গাসসান কানাফানি: যাকে দিয়ে বৈরুতে মোসাদের গুপ্তহত্যা শুরু
১৯৭২ সালের ৮ জুলাই, শনিবার। বৈরুতে গরম পড়েছে। অনেক বাসিন্দাই শহরতলির পাহাড় আর গ্রামে ছুটি কাটাতে ব্যস্ত। ১৭ বছরের কিশোরী লামিস নাজিমের সেদিন আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতে রেজিস্ট্রেশন করার কথা। গাসসান কানাফানির ইচ্ছা ভাতিজিকে বিশ^বিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবেন। অফিস মানে সাপ্তাহিক আল হাদাফ; পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের সাপ্তাহিক। কানাফানি এর সম্পাদক। একই সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামে কাজ করা পিএফএলপির মুখপাত্র।
সকাল সাড়ে ১০টার সামান্য আগে ঘর থেকে বের হন কানাফানি। এগিয়ে যান নিজের ধূসর রঙের অস্টিনের দিকে। লামিস নাজিমও গাড়িতে উঠে বসে। চালু হয়ে দুই হাত দূরেও যেতে পারেনি গাড়িটা। মুহূর্তে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যায় গাড়ি। কিশোরীর ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যায় কয়েক মিটার দূরে। ৩৬ বছর বয়সী কানাফানির দেহ পুরোপুরি জ¦লে ছাই।
একজন কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, চিত্রশিল্পী ও সম্পাদককে হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার লেবাননে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামীদের গুপ্তহত্যার সূচনা করে মোসাদ। এরপর এই ধারা এখনো চলমান রয়েছে। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না।
এই গুপ্তহত্যার খবর আরব গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। তারা আলো ফেলে কানাফানির অমূল্য সাহিত্যকীর্তির ওপর। ছোট এই জীবনে দেড় ডজন বই তিনি লিখে গেছেন। তার রাজনৈতিক প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংখ্যা অনেক। আরবি থেকে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানসহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে তা। এসবের মধ্য দিয়ে সারা দুনিয়ায় ফিলিস্তিনের গল্প ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। মাতৃভূমি থেকে উৎখাত হওয়া উদ্বাস্তুদের বেদনার কথা লিখেছেন কানাফানি। নাকবায় যে ট্রাজেডির শিকার হয়েছে, ফিলিস্তিনের নিরপরাধ মানুষ তা লিখে গেছেন সাহিত্যের উচ্চতম ভাষায়। তার এই ভীষণ ফলনশীল কলমকে বন্ধ করে দিতেই গুপ্তঘাতকেরা গাড়ির বাম্পারে বোমা বেঁধে রেখেছিল।
লেবাননের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার লেখে, 'গাসসান কানাফানি এমন এক কমান্ডার ছিলেন, যিনি কখনো একটি গুলিও ছোড়েননি। তার অস্ত্র ছিল একটি বলপয়েন্ট কলম। তার যুদ্ধক্ষেত্র ছিল সংবাদপত্রের পাতা।' লেবাননের সর্বাধিক প্রচারিত আরব দৈনিক আন-নাহারের সম্পাদক গাসসান তুয়েনি লেখেন, 'কানাফানির মৃত্যু ফিলিস্তিনি বিপ্লবের একটি যুগের সমাপ্তি। আর কোনো গাসসান কানাফানি আসবে না।' আর কোনো গাসসান কানাফানি আসেননি ঠিক, কিন্তু ফিলিস্তিনি শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য একটি পরিষ্কার পথ তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তার সৃষ্ট এ পথে হাঁটতে ভোলেননি পরবর্তী শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। বয়সে কানাফানির মাত্র পাঁচ বছরের ছোট মাহমুদ দারবিশের কবিতা ভুলতে পারবে না এ জগতের সহৃদয়বান কেউ। প্রেম ও বিপ্লবের সমান্তরালে যে উর্বর সাহিত্য ফিলিস্তিন এ দুনিয়াকে উপহার দিয়েছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে জন্মান্তরেও।
মোসাদের এই গুপ্তহত্যা আলোড়ন তোলে ইসরায়েলেও। দুই মাস আগে ইসরায়েলের লড বিমানবন্দরে তিন জাপানির হামলা করার পেছনের মানুষ হিসেবে কানাফানিকে সামনে আনার চেষ্টা করে মোসাদ। ১৯৭২ সালের মে মাসের এই হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। কানাফানির মৃত্যুর পরদিন ইসরায়েলের হারেৎজ লেখে, 'পিএফএলপি নেতা কানাফানি গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। কানাফানি লেবাননে পিএফএলপির প্রধানদের একজন এবং লড গণহত্যার পরিকল্পনাকারীদের একজন। গাড়িবোমা বিস্ফোরণে তার মৃত্যু হয়েছে।' আরও উল্লেখ করা হয়, কানাফানি লডে জাপানিদের আত্মঘাতী হামলার জন্য নিয়োগকারীদের একজন।
১৯৭২ সালের ৩০ মে। প্যারিস থেকে এয়ার ফ্রান্সে উড়ে এসে ইসরায়েলের লড এয়ারপোর্টে (বর্তমান নাম: বেন গুরিয়ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) তিন জাপানি। তিনজনই ছাত্র। তারা জাপানি রেড আর্মির সদস্য। হাতে লাগেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বের করে আনে অটোমেটিক বন্দুক এবং হ্যান্ড গ্রেনেড। আচমকা ওপেন ফায়ার শুরু করে তারা। ছুড়ে মারে বোমা। সঙ্গে সঙ্গে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় কয়েক ডজন। তিন জাপানির একজন নিজের বোমার আঘাতেই মারা যায়। দ্বিতীয়জন নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে নিহত হয়। আরেকজন ধরা পড়ে। বিবিসি জানায়, পিএফএলপি এই আত্মঘাতী হামলা চালাতে জাপানি রেড আর্মির সদস্যদের ভাড়া করেছিল। বিবিসি এ-ও বলে, পিএফএলপি বলেছে এই তিনজন 'হাজার মাইল দূর থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামে অংশ নিতে উড়ে এসেছে।' ৮ মে এই বিমানবন্দর থেকে বিমান ছিনতাই করার সময় দুই আরব ছিনতাইকারীকে হত্যার প্রতিশোধ নিতেই জাপানিদের দিয়ে পিএফএলপি এই হামলা চালিয়েছে বলে বিবিসি খবর দেয়।
গাসসান কানাফানি ছিলেন পিএফএলপির নেতা ও মুখপাত্র। ইসরায়েলের দাবি, জাপানি তিন ছাত্রকে এই মিশনের জন্য নিয়োগ করা, তাদের লেবাননের বালবেকে এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং আত্মঘাতী হামলা করার পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন কানাফানি। এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে আল-জাজিরা বলছে, ওই এয়ারপোর্টে ফিলিস্তিনিরা হামলা করতে পারে এই মর্মে আগে থেকেই রেড অ্যালার্ট জারি ছিল। তারপরও জাপানিদের হামলা রহস্যজনক। অন্যদিকে কানাফানিকে হত্যা করার পরিকল্পনা বিমানবন্দরে আত্মঘাতী হামলার অনেক আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিল মোসাদ। অর্থাৎ যেকোনোভাবেই কানাফানিকে দেশের জন্য জীবন দিতে হতোই।
মোসাদ এখানেই থেমে থাকেনি। কানাফানির পর পিএফএলপির মুখপাত্র হন এর নেতা বাসসাম আবু শরিফ। একই বছরের ২৫ জুলাই তাকেও হত্যার চেষ্টা করে মোসাদের গুপ্তচরেরা। বৈরুতে বাসসামের কাছে একটি পার্সেল পাঠিয়ে দেয় মোসাদ। ভেতরে ভরে দেয় শক্তিশালী একটি বোমা। পার্সেলটি বাসসামকে প্রাণে মারতে ব্যর্থ হয়। তবে সঙ্গে তার হাতের চারটি আঙুল উড়ে যায়। আংশিক দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন আজীবনের জন্য। বাসসামের ওপর এই গুপ্ত হামলা দিয়ে বোঝা যায়, বিমানবন্দরে জাপানিদের হামলা নয়; ফিলিস্তিনের অধিকার ও মুক্তিসংগ্রামের সমর্থন জোগানোর জন্যই গাসসান কানাফানিকে লক্ষ্য বানিয়েছিল মোসাদ।
এরপর কয়েক বছর মোসাদের এই গুপ্তহত্যার মিশন জোরদারভাবে চলতে থাকে। এসব হত্যায় অংশ নেয় এহুদ বারাকের মতো কট্টর ইহুদিবাদী সেনা কর্মকর্তা ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও। ১৯৭২ সালেরই ঘটনা। সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে মিউনিখ সামার অলিম্পিকের ইসরায়েলি ১১ খেলোয়ারকে কিডন্যাপ করে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যরা। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা ইয়াসির আরাফাতের সংগঠন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) একটি উপসংগঠন। জার্মান কর্তৃপক্ষ জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে হত্যা করে ফেলে।
এই ঘটনার 'প্রতিশোধ' নিতে গুপ্তহত্যার মিশন নিয়ে জোরেশোরে মাঠে নামে মোসাদ। অপারেশন স্প্রিং অব ইয়ুথ নামের এ মিশন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের মূল পরিকল্পকদের হত্যা করা বলে ঘোষণাও দেয় তারা। পরের বছর ১০ এপ্রিল হাইফা থেকে নৌকায় রওনা দেয় তাদের একটি স্পেশাল ফোর্স। পরদিন বৈরুতের সমুদ্রসৈকতে এসে দলটি নামে। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন যে কমান্ডার, তিনি এহুদ বারাক; ইসরায়েলের দশম প্রধানমন্ত্রী। নিজেকে একটি নারীবেশে সাজিয়ে গুপ্তহত্যার মিশনে নামেন এই ইহুদি নেতা। দীর্ঘদিন নজরদারিতে রাখা তিন পিএলও নেতার বাড়িতে হামলা করে তারা। তিন শীর্ষ কর্মকর্তা তথা ইয়াসির আরাফাতের ডেপুটি মুহাম্মদ ইউসেফ আল-নাজ্জার, মুখপাত্র কামাল নাসের এবং পশ্চিম তীরের সামরিক নেতা কামাল আদওয়ানকে হত্যা করে ইসরায়েলে ফিরে যায় এই ঘাতক দল। ১৯৭৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বহুবার ইয়াসির আরাফাতের ওপর মোসাদের গুপ্তঘাতকেরা হামলা করে। কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে।
গাসসান কানাফানিকে গুপ্তহত্যার মধ্য দিয়ে যে মিশন মোসাদ শুরু করেছিল, তা এখনো শেষ হয়নি। চলতি বছরের শুরুতেই হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসসাম বিগ্রেডের প্রতিষ্ঠাতা সালেহ আল-আরৌরিসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে দক্ষিণ বৈরুতের দাহিয়েহ এলাকায় ড্রোন চালিয়ে হত্যা করে মোসাদ।
সম্প্রতি লেবাননজুড়ে পেজার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হিজবুল্লাহর বড়সংখ্যক নেতা-কর্মীকে হতাহত করেছে তেল আবিব। লেবাননের সাধারণ মানুষ এখন মোবাইল ব্যবহার করতে ভয় পাচ্ছে। এটিও মোসাদের গুপ্তহত্যার পুরোনো ধারাবাহিকতা। যে বছর গাসসান কানাফানিকে হত্যা করে, সে বছরই ফোনে ক্ষুদ্রাকৃতির বোমা ঢুকিয়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ পিএলও নেতাকে হত্যা করে মোসাদ। গুপ্তহত্যার সেই ঘটনাও বেশ অভিনব।
মিউনিখ সামার অলিম্পিকের ঘটনায় সরাসরি জড়িত বলে ইসরায়েল এবং কিছু গণমাধ্যম পিএলও নেতা মাহমুদ হামশারিকে অভিযুক্ত করে। তারা দাবি করে, তিনি ফ্রান্সের ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশনের নেতা। মাহমুদ হামশারি এই ঘটনার সময় ফ্রান্সে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ইতালীয় একজন সাংবাদিক, যিনি আদতে মোসাদের এজেন্টের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য হামশারির সাথে যোগাযোগ করেন। সাক্ষাৎকার চলা অবস্থায় মোসাদের একটা দল তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তারপর টেলিফোনের ভেতর একটি ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী বোমা রেখে দেয়। এই কাজটির দলপ্রধান ছিল জেভি মালচিন। ১৯৭২ সালের ৮ ডিসেম্বর সকালে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। হামশারি গুরুতর আহত হন। সঙ্গে সঙ্গে একটি পা হারান তিনি। এক মাসের মাথায় তার মৃত্যু হয়। মোসাদ বরাবরের মতো জোরদার মিথ্যা প্রচারণা চালায়। তারা বলে, হামশারি বাড়িতে বিস্ফোরক তৈরির সময় আহত হন এবং পরবর্তী সময় তার মৃত্যু হয়।
হামশারির হত্যার পর ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যরাও আক্রমণ তীব্র করে। প্রথমেই তারা থাইল্যান্ডের ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করার চেষ্টা করে। এরপর ১৯৭৩ সালের ২৬ জানুয়ারি স্পেনের মাদ্রিদে মোসাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তা বারুচ কোহেনকে হত্যা করে।
ডিকেন্স, হেমিংওয়ে, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজÑসাহিত্যজগতের কয়েকটি বিগ নেম। তারা সবাই নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা দিয়ে। পরবর্তী সময়ে মানুষ তাদের রিপোর্টিং ভুলে যেতে থাকে। কিন্তু তাদের জাদুকরি গদ্য আজও আবিষ্ট করে রাখে পাঠককে। গাসসান কানাফানিও এমন একটি নাম, যাকে নির্দ্বিধায় এই তালিকায় যোগ করা যায়। কানাফানি তার 'রিজাল ফিস শামছ'-এর (মেন ইন দ্য সান) মতো বইয়ের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি ও স্থানচ্যুতিকে মানবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। আ-য়িদ ইলা হাইফা (রিটার্ন টু হাইফা) উপন্যাস দিয়ে ফিলিস্তিনিদের তাড়া খাওয়া জীবনের জটিল এক দিক উন্মোচন করেছেন। তার এসব সৃষ্টি ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বহু ভাষায়। তবে সাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরে তিনি প্রথম ও প্রধানত সাংবাদিক ছিলেন।
গত শতকের ষাটের দশকের বৈরুতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি গাসসান কানাফানি। বৈরুত তখন তরুণ সাংবাদিক, বিপ্লবী, অভিবাসীদের জন্য ছিল চুম্বকের মতো। নির্বাসিত ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের নিমন্ত্রক। এই বৈরুতেই কানাফানি আল হাদাফ নামের একটি অগ্রচিন্তার ফিলিস্তিনি সাময়িকী তৈরি করতে পেরেছিলেন। ফিলিস্তিনের গাসান কানাফানি একজন লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে আরব বিশ্বে তার স্থায়ী উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। কানাফানিকে লেনিন, কাস্ত্রো, চে গুয়েভারার বিপ্লবী দর্শন উদ্বুদ্ধ করত। নিজে সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত না থাকলেও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রবল সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'সংগ্রাম চুপিসারে চললে কোনো টেলিভিশন স্বেচ্ছায় ফিলিস্তিনিদের এক মিনিটের কাভারেজ দেবে না।' ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামকে সব সময় দুনিয়ার চোখের সামনে রাখতে চেয়েছেন কানাফানি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর নতুন মাত্রায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যে লড়াই শুরু হয়েছে, এর পেছনেও ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামীরা কানাফানির ওপরের কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক এবিসি নিউজের সাংবাদিক রিচার্ড কার্লটন কানাফানির একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। চার বছর আগে আল-জাজিরা সেই ভিডিও সাক্ষাৎকারটি আবার সামনে নিয়ে আসে। আরবীয় আঞ্চলিক টানে বলিষ্ঠ বক্তব্যে কানাফানি সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন। এর একটি অংশ দিয়েই লেখাটি শেষ করা যাক।
কার্লটন: এই গৃহযুদ্ধের কোনো মানে আছে? কী মনে হয় আপনার?
কানাফানি: গৃহযুদ্ধ নয়। মানুষ এখানে একটি স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার সংগ্রাম করছে।
কার্লটন: আমি সংঘর্ষের কথা বলছি।
কানাফানি: না, এটা সংঘর্ষও নয়। মুক্তির জন্য সংগ্রাম, ইনসাফের লড়াই।
কার্লটন: আচ্ছা, যা-ই হোক।
কানাফানি: না, এটা 'যা-ই হোক' না। এটাই সব সমস্যার মূল।
কার্লটন: আপনারা আলোচনা করছেন না কেন?
কানাফানি: কার সাথে আলোচনা?
কার্লটন: ইসরায়েলের সাথে।
কানাফানি: গর্দানের সাথে তলোয়ারের আলোচনা?
কার্লটন: না, যেকোনো মূল্যে আলোচনা।
কানাফানি: আলোচনাটা কিসের জন্য হবে?
কার্লটন: যুদ্ধ বন্ধের জন্য।
কানাফানি: যুদ্ধ বন্ধ! কী পাওয়ার জন্য?
কার্লটন: হতাহত বন্ধের জন্য।
কানাফানি: কাদের হতাহত?
কার্লটন: ফিলিস্তিনি, ইসরায়েলি, আরবদের।
কানাফানি: অথচ এই ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত। ২০ বছর ধরে শরণার্থীশিবিরে ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এমনকি ফিলিস্তিনি পরিচয়ও ব্যবহার করার অধিকার হারিয়েছে তারা।
কার্লটন: কিন্তু যুদ্ধ করে এমন মৃত্যুরও তো কোনো অর্থ নেই।
কানাফানি: সেটা আপনাদের জন্য, আমাদের জন্য অর্থহীন নয়। আমাদের জন্য স্বাধীনতা, মর্যাদা আর সম্মান জীবনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।