শার্লক হোমসের পেছনে দাঁড়িয়ে কে?
কে বড়, সৃষ্টিকর্তা না তার সৃষ্টি?
সৃষ্টি যদি স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, স্রষ্টাকে বরং সার্থক বলা হয়। শার্লক হোমস পৃথিবীজুড়ে যতটা পরিচিত, এই গোয়েন্দার স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল মোটেও ততটা নন। জীবদ্দশায় তাকে শার্লক হোমসের নাম বলে পরিচয় দিতে হতো। যেন শার্লক হোমস করুণা করে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
গিনেসের রেকর্ড বইয়ে শার্লক হোমস প্রায় স্থায়ী একটি আসন দখল করে আছেন পৃথিবীর সর্বাধিক অভিনীত চলচ্চিত্র চরিত্র হিসেবে। নির্বাক যুগে ১৯০০ সালে তাকে নিয়ে প্রথম সিনেমা 'শার্লক হোমস ব্যাফল্ড'। এখনো ছয় কুড়ি বছর পেরিয়ে প্রতিবছর কোনো না কোনো দেশে খ্যাতিমান কোনো এক অভিনেতা শার্লক হোমস চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত দুই শতাধিক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, অন্তত ৭০ জন বিখ্যাত অভিনেতা নিজেদের শার্লক হোমস হিসেবে চলচ্চিত্রায়িত হতে দেখেছেন।
শার্লক হোমস
আর্থার কোনান ডয়েলের কাছ থেকে ধার নিয়ে এই গোয়েন্দাকে অন্যতম চরিত্রে রেখে কাহিনি রচনা করেছেন অ্যান্থনি বার্জেস, ডরোথি হিউজেস, স্টিফেন কিং, পি জি উডহাউস, এ এ মিলনে, নেইল গেইম্যান, জন ডিক্সন কার এবং আরও অনেকে।
শার্লক হোমস প্রায় সব ভাষার শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা লেখকদেরও প্রভাবিত করেছে। বাংলা সাহিত্যের দুই প্রধান গোয়েন্দা ব্যোমকেশ ও ফেলুদা শার্লক হোমসের কায়দাকানুন এবং অনুসন্ধান-পদ্ধতি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছেন। এমনকি আগাথা ক্রিস্টিও শার্লক হোমস প্রভাবিত হয়ে লিখেছেন দীর্ঘদিন।
স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের প্রথম উপন্যাস 'আ স্টাডি ইন স্কারলেট' ১৮৯০ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আর শার্লক হোমস নামের প্রাতঃস্মরণীয় গোয়েন্দা চরিত্রটিও আবির্ভূত হয় এই উপন্যাসে। সঙ্গে ডাক্তার জন ওয়াটসন।
শার্লক হোমসের গোয়েন্দাগিরির ক্ষমতা নির্ধারণের জন্য ওয়াটসন শুরুতেই তার সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন পেশ করেন: সাহিত্যজ্ঞান: শূন্য; দর্শনজ্ঞান: শূন্য; মহাকাশজ্ঞান: শূন্য; রাজনৈতিক জ্ঞান: কিঞ্চিৎ; উদ্ভিদজ্ঞান: কোনোটা কম কোনোটা বেশি; বেলাডোনা, আফিম ও কিছু বিষাক্ত বৃক্ষ ভালোই চেনে, কিন্তু বাগান করা সম্পর্কে কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই; ভূতাত্ত্বিক জ্ঞান: বাস্তব জ্ঞান আছে, কিন্তু তা সীমিত; একনজর দেখেই বলতে পারে কোনটা কোন ধরনের মাটি। আমরা হেঁটে আসছিলাম, তার ট্রাউজারে বিভিন্ন রকম রং লেগে যায়। রং দেখে তিনি বলে দিলেন লন্ডন শহরের কোন অংশ থেকে কোন রং লেগেছে। রসায়নজ্ঞান: গভীর; দেহবিদ্যা: যথার্থ, তবে পড়াশোনা পদ্ধতিগত নয়। লোমহর্ষ ঘটনার জ্ঞান: দারুণ; এই শতাব্দীতে যত ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে, তিনি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান রাখেন...এ বিবরণ আরও দীর্ঘ।
এই কাহিনিতেই দেখা যায় শার্লক হোমসের ল্যাটিন ভাষাজ্ঞান বেশ সন্তোষজনক। 'আ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া' উপন্যাসে এসে প্রমাণিত হয়, তার রাজনীতিজ্ঞান মোটেও শূন্য নয়। তারপর অন্য কাহিনিতে এসে দেখা যায় চরিত্রটি শেক্সপিয়ার এবং গ্যেটে থেকে একনাগাড়ে উদ্ধৃতি দিচ্ছে, বাইবেলের উদ্ধৃতিও ছাড়ছে না; গুস্তাব ফ্লবেয়র ও জর্জ স্যান্ডের লেখা থেকে গোয়েন্দাপত্রের উদ্ধৃতি দিচ্ছে মূল ফরাসি ভাষায়। 'দ্য হাউন্ড অব বাস্কারভিল'-এ এসে যশুয়া রেয়নল্ড ও মার্টিন জোলারের রচনা তিনিই শনাক্ত করছেন। গুপ্তলেখাবিদ্যা তিনি বেশ ভালো বোঝেন এবং ডিসাইফার করতে পারেন। পায়ের ছাপ, খুরের ছাপ, বাইসাইকেলের ট্র্যাক বিশ্লেষণ করতে জানেন, সিগারেটের ছাই ও সিগারেটের বাঁট বিশ্লেষণ করে অপরাধী শনাক্ত করতে পারেন। তিনি আঙুলের ছাপও পাঠ করতে পারেন।
শার্লক হোমস তার গোয়েন্দাবৃত্তিতে 'অ্যাবডাকশন রিজনিং' এবং 'ডিডাকশন রিজনিং'- দুটোই ব্যবহার করেন। সবকিছু মিলিয়ে শার্লক হোমস ও গোয়েন্দা- এই দুটি প্রত্যয় পরস্পরের মধ্যে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে যে শার্লক হোমস মানেই দাঁড়িয়েছে একজন সফল গোয়েন্দা।
'আ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া'তে শার্লক হোমস বলেছেন, 'আপনি দেখেন আর আমি পর্যবেক্ষণ করি, তফাতটা এখানেই।' 'আ স্টাডি ইন স্কারলেট'-এ তিনি বলেন, 'আমি তাদের গল্প শুনি, তারা শোনে আমার মন্তব্য। তারপর আমার পাওনা ফি' টা আমি পকেটে পুরে ফেলি।'
শার্লক হোমস থাকতেন একটি বাস্তব ঠিকানায়, ২২১ বি বেকার স্ট্রিট।
জোসেফ বেল (২ ডিসেম্বর ১৮৩৭- ৪ অক্টোবর ১৯১১)
আর্থার কোনান ডয়েল ডাক্তারি পাস করে ১ নম্বর বুশ ভিলা, এলম গ্রোভ, সাউথ সি, প্লাইমাউথে বাড়ি ভাড়া করে চেম্বার খুললেন। ডাক্তারি করার পাশাপাশি এ বাড়িতে বসবাসও শুরু করে দিলেন। শার্লক হোমসের হাত নিশপিশ করছিল; হাত নিশপিশ করা একটি দুরারোগ্য ব্যাধি, যাতনা কমাতে তিনি লেখায় হাত দেন। যা হবার তা-ই হলো। ব্যাধি এতটাই প্রকট হয়ে উঠল যে তিনি ডাক্তারি লাটে উঠিয়ে পুরোদস্তুর কলমবাজি শুরু করলেন।
১৮৮৭ সালে প্রকাশ করলেন 'আ ট্যাঙ্গলড স্কিইস্ফ'। এই উপন্যাসেই ৩৩ বছর বয়স্ক শার্লক হোমসের জন্ম। কিন্তু শুরুতে নাম দিয়েছিলেন 'শেরিঙ্গফোর্ড হোমস'। তিনি কাহিনির প্রস্তাবিত অপর দুই ভাই শার্লক ও মাইক্রফটের বড় ভাই। নামটা জুতসই হয়নি মনে করে নাম দিলেন শার্লক হোমস। উপন্যাসটির নামও বদলালেন: 'আ স্টাডি ইন স্কারলেট'। শার্লক হোমস বিয়েশাদি করেননি। বেকার স্ট্রিটের বাড়িতে তার গৃহকর্ত্রী ছিলেন মিসেস হাডসন।
এটা প্রায় প্রতিষ্ঠিত যে জোসেফ বেল নামের স্কটিশ সার্জন এবং এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের লেকচারার আর্থার কোনান ডয়েলের কাছে শার্লক হোমস হয়ে ধরা দিয়েছেন। শার্লক হোমসের সত্যানুসন্ধান-সাফল্য অনেক সময়ই ঐশ্বরিক বলে মনে হয়েছে। আর্থার কোনান ডয়েল আবির্ভাবের মাত্র বছর না যেতেই শার্লক হোমসকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যিস মারেননি।
জোসেফ বেলের জন্ম ২ ডিসেম্বর ১৮৩৭, মৃত্যু ৪ অক্টোবর ১৯১১। তার বাবা বেঞ্জামিন বেল (১৮১০-১৮৩) এবং মা সিসিলিয়া বারবারা ক্রেইগি (১৮১৩-১৮৮২)। জোসেফ বেলের প্রপিতামহ বেঞ্জামিন বেল সেকালের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ফরেনসিক সার্জন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এডিনবরা মেডিকেল স্কুলের মেধাবী ছাত্র জোসেফ বেল ১৮৫৯ সালে এমডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার অভিসন্দর্ভের শিরোনাম, 'এপিথেলিয়াল ক্যানসার: ইটস প্যাথলজি অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট'। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি রয়্যাল মেডিকেল সোসাইটির সদস্য হন এবং সেখানে তার গবেষণালব্ধ বিষয় উপস্থাপন করেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ম্যানুয়াল অব দ্য অপারেশনস অব সার্জারি ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়। ৪ অক্টোবর ১৯১১ তিনি মৃত্যুবরণ করেন, এডিনবরার ডিন সিমেটারিতে মৃত স্বজনদের মাঝে তাকে সমাহিত করা হয়।
১৮৭৭ সালে জোসেফ বেলের সাথে আর্থার কোনান ডয়েলের সাক্ষাৎ। আর্থার তার কেরানি হিসেবে এডিনবরা রয়্যাল ইনফার্মারিতে চাকরি নেন। পরবর্তী সময়ে আর্থার কোনান ডয়েল যখন রহস্য ফিকশন লিখতে শুরু করলেন দেখা গেল শার্লক হোমস চরিত্রটি খানিকটা তার বসের চরিত্রের ওপর ভিত্তি করেই লেখা হচ্ছে। বিষয়টি জোসেফ বেল নিজেও জানতেন। আরও নিশ্চয়তা পাওয়া গেল জোসেফ বেলের কাছে লেখা আর্থারের একটি চিঠি থেকে: 'এটা অবশ্যই আপনার কাছ থেকে, শার্লক হোমসের জন্য আমি ঋণী।'
একেকটা শার্লক হোমস কাহিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতো আর আর্থার তার একটি কপি ডাক্তার জোসেফ বেলের কাছে পাঠাতে দেরি করতেন না। এটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল যে আর্থার তার শার্লক হোমসকে তুলে এনেছেন বাস্তব মানুষের জীবন থেকে। নতুন কোনো শার্লক হোমস গ্রন্থ প্রকাশিত হলে অমনি লোকজন জোসেফ বেলের প্রশংসা করত, তাকে নিয়ে আরও কৌতূহলী হয়ে উঠত। কিন্তু ডাক্তার বেল কৃতিত্ব দিতেন লেখককে, বলতেন, 'আর্থার কোনান ডয়েল একজন জাত লেখক।' শার্লক হোমসের যেমন ডাক্তার ওয়াটসন, তেমনি বাস্তবের ডাক্তার বেলের জন্য ছিলেন আর্থার কোনান ডয়েল। ওদিকে আর্থার আনুষ্ঠানিকভাবে পত্র লিখে তার প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন এবং বারবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
শার্লক হোমস ও ডাক্তার ওয়াটসন
ডক্টর জোসেফ বেল শার্লক হোমসের মতো অসাধারণ পর্যবেক্ষণক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তিনি নাবিকের ট্যাটু দেখে বলে দিতেন তারা কোন বন্দর থেকে এসেছে, কণ্ঠস্বর শুনে বলে দিতেন তার কাছে আসা মানুষটি দেশের কোন অঞ্চলের। করতল দেখে বলতেন তার পেশা কোনটি। কোটের বুকপকেটে করে কেউ বোতল আনত, সে যে অ্যালকোহলে আসক্ত, এ নিয়ে জোসেফ বেল কোনো সন্দেহ পোষণ করতেন না। পাজামার হাঁটুর কাছে ছেঁড়া দেখে তিনি বলতেন মানুষটি কীভাবে জীবন ধারণ করছে। মানুষের আচরণ, মুদ্রাদোষ ইত্যাদির পর্যবেক্ষণ করে জোসেফ বেল রোগ নির্ণয় করতেন, সেভাবেই প্রতিবেদন দিতেন।
আর্থার কোনান ডয়েল বেলকে নিয়ে লিখেছেন:
বেল রোগীকে কিছুক্ষণ দেখে বললেন, বেশ বাবা, তুমি তো সেনাবাহিনীতে ছিলে?
রোগীর উত্তর, জি স্যার।
বরখাস্ত হয়েছ, খুব বেশি দিন আগে নয়।
জি না, স্যার। অনেক আগে।
হাইল্যান্ড রেজিমেন্টে, তাই না?
জি স্যার।
ননকমিশন্ড অফিসার তো?
জি স্যার।
ডাক্তার বেল এবার শিক্ষার্থীদের বললেন, 'জেন্টলম্যান, এই মানুষটি শ্রদ্ধাভাজন, কিন্তু তিনি তার হ্যাট খোলেননি। আর্মিতে তা করা হয় না। কিন্তু এই লোকটি তো বহু বছর আগে বরখাস্ত হয়েছে। এত দিনে তার বেসামরিক আচরণ শিখে নেওয়া উচিত ছিল।
একজন রোগীকে চেম্বারে প্রবেশ করতে দেখেই তিনি রোগ নির্ণয় করতে পারতেন বলে আর্থার কোনান ডয়েল সাক্ষ্য দিয়েছেন।
৪ অক্টোবর ১৯১১ তার মৃত্যু হলে লন্ডনের 'দ্য টাইমস' লিখেছে, জোসেফ বেল ছিলেন একজন বিশেষ মানুষ। অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল তার।
বেল যদি বেঁচে থাকতেন, দেখতেন, শার্লক হোমসের জনপ্রিয়তা তার মৃত্যুর শত বছর পরও কতটা তুঙ্গে।
আর্থার কোনান ডয়েল ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের এমসিসি-মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে দশটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচও খেলেছেন। তিনি মূলত ব্যাটসম্যান, তবে ডব্লিউ জি গ্রেসের উইকেট নেবার কৃতিত্বও তার রয়েছে। ক্রিকেটে সেঞ্চুরি না থাকলেও রহস্য সমাধানে তার সেঞ্চুরি অবশ্যই হয়েছে। তার সমকক্ষ সেঞ্চুরিয়ান আর কেউ নেই।