কে বেশি বাঁচে? পুরুষ না নারী?
দাদির মাথায় যতো চুল নাতি বা নাতনি যেন তত বছর আয়ু লাভ করে এই প্রার্থনা শুনলে শৈশবে খুশি হলেও বার্ধক্যে এসে আতঙ্কিরত হতে হয়। জাপানি দাদিরা এমনই আর্শীবাদ করেছিলেন কি না কে জানে। জাপান এখন বুড়ো মানুষদের দেশ, আয়ুষ্মানদের দেশ।
জন্মের পর প্রথম ক্রন্দন থেকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন যে সময়টুকু, সেটাই আয়ু। যিশু খ্রিষ্টের আয়ু ৩৩ বছর, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আয়ু ৬৩ বছর। হযরত মুসা (আ) যখন ফেরাউনের মোকাবেলা করেন, তখন তার বয়স ৮০ বছর। তিনি ১২০ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের আয়ু ২১, রবীন্দ্রনাথের ৮০ বছর।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত মানুষ একজন নারী। তিনি স্পেনের মারিয়া ব্র্যানিয়াস, বয়স ১১৬ বছর ৪ মাস। আর সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষ হচ্ছেন ভেনেজুয়েলার ইউহান ভিসেন্তি। বয়স ১১৪ বছর ১ মাস। প্রতিযোগিতায় পুরুষ পিছিয়ে আছে। ২০২১ সালের হিসেবে পুরুষের গড় আয়ু ৬৮.৯ বছর আর নারীর ৭৩.৯ বছর।
উদ্দেশ্য নিয়েই হোক কিংবা উদ্দেশ্যহীনভাবেই হোক, মৃত্যুপূর্ব যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ, এই কালটাই আয়ু।
পুরুষের আয়ু আর নারীর আয়ু সম্ভবত এক ধরনের নয়। লোককথার একটি বয়সকাহিনী হুমায়ূন আহমেদ তার নাটকে আবুল হায়াতকে দিয়ে কয়েকজন কিশোরীকে শুনিয়েছেন। শুনে তাদের চক্ষু ছলছল। কাহিনীটা অনেকটা এরকম:
সৃষ্টিকর্তা গাধা সৃষ্টি করে তার পঞ্চাশ বছর আয়ু দিলেন এবং বললেন তোর কাজ কেবল বোঝা বয়ে বেড়ানো। গাধা বলল, পঞ্চাশ বছর অনেক দীর্ঘ সময়, আমি কুড়ি বছরে বেশি আয়ু চাই না। প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। তারপর কুকুর সৃষ্টি করে ৩০ বছরের আয়ু দিলেন এবং বললেন, তোর কাজ মানুষের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেড়ানো। কুকুর বলল, উচ্ছিষ্ট খেয়ে এত বছর বাঁচতে চাই না। ১৫ বছর হলেই চলবে। প্রার্থনা কবুল হলো।
তারপর বানর সৃষ্টি করে ২০ বছর আয়ু দিলেন আর বললেন, তোর কাজ এ ডাল থেকে ও ডাল ঘুরে বেড়ানো আর মানুষকে আনন্দ দেওয়া। বানর বলল, এতদিন এ কাজ করতে পারব না, আমাকে দশ বছরের আয়ু দিন। তা-ই মঞ্জুর হলো।
এবার এলো পুরুষ মানুষ, সৃষ্টির সেরা ও বৃদ্ধিমান। স্রষ্টা তাকে আয়ু দিলেন ২০ বছর। শুনেই বুদ্ধিমান পুরুষের মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, এতো কম। তুমি বরং গাধার ছেড়ে দেওয়া ৩০ বছর কুকুরের ছেড়ে দেওয়া ১৫ বছর এবং কুকুরের ছেড়ে দেওয়া ১০ বছর যোগ করে আমাকে দিয়ে দাও। কুড়ি বছর বড্ড কম সময়। তুমি তো দয়ার সাগর। দাও না, প্লিজ। স্রষ্টা তা-ই করলেন, কুড়ির সাথে আরও ৫৫ বছর যোগ করে গড়পড়তা ৭০ বছর আয়ু দিলেন।
এ জন্য পুরুষ মানুষ নিজের আয়ু নিয়ে পুরুষের মতো বাঁচে ২০ বছর। সংসারের বোঝা টেনে গাধার মতো বাঁচে ৩০ বছর, সংসারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে কুকুরের মতো বাঁচে ১৫ বছর আর এক ছেলের বাড়ি থেকে অন্য ছেলের বাড়ি গিয়ে নাতি-নাতনিদের হাসিয়ে বানরের মতো বাঁচে আরো ১০ বছর।
আবুল হায়াতের পাশে থাকা কিশোরীদের চোখ ছলছল করতে থাকে; আহা রে পুরুষ মানুষের কতো কষ্ট।
নারীর কি কষ্ট নেই?
গড়পড়তা নারীর আযু পুরুষের চেয়ে বেশি।
এমনিতেই পুরুষ অপেক্ষাকৃত কমবয়সী নারীকে বিয়ে করে। সঙ্গত কারণেই মৃত্যুশয্যায় পুরুষই আগে আসে। মরার সময় স্ত্রীকে কী দিয়ে গেল এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলে। উল্টোটা ঘটার নজির দুর্লভ।
হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফ্যাকান্টি ডাক্তার রবচার্ট স্মেরলিংকে তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন তুমি কেনো ধরে নিচ্ছে যে তুমি আমার আগে মারা যাবে?
তার এক শব্দের জবাব: পরিসংখ্যান। তিনি বললেন আমেরিকাতে ৮৫ বছরের উপরে যারা বেঁচে আছে তাদের ৬৭ ভাগ নারী, আর ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৫৭ ভাগ নারী।
স্বামী ও স্ত্রী সমবয়সী হওে পরিসংখ্যানের হিসেবে স্বামীরই আগে মরার কথা।
পুরুষের কেন আয়ু কম?
রবার্ট স্মেরলিং কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন:
পুরুষ বড় ধরনের ঝুঁকি নেয়: কারণটা বায়োলজিকাল নিয়তি। মস্তিষ্কের সামনের অংশ ফ্রন্টাল লোব পরিস্থিতি বিচার করা ও পরিণতি আচ করার কাজ করে থাকে। এই অংশের বিকাশ ছেলেদের বেলায় শ্লথগতিতে হয়। একই বয়সী মেয়ের বিচারবোধ তখন অধিকতর পরিণত হয়ে উঠে। দুর্ঘটনা ও সহিংসতায় এ কারণে ছেলেদের মৃত্যুহার মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। ধূমপান, মাদক সেবন ও বেপরোয়া জীবনযাপন তাদের মধ্যেই বেশি, তা সবদেশেই।
পুরুষ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ নিয়োগপ্রাপ্ত: যুদ্ধ, অগ্নিনির্বাপন এবং নির্মাণকাজে এক চেটিয়াভাবে পুরুষনির্ভর, মৃত্যুঝুঁকি এখানে বহুগুণ বেশি।
কম বয়সে হৃদরোগে বেশি মারা যায়: কম বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পুরুষর মৃত্যুর হার নারীর চেয়ে অনেক বেশি। পুরুষের অ্যাস্ট্রোজেন হরমোন লেভেল নারীর চেয়ে কম হওয়া এর একটি কারণ হতে পারে। তবে পুরুষের বেলায় উচ্চ রক্তচাপও ঝুকিবহুল কলেস্টোরেল লেভেলেরও ভূমিকা রয়েছে।
নারীর চেয়ে বৃহৎ দেহধারী: প্রাণী জগতে দেখা যায় বড় আকারের প্রাণী কম বয়সে তুলনামূলকভাবে বেশি মারা যায়। পুুষের তুলনামূলক দেহকাঠামোর এ ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়।
আত্মহত্যাপ্রবণতা পুরুষের বেশি: বিষণ্নতা ও মানুষিক চাপে পুরুষ দ্রুত রেহাই পেতে আত্মহত্যা নিশ্চিত পথ বেছে নেয়। পুরুষ প্রকৃতিগত কারণে তার মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি শেয়ার করতে এবং কারো উপর নির্ভর করতে চায় না।
অসামাজিক ধরনের পুরুষের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি: একই বয়সী অসামাজিক পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় পুরুষের কম বয়সে মৃত্যু হার বেশি।
পুরুষ ডাক্তার এড়িয়ে চলে: এই প্রবণতাটি বৈশ্বিক। তারা নিয়মিত মেডিক্যাল চেকআপ করায় না, ডাক্তার এড়িয়ে চলে, বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও অনেক সময় স্বয়ংক্রিয় সুস্থ্যতা প্রত্যাশা করে। ফলে মৃত্যুহার তাদের তুলনামূলকভাবে বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা নারীর বেশিদিন বেঁচে থাকা ও পুরুষের পিছিয়ে পড়াকে অংশত জিন এর গঠনের দায় বলে উল্লেখ করেছ। ব্যাপারটা জেনেটিক। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের গবেষণা দেখিয়েছে নারী ভ্রুণের চেয়ে পুরুষ ভ্রুণ অধিকতর মৃত্যুপ্রবণ। বেশি বয়সে গর্ভধারনের ক্ষেত্রে সমীক্ষা দেখাচ্ছে পুত্রশিশুর মৃত্যুর গড় কন্যাশিশুর চেয়ে কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ বেশি। হরমোনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নারীর বেলায় তার হরমোন এসট্রোজেন মন্দ কলেস্টোরেল (এলডিএল) কমিয়ে আনে আর পুরুষের বেলায় তার হরমোন টেস্টোস্টেবল মন্দ হরমোনের বৃদ্ধি সহায়ক এবং ভালো কলেস্টোরেল (এইচডিএল) হ্রাস কারক।
২০২৩ সালের হিসেবে বাংলাদেশে নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭১.৭ বছর এবং পুরুষের ৬৭.৯ বছর। পৃথিবীতে এখনো পুরুষের সংখ্যা বেশি। প্রতি ১০১ জন পুরুষের বিপরীতে ১০০ জন নারী (২০২১ সালের হিসেব)।
জন্মলগ্নে প্রত্যাশিত আয়ু
লাইফ এক্সপেক্টেন্সি অ্যাট বার্থ বা জন্মলগ্নে প্রত্যাশিত জীবন একটি পরিসংখ্যান। ফরাসি নারী জিন ক্যালমেন্ট রেকর্ডভুক্ত সবচেয়ে বেশি আয়ু লাভ করা মানুষ। তার জন্ম ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫। মৃত্যু ৪ আগস্ট ১৯৯৭। তিনি বেঁচে ছিলেন ১২২ বছর ১৬৪ দিন। কেউ কেউ ৯০০ বছরও বেঁচে ছিলেন পুরানে ও লোকগল্পে এসব দেখা যায়। এ সবের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, সুতরাং পরিত্যাজ্য।
প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের গড় আযু ২২ বছর। নব্য প্রস্তুর যুগে ২০ বছর (মহামারী ঘটে থাকলে আয়ু কমে আসার যৌক্তিক। ব্রোঞ্জ যুগে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ বছর। ধ্রুপদী গ্রিক এ ২৫ থেকে ১৮ বছর। প্রাচীন রোমে ২০-৩৩ বছর। পঞ্চম থেকে দশম শতকের ইউরোপে ৩০ থেকে ৩৫ বছর। ১৬ থেকে ১৮ শতকের ব্রিটেনে ৩৩ থেকে ৪০ বছর উনবিংশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে ৪০ বছর।
১৯০০ সালে পৃথিবীতে মানুষের গড় আয়ু ৩১ থেকে ৩২ বছর; ১৯৫০ পরবর্তী ৬০ বছরের গড় ৪৫.৭-৪৮ বছর এবং ২০১৯-২০২০ এ গড় দাঁড়িয়েছে ৭২.৬ থেকে ৭৩.২ বছর। এই কমবর্ধমান প্রবণতাটি অব্যাহত আছে। তবে কলেরা, প্লেগ, এইডস, কোভিড মহামারী প্রত্যাশিত গড় আয়ুতে বড় ধরনের আঘাত করেছে।
দীর্ঘায়ু ক্রদেপের ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ
ষাট বছর বয়সে সৃষ্টিশীল মানুষ মরে যাবে আর কচ্ছপ বেঁচে থাকবে তিনশত বছর—এটা মেনে নেওয়া যায় না। ক্যান্সারাক্রান্ত হুমায়ূন আহমেদও এই আপসোসটি করে গেছেন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আয়ু পেয়েছিলেন মাত্র তেত্রিশ বছরের, রণাঙ্গনে তার মৃত্যু হয়নি। যীশু খ্রিষ্ট যখন ক্রুশবিদ্ধ হন তিনিও ছিলেন ৩৩ বছর বয়সী। মার্টিন লুথার কিংভুলিয়র এবং ম্যালকম এক্সাক আততারীর হাতে নিহত হয় ৩৯ বছর বয়সে; ম্যারিলিন মনরো, ডায়ানা প্রিন্সেস অব ওয়েলস, শিল্পী বব মার্লে তিনজন ৩৬ বছর আয়ু পেয়েছেন, ম্যারিলিন বিদায় নিয়েছেন অতিরিক্ত বার্বিচুয়েট সেবন করে ডায়ানা সড়ক দুর্ঘটনা এবং বব মার্লে ফুসফুস ও মস্তিষ্কের ক্যান্সারে। মার্শাল আর্টের ক্রস লি মারা গেলেন ৩২ বছর বয়সে সিলভিয়া প্লাথ ৩০-এ। সঙ্গীত শিল্পী জিমি হেন্ডরিক্স, রব শিল্পী জিম মরিমল চলে গেলেন ২৭ বছরে। আমাদের সুকান্ত ভট্টাচার্য তো তিরিশও ছুতে পারেননি। অথচ ১৮৩৫ এ বিগল জাহাজে অভিযাত্রার সময় চার্লস ডারউইল গ্যালাপাগেসি দ্বীপপুঞ্জ থেকে ডিনারের থালার আকৃতির যে কচ্ছপট দুটোকে ধরে এনেছিলেন তাদের একটি নাম হ্যারিয়েট ২০০৬ সালে যখন মারা যায় কি যে দুঃখ মানুষের। আর ডারউইন কবেই মরে ভূত। একই বছরকোলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় অদ্বৈত নামের যে কচ্ছপটি মারা গেল তার জন্ম রবীন্দ্রনাথের বাবা ঠাকুর দেবেন্দ্রনাথেরও বাবা দ্বারকানাথের আগে জন্মগ্রহণ করেছে। মৃত্যুকালে অদ্বৈতের বয়স হয়েছিল ২৫৫ বছর।
গ্রিনল্যান্ডের হাঙ্গরের আয়ু গড়পড়তা ৪০০ বছর। কই মাছ ২০০ বছর বেঁচে থাকার রেকর্ড করেছে। তিমির আয়ু ২০০ বছর ছাড়িয়ে। সামুদ্রিক স্পঞ্জ প্রাণীর আয়ু শুনলেই থ হয়ে থাকতে হবে—ডিপসি স্পঞ্জ (মনোরাফিন চুনি) যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও ৯ হাজার বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছে।