সমুদ্র লুণ্ঠন, মাছের লড়াইয়ের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব
শ্রীলঙ্কার মৎস্যজীবীরা উপকূল থেকে উঠে এসে রাজধানী শহর কলম্বোতে জমায়েত হয়েছে, বিক্ষোভ করেছে, তাদের সমুদ্রসীমানায় ভারতীয় ট্রলারের অনুপ্রবেশ ও অবাধ মৎস্য এবং সমুদ্র সম্পদ লুণ্ঠনের প্রতিবাদে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশে তুলেছে, নিজেদের সরকারের ব্যর্থতার নিন্দা করেছে। তাদের জীবিকার ওপর হাত পড়েছে, বিদেশি লুণ্ঠনকারীর সাথে লড়াই করতে গিয়ে তাদের সদস্যরা জীবনও দিয়েছে।
অনুপ্রবেশকারী ফিশিং ট্রলার কেবল জেলে আর জাল নিয়ে ঢোকে না, মারণাস্ত্রও সাথে রাখে। কখনো কখনো শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী দেশাত্মবোধের পরিচয় দিয়ে থাকে বলে তারা জানায়, কিন্তু তাদের সামর্থ্য কম। একটি ঘটনায় শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী সশস্ত্র মৎস্য লুণ্ঠনকারীদের ওপর চড়াও হয়েছিল, তাতে পাঁচজন বহিরাগত লুণ্ঠনকারী নিহত হয়েছে। অবশ্য শ্রীলঙ্কা সরকার শক্তিশালী প্রতিবেশীর সাথে দ্বন্দ্ব এড়াতে বিষয়টি স্বীকার করেনি। কেবল বলেছে নৌবাহিনী ধাওয়া করে তাদের সমুদ্রসীমানা থেকে বের করে দিয়েছে। মৎস্য সম্পদ লুণ্ঠন নিয়ে ভারতীয় গবেষণাকারী এন মনোহরন (বেঙ্গালুরু ক্রাইস্ট ইউনিভার্সিটির ইস্ট এশিয়া স্টাডিজ বিভাগের ডিরেক্টর) বলেছেন, যতই সময় যাচ্ছে, লুণ্ঠনকারী ও প্রতিরোধকারীর মধ্যে দ্বন্দ্বের তীব্রতা বাড়ছে, সহিংসতা বাড়ছে, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
ভারত মহাসাগরের ৬০০ মাইল দীর্ঘ উপকূলজুড়ে এটাই নিত্যকার রুটিনে পরিণত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, ভারতীয় জলসীমায় অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে মাছের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সতর্কবার্তা এবং মৃত্যুভীতি উপেক্ষা করে জেলেরা ট্রলার নিয়ে অবৈধভাবে শ্রীলঙ্কার জলসীমায় ঢুকে মৎস্য লুণ্ঠন অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে ভারতের অভিযোগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যবর্তী আরব সাগরের বিতর্কিত অধিকারের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান মেরিটাইম অথরিটি ভারতীয় ট্রলারের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে।
সমুদ্রবক্ষে এই পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও আক্রমণ সারা পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই সহিংস যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করছে। শ্রীলঙ্কা থেকে আর্জেন্টিনা, আর্জেন্টিনা থেকে সাউথ চায়না সি; সকল সমুদ্র ও মহাসমুদ্র হয়ে উঠেছে জাতিসমূহের বৈরিতার বর্ধিত রণাঙ্গন। মৎস্য চাহিদা নয় বরং মৎস্য লোভ, ওভারফিশিং বরং মৎস্যশূন্যতার কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে; পৃথিবীর সকল মানুষকেই যে তা এই প্রাকৃতিক সুলভ সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, তা সরকারগুলো বিবেচনাতেই আনছে না। অস্ট্রেলিয়ান গবেষক জেমিকা স্পাইকার চার দশকের সমুদ্র দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণ করেছেন এবং সাম্প্রতিক ৩৬০টি ঘটনার তথ্য উদ্ঘাটন করে দেখিয়েছেন—যতই দিন যাচ্ছে, সমুদ্রে অবৈধ মৎস্য আহরণের দ্বন্দ্ব ততই সশস্ত্র এবং রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। উপকূল থেকে শত মাইল দূরের এসব ঘটনার বিবরণ গণমাধ্যমে আসছে না, কেবল ভুক্তভোগী পরিবারগুলোই জানছে তাদের দুর্ভাগ্যের খানিকটা ইতিবৃত্ত।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ বিশেষজ্ঞ ইউহান বারগেমাস বহু বছর ধরেই সমুদ্র লুণ্ঠন এবং একে কেন্দ্র করে মারাত্মক নৌযুদ্ধের পরিণতির সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। মাছের অবিশ্বাস্য মজুত মানুষের বেঁচে থাকাকে আরও স্বাস্থ্যকর ও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারত; কিন্তু মৎস্য লোভ সে সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে জাতিগুলোকে অকারণে সমুদ্রযুদ্ধে টেনে আনছে। দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম আফ্রিকায় ও ল্যাটিন আমেরিকার পশ্চিম ভারতীয় মহাসাগর অঞ্চলে। ইউএস কোস্ট গার্ড ধরে নিয়ে গেছে বহুসংখ্যক ফিজিয়ান ট্রলার। ফিজির ভূ-ভাগের চেয়ে ৭০ গুণ বড় তার জলভাগ, অর্থনীতির ভিত্তিই সমুদ্রসম্পদ। কিন্তু ফিজির সমুদ্রসীমানায় ঢুকে আরও অনেক দেশ উজাড় করে নিয়ে যাচ্ছে টুনা ফিশ আর হাঙ্গর। যে পরিমাণ আহরণের পরিসংখ্যান প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে, বাস্তব আহরণ আরও অনেক বেশি। ছোট মাছ ও মৎস্য প্রজননক্ষেত্র মানুষের নির্মম লোভ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সমুদ্রে চলছে 'দূরের স্বৈরশাসন'। অনেক সময় দুর্বল নৌপ্রহরার দেশ জানতেও পারছে না লুণ্ঠনকারী কত বেপরোয়া হয়ে নিঃশেষ করছে তাদের ভাগের মৎস্যসম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাক ইয়ার্ডের দেশগুলোর সাথে যৌথ নৌপ্রহরার চুক্তি থাকলেও ইদানীং প্রহরা ঢিলে হয়ে গেছে; কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তার সম্পদ ও উদ্যোগ নিয়োজিত করছে চীনের ক্রমে অগ্রসরমান সমুদ্রযাত্রা ঠেকাতে।
দক্ষিণ আমেরিকার সমুদ্রসীমানায় এবার শত শত চীনা ট্রলার। আর্জেন্টিনার নৌবাহিনী তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে চীননির্ভরতা তাদের প্রতিরোধ শক্তি কমিয়ে দিয়েছে। বহুসংখ্যক চীনা ট্রলার গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের চারদিকে মাছ মেরে চলেছে। সাউথ চায়না সি এখন লুণ্ঠনের অন্যতম ভান্ডার। একই সঙ্গে লুণ্ঠন ও প্রতিরোধে নেমেছে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া। ২০১০ থেকে ২০২০-এর মধ্যে এই সমুদ্রে ছোটবড় ১৭টি সশস্ত্র যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। চীন নিয়োগ করছে মিলিশিয়া ফিশিং বোট এবং একাধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। চীনের সাথে পেরে ওঠার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন এশিয়া মেরিটাইম ট্রান্সপারেন্সির প্রধান গ্রেগরি পোলিং। চীনকে ঠেকানো সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন, ধাওয়া করার জন্য যে জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে নামবেন, নেমেই হতাশ হয়ে দেখবেন চীনের জাহাজ অনেক বড় ও শক্তিশালী এবং সংখ্যায় অনেক। তাদের ফিশিং ট্রলার ও জেলের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে সহায়তাকারী সশস্ত্র মেরিটাইম মিলিশিয়া জাহাজ।
১,৭০০০ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়ার স্থলভাগের চেয়ে অনেক বেশি জলভাগ। বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তির এ যুগে অজ্ঞতাবশত অন্য দেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ার ঘটনা তেমন ঘটে না। প্রায় সবই ইচ্ছাকৃত, লোভচালিত—'গ্রিড-ড্রিভেন'। ইন্দোনেশিয়া তার জলসীমানায় অবৈধ প্রবেশকারী বহুসংখ্যক ট্রলারের মধ্যে ৩৭০টি সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে। ওদিকে অস্ট্রেলিয়া দাবি করছে ইন্দোনেশিয়া নিজেই মাছ লুটেরা দেশ। তারা চার মাসের ব্যবধানে ১৫টি ফিশিং ট্রলার নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। গণমাধ্যমে পাঠানো তাদের ছবিতে দেখা যাচ্ছে এগুলো ইন্দোনেশিয়ার। যুক্তরাষ্ট্র কোথায় লুণ্ঠন চালাচ্ছে, তার বিবরণ তেমন না পাওয়া গেলেও টেক্সাসের কাছাকাছি উপকূলে যুক্তরাষ্ট্র কোস্ট গার্ড ৪৪০টি মেক্সিকান ফিশিং বোট কেটে খণ্ডিত করেছে এবং ইঞ্জিন অকেজো করে দিয়েছে। রোমানিয়ান নৌবাহিনী গুলি ছুড়েছে তুরস্কের ফিশিং ট্রলারের ওপর, ইতালি সশস্ত্র ধাওয়া করেছে ইথিওপিয়ার ট্রলার। এখন বড় দেশগুলোর লুণ্ঠন-নজর পড়েছে মেরু অঞ্চল ও ট্রপিক্যাল প্যাসিফিকে যে হারে বরফ গলছে, তাতে একদিকে ভাটির দেশগুলোর জন্য হুমকি বাড়ছে; কিন্তু অন্যদিকে রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবমুক্ত হচ্ছে বিশাল এবং অবিশ্বাস্য এক ফিশিং জোন। সেই সম্ভাবনা লালনের প্রস্তুতি দরকার, লুণ্ঠন নয়।
মৎস্যাধিকারের দ্বন্দ্বে ভূমধ্যসাগরও জর্জরিত। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের আগেই গাজার ১০০০ জেলের দুই-তৃতীয়াংশ মৎস্যজীবিকা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আগে পাইকারি বাজারে মাছ ব্যবসায়ী ১০০ থেকে ২০০ বাক্সভর্তি মাছ নিয়ে বসত, কিন্তু অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে ভূমধ্যসাগরে মাছের খরা চলছে; নদী, শাখানদীতে মাছের হাহাকার। এখন ব্যবসায়ী মাছের হাটে বসছে ১০ থেকে ২০ বাক্সভর্তি মাছ নিয়ে, সরবরাহ ৯০ শতাংশ নেমে যাওয়ার মানে হচ্ছে মৎস্যজীবীরা কেউ আর টিকে থাকতে পারছে না।
ব্রাজিলিয়ান আমাজন এবং এর শাখানদীগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে লুণ্ঠনকারী দস্যুদের হাতে। হোসে মারিয়া বাতিস্তা দামাসেনো কাঁদতে কাঁদতে বলল, যখন জাপুরা নদীতে মাছ ধরছিল, এক মৎস্যদস্যু এসে তাকে হুমকি দিল, এখনই এই নদী ছেড়ে চলে যা, নতুবা আমার হাতের হারপুন দিয়ে এখনই তোকে হত্যা করব। মুখোশধারী শহুরে ভদ্রলোক ব্যবসায়ীদের ভাড়াটে দস্যুরা অনেক নদীতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। হোসে মারিয়ার জন্ম জেলে পরিবারে, 'সাসটেইনেবল ফিশিং' কী, সেটা তার জানা। মাছ জন্মাতে ও বড় হতে সে সাহায্য করবে, আবার মাছও ধরবে। কিন্তু দস্যুর টেকসই মাছভাবনা থাকার কথা নয়। অরণ্যের পোচিং শব্দটি এখন নদীতে নেমে এসেছে। ল্যাটিন আমেরিকার মাছ লুটেরাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'হেভিলি আর্মড অ্যান্ড ওয়েলথি ক্রিমিনাল অ্যাসোসিয়েশন'।
হাজার বছর ধরে নীল নদ মিসরের নিয়ন্ত্রণেই আছে। নীলের দুপাশের চাষি এবং নদীর জেলেরা আছে কাটায় মহা আতঙ্কে। উজানে ৪-৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ইথিওপিয়া বাঁধ নির্মাণ করতে শুরু করেছে। পানি প্রত্যাহার প্রায় অবধারিত মনে করা হচ্ছে। মিসরীয় জেলে ও চাষির চিৎকার শোনা যাচ্ছে: নীল নদ ছাড়া মিসর টিকে থাকবে না, আমরা বাঁচব না।
আফ্রিকার মাছশিল্প ক্রিমিনালদের দখলে। বিদেশি ফিশিং কোম্পানি আফ্রিকাকে ঘিরে রাখা সমুদ্র ও নদীর মাছ দুর্বৃত্তের মতো লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকানদের মাথাপিছু মাছ গ্রহণ তলানিতে এসে ঠেকেছে। ১১টি আফ্রিকান দেশের মধ্যে 'সাসটেইনেবল ফিশারিজ পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট' হলেও বহিরাগত কোম্পানিগুলো শর্ত মানছে না, লুণ্ঠন চলছেই। সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্ত চীনা মৎস্য লুটেরা, অভিযোগ উঠেছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেও মৎস্যাধিকার দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এটা স্মরণ রাখা ভালো যে সেকালের জলদস্যুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইউরোপের নাগরিক। তাদের শিক্ষিত উত্তরসূরিরা সভ্যতার জয়গান করলেও বংশানুক্রমিক দস্যুবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এ নিয়ে লড়াই চলছে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে। ফরাসি জলসীমায় ব্রিটিশ ফিশিং ট্রলার চুক্তিবহির্ভূত মাছ ধরা অব্যাহত রাখলে ফ্রান্স ব্রিটেনের ওপর স্যাংশন দেবার ঘোষণা দিয়েছে। ব্রিটেন বলছে মৎস্য লুণ্ঠনকারী ফ্রান্স। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মৎস্যাধিকারপ্রাপ্ত মাছ ধরার ১৬৭৩ জাহাজের ৭৩৬টি মালিকানাই ফ্রান্সের। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, আয়ারল্যান্ডসহ ১৪টি ইইউভুক্ত দেশ পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি করার জন্য ব্রিটেনকে দায়ী করেছে।
এদিকে সাউথ চায়না সির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চীন মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের ইলিশ? কোন ফাঁদে পড়ে যে বাংলাদেশের ইলিশ হারিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কিন্তু হইচই তেমন নেই। ইলিশ রক্ষার জন্যও কি আন্দোলন দরকার হবে?