যেভাবে দেওয়া হলো বাংলাদেশের সমস্ত পাখির বাংলা নাম
পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল একটা বই সম্পাদনার, যাতে স্থান পাবে বাংলাদেশের সমস্ত পাখির নাম, ছবি ও তথ্য। বিশেষ করে নামগুলো অবশ্যই বাংলা হতে হবে। ১৯৯৫ সালে খবরের কাগজের জন্য পাখি নিয়ে নিয়মিত ফিচার লিখতে গিয়ে তিনি দুটি জিনিস খেয়াল করলেন; কিছু পাখির অনেকগুলো করে নাম (যেমন কানাকুয়োকে বলা হয় কুবো, আইড়া কুইড়া, কানাকুয়ো) আর অধিকাংশ পাখির কোনো নামই নেই! দেখা গেল, বাংলাতে কিছু কিছু পাখির নাম দিয়েছিলেন সালিম আলী, লেখক বনফুল, অজয় হোম ও ড. রেজা খান। কিন্তু সেগুলো সব একসাথে করেও ২৫০টির বেশি হলো না, আবার সেখানে দেখা দিল নানাবিধ সমস্যা, বিশেষ করে নাম দিয়ে পাখিটির পরিবার চেনা যায় না! যেমন তিলা বাজ, যা কি না একধরনের ইগল। কাজেই নামের মাঝে আছে ভুল জাত নির্ণয়।
এরপরে তিনি নিজেই চেষ্টা করতে থাকলেন এই দুরূহ কাজ সম্পাদনের, সংগ্রহ করলেন ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় সারা বিশ্বের সমস্ত পাখির নাম। অবশ্য নানা পাখির ও গাছের নাম সংগ্রহের শখ তার অনেক আগে থেকেই, মনে করলেন ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামে এক অচেনা গাছ দেখে স্থানীয় লোকের কাছে সেই বৃক্ষের নাম শুনেছিলেন নচিন! ব্যস, খাতায় লিখে ফেললেন নচিন গাছ! এই নিয়েই পরে সহকর্মীদের মাঝে ব্যাপক হাসাহাসি, নচিন তো কোনো নাম নয়, এর মানে 'ন চিনি' অর্থাৎ চিনি না! এমনভাবেই একবার খঞ্জন দেখাতেই এক গ্রামবাসী বলেছিল, পাখিটির নাম বাউই, মানে কিনা বাবুই! পরবর্তী সময়ে সংগ্রহে আসল ডাচ, ফিনিশ ইত্যাদি ভাষায় সমস্ত পাখির নাম।
সেগুলোর রীতিনীতি লক্ষ্য করে তিনি ঠিক করলেন, নাম হতে হবে বর্ণনামূলক এবং যতদূর সম্ভব স্থানীয় প্রচলিত নাম। যেমন বাংলাদেশে দুই ধরনের কাক দেখা যায়, পাতিকাক এবং দাঁড়কাক, পাতি মানে ছোট! মানে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে নামের মাঝেই।
সেই সাথে যে ১১টি পাখির নামের শেষে Benghalensis আছে, সেগুলোর নামের প্রথমে বসালেন বাংলা! যেমন বাংলা-শকুন, বাংলা-কাঠঠোকরা ইত্যাদি।
আর কোনো মানুষের নামে পাখিদের নামকরণ করা হলে সেই নাম অবিকৃত রেখেই পাখির নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আর যে সমস্ত পাখি নামের প্রথমে Indian মানে ভারতবর্ষ আছে, তাদের নামের প্রথমে থাকবে দেশি, কিছু কিছু শব্দ নিজে থেকেই সৃষ্টি করতে হলো প্রয়োজনের তাগিদে, যেমন Oriental শব্দের যথার্থ মানে পাওয়া যাচ্ছিল না; ডিকশনারি ঘেঁটে দেখা গেল, ওরিয়েন্ট মানে যেখানে সূর্য উদিত হয়, জাপান থেকে শুরু করে ইরান পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ড এর আওতায় আসে, তাই নামের প্রথমে ওরিয়েন্টাল থাকলে সেটাকে উদয়ী করে দেওয়া হলো বাংলাতে। চেষ্টা করা হতে থাকল পাখির নাম দুই শব্দের দিতে এবং শেষের শব্দটি দিয়ে পাখিটির প্রজাতি বোঝাতে।
সেই সাথে ইনাম আল হক চেষ্টা করতে থাকলেন যথার্থ বর্ণনামূলক নাম দিতে, যেভাবে অনেক ভাষাতে দেওয়া হয়েছে এবং যে নামগুলো টিকে থাকবে। দেহের গড়ন, মাথার রং, পাখনার আকার ইত্যাদির বর্ণনা এবং পাখির পরিবারের নাম জুড়ে দেওয়া হলো। এর আগে কেউ কেউ চমৎকার সব কাব্যিক নামও দিয়েছেন; যেমন কোনো সুন্দর নীল পাখির নাম নীলপরি, কিন্তু তাতে যেমন তার পরিবার বোঝা যাচ্ছে না, তেমন পাখিটি নীল বাদে আর কোনো তথ্যও নেই, ফলে সেই নাম হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ইগলদের নাম দিতে গিয়ে দেখা গেল, দেশে স্নেক-ইগল এবং সার্পেন্ট-ইগল দুইই আছে, তাই স্নেক-ইগলের বাংলা নাম দেওয়া হলো সাপ-ইগল ও সার্পেন্ট-ইগলের নাগ-ইগল, ফলে তিলাবাজ পেল তার যথার্থ নাম — তিলা নাগ-ইগল!
খুব বেশি সমস্যা হয়ে ছিল বকের নাম দিতে গিয়ে, বাংলাদেশে ইগ্রেট, হেরন এবং বিটার্ন — এই তিন পরিবারের বেশ কয়েক প্রজাতির বক পাওয়া যায়। ইগ্রেট বা সাদা বকদের পরিবারের নাম দেওয়া হলো বগা, রঙিন বক বা হেরনদের বক, কিন্তু সমস্যা বাধল বিটার্নদের নিয়ে! তাদের জন্য অনেক খুঁজেও এমন কোনো নাম পাওয়া যাচ্ছিল না, যা দিয়ে বকজাতীয় পাখিও বোঝা যাবে আবার অন্য বকদের চেয়ে আলাদা, সেইটাও বোঝা যাবে! শেষে এক পাখি পর্যবেক্ষণ ট্রিপের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. আব্দুল মান্নান বললেন, তাদের সময়ে বগলা নামের এক সিগারেট খুবই জনপ্রিয় ছিল, সেইখান থেকে এল বগলা নামটি!
খবরের কাগজে এসব নাম দেখে অনেক সময়ই গঠনমূলক ফিডব্যাক যেমন আসত, তেমনি মিলত বিরূপ সমালোচনাও। এক বৃদ্ধ দেখা করে কড়া করে বললেন, আপনি পাখিদের নাম কালা, ধলা এসব কী দিচ্ছেন! ইনাম আল হক বলেছিলেন, বাংলাদেশের রং দিয়ে কোনো নাম হয় না, সব গ্রামেই কালা মিয়া, ধলা মিয়া নামে কেউ না কেউ আছে, কিন্তু সারা বাংলাদেশে সাদা মিয়া বা কালো মিয়া নাই! তেমনভাবেই ধূসর হয়ে গেল মেটে!
আবার সাদা-কালো বা Pied হলে সেটাকে পাকরা বলা এবং দাগ থাকলে দাগি শব্দ ব্যবহার করা হতো। আসলে ইতিহাসের একপর্যায়ে ভয়াবহ আসামিদের গায়ে ছাপ মেরে বা দাগ দিয়ে দেওয়া হতো, সেখান থেকে দাগি আসামি কথাটা এসেছে, তাই পাখিদের ক্ষেত্রেও দাগের ব্যাপারটা থেকে গেল সঙ্গত কারণেই।
আবার প্যাঁচাদের নাম দিতে গিয়ে Eagle Owl-দের নাম দেওয়া হলো হুতোমপ্যাঁচা, Scops Ow-দের নিমপ্যাঁচা, খুদে আকারের Owlet-দের কুটিপ্যাঁচা, Wood Owl-দের গাছপ্যাঁচা, Hawk Owl-দের শিকরেপ্যাঁচা। কাঠঠোকরাদের যেহেতু এলাকাভেদে কাঠকুড়ালিও বলা হয় তাই Yellownape-দের নামকরণ করা হলো হলদেকুড়ালি, আর Piculet-দের কুটিকুড়ালি। কোকিলদের ক্ষেত্রে Koel হলো কোকিল, Cuckooরা সব পাপিয়া এবং Hawk Cuckoo-রা সবাই চোখগ্যালো। মুশকিল বাধল Drongo Cuckko-দের নিয়ে, শেষে তাদের নাম দেওয়া হলো ফিঙ্গেপাপিয়া।
শিকারি পাখিদের নিয়ে বাধল বিস্তর গোলমাল, তাদের এক জনপ্রিয় নাম ছিল রাখানভুলানি, কিন্তু যাচাই করে দেখা গেল যে যারা বাতাসে ডানা মেলে ভেসে বেড়ায়, তাদের সবাইকেই রাখালভুলানি বলা হয়। চিল, বাজ, শিকরে তো বটেই, এমনকি রাতচরাদেরও! তাই পরিবার অনুযায়ী আলাদা আলাদা নাম করল করা হলো, সমস্ত Falcon-দের উপমহাদেশের প্রচলিত নাম শাহিন দেওয়া হলো, তার সব দ্রুতগতির শিকারি পাখি। এদের মাঝে Hobb-দের টিকাশাহিন আর Kestrel-দের নাম কেস্ট্রেল রাখা হলো। Baja-দের নাম বাজ, Buzzard-দের নাম তিসাবাজ, Honey Buzzard-দের মধুবাজ, Harrier-দের নাম কাপাসি রাখ হলো। এর মাঝে কিছু পাখির নামের সাথে পান বা পানি জুড়ে দেওয়া হলো; যেমন পানকৌড়ি, পানচিল, পানকাপাসি ইত্যাদি।
অবশেষে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ২৬ নম্বর খণ্ডে বাংলাদেশের সমস্ত পাখির তথ্য ও ছবি নিয়ে বইটি প্রকাশিত হয় প্রথমে ইংরেজিতে এবং ২০০৯ সালের আগস্টে বাংলায়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে অধিকাংশ পাখির বাংলা নাম এই 'পাখি জ্ঞানকোষ' থেকেই নেওয়া হয়েছে। এবং পরবর্তীসময়ে ২০১৫ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের পাখির ফিল্ডগাইড'-এ এই বাংলা নামগুলোও ব্যবহার করা হয়েছে।
পৃথিবীর ১২ হাজার পাখির নাম বেশ কিছু ভাষাতেই দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলায় এখনো উপমহাদেশের হাজার পাখির নামই দেওয়া হয়নি, গঠনমূলক নাম দেওয়া অত্যন্ত দুরূহ। বর্তমানে ইনাম আল হক চেষ্টা করে যাচ্ছেন পৃথিবীর সমস্ত পাখির বাংলা নামকরণ করতে; আশা রাখি, একদিন পৃথিবীর সকল পাখির বাংলা নাম দেওয়া সম্ভব হবে।
লেখক: পরিব্রাজক, পাখি পর্যবেক্ষক, লেখক