ব্যক্তি উপযোগী চিকিৎসা—ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবা
এক মাপের জুতা পরিবারের সবার পায়ে আঁটবে না। একই খাবারও সবাই খেতে পারেন না। দুধের মতো ভালো খাবারও অনেকেরই হজম হয় না। চিনা বাদাম, ইলিশ মাছ, গরুর গোশত বা হাঁসের ডিম, চিংড়ি কেবল গলা দিয়ে নামলেই হলো। অনেকেরই গায়ে চুলকানি শুরু হবে সাথে সাথেই। ফুসকুড়িতে ভরে যাবে শরীর। এমনকি শ্বাসকষ্টও হতে পারে। কপাল খারাপ হলে হতে পারে আরও মারাত্মক পরিণতি।
এভাবে সবার জন্য একই পথ্যও কাজ করে না—এটাও জানা কথা। জিন, জৈব গঠন, অন্ত্রের ভেতরের অণুজীবমণ্ডলী বা গাট মাইক্রোবায়োমি, রোগের উপসর্গ এবং ইতিহাস, দৈহিক গঠন, ব্যায়াম করার অভ্যাস এবং পরিবেশের প্রভাব সবই পথ্য নির্বাচনের বিষয়ে বিবেচনায় নিতে হবে।
অদূর ভবিষ্যতে চিকিৎসক কোনো অবস্থায়ই রোগীকে বলবেন না, বেছে বেছে স্বাস্থ্যকর খাবার খাবেন। প্রচলিত অর্থে 'স্বাস্থ্যকর' খাবার হয়তো থাকবে না। রোগীর সব দিক বিবেচনা করবেন চিকিৎসক এবং খাদ্যবিদ। খতিয়ে দেখবেন প্রতিটি বিষয়, জিনের গঠন থেকে পরিবেশ, তারপর খাদ্যতালিকা দিবেন। কম ক্যালরির খাবার খাবেন—চিকিৎসকের এমন উপদেশ আর আগামীতে শোনা যাবে না। তার বদলে সুনির্দিষ্ট কোন ভিটামিন দরকার, প্রয়োজন কোন খনিজ উপাদান, কোন কোন পুষ্টি উপাদানে ঘাটতি রয়েছে এবং কোন খাবার রোগী দেহের ডিএনএকে চাঙা করে তুলবে, তার ভিত্তিতে পথ্য নির্ধারণ করা হবে। শুধু তা-ই না, বংশগত রোগের আশঙ্কাও কোন খাবার কমাবে, তা-ও সেই পথ্য নির্বাচনের সময় বিবেচনায় নেওয়া হবে।
ব্যক্তি উপযোগী ওষুধ
ব্যক্তিভেদে সুনির্দিষ্ট পথ্য দেওয়াকে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাব্যবস্থার একটি ছোট অংশ বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। এ চিকিৎসাব্যবস্থাকে ব্যক্তি উপযোগী চিকিৎসাব্যবস্থা বা পারসোনালাইজড মেডিসিনও বলা হয়। বিকাশমান এ চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যক্তির জিন বৈচিত্র্য, পরিবেশ, জীবনযাপন খতিয়ে দেখা হয়। তারপর সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য হুমকিগুলো চিহ্নিত করার কাজ চলে। চিকিৎসার পর্ব আসে এ পথ ধরে। হরেদরে কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা দেওয়া হয় না। বরং ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে যেসব আলামত পাওয়া যাবে, তারই ভিত্তিতে চিকিৎসার আয়োজন করা হয়।
বছরখানেক আগের কথা। ব্যক্তি উপযোগী চিকিৎসা নিয়ে এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই দুই হাজারের বেশি গবেষণা প্রকল্প নিরলস কাজ করছে। ত্বক-প্রদাহ থেকে শুরু করে জিনজনিত অসুখ-বিসুখ কিংবা ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র থেকে সৃষ্ট হতাশাবোধ পর্যন্ত নানা রোগের ব্যক্তি উপযোগী চিকিৎসার গবেষণা চলছে। ব্যক্তিকে ঠিক কোন ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে, তাই নির্ধারণ করা হয় তার কাছ থেকে পাওয়া বা নেওয়া নানা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।
মার্কিন সরকারের বড় একটি গবেষণা কর্মসূচির প্রধান ডা. জোশ ডেনি এ ধরনের চিকিৎসার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ব্যক্তি উপযোগী বা সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতির মধ্য দিয়ে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা দেওয়া হয়।
কেবল চিকিৎসা নয়, বরং রোগ প্রতিরোধের পথও সুগম হচ্ছে। প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধ উত্তম—এ আপ্তবাক্যও কার্যকর হচ্ছে এ পদ্ধতিতে। রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া থেকে শুরু করে হৃদ্রোগ, কিংবা খিঁচুনির চিকিৎসাপদ্ধতি এভাবে উন্নত হয়েছে। ক্যানসার বা কর্কট রোগ চিকিৎসার কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে উজ্জ্বল নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসছে এ ব্যবস্থা। স্তন, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, রক্ত বা যকৃত কিংবা লিভার ক্যানসারসহ সব ক্যানসারের বেলায় ডিএনএর গঠনপ্রক্রিয়া বদলে যায়। এতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে শুরু করে স্বাভাবিক দেহ কোষরাজি। একজন গবেষক বলেন, ক্যানসারের সাথে জড়িত জিন সম্পর্কে যদি যথাযথ তথ্য পাওয়া যায় এবং তার চলার পথও বের করা সম্ভব হয়, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তির উপযোগী সেরা চিকিৎসা নির্ধারণ করা যাবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় 'প্রিসিসিওন অনকোলজি'। বাংলায় বলা যায়, 'সুনির্দিষ্ট ক্যানসার চিকিৎসাবিদ্যা'। এই চিকিৎসাবিদ্যা দ্রুতই ক্যানসারের মান বা প্রমিত চিকিৎসা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অনেক ওষুধই দেওয়া হয় রোগীর ওপর কাজ করছে কি না, তা যাচাই করার জন্য। কাজ করলে ওষুধ চালু রাখা হয়। না হলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমন ওষুধ রোগী দেহে কাজ করবে কি না, তা প্রয়োগের আগে বোঝার উপায় নেই। এ কারণে অসহায় চিকিৎসক নিরুপায় রোগীকে এমন ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিতে বাধ্য হন। ব্যক্তি উপযোগী চিকিৎসার আওতায় নিরাপদেই ওষুধ দেওয়া যাবে। ব্যবস্থাপত্র লিখতে গিয়ে অস্থিরতায় ভুগতে বা অসহায় বোধ করতে হবে না চিকিৎসককে। চিকিৎসার এই নব ব্যবস্থাকে বলা হয় ফার্মোকোজেনোমিক্স বা সংক্ষেপে পিজিএক্স। (ইংরেজিতে লেখার সময় বড় হাতের পিজি লিখতে হবে আর 'এক্স'টা হবে ছোট হাতের। অক্ষর তিনটির মধ্যে কোনো ফাঁক থাকবে না।) এ চিকিৎসাব্যবস্থায় রোগী দেহের জিনের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয় ওষুধ কীভাবে কাজ করবে। চুলের বা চোখের রং কী হবে, তা ঠিক করে জিন। একইভাবে জিনই নির্ধারণ করে দেয় শরীর কোন ওষুধে কী ধরনের সাড়া দেবে বা প্রতিক্রিয়া হবে। বেশির ভাগ ওষুধই শরীরে প্রক্রিয়া করে। জিনের কোনো কোনো ধরন ওষুধকে ভাঙার বা শরীর থেকে ওষুধ বের হয়ে যাওয়ার কাজে প্রভাব ফেলে। ডেনি বলেন, পরিস্থিতি এ রকম হলে রক্তধারায় হয়তো মাত্রাতিরিক্ত বা অতি অল্প পরিমাণ ওষুধ থাকবে। তাতে হয় ওষুধ কার্যকারিতা হারাবে আর না হয় ডেকে আনবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ খাতে বিশাল তৎপরতা চলছে। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় নানাভাবে কাজ করে চলছে। ২০২৬-এর মধ্যে ১০ লাখ মার্কিন নাগরিকের জিনভিত্তিক তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে চাইছে দেশটি। 'অল অব আস' কর্মসূচির আওতায় এ কাজ চলছে। ২১৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে কর্মসূচিটি শুরু হয় ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বারাক ওবামার শাসনামলে। পাশাপাশি মার্কিন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও বায়োব্যাংক গড়ার কাজ এগিয়ে চলেছে। মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ বা এনআইএইচ দেশটির ন্যাশনাল হার্ট, লাং এবং ব্লাড ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ট্রান্স-ওমিকস ফর প্রিসিসিউন মেডিসিন (টপমেড) কর্মসূচি নিয়েছে। এ কর্মসূচিতে প্রধানত হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, রক্ত এবং এ-সংক্রান্ত ঘুমের সমস্যা নিয়ে গবেষণা করবে। সবাই তাদের গবেষণার তথ্য পরস্পরকে জানাবে।
ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড সংক্ষেপে ডিএনএ হিসেবে পরিচিত। ডিএনএ একটি নিউক্লিক অ্যাসিডের মধ্যে জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণের জিনগত নির্দেশ থাকে। শরীরকে একটি ঘর হিসেবে কল্পনা করা হলে ডিএনএ এটি নির্মাণের নীলনকশা। প্রতিটি ব্যক্তির দেহ নির্মাণের নির্দেশাবলিই হলো জিনোম। এটি জিন নামক ক্ষুদ্র অংশ থেকে তৈরি। এসব জিন নীলনকশায় লিখিত বাক্যের মতো। যদিও প্রায় সব মানুষের নীলনকশা ৯৯.৯ শতাংশ একই। অতি সামান্য পার্থক্য, ০.১ শতাংশের জন্য, মানুষে মানুষে পার্থক্য দেখা যায়। মানুষের মধ্যে, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ নানা রোগ হওয়ার আশঙ্কা কমবেশি এ কারণেই থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা মুখের লালা বা রক্তের নমুনা গ্রহণ করে ডিএনএর এই পার্থক্যগুলো তালাশ করেন। তারা সুস্থ মানুষের ডিএনএ সংকেতের সাথে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডিএনএর তুলনা করে দেখছেন। দেহের এই নীলনকশায় কোনো 'ভুল বানান' আছে কি না, যা অসুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়। কোনো একটি রোগের ক্ষেত্রে যদি এ রকম ভুল বানান খুঁজে পান, তাহলে 'ভুল বানান' কীভাবে হলো, তা বের করার সূত্র হয়তো খুঁজে পাবেন বিজ্ঞানীরা। তাহলে 'ভুল বানান' শোধরানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়তো করতে পারবেন। কিংবা আদৌ যেন 'বানানটি ভুল না হয়' তারও পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
ডিএনএ এবং নানা অসুখ-বিসুখ আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, তা ভালোভাবে বুঝতে হবে। ব্যক্তি উপযোগী চিকিৎসাপদ্ধতিকে কার্যকর করতে গেলে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রত্যেক রোগীভেদে চিকিৎসার ধরন বদলে যায়, তাই এ পদ্ধতি চমৎকারভাবে কার্যকর হওয়া উচিত। তবে এ-সংক্রান্ত গবেষণা-সমীক্ষার ফলাফল সবেমাত্র আসতে শুরু করেছে। এখনো এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা চালাতে গিয়ে চিকিৎসকদের মনে হচ্ছে—তারা অচেনা পথে হাঁটছেন।
ডিএনএ-সংক্রান্ত তথ্য জোগাড়ের পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে খরচ। মুখের লালা বা রক্ত থেকে ডিএনএর মানচিত্র তৈরির কাজ এখনো সস্তা নয়। ২০১৫-এর মাঝামাঝি এমন কাজে আমেরিকায় খরচ পড়ত সাড়ে চার হাজার ডলারেরও বেশি। সম্প্রতি খরচ কমে এক হাজারের ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এখনো একে সস্তা বলা যাবে না। আশার কথা—এ খাতে খরচ আরও কমবে।
ডিএনএ তথ্যের ভিত্তিতেই বিশেষজ্ঞরা ব্যক্তি উপযোগী চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করবেন। ওষুধ তৈরি করবেন। অন্যান্য গবেষণা চালাবেন। কাজগুলো বিশাল। এ কাজে সময় লাগবে।
এদিকে ব্যক্তিগত ডিএনএ উপাত্ত চুরি হওয়ার বা ফাঁস হওয়ার আশঙ্কাও থাকছে। এ নিয়েও অনেকে দুশ্চিন্তা করছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, আগামী দিনের চিকিৎসাব্যবস্থার রূপরেখা পুরোই বদলে যাবে। বংশগত রোগ থেকে শুরু করে অনেক কঠিন অসুখের লাগসই চিকিৎসা চলবে। বহু রোগ সেরে যাবে। অন্যদিকে রোগ ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। নিশ্চিত হবে রোগীর মানসম্পন্ন জীবন ।
বাংলাদেশে সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার রিসার্চ সেন্টার গড়ে তোলার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলছে বিশাল আয়োজন। কিন্তু এখনো ফার্মোকোজেনোমিক্স বা পিজিএক্স নিয়ে তেমন কোনো তৎপরতা নেই বলে জানালেন সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনবিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। আর বিলম্ব নয়, এ খাতে নজর দেওয়ার সময় এসে গেছে।