রক্তচোষার সত্য কথা
'জীবন এক পাগলা ঘোড়া'—কথাটা কিন্তু মোটেও মিথ্যে নয়। সে কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায়, মানুষের তা জানার সাধ্য নেই। সে একেক সময় একেক রূপে এসে হাজির হয় মানুষের দুয়ারে; ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় তাকে বরণ করে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
একসময় 'ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি' ছিল জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। পরবর্তীতে জীবন বদলে যায় অন্য রূপে। জড়িয়ে পড়ি অন্য এক জীবনধারায়। কেন জানি ফটোগ্রাফির ওপর থেকে মন উঠে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই এ জগতে এক বিশাল পরিবর্তন চলে এসেছিল তখন। একসময় যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ শুরু করতে হতো, সেখানে বলতে গেলে দেশের তাবৎ মানুষ রাতারাতি ফটোগ্রাফার বনে যায়। আসে ডিজিটাল ফটোগ্রাফির যুগ। আলোর তুলি দিয়ে ছবি আঁকার সেই সুনিপুণ শিল্পের বলতে গেলে অবসান ঘটে। তবু কিছু মানুষের কাজে আজও চোখ আটকে যায়। তাদের মাধ্যমে আলোকচিত্রের সীমাহীন রহস্যময় জগৎটি আবার সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক।
নিজের সংগ্রহ থাকা পুরোনো ছবি আর নেগেটিভ আজ নষ্ট হতে চলেছে। কিন্তু সেই সময়ের প্রতিটি স্মৃতি আজও বুকের গহিনে ঝকঝকে আলোকচিত্র হয়ে ফুটে আছে। তেমনি এক স্মৃতিময় দিনের কথাই আজ বলি।
সময়টা ২০০৩; ভাওয়াল গড়ের ধনপুর শালবনে প্রবেশ করেছিলাম কিছু পাখির ছবি ক্যামেরাবন্দী করার জন্য। আমার সঙ্গে সহকারী হিসেবে ছিল জামিল নামের এক কিশোর। শালবনের পাশেই তার বাড়ি। দারুণ চটপটে ছেলে, পাখি আর বন্য প্রাণী সম্পর্কে খুবই কৌতূহলী। এখানকার প্রায় সব প্রাণীর অবস্থান বলতে গেলে তার নখদর্পণে।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বেশ কিছু পাখির ছবি তুলে একখণ্ড বনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, জামিল আমার কাছ থেকে কয়েক হাত পেছনে। হঠাৎ আমাকে একটা ডাক দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। আমি ভাবলাম নতুন কোনো পাখি বা জন্তু তার চোখে পড়েছে। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না, স্পষ্ট আতঙ্কের ছবি ভেসে আছে সেখানে। এবার আমি ধরে নিলাম বিষাক্ত কোনো সাপ তার নজরে পড়েছে। দ্রুত তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে তখন কম্পমান হাতের ইশারায় আমাকে সামনের দিকে দেখবার ইঙ্গিত করে বলল, 'দাদা, সামনের দিকে চাইয়া দেখেন রক্তচোষা কেমনে আমার রক্ত খাইয়া ফেলতাছে।'
একটু ভালো করে তাকাতেই মাঝারি আকারের একটা শালগাছের গায়ে বসা প্রাণীটাকে দেখতে পেলাম, তার মুখ আর ফুলে ওঠা গলা আগুনের মতো টকটকে লাল হয়ে আছে। সে তখন সোজা তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। তার গলার রক্তলাল থলেটা টলটল করে নড়ছে। জামিল তার মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, 'দাদা, তাড়াতাড়ি ছবি তোলেন, তা না হলে আপনার শরীরের সব রক্ত রক্তচোষার পেটে চইলা যাইব।'
আমি তার কথা শুনে মনে মনে হেসে কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে রক্তচোষার কয়েকটা ছবি ক্যামেরাবন্দী করলাম। এরপর ক্যামেরাটা জামিলের হাতে দিয়ে বললাম, 'এদিকে আর তাকানোর দরকার নেই, তুমি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াও, আমি আসছি।'
অনেকের মতো জামিলেরও ধারণা এই প্রাণীর দিকে সরাসরি তাকালে মানুষের শরীরের সমস্ত রক্ত তার পেটে চলে যায়। এই ভাবনায় যেকোনো মানুষই মুহূর্তে আতঙ্কিত হয়ে উঠতে পারে।
জামিলকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি খুব সন্তর্পণে সামনে এগিয়ে গেলাম। তারপর সুযোগ বুঝে খপ করে রক্তচোষাটাকে ধরে ফেললাম। যদিও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির নিয়ম অনুযায়ী এটা করা মোটেই ঠিক হয়নি। কিন্তু আমার অন্য একটা উদ্দেশ্য ছিল—জামিলের মনের ভয় দূর করা। ধরার সময় রক্তচোষাটা আচমকা আমার হাতে কামড় দিয়ে বসল। প্রাণীটাকে হাতে নিয়ে আমি সোজা জামিলের সামনে এসে হাজির হলাম। কামড়ের স্থান থেকে তখন রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। তা দেখে জামিল চিৎকার করে বলে উঠল, 'আপনি তো আর বাঁচবেন না, দাদা। কথায় আছে, কক্কায় কামড় দিলে রক্ষা নাই (অনেকে এদের কক্কা নামেও ডাকে)।' এবার আমি না হেসে পারলাম না, জামিলকে খুলে বললাম রক্তচোষার আসল পরিচয়।
আমাদের দেশে সাপের পরে যে প্রাণীটিকে দেখলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে, সে হচ্ছে রক্তচোষা। দেশের বিভিন্ন স্থানে এরা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। কেউ ডাকে কক্কা, কেউ ডাকে কাকলাস, কেউ বলে চ্যাপা গিরগিটি। অদ্ভুত নাম আর অদ্ভুত পরিচয়ে যুগের পর যুগ ধরে সাধারণ এই গিরগিটিটি মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি করে রেখেছে। সত্যিই কি এরা রক্ত চুষে খায়? সত্যিই কি ওদের কামড়ে বিষ আছে? আসল কথা হচ্ছে এগুলো সম্পূর্ণই ভুল ধারণা। সাধারণ এক গিরগিটির পক্ষে কোনো অবস্থাতেই দূর থেকে মানুষের রক্ত চুষে খাওয়া সম্ভব নয়। আসলে এদের চেহারার আকৃতিতেও কিছুটা কিম্ভূতকিমাকার। খুব চিকন ধরনের শরীর, লম্বা লেজ, ভোঁতা মাথা, শরীরভর্তি আঁশ, পিঠের ওপরে কাঁটার সারি—এসব বৈশিষ্ট্যই এদের চেহারাকে সাধারণের দৃষ্টিতে অদ্ভুত করে তুলেছে; অনেকের মনে ধারণা জন্মেছে, প্রাণীগুলো বিষাক্ত। তবে এটা একেবারেই মিথ্যা। আমার দৃষ্টিতে এরা খুবই সুন্দর একটি প্রাণী। এদের ইংরেজি নামটিও সুন্দর: Oriental garden lizard. আর বৈজ্ঞানিক নাম Calotes versicolor.
এই প্রাণীগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা ইচ্ছে করলেই নিজেদের দেহের রং পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে রঞ্জক কোষ এবং ক্রোমাটোফোরের স্থানান্তরের কারণে রক্তচোষার গায়ের রঙের হেরফের ঘটে থাকে। আর এ কাজটি তারা করে থাকে আত্মরক্ষার তাগিদে অথবা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে কিংবা প্রজননের তাড়নায়। নিজেদের জন্য হুমকিস্বরূপ যেকোনো প্রাণী, যেমন মানুষ, এদের অবস্থানের কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে এরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তখনই নানা রঙের ছটায় ভরে যেতে থাকে এদের শরীর। সে সময় এদের ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত যেসব রঙের পরিবর্তন ঘটে, তা মানুষের অনুভূতিকে স্পর্শ করে না। তবে যখন মুখ আর গলার রং হয়ে ওঠে তীব্র লাল, তখনই মানুষের মনে ভীতির বোধ জাগ্রত হয়ে ওঠে। আর চিন্তাশক্তি হয়ে যায় এলোমেলো।
'রক্তচোষা চোখ দিয়ে তাকিয়ে মানুষের রক্ত খেয়ে ফেলে'—এই ভ্রান্ত ধারণাটি ওই এলোমেলো চিন্তারই ফসল। কী অদ্ভুত ঘটনা, সাধারণ এক গিরগিটি হয়ে উঠেছে ড্রাকুলার প্রতিমূর্তি। তবে রক্তচোষার রক্তিম রূপ শুধু বাঙালিদেরই নয় ইংরেজদেরও বিভ্রান্ত করেছিল। তাই তো তারা একসময় এদের নাম দিয়েছিল Blood Sucker.
রক্ত নয়, এই গিরগিটিদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে পোকামাকড়। ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ ভক্ষণ করে এরা একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, অন্যদিকে রক্ষা করে কৃষকের খেতের ফসল। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে শুধু নামের (নাকি দুর্নাম) কারণে অজস্র রক্তচোষা মানুষের হাতে মারা পড়ে। পরিবেশবান্ধব এই প্রাণীটির দুর্নাম ঘুচে যাক; মানুষ জানুক, রক্তচোষা আমাদের শত্রু নয়, উপকারী এক বন্ধু।