‘সুন্দরবনের রহস্যময়ী’
সুন্দরবনের গহিনে বাস করে বাঘের চেয়েও রহস্যময় ও বিরল বিপন্ন এক প্রাণী, তারই খোঁজে আমাদের যাত্রা শুরু সেবার। মনে হচ্ছে অ্যানাকোন্ডা চলচ্চিত্রটির মুভি সেটে চলে এসেছি, তেমনি একটানা বৃষ্টি, আদিগন্ত বহমান নদী, একরত্তি জাহাজে আমাদের ছুটে চলা, খুলনার জেলঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে বন বিভাগের প্রয়োজনীয় পাস নিয়ে বাগেরহাটের আন্দারমানিক এলাকা দিয়ে শুরু হয়েছে বাদাবনের রাজত্বে অভিযান, সারি সারি মাছ ধরা নৌকা প্রথমে বেশ নজরে এলেও দিনের শেষে গোলপাতা ছাওয়া দুয়েকটা বাওয়ালি নৌকা ছাড়া নদীর সঙ্গী আর কেউই ছিল না, বেশ কটি শুশুক ছাড়া, প্রায়ান্ধ এই অসাধারণ ডলফিনগুলো মাঝে মাঝেই জানান দিচ্ছিল তাদের নির্মল ও অতিগুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব। মাঝে অবশ্য জাহাজের ক্যাপ্টেন এক বিশাল কুমির দেখার কথা জানান দিলেও আমাদের চক্ষুগোচর হবার আগেই সে ডুব দিয়েছে ঘোলা জলে, শীতকালে কুমির দর্শন বিরল না হলেও এই বর্ষায় তাদের দেখা পাওয়া বেশ সৌভাগ্যের ব্যাপার বৈকি!
বনবেষ্টিত নদী-খালের রাজ্য দিয়ে আমাদের খুদে জাহাজ ছুটে চলেছে, ঘন বর্ষাকাল, সুন্দরবনের চেহারা পাল্টে গেছে এই মেঘ-রোদ-ছায়া আর হরেক কিসিমের বৃষ্টির পাল্লায়। নির্নিমেষ চেয়ে আছি খালের ধারের বন-ঝোপের দিকে, হয়তো সেখানে এক পরত গাছের আড়ালেই নিশ্চিন্তে অভিসার চালাচ্ছে এক জোড়া হলুদ-কালো ডোরাকাটা বড় বিড়াল বা হাপুস-হুপুস করতে করতে জলকেলি করতে নামবে গাঢ় চকলেট রঙের আদুরে ভোঁদড়, সপ্তবর্ণা ঝলমলে বনমোরগ! কত কী-ই না ঘটে যেতে পারে মুহূর্তের মাঝে এই জোয়ার-ভাটার রাজ্যে, বা ঘটেই চলেছে প্রতিনিয়ত, কেবল অপেক্ষা আমাদের চোখে পড়ার।
আমরা বলে নৌকার মাঝি ভাইদের বাদ দিলে আমি এবং পাখি গবেষক সায়েম ইউ চৌধুরী। সায়েম গত ১২ বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছেন সেই অসাধারণ রহস্যময় প্রাণীটিকে তাদের প্রজনন মৌসুমে, নাম তার কালামুখ প্যারাপাখি বা 'Masked Finfoot', স্থানীয় জেলেরা বলে হাঁসপাখি, অনেকেই আবার বলে গোলবনের হাঁস বা সুন্দরী হাঁস, যদিও মোটেও হাঁস গোত্রের কোনো নিকটাত্মীয় তো নয়ই, দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও নয় এই প্যারাপাখি, তারপরও স্থানীয়দের মতো তাদের হাঁসপাখি বলেই সম্বোধন করছি এই লেখাতে, যাতে আপনারা বুঝতে পারেন, হাঁসের মতো আকৃতির এবং পানিতে ভেসে চলে এমন একটি পাখির কথা বলছি আমরা, কিন্তু তা মোটেও হাঁস নয়! নিভৃতচারী হাঁসপাখি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা নেই মানুষের, যার জন্যই তাকে দেওয়া হয়েছে বাদাবনের সবচেয়ে রহস্যময় প্রাণীর তকমা, শুধু জানা ছিল বিশ্বব্যাপী অস্তিত্বের টানাপোড়নে আছে অপূর্ব পাখিটির মাত্র ৩০০টি টিকে আছে সারা গ্রহে এবং আমাদের সুন্দরবনেই হয়তো সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছে তা, তা-ও শদুয়েকের বেশি নয় বলেই গবেষকদের অনুমান। আর এই সপ্তাহেই তাদের মহাবিপন্ন বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
সায়েম এবং তার সহকর্মীদের নিরলস গবেষণার ফলে জানা গেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য, বিশ্বে প্রথমবারের মতো তোলা হয়েছে হাঁসপাখির ছানার ছবি, তাদের বাসার ওপরে ৫ মিনিট অন্তর অন্তর ছবি তুলতে সক্ষম এমন ক্যামেরা ফিট করে জানা যাচ্ছে প্রজননের সময়ের আচরণ সম্পর্কেও। কিন্তু এখনো অনেক অনেক তথ্য জানার বাকি আছে প্রাণীটির সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। আর সেগুলোর জন্য সবচেয়ে জরুরি তাদের বাসা খুঁজে বের করা। অতিমাত্রায় গোপনীয়তা রক্ষাকারী হাঁসপাখি একই বাসায় তো বটেই, সাধারণত একই খালে পরপর দুই বছর বাসা বেঁধে ডিম দেয় না! ফলে তাদের নতুন বাসা খুঁজতে খুঁজতেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাঘ-কুমিরের রাজ্যে অনেক দিন চলে যায় গবেষকদের। প্রথম যখন কাজ শুরু করেন সায়েম, তখন এ-ও জানা ছিল না যে কী ধরনের গাছ এবং খালে বাসা করে হাঁসপাখিরা! এখন অন্তত জানা যাচ্ছে সরু কয়েক মিটার চওড়া খালে বিশেষ বিশেষ প্রজাতির গাছে বাসা করে তারা, ৩-৫টা করে ডিম দিয়ে মিয়া-বিবি যৌথভাবে তা দেয়।
অনন্য সেই ভুবন, সরু সরু ফিতার মতো খাল। গেওয়া, ছৈলা, ধুন্দল, সুন্দরীর সারি, সাথে ঘন গোলপাতার পদাতিক সৈন্যরা। মাঝে মাঝেই দুই দিকের গাছের ঝুলে পড়া ডাল তাদের স্মৃতি স্পর্শ রেখে যাচ্ছে দেহ-মনে, সেই সাথে খালটিকে এমন সরু বানিয়েছে যে আমাদের নৌকার ঠেকে যাবার জোগাড়, অনেক বেঁকেচুরে, কসরত করে মাঝি ভাই নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সামনের রহস্যের দিকে, তেমন জায়গায় বাঘ মামা এসে একটা হাঁচি দিলেও আমাদের কম্ম সাবাড় হয়ে যাবে, হয়তো বা অতর্কিতে খালের একপাশ থেকে লাফ দিয়ে ঘন হয়ে বসে থাকা গত দুই মানবসন্তানকে সুন্দর করে বয়ে নিয়ে যাবে এক ঝটকা টানে। রোমাঞ্চে রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে, হৃৎপিণ্ড রীতিমতো দিড়িম দিড়িম ঢাক পিটাচ্ছে বুকের মাঝে, আড্রিনালিনের বন্যা রীতিমতো টালমাটাল করে দিচ্ছে জানা জগৎকে, যেকোনো মুহূর্তে হলদে-কালো ডোরা যেমন ঝলকে উঠতে পারে, মহাবিশ্বজুড়ে তেমনি সামনের বাঁকে দেখা মিলতে পারে মনের সুখে কাঁকড়া ভোজনরত হাঁসপাখির। এবং আসলেই একবার এভাবেই দেখা মিলল একটি পুরুষ হাঁসপাখির, সে আমাদের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র তিরের বেগে তীরে উঠে হাচড়ে-পাচড়ে চলে গেল ঝোপের গোপনীয়তায়। চোখে লেগে থাকল তার কালো কুচকুচে গ্রীবা বেয়ে চকচকে জলের গড়িয়ে পড়া।
উল্লেখ্য এই পাখিটি আমাদের চিরচেনা, অতি আপন, কারণ এটি বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতীক! বিপন্ন পাখিটিকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতীক নির্বাচিত করেছিলেন ক্লাবের সদস্যরা।
প্রথম প্রথম প্রায় খালেই ঢোকার সময় ঠাস ঠাস শব্দে চমকে উঠছিলাম, মনে হচ্ছিল কী যেন লাফিয়ে পড়ছে বহমান জলে। পরে মাঝি জানাল আসলেই গাছের ডাল শুয়ে শুয়ে সূর্যস্নান করতে থাকা বড়সড় গুইসাপেরা নৌকার আভাস পেয়ে জলে ঝাপ দিচ্ছে, এমন একবার তো প্রায় আমাদের গায়েই এসে পড়েছিল নিচু ডাল থেকে ঝাপ দেওয়া এক সরীসৃপ!
নোঙর ফেলা আশ্রয়ে ফেরার পরও নাটকীয়তার শেষ নেই বাদাবনে, গা-ছমছমে রোমাঞ্চ ঘিরে রাখে এখানে অষ্টপ্রহর। নৌকায় প্রতি কেবিনে দুটি বিছানা, ওপরেরটি থেকে মাথা ঘুরালেই পোর্টহোল জানালা দিয়ে চোখে পড়ে চলমান জলরাশি আর ম্যানগ্রোভ বন, সারি সারি শ্বাসমূল, গোলপাতার দল। রাতের মেলা আদিম আঁধার অরণ্য, নিচ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা, গাঢ় আঁধার।
দুবার ঘুম ভেঙে গেছে জানালা দিয়ে ময়াল সাপ ঢুকে পড়ল নাকি এই চিন্তায়, অথবা যে গুইসাপটি ঝাপ দিয়েছিল আজ গাছের ওপর থেকে আমাদের নৌকার পাশে, ঘুম ভেঙেই কী দেখবÑসরীসৃপের সারি সারি ধারালো দাঁত! নাকি শার্দূলের গুমোট বোটকা গন্ধে ঘুম ভাঙবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
সিটাকটকা, সুপতি, দুধমুখী, হরিণটানা, তাম্বুলবুনিয়া, আন্দারমানিক, চাংপাইÑমনের পর্দায় এমন সব টুংটাং ধ্বনি তোলা সব রাজ্য পেরোয় আমাদের নৌকা, বাওয়ালিদের সাথে দেখা হয়, দেখা হয় কাঁকড়াশিকারি আর জেলেদের সাথে, যারা কেবল ক্ষুণ্নিবৃত্তি মেটানোর তাগিদে অংশ নিয়েছে এই বিপৎসংকুলজীবনে। তাদের জীবনের কথা আমাদের মতো শহুরেদের কাছে অব্যক্ত, অছোঁয়াই থেকে যায়। কিন্তু অনেক মৎস্যজীবীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে পাওয়া গেছে এক ভয়াবহ তথ্য, তাদের শতকরা ৮০ জনই অন্তত একবার হলেও বিরল এবং বিপন্ন হাঁসপাখির মাংস আস্বাদন করেছে!
আসলে হাঁসপাখি সাধারণত যে রকম ক্ল্যামোফেজ নিয়ে বাসা তৈরি করে, তা আগে থেকে জানা না থাকলে খুঁজে বের করা মুশকিল, কিন্তু জেলেরা জাল পাততে গিয়ে যখন নিজের অজান্তেই হাঁসপাখির বাসার কাছে চলে যায়, তখন বাসায় অবস্থানরত পাখি প্রাণের ভয়ে সেখান থেকে পালায়, লোভী জেলেরা রাতেই এই স্থানে ফিরে জোরালো টর্চ নিয়ে আসে, যার আলোতে হাঁসপাখি প্রায় কিছুই দেখে না এবং সরাসরি তার বাসায় টর্চের আলো ফেলে চোখ ধাঁধিয়ে ধরা হয় পাখিটিকে। যেখানে লোনাপানির রাজ্যে প্রায়ই স্রেফ লবণ, মরিচ দিয়েই ভাত খেতে হয় অনেক মানুষকে, তাদের কাছে হাঁসপাখির মাংস বলা চলে বিশাল এক উপহার!! এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, মানুষই সবচেয়ে বড় হুমকি হাঁসপাখির জন্য।
আগের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে একটি খালে আগের বছরের বাসাতেই আমরা পেয়ে যাই হাঁসপাখির ডিম, তা-ও রেকর্ড পরিমাণ ৬টি! আমাদের দেখে মেয়ে হাঁসপাখিটি দূরে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায় ঘন গোলপাতার আড়ালে। সায়েম দ্রুত মাঝিদের সহায়তায় বাসার ওপরে ক্যামেরা বেঁধে ফেলে, যা প্রতি ৫ মিনিট পরপর একটি ছবি তুলবে এবং তা কাজ করবে প্রায় ৩ সপ্তাহ। পরের বার যখন আসা হবে, তখন আবার বদলে দেওয়া হবে নতুন ক্যামেরা বা ব্যাটারির সাথে।
এভাবেই একের পর এক জানা-অজানা খাল চষে ফেলি আমরা দাঁড়টানা নৌকা নিয়ে, বিপন্ন এক পাখিকে রক্ষার তাগিদ থেকে। তার পরিত্যক্ত বাসা পেলেও সযত্নে জিপিএস দিয়ে সেই তথ্য টুকে রাখা হয়, আর পাখির দর্শন পেলে তো কথাই নেই! ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে আসে একপর্যায়ে, দুরু দুরু বুকে সরু খালে নৌকা বেয়ে চলা অ্যাড্রিনালিনের প্রবাহময় দিনগুলোর অভাব ভীষণভাবে অনুভূত হয় মনোটোনাস নগরজীবনে। কিন্তু ভাবতে ভালো লাগে, হয়তো কোনো একদিন কিছু স্বপ্নাদৃষ্ট প্রকৃতিপ্রেমীর জীবনের ঝুঁকির বিনিময়ে পাওয়া তথ্য হয়তো ভূমিকা রাখবে মহাবিপন্ন হাঁসপাখি সংরক্ষণে। কিন্তু এই গ্রহে তাদের শেষ আবাস এই সুন্দরবনেই কি পারব তাদের আমরা রক্ষা করতে? নাকি গোলাপি মাথাহাঁসের মতোই এরাও বিলুপ্ত পাখির তালিকায় আশ্রয় নিতে যাচ্ছে?