কাঠ দিয়ে তৈরি করেছিলেন। তাকে কোনোরকমে তারের লেজ দিয়ে মোচড় দিতেই টক করে হাত থেকে লাফিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল সে সময়। খুঁজে তাকে পাওয়া গেল না। এমনকি ইঁদুর না পেয়ে রাতে ভালো ঘুমও হয়নি। সকাল অবন ঠাকুর নিচে বাগানে খুঁজতে যান। পেলেন না। রানী চন্দকে বললেন, ও জ্যান্ত হয়ে একেবারে গর্তে ঢুকে মজা দেখছে। তবে হাল ছেড়ে দেননি। অতটুকু তারের নেজের কাঠের টুকরার ইঁদুরের খোঁজে তিন দিন সমানে বাগানের আনাচ-কানাচে ঘুরেছেন!
এ গল্প রবীন্দ্রনাথ শুনে সে কী হো হো হাসি। বললেন, 'অবন চিরকালের পাগলা।'
বয়সের তরী ৮০-এর ঘাটে ভেড়ার পর, ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তুলি-কলমের বাদশা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।